সত্যেন সরদার
উন্মত্ত হিংস্রতায় দেদার লাঠি চালায় পুলিশ। সাথে টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটানো হয় উদ্দামভাবেই। সরকারী হিসাবেই খুন হয়েছিলেন ৮০ জন। বেসরকারী হিসাবে মানুষের মৃত্যুর কোনো ইয়ত্তা নেই। খোঁজই মেলেনি বহু জনের।
১৯৫৯ সালের ৩১ শে আগস্ট। কলকাতার বুকে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত। ভুখা মানুষের মিছিল। ঠিক দু‘মুঠো, বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু খাবারের প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই। সেই খাদ্যের দাবীতেই সেদিন কলকাতার বুকে লাখো মানুষের প্রতিবাদী মিছিল। সেই মিছিলেই পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে গণহত্যা সংগঠিত করেছিলেন তখনকার কংগ্রেসী সরকারের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন।
রোজ দু‘মুঠো ভাতও জোটে না। গ্রাম বাংলার মানুষ, শহরের গরিব মানুষ কোনো রকমে আধপেটা খেয়ে দিন কাটান। ভাতের বদলে অনেক সময় মাইলো-ই ভারসা। কোনোদিন আবার সেই মাইলোটুকুও জোটে না। গোটা বাংলা ক্ষোভে, যন্ত্রনায় গুমড়ে ছিলো। আর মানুষের সেই ক্ষোভকে উত্তাল আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলো তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির শক্তি ছিলো কম। তাও সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন করেই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন রাজ্যের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব। শুধু পরিকল্পনা গ্রহণ করাই নয়, তার সফল রূপায়নও তাঁরা ঘটিয়েছিলেন। সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়েই। কোন পথে? আসুন একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। দেখে নিই সেদিন ঠিক কি ঘটেছিলো।
সেই সময় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটি রাজ্যের সমস্ত পার্টির ইউনিটকে খাদ্য সংকটের মোকাবিলার পথনির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি লিখলো। পার্টি চিঠি হিসাবে সেই আহ্বান পাঠানো হলো রাজ্যের প্রতিটি পার্টি ইউনিটকে। তখন একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। গান গাইছেন গ্রাম বাংলার নামী-অনামী অনেক লোকসঙ্গীত শিল্পী, গণসঙ্গীত শিল্পী। যে গান রাজ্যের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে যেন দ্বিগুন করে তুললো। অবিবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সেই আহ্বান এবং একের পর এক গণসঙ্গীত স্লোগান হয়ে সেদিন কলকাতার রাজপথে আছড়ে পড়েছিলো। স্লোগান উঠলো ‘‘আমরা বাংলার সন্তান, খাদ্য চাই’’। স্লোগান উঠলো ‘‘ক্ষুদার্ত মানুষকে খাদ্য দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও‘‘। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল রাজপথ। গোটা ধর্মতলা চত্বর। কমরেড জ্যোতি বসুর নামে জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তখন তিনি আত্মগোপনে। তাই ভুখা মানুষের সেই মিছিলে থাকতে পারেননি কমরেড জ্যোতি বসু। সেদিন মানুষের সেই শান্তিপূর্ণ কিন্তু বেপরোয়া ক্ষোভের মিছিলেই দলে দলে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন।
খাদ্য আন্দোলনে কি ছিলো অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা?
