গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জী
পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে আদানীদের চলে যাওয়া নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে আদানীদের চলে যাওয়ার খবর ঠিক নয়। যদি ঠিক না হবে তাহলে আবার টেন্ডার ডাকার প্রশ্ন উঠছে কেন? নিশ্চয়ই কোন সমস্যা তৈরী হয়েছে? আসলে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প পরিস্থিতি এমনই যে এখানে কোন শিল্পপতি দেশলাই এর কারখানা করতেও আগ্রহী নন। তাজপুরের মত বৃহৎ সমুদ্র বন্দরের বিনিয়োগ তো দুর অস্ত। আদানীদের তাজপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষা।
আমরা অনেকেই জানি শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের পর সেখানে আমেরিকার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ বেড়েছে। গৌতম আদানির নেতৃত্বাধীন আদানি গোষ্ঠী "আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড" কলোম্বো বন্দরের ওয়েস্ট কন্টেইনার টার্মিনালে (WCT) সম্প্রসারণের কাজ করছে। খবরে প্রকাশ কলোম্বো বন্দরের ওয়েস্ট কন্টেইনার টার্মিনালে সম্প্রসারণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (DFC ) কলম্বোর ওয়েস্ট কন্টেইনার টার্মিনাল (WCT) প্রকল্পে ৫৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৪৬০৪ কোটি টাকা লোন হিসাবে মঞ্জুর করেছে। এই লোন মঞ্জুর করার পিছনে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত DFC র বক্তব্য, এই লোন মঞ্জুর করা হয়েছে যাতে দক্ষিন এশিয়ার এই দেশটির আর্থিক সমস্যার প্রেক্ষিতে আমেরিকা ও তার মিত্রদের অবস্থান শক্তিশালী হয়। আমাদের সকলের জানা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ভারত সরকার আমেরিকার সব থেকে বিশ্বস্ত বন্ধু। আর ‘বন্ধুর বন্ধু আমার বন্ধু’ এই নিয়মে আদানীরা এখন মোদি এবং আমেরিকার বড় বন্ধু। শ্রীলঙ্কার ওয়েস্ট কন্টেইনার টার্মিনাল বর্তমান সময়ে আর্থিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রন কায়েমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশগত কারণেই। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আদানীদের কাছে এই প্রকল্প এখন বিশাল লাভজনক প্রকল্প - ওদের (আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড) পাখির চোখ এখন কলোম্বো বন্দরের ওয়েস্ট কন্টেইনার টার্মিনালে (WCT)। এদিক থেকে তাজপুর গভীর বন্দর পশ্চিমবঙ্গের এই অস্বাস্থ্যকর শিল্প পরিস্থিতিতে একেবারেই ওদের না-পসন্দ।
ভারতের কলকাতা, হলদিয়া, ভাইজাগ, চেন্নাই ও বিশাখাপত্তনম বন্দর থেকেই পণ্য পরিবহন বেশি করা হয়। বিশাখাপত্তনম থেকে ভারত মহাসাগরের কলোম্বোর ওয়েস্ট কন্টেইনার টার্মিনালে (WCT)
বন্দরের দুরত্ব ১৯৯৫ কিলোমিটার আর কলম্বো থেকে তাজপুরের দুরত্ব ২৭৩২ কিলোমিটার। আর বিশাখাপত্তনম অনেক আধুনিক বন্দর সেখান থেকে সারা ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব সুবিধাজনক। এবার বুঝুন কেন তাজপুরে গভীর বন্দর বানানোর জন্য আদানীরা সক্রিয় হবে? আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমনিতেই ভাঁড়ে মা ভবানী, রাজ্য সরকার তো কোন সাহায্যই করবে না, উল্টে মাফিয়াদের চাপ। কোন দু:খে আদানিরা তাজপুরে গভীর সমুদ্রে গাঁটের কড়ি খরচ করে বন্দরে পয়সা ঢালতে আসবে!