সরকারের নতুন খাদ্যনীতির ফরমায়েশে মজুতদারের দল সবই লুকিয়েছিলো নিজেদের আড়তে। কালোবাজারির ধান্দায়। তারপর গুদামে মজুত করা সেই খাদ্যশস্যই বেচেছে চড়া দামে। যে দাম খেটে খাওয়া মানুষের আয়ত্তের বাইরে। একদিকে খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের চরম ব্যর্থতা, মজুতদারদের দাপট, অন্যদিকে সীমান্ত সংঘাত পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধির কোপ। বাংলার তলিয়ে যাচ্ছিলো চরম অন্ধকারে। একইসাথে বাংলায় তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জোতদার, জমিদার এবং সামন্তপ্রভুদের বাস্তু ঘুঘুর দল। প্রান্তিক চাষীদের হাতে জমি নেই। বেশিরভাগই ভাগ চাষী, নাহলে খেতমজুর। তাঁরা দামও পান না ফসলের। মজুতদার আর কালোবাজারির দাপটে গরিব এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে হাঁড়ি চড়েনা দিনের পর দিন। না খেয়ে মরতে থাকা মানুষের ভিড়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বাংলার। খাদ্যের দাবিতে মানুষ ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। আর মানুষের সেই ক্ষোভকে আরো তীব্র করে তুলতে, খাদ্যের দাবিতে গ্রাম শহরের বুকে আন্দোলনের তুফান তুলতে অনুঘটকের ভূমিকা নিলো তখনকার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। খাদ্যের দাবিতে রাজ্য জুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির পক্ষ থেকে তার ইউনিটগুলিকে একটি চিঠি পাঠানো হলো। ১৯৫৮ সালে, পার্টি চিঠির আকারে। সেই পার্টি চিঠির শিরোনাম ছিলো, ‘‘আগামী দুর্ভিক্ষের বিপর্যয় প্রতিরোধের জন্য পার্টির আশু কর্তব্য’’।
এই চিঠি নিছক একটি ঐতিহাসিক দলিল নয়। আজকের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে, সে বিষয়ে মিলিট্যান্ট আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচী গ্রহণ করতেই যে শুধুমাত্র এই চিঠির কথা স্মরণ করা প্রয়োজন, তাও নয়। পরিস্থিতির মোকাবিলায় কমিউনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি কি হওয়া উচিত তা নিয়ে একটি স্বচ্ছ বোঝাপড়া গড়ে তোলার জন্যও ১৯৫৮ সালের এই পার্টি চিঠি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সেই চিঠিতে লেখা হলো,‘‘ ১৯৫৭ সালের খাদ্য সংকটের জের এখনো চলছে। তার উপর এবার যেরূপ শস্যহানি ঘটেছে তাতে ১৯৫৮ সালে অতি ভয়াবহ খাদ্য সংকটের আশঙ্কা বাস্তব বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে কৃষকসভার প্রাদেশিক কমিটি এ সম্বন্ধে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়েছে, গত আইনসভার অধিবেশনে পার্টির পক্ষ হতে যে বক্তব্য রাখা হয়েছে এবং তারপর পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটি যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে তাও আপনারা স্বাধীনতায় দেখেছেন। এইসব প্রস্তাব, বক্তব্য ও বিবৃতি হতে আপনারা আগামী সংকটের ভয়াবহ গভীরতা ও তার প্রতিকারের পথ সম্বন্ধে জানতে পেরেছেন। এ সম্বন্ধে পার্টি হতে এক প্রচার পুস্তিকা ও প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে বিস্তারিতভাবে অবস্থান ব্যাখ্যা ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলির প্রয়োজনীয়তা জানতে পারবেন। সেই জন্যই এই চিঠিতে সেসব সম্বন্ধে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই ।
ওই পার্টি চিঠিতে আরো বলা হলো, ‘‘এখানে শুধু সংকট ও তার প্রতিকার সম্বন্ধে কয়েকটি আশু প্রধান বক্তব্য সংক্ষেপে উল্লেখ করা হচ্ছে। গতবছর খাদ্যের ঘাটতি ছিল তিন লক্ষ টন (চাল), এবারে ১২ লক্ষ টন (সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী)। তার উপর ১৯৫৭ সালের সংকটের আঘাতে জনসাধারণের ক্রয় শক্তি এবারে আরো কমেছে। এই অবস্থায় সরকারকে গতানুগতিক পদ ছাড়তে বাধ্য করতে না পারলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হতে বাধ্য। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, সরকার প্রকৃতির ও বাজারে নিয়মে দোহাই দিয়ে এই ঘাটতি জনিত সংকটের দায়িত্ব এড়াতে এবং জনসাধারণের কাছে নিজেদের ত্রুটি ও অপদার্থতা ঢাকতে চাইছেন। কিন্তু আমরা জানি যে বাস্তবে এতো বিরাট ঘাটতির জন্য সরকারি নীতির ব্যর্থতা ও ত্রুটি কম দায়ী নহে। তাছাড়া সরকারের নীতি খাদ্যের বাজারে ফাটকাবাজি মুনাফাখোরী কার্যকলাপকে শক্তিশালী করেছে‘‘।
শুধু পার্টির শক্তির জোরে আন্দোলন গড়ে তোলা নয়। মাঠ আরো বড় করার প্রয়োজনীয়তার বার্তাও ওই পার্টি চিঠির মাধ্যমে পার্টির প্রতিটি ইউনিটের কাছে পাঠানো হয়েছিলো। মাঠ বড় করার যে প্রয়োজনীয়তার কথা, আন্দোলনের বৃত্ত আরো বড় করার যে গুরুত্বের কথা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও আমাদের ভাবতে হচ্ছে এবং সেই মতো করে আমাদের পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও হচ্ছে। বাম ঐক্যকে আরো শক্তিশালী করে সেই মাঠ বড় করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরতে এবং পার্টি ও গণসংগঠনগুলিকে আরো উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ১৯৫৮ সালের ওই পার্টি চিঠিতে লেখা হলো, ‘‘অবশ্যই এই শিক্ষা নেওয়া ভুল হবে যে সর্বদলীয় ঐক্য' এর প্রয়োজন বা গুরুত্ব নাই। আন্দোলনের অগ্রগতি ও সাফল্যের জন্য এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে এবং তার জন্য আমাদের নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হবে। কিন্তু এ হতে আমাদের যে শিক্ষা নেওয়া দরকার তা হলো পার্টি ও কৃষক সভার মত গণসংগঠনের আরো বেশি উদ্যোগ নিতে হবে, এবং তা শুধু আলোচনার ক্ষেত্রে নয়, আন্দোলন শুরু করার ব্যাপারেও। সমস্ত বামপন্থী দলগুলো এক না হলে কোন আন্দোলন শুরু করা যাবে না। এইরূপ মনো ভাবনা নিয়ে আমাদের অবস্থানুযায়ী আন্দোলনে উদ্যোগ ও নিতে হবে এবং সেইসঙ্গে বামপন্থী ঐক্যের জন্য ও সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের এইরূপ উদ্যোগ নেবার উপরও এই ঐক্য অনেকটা নির্ভর করে। প্রাদেশিক কমিটি মোটামুটি এই ভাবেই চিন্তা করেছে। আপনারা জানেন যে বর্তমানে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের প্রশ্নে জটিলতা আরও বেড়েছে। কোন কোন দলের মধ্যে কমিউনিস্টবিরোধী প্রবণতা বেড়েছে। এমনকি তাদের দ্বারা প্রাদেশিক স্তরে বিভেদ সৃষ্টির ও আশঙ্কা আছে। এই অবস্থায় পার্টির ও গণসংগঠনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রশ্ন আরও গুরুত্ব লাভ করেছে এবং এইরূপ উদ্যোগ নিয়ে শক্তিশালী আন্দোলন করার উপরই উক্ত বিভেদ প্ৰচেষ্টা বানচাল করে সর্বাধিক ঐক্য গঠনও অনেকাংশে নির্ভর করছে। ১৯৫৩ সালের খাদ্য আন্দোলনের ও নির্বাচনের সময় এর অভিজ্ঞতা হতেও তা বোঝা যায়। পার্টি ও গণ সংগঠনগুলি উদ্যোগ নিলে এবং সমস্ত কর্মীরা সচেষ্ট হলে নিশ্চয়ই ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করা যায়, বিভেদ প্রচেষ্টা কে ও বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং সরকারের উপর ও প্রবল চাপ সৃষ্টি করা যায়। সমস্ত কমরেডরা কাজে নামলে আমরা ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত করতে পারি, এ বিশ্বাস আমাদের আছে এবং তা কল্পনা নয়, বাস্তব সত্য’’।