বঙ্গোপসাগরের তাজপুর বন্দর থেকে কোলকাতা শহরের দুরত্ব কত? তাজপুর থেকে কলকাতার দুরত্ব প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। আর এখন আদানীদের উড়িষ্যায় ধামড়ায় একটি বন্দর আছে, যার ১০০% মালিকানাই ওদের।
এই ধামড়া থেকে তাজপুরে প্রস্তাবিত বন্দরের দুরত্ব প্রায় ২২০ কিলোমিটারের আশেপাশে। ‘সেজ’ (SEZ) তকমা প্রাপ্ত ধামড়া পোর্ট কোম্পানি লিমিটেড (DPCL) তৈরী হয়ে গিয়েছে। এটা হল আদানি পোর্টস এবং সেজ (SEZ)-এর ১০০% সহযোগী সংস্থা। উড়িষ্যার সরকারের সাথে এক চুক্তির ভিত্তিতে ধামড়া বন্দর, লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো এবং টাটা স্টিলের ৫০:৫০ অংশীদারিত্বে গড়ে উঠেছে। পরে সেজ তকমা ভুক্ত আদানি গোষ্ঠী ধামড়া পোর্ট কোম্পানি লিমিটেড ( DPCL) ৫৫০০ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নেয় এই বন্দরটি। এরপর এই বন্দরের দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারণের জন্য প্রায় ৭০০০ কোটি টাকার বেশী বিনিয়োগ করে আদানিদের Ports & SEZ সংস্থা।
এখন ধামড়া বন্দরের ১০০% মালিকানা আদানীদের। ধামড়া বন্দর যখন লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো এবং টাটা স্টিলের অংশীদারিত্বে গড়ে উঠে তখন এর দু টি বার্থ থেকে বছরে সর্বাধিক এক কোটি থেকে দেড় কোটি টনের কাছাকাছি পণ্য খালাস করার ক্ষমতা ছিল। এর পর এই বন্দর আদানিদের সেজ তকমা প্রাপ্ত " ধামড়া পোর্ট কোম্পানি লিমিটেড (DPCL) ১০০% মালিকানায় আসাতে এরা এখানে ৭০০০ হাজার কোটি টাকার বিপুল বিনিয়োগ করে বার্থের সংখ্যা বাড়িয়ে করেছে ১৩টি । এখানে সারা বছরে মাল খালাসের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৮০ মিলিয়ন টনের কাছাকাছি। পরে এটাকে ১৫০ মিলিয়ন টনে নিয়ে যাওয়ার কথা। শুধুমাত্র এই বছর ২৭ অক্টোবর ২০২৩-এ, ধামড়া বন্দর ২,৫৮,২১৪ মেট্রিক টন মাল হ্যান্ডলিং করেছে। যার ফলে এর আগে এক মাসে তৈরি করা ২,২৬,৬১০ মেট্রিক টন হ্যান্ডলিং-এর রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বুঝুন কি বিশাল কর্মকান্ড চলছে উড়িষ্যার এই ধামড়া বন্দরে!
খবরে প্রকাশ গত ২০২৩ সালের ২৫ আগষ্ট শ্রী দেবেন্দ্র ঠাকর (Devendra Thakar) ধামড়া বন্দরের চিফ একজিকিউটিভ অফিসার হিসাবে দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন।এই দেবেন্দ্র ঠাকর প্রায় তিন দশক ধরে সরকারী এবং বেসরকারী ক্ষেত্রে বন্দর সংক্রান্ত কাছে অভিজ্ঞ।
গুজরাট, মহারাষ্ট্র, গোয়া, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং ওড়িশার সাতটি রাজ্যের ১৩টি গভীর সামুদ্রিক বন্দরে আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোনের উপস্থিতি রয়েছে। কার্যত ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের গভীর সামুদ্রিক বন্দরগুলোতে আদানীদের একছত্র আধিপত্য তৈরী হয়ে গিয়েছে। এই বন্দরগুলি অত্যাধুনিক কার্গো-হ্যান্ডলিং পরিকাঠামোর সুবিধা দিয়ে সজ্জিত, যা শুধুমাত্র প্রথম-শ্রেণীর নয়, ভারতীয় উপকূলে আগমনরত বৃহত্তম জাহাজগুলিও এখানে ঢুকতে পারে।