শুধু আন্দোলনও নয়। শুধু সরকারের তরফে রিলিফ দেওয়ার দাবিতে লড়াই-সংগ্রামও নয়। তার সাথেই মানুষের বিশ্বাস অর্জন করার প্রয়োজনীয়তার কথাও সেই তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। আর তার জন্য মানুষের জীবন-জীবিকার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি জনগনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, তাঁর ঘরের দুয়ারে পৌঁছে যাওয়া এবং ত্রানের কাজে এগিয়ে আসার জন্য অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির পক্ষ থেকে তার সমস্ত কর্মী ও নেতাদের আছে আহ্বান জানানো হয়েছিলো। এবিষয়ে ওই পার্টি চিঠিতে বলা হলো, ‘‘রিলিফের দাবি আদায় করাই একমাত্র কাজ হবে না। নিজেদের ও গণসংগঠনের দ্বারা রিলিফ সংগঠিত করা, পারস্পরিক সাহায্যের ব্যবস্থা করাও এবারের আন্দোলনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হওয়া উচিত। বিরাট সংকটের মুখে এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। কারণ এইরূপ কাজ শুধু কিছু লোককেই বাঁচায় না, এতে জনসাধারণের মনে ভরসা বাড়ে, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ে, আন্দোলন শক্তিশালী হয়। নিজেদের চেষ্টায় ধান কর্জের ব্যবস্থা করা, ধর্মগোলা করা প্রভৃতির ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। সচেষ্ট হলে ধান কর্জের কিছু ব্যবস্থা করা যায় তা অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে। অনুরূপ অন্যান্য ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। তাছাড়া বাজারের অখাদ্য চলাচলের উপর নজর রাখা, মজুতের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা, ও প্রয়োজন হলে মজুত উদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হওয়া প্রভৃতি কাজও খুব গুরুত্ব লাভ করেছে। এইসব কাজের জন্য এবং ঋণ, রিলিফ ও রেশন বিতরণের তালিকা প্রস্তুত ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য এখন হতে স্বেচ্ছা বাহিনী গড়ে তোলা প্রয়োজন ।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গোটা রাজ্যে আমাদের পার্টির, সিপিআই(এম)-র সংগঠন সব জায়গায় সমান শক্তিশালী নয়। নানা জায়গায় পার্টির সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে তোলাও বর্তমানে সিপিআই(এম)-র রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান কাজ। ১৯৫৮ সালের পটভূমিতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক দুর্বলতা যে আরো অনেক বেশি ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই দুর্বলতাকে মান্যতা দিয়েই রাজ্য জুড়ে খাদ্যের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার ওয়াদা করেছিলো অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটি। এটা অবশ্য শুধু ভারত কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহ্য নয়। গোটা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনেই এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে, সঠিক রণনীতি এবং রণকৌশলের ভিত্তিতে, যদি সঠিক পথে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করা যায়, মানুষের সমর্থনকে হাতিয়ার করা যায়, তবে সাংগঠনিক দুর্বলতাকে সঙ্গী করেই কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে উল্লেখযোগ্য নজির গড়ে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। যেমন কিউবায় হয়েছিলো। কিউবার সফল বিপ্লবের পর ফিদেল কাস্ত্রো যেমন বলেছিলেন, যদি আপনার বিশ্বাস এবং পরিকল্পনা থাকে তবে সংখ্যায় আপনি কত সেটা কোনো বিষয় নয়। আমি ৮২ জনকে নিয়ে বিপ্লব শুরু করি। তা যদি আমাকে আবার করতে হয় তবে প্রয়োজনে আমি ১০ কিংবা ১৫ জনকে নিয়েও তা করবো। এবং তা সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়েই করবো।
ঠিক সেই বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই রাজ্য জুড়ে খাদ্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ১৯৫৮ সালের সেই পার্টি চিঠিতে লেখা হলো, ‘‘কমরেডগণ, আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা সম্বন্ধে নিশ্চয়ই আমাদের সজাগ থাকতে হবে। সেই সঙ্গে পার্টির উপর যে গুরু দায়িত্ব রয়েছে এবং জনসাধারণ আমাদের কাছে যে আশা করে তা খেয়াল রেখে আসন্ন সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলন আমাদের সংগঠিত করতে হবে। সকলের উদ্যোগী হয়ে কাজে নামলে নিশ্চয়ই আমরা দ্বায়িত্ব পালন করতে পারি। প্রকৃত দেশ গঠনের জন্য সরকারের গণবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য এবারের খাদ্য আন্দোলন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হবে’’।
গণআন্দোলন এবং খাদ্য আন্দোলনে গণসঙ্গীতের ভূমিকা
ভারতের বুকে কমিউনিস্ট পার্টির পথম পদচারনার সেই সময় শুধু নয়, শোষণ-অত্যাচার-নিপিড়নের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম যবে থেকে শুরু হয়েছে, তখন থেকেই গানে, কবিতায়, সুরে, কথায় এবং নানা শিল্পের মাধ্যমে মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠ মুখরিত হয়েছে। বাংলায় কথা বলা মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস যতদিনের গণসংগ্রামের গানও ঠিক ততদিনের। আর গণ-আন্দোলনে গণসঙ্গীতের ভূমিকা কি, তা নিয়ে সলিল চৌধুরীর থেকে সহজ সরল ভাবে খুব কম জনই বলতে পারতেন। তাঁর কথায়, যে গণ আন্দোলনের শরিক, গণ আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে মানুষ, সে যেভাবে এর অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারবে, খুব বড় সঙ্গীতজ্ঞ পন্ডিতও সেটা করতে পারবে না। ১৯৮৮ সালের ৭ থেকে ১৪ই জুন কেন্দ্রীয় নাট্য প্রশিক্ষন কমিটির উদ্যোগে মৌলালি যুব কেন্দ্রে গণসঙ্গীত নিয়ে এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সেই কর্মশালায় উপস্থিত হয়ে এই কথাই বলেছিলেন বলেছিলেন সলিল চৌধুরি। ওই কর্মশালায় তিনি আরো বলেন, প্রথম কথা প্রত্যক্ষভাবে যারা গণআন্দোলনে জড়িত নন, গণআন্দোলনকে যারা নিজের করে নিতে পারেননি, তাঁদের কাছে গণসঙ্গীত তাত্ত্বিক কচকচি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যাঠে- ময়দানে, কলে-কারখানায় বিভিন্ন গণ আন্দোলনের শরিক হিসাবে যে শিল্পীরা কাজ করেন তাদের গলায় যে সঙ্গীত স্বতস্ফুর্তভাবে উঠে আসে তা লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, আধুনিক সঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, পাশ্চাত্য প্রভাবিত সঙ্গীতের আঙ্গিকে হোক, তার বক্তব্যে, তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর সংগ্রামের (যে সংগ্রাম সে করছে) ছবি ফুটে ওঠে। প্রথম কথা হচ্ছে গণসঙ্গীত যারা করবেন, তাদের কি সঙ্গীত জানা দরকার? নাকি আন্দোলনের সঙ্গে থাকলেই তারা গণসঙ্গীত সৃষ্টি করতে পারবেন? এটা আমি এই জন্যই বলছি যে, গণআন্দোলনের শরিক যে শিল্পী, সে যখন সেই গণআন্দোলনের কথা বলতে পারে, বলতে চায়, তখন তার হাতে যদি তার আঙ্গিকের দক্ষতা থাকে, শব্দ চয়নের দক্ষতা থাকে, তাহলে যে গণসঙ্গীত হয় – তবে তা ভালোভাবেই উতরে যায়। যুগ যুগ ধরে সেই গণসঙ্গীত মানুষের সংগ্রামের সাথী হিসাবে থাকে এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করে এবং সেটার রেশ কখনোই মিলিয়ে যায় না।
সলিল চৌধুরি আরো বলেন, ওই গণসঙ্গীত শিল্পীরা গান রচনা করেছেন আবেগ দিয়ে, যে আবেগ তার সংগ্রামের আবেগ। আমি ব্যক্তিগতভাবে যে কথাটা স্বীকার করছি- এককালে আমি প্রত্যক্ষভাবে গণআন্দোলনের সাথে জড়িত থেকে কৃষক আন্দোলনে, বিশেষ করে, তার সাথে জড়িত থেকে দিনের পর দিন গান রচনা করেছি এবং ছাত্র আন্দোলন এবং সাধারণ কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকে যে সমস্ত গান তখনকার দিনে রচনা করেছি সেগুলি বৈঠকখানায় বসে নয়, আন্দোলনের মাঠে জন্ম নিয়েছে। আমি আরো একটা কথা বলব, শুধু শ্লোগান দিয়ে মানুষের মন জয় করা যাবে না। আপনাদের আজকের দিনের যারা গীতিকার ও সুরকার, তাদের শিখতে হবে। আজকের বুর্জোয়ারা যে গানগুলো তৈরী করছে- TV তে বলুন, Record-এ বলুন, Cassette বলুন, যেসব অসাধারণ orchestration, অসাধারণ recording, অসাধারণ perfection দিয়ে যেসব পচা জিনিস ওরা প্রচার করছে, তার জৌলুসে, তার আঙ্গিকের চমত্কারিত্বে তা যুবমানসকে আপ্লুত করছে। তার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে গেলে শুধু একটা একতারা নিয়ে বা হারমোনিয়াম নিয়ে চলবে না। নিশ্চয়ই সেটা আমরা গাইব, মাঠে ময়দানে সে রকম দরকার হলে, কিন্তু আমাদেরও ওই technique আয়ত্ত করতে হবে, তা না হলে আমরা পারবনা। এটা আমার বিশেষ অনুরোধ, বিশেষ করে যারা সুরকার তাদের কাছে, এই technique-কে যদি আমরা আয়ত্ব করতে না পারি, ওদের সাথে আমরা পাল্লা দিতে পারবনা। ওরা যদি মেশিনগান চালায়, আমরা তলোয়ার নিয়ে লড়াই করতে পারবনা। অস্ত্রাগার, যেটা ওদের রয়েছে, সেই অস্ত্রাগারের অধিকাংশ অস্ত্র আমারও দরকার। এ ক্ষমতা অর্জন করতে গেলে আমাদের শিখতে হবে, খাটতে হবে।
ওই কর্মশালায় সলিল চৌধুরি আরো বলেন, গণসঙ্গীত রচনা করতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে গানের কথা কি জাতীয়। তা কি গ্রামীণ লোকগীতির ছাঁদে লেখা, না ছন্দবদ্ধ পদ্ধতিতে রচিত, কিম্বা আধুনিক স্বচ্ছন্দ ভঙ্গীতে লেখা। দ্বিতীয়ত, দেখতে হবে তার মধ্যে দিয়ে কোন জাতীয় ভাব প্রকট হচ্ছে বা প্রকাশ পাচ্ছে। তা কি বিদ্রুপাত্মক, না বীর-রসাত্মক, না কি বিশেষ কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করে শ্রোতাকে সচেতন করার জন্য রচিত। যেটা স্বভাবত তার পরে বিবেচ্য হবে, এবং যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, শ্রোতা কারা? অবশ্য যিনি গীত রচনা করেছেন তাঁর চিন্তাধারায় এটি প্রকট থাকতেই হবে। নয়তো তিনি গীতরচনা করতে পারেন নি, করতে পারেন না। কাজেই সেই ভিত্তি ধরেই সুরকারকে এগোতে হবে। চতুর্থত, এবং সবচেয়ে জরুরী হল শ্রোতার সাথে সহমর্মিতা অর্জন করা। অর্থাৎ কমিউনিকেশন। 'শ্রোতা কারা' আমরা যদি তা জানতে পারি তবে কোন আঙ্গিকে, কোন বিশেষ ভঙ্গিতে একটা গানে সুর করতে পারলে সেই শ্রোতার কাছে পৌঁছতে পারব, সেটা ভাবা যেতে পারে। তেমনই কোন গণসঙ্গীতকে আবার সার্বজনীন রূপ দেওয়ার প্রয়োজন, সে কথাও আমাদের গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে।