ওদিকে ভুমধ্য সাগরে ইজরায়েলের হাইফা বন্দর "আদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকনমিক জোন লিমিটেড" ১২০ কোটি ডলারে কিনে নিয়েছে, লজিস্টিক সংস্থা গ্যাডটের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে। এখানে আদানিদের অংশীদারি ৭০ শতাংশ। এই বন্দর কিনতে গ্যাডট এবং আদানী সহ অন্য যে সব কোম্পানি টেন্ডার দিয়েছিল তার থেকেও যতদুর জেনেছি ৫০ থেকে ৬০% বেশি দরে টেন্ডার ডেকেছিল। স্বাভাবিকভাবেই ইজরায়েল খুব খুশি। আদানিরাই এই বন্দর পেল। এ নিয়ে কেলেঙ্কারির অনেক খবর আমরা কেউ জানি আবার জানিও না - তবে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের কথা আমরা অনেকেই অল্প বিস্তর শুনেছি।
আমেরিকার লক্ষ্য - ভারতের মোদি মতো বিশ্বস্ত বন্ধু সরকারের নিকট আত্মীয় আদানিদের মাধ্যমে হাইফা বন্দর কিনিয়ে ভারত থেকে সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, সৌদি আরব, ইজরায়েল হয়ে ইউরোপের প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য পণ্য সহ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের করিডর তৈরী করা। ভারত থেকে মধ্য প্রাচ্য হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর এই করিডরকে বিরাট অগ্রগতি হিসাবে দেখিয়েছে ভারত, ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সম্ভাব্য এই করিডরের এক প্রান্তে থাকছে মুম্বাই ও মুন্দ্রা বন্দর — যা এখন আদানিদের হাতে। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে জলপথে যোগাযোগ রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বন্দরগুলির। এতে স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে যেমন চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবাকে চাপে রাখা যাবে, তেমনি ভারতেও উদারনীতির দারিদ্রের আলকুশীর চাষ ভালই হবে। চুলকে মরবে ভারত সহ দক্ষিন এশিয়ার আপামর মেহনতী মানুষ। শুধু তাই নয় গ্রীসের কাভালা এবং এথেন্সের ভোলোস বন্দরও কিনতে এগিয়েছে আদানিদের "পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন।" এ বিষয়ে মোদি সাহেবের উৎসাহের কথাও আমরা জেনেছি। কাজেই গোটা বিশ্বেই জলপথের চালু বন্দরগুলো দখলের পরিকল্পনা চলছে আদানী-মোদি-আমেরিকা এই ট্রায়োর।
এসব কিছুর সাথেই যুক্ত ২০১৯ সালের হিসেবে ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তাজপুরে ১২ মিটার গভীরতা সম্পন্ন (সেখানে ধামড়া ১৮ মিটার গভীরতা সম্পন্ন) বন্দরের নির্মাণ ছেড়ে আদানীদের চলে যাওয়ার গভীর সম্পর্ক।
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একক ভাবে তাজপুরে গভীর বন্দর তৈরী করার এক অবাস্তব পরিকল্পনার কথা ঘোষনা করে। যদিও রাজ্যের এত টাকা খরচ করে এই বন্দর নির্মানের কোন ক্ষমতাই ছিল না। পরে রাজ্য ২৪% এবং কেন্দ্র ৭৬% অংশীদারিত্বে এই বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় এবং "আদানীদের পোর্টস স্পেশাল এন্ড ইকোনমিক জোন" দরপত্র দেয় এবং তারা এই বন্দর গড়ার কাজ করবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু আদানীদের লক্ষ্য তো বন্দরের পুরো মালিকানা, তারা কেন ভুতের বেকার খাটবে?
কিন্ত ইতিমধ্যেই আদানীরা উড়িষ্যার ভদ্রক জেলায় ভদ্রক স্টেশন থেকে ৬২ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত গভীর সমুদ্রে ধামড়া বন্দর পুরো মাত্রায় চালু হয়ে যায়। এই বন্দরের গভীরতা ১৮ মিটার এবং একসাথে ১৩টি বার্থ এখানে চালু থাকে। ফলে এখানে বিপুল পরিমাণ পন্য নিয়ে কোনও মালবাহি জাহাজের প্রবেশের কোন অসুবিধা নাই। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বছরে ৮০ মিলিয়ন টন পণ্য পরিবহনের ক্ষমতা রাখে এই বন্দর। ২০১১ সাল থেকে এই বন্দর চালু হয়েছে।
এই বন্দরটি উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের খনিজ বলয়ের কাছাকাছি অবস্থিত। ধামড়া বন্দর উড়িষ্যার ভদ্রক মহাসড়ক এবং রেললাইনের সাথে ১২৫ মিটার প্রশস্ত ইউটিলিটি করিডোরের সাথে যুক্ত। এছাড়াও দুটি রেল ট্র্যাক এবং একটি চার লেনের রাস্তার পাশাপাশি বিশাল পরিষেবা লাইনের মাধ্যমে এখানে দুরন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে ব্যাপক লাভজন পরিকাঠামো গড়ে উঠতে চলেছে। তার পরেও বন্দরটিকে রেলপথের সাথে যুক্ত করার জন্য হাওড়া-চেন্নাই মেইন লাইনে ধামড়া থেকে ভদ্রক/রানিতাল লিঙ্ক কেবিন পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার রেললাইনকে ডবল লাইন করার কাজ চলছে। ফলে এই বন্দর থেকে পূর্ব, মধ্য ও উত্তর ভারতে সড়কপথে পণ্য পাঠানোর আর কোন পরিকাঠামোগত সমস্যা আদানীদের হবে না।
অতএব ছাড়ো তাজপুর - এখানে ২৫ হাজার কোটি খরচ করে উলুবনে মুক্ত ছড়িয়ে আর যাই হোক লাভের লাভ কিছুই হবে না। এরকম বহু সামুদ্রিক বন্দরের মালিকানা এখন আদানিদের হাতে।
পশ্চিম বঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তাজপুর বন্দর থেকে আদানীদের চলে যাওয়া নিয়ে বহু কথা শুরু হয়েছে। রাজ্য সরকার গোলমেলে কথা বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে। কিন্ত মোদির বিজেপি সরকার আর রাজ্য সরকারের জানাই ছিল তাজপুর থেকে আদানীদের চলে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী ।
আসলে বছর দুই আগে যখন ডেউচা পাঁচমী কয়লাখনি নিয়ে এবং বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ডকে (Bangladesh Power Development Board) ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের আদানীদের মালিকানাধীন গোড্ডার পাওয়ার প্লানট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই সাপ্লাই করার বিষয়ে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে কথা হচ্ছিল, তখনই এসব কথা সামনে চলে আসে। কিন্তু বিশ্বাস করার মত মানুষের বড়ই অভাব ছিল।
এখন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডাতে আদানি বিশাল আকারের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাচ্ছে। এর উৎপাদিত বিদ্যুৎ পুরোটাই বিক্রি করবে বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ডকে। ঝাড়খণ্ডের গোডডাতে সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালের হিসেব অনুসারে আদানীরা যে পাওয়ার প্লান্ট তৈরী করছে তার আনুমানিক নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে US$1.94 billion ডলার। (এক বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি) ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে ১৩০০০ থেকে ১৫০০০ কোটি টাকার প্রোজেক্ট।
২০১৯ এর ২৫ ফেব্রুয়ারি মোদি সরকার ঘোষনা করে এই পাওয়ার প্রোজেক্ট ভারতের প্রথম স্টান্ডার্ড পাওয়ার প্রোজেকট হবে এবং তা Special Economic Zone, বা সেজ তকমা পাবে। ফলে ট্যাক্স ছাড় সহ নানা সুয়োগ পাবে।
এই পাওয়ার প্লান্টের জন্য আদানীরা কয়লা আনবে অস্ট্রেলিয়ার Australian Carmichael Coal Project থেকে। এই কয়লা প্রথমে আসবে উড়িষ্যার ধামড়া বন্দরে। সেখান থেকে ৭০০ কিলোমিটার রেলপথে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে পৌঁছাবে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডাতে। অথচ গোড্ডা এমন এক এলাকা যার মাটির নিচেই সহজলভ্য বিশাল কয়লার ভান্ডার আছে। কিন্ত তা থাকলেও ফিনান্স পুঁজির দায় অনেক! ভারতের মত দেশকে তো আর্ন্তজাতিক লগ্নি পুঁজির সেবা কিছুটা করতেই হবে!
এই প্রজেক্ট বাংলাদেশে না করে ভারতে তৈরী হওয়ার কারণ সেখানে এই ধরনের তাপ বিদ্যুত তৈরী করার বিরুদ্ধে পরিবেশ রক্ষার জোরদার আন্দোলন চলছে। সুন্দরবনের ‘