অতীত দিনে বিভিন্ন গণআন্দোলনকে যাঁরা নাড়িয়ে দিয়েছিলেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে আরো বেশি সংখ্যায় সেই নির্দিষ্ট আন্দোলন সংগ্রামের দিকে টেনে এনেছিলেন, সেই গণসঙ্গীত শিল্পীরা কিন্তু সলিল চৌধুরি ওই কর্মশালায় যেভাবে বলেছিলেন ঠিক সেভাবেই ভাবতেন। সেই পথে হেঁটেই গান, কবিতা, গল্প উপন্যাস রচনা করতেন, ছবি আঁকতেন। তা তিনি নজরুল ইসলামই হোন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস হোন কিংবা রামকিঙ্কর বেইজ, সোমনাথ হোর অথবা আরো অনেকেই। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম সেই কবে লিখেছিলেন, “মহা - বিদ্রোহী রণক্লান্ত / আমি সেই দিন হব শান্ত। / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, / অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না- / বিদ্রোহী রণক্লান্ত / আমি সেই দিন হব শান্ত ”। সেই কবিতা তো আজও মানুষকে নাড়ায়। সময়ের গন্ডীতে যে কবিতাকে কোনো দিন বেঁধে রাখা যাবে না। অথবা তেভাগা আন্দোলনের বীর শহীদ অহল্যা মা, পেটে সন্তান নিয়ে পুলিশের গুলিতে যাঁর মৃত্যু, তাঁকে স্মরণ করে সলিল চৌধুরির কলম থেকে যে আগুনের বর্ণমালা ঝরে পড়লো তা তো আজও আমাদের নাড়িয়ে দেয়। ‘সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিলো’, সেই কবিতা। যে কবিতায় সলিল চৌধুরি লিখলেন, ‘তাই, গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরী হও / কার ঘরে জ্বলেনি দীপ? চির আঁধার তৈরী হও, / কার বাছার জোটেনি দুধ, শুকনো মুখ তৈরী হও, / ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই, তৈরী হও, জোটবাঁধো / মাঠে কিষান, কলে মজুর, নওজোয়ান জোট বাঁধো’। মানুষের জোট বাঁধার আহ্বান এর থেকে ভালো আর কিই বা হতে পারে।
খাদ্য আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই গানে গানে মানুষকে উদ্দাম ভাবেই আকর্ষণ করতেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সেটা ১৯৪৪। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখলেন, ‘মশাল জ্বালো, মশাল জ্বালো / প্রেতপুরীর এই অন্ধকারে আনো আলো /..../ শিক্ষাবিহীন গৃহহারা যারা কাঁদিছে আঁধারে/ হে প্রগতির সৈনিক তোরা ভুলিবি কি তাদের! /... কঙ্কালে প্রাণ দাও/ জীবনের গান গাও/......ধনপিপাসায় মূঢ় হতাশায় আগুন জ্বালাও।”
১৯৪৩ সাল। পরাধীন ভারতে এক ভয়ঙ্কর মন্বন্তর সাক্ষী আমাদের বাংলা। অবিভক্ত বাংলা জুড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু। সেই পর্ব পেরিয়ে ভারত স্বাধীন হলো। তবে খাদ্যের সঙ্কট যে পুরোপুরি মিটে গেলো তা নয়। বাংলার বুকে খাদ্যের অভাব তখনো আছে। তবে খাদ্য আন্দোলনের শুরুয়াত তখনো হয়নি। যদিও খাদ্যের সংকট একটু একটু করে দানা বাঁধছে। খাদ্যের দাবিতে বাংলার বুকে মানুষের ক্ষোভ একটু একটু করে জমাট হচ্ছে। আর ঠিক তখন সোভিয়েত এবং চীনে সমাজতন্ত্র নির্মানের এক মহাযজ্ঞ চলছে। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চীন-সোভিয়েত সহযোগিতার চুক্তি সাক্ষর হলো। সমাজতন্ত্র নির্মানের লক্ষ্যে রাশিয়া এবং চীনের যুব সমাজের লড়াইয়ে অনুপ্রানিত হয়ে আমাদের বাংলার যুব সমাজকে গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তিনি লিখলেন, ‘ঘরেতে আজ হাহাকার, দ্বারে দস্যুদল / আমরা কিরে দেখব বসে মায়ের চোখের জল ; / দেশের লাগি লড়ছে জোর / চীন রাশিয়ার বীর কিশোর / তাদের হাতে হাত মিলায়ে লড়ব মোরা চল’। যে গান বাংলার যুব সমাজের বুকে আলোড়ন ফেললো।
এলো ১৯৫৯ সাল। খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বান। হেমাঙ্গ বিশ্বাস সহ গ্রাম বাংলার লোকশিল্পী, গণসঙ্গীত শিল্পীদের একের পর এক গানে মানুষ আরো উত্তাল। এলো ৩১শে আগস্ট। কলকাতার বুকে খাদ্যের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত মানুষের উপর পুলিশের বর্বর অত্যাচার। শুধু মাত্র একের পর এক লাঠির আঘাতে অসংখ্য মানুষকে খুন করলো কংগ্রেসী সরকারের পুলিশ। সরকারী হিসাবে ৮০। আবার ফুঁসে উঠলো হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কলম। তিনি লিখলেন, ‘ভুলবো না, ভুলবো না, ভুলবো না---- মহানগরীর রাজপথে যত রক্তের স্বাক্ষর, অগ্নিশিখায় অঙ্কিত হলো লক্ষ বুকের পর / আমরা ভুলবো না‘। ওই গানেই তিনি প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে বললেন, উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল, বুভুক্ষিতের অশ্রুজল, / পুঞ্জিত হয়ে এনেছে এবার কালবৈশাখীর ঝড় / আহত বক্ষে গর্জে ক্রোধ / চাই প্রতিরোধ; চাই প্রতিরোধ, / রক্তে রাখি-বন্ধনে মোরা মিলেছি পরস্পর। ভুলবো না, ভুলবো না, ভুলবো না’। এত মৃত্যু, এতো হাহাকার দেখে দুঃখে, যন্ত্রনায় আরো একটা গানে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখলেন, ‘গুলিবিদ্ধ গান যে আমার খুঁজে খুঁজে মরে / কোন অভাগিনী মায়ের সন্তান ফিরেনি ঘরে / তারে খুঁজে খুঁজে মরে। / সান্ধ্য আইনের কুটিল অন্ধকারে / কৃষ্ণনগর হতে যায় যে কোন্নগরে / ঘুরে আউলী হয়ে বসিরহাটে, ইচ্ছামতীর চরে / কারে খুঁজে খুঁজে মরে’।
খাদ্য আন্দোলন ১৯৫৯ সালের ৩১শে আগস্টেই থেমে যায়নি। সেই আন্দোলনের প্রবাহ জারি ছিলো ১৯৬৬ সালেও। ’৬৬ সালে পুলিশের গুলি, লাঠিতে অনেক শহীদের মধ্যে একজন নুরুল ইসলাম। সে ছিলো ছাত্র। আনন্দ হাইত মারা গেলেন পুলিশের বুলেটে। সে এক উত্তাল সময়, ধর্মঘট, অবরোধ, কলকাতার রাজপথ জুড়ে ফের খাদ্যের দাবিতে লড়াই। ’৬৬ সালে গান লেখা হল, ‘শপথ করো, শপথ করো দিল প্রাণ বলিদান, / বাংলা মায়ের দামাল ছেলে নুরুল ইসলাম’। গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত পান্ডে গাইলেন, ‘ও নুরুলের মা, সারাদিন চোখের জলে বাণ ডাকাইয়া জমিন ভিজাস না, / কাইন্দা মরে হাজার নুরুল, ভুখের আগুন পেটে, / আরে যে জমিন খুইড়াঁ তুলল সোনা, অন্ন না তার জোটে’।
এভাবেই মানুষের মনে আলোড়ন তুলেছিলো একের পর এক গান। খাদ্য আন্দোলনের আগে। খাদ্য আন্দোলনের সময়। খাদ্য আন্দোলনের পরে। গণসঙ্গীতের সেই প্রবাহ আজ অনেকটাই স্থিমিত। তাই আমাদের সামনে আজ নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। নতুন ভাবনায়, নতুন নুতুন গান লেখা আজ বড় জরুরী। এমন গান, যা অতীত দিনের মতোই মানুষের মনে আলোড়ন তুলবে। তবে সেই গান হতে হবে এ’যুগের উপযোগী। নানা আঙ্গিকে। নানা ধরনে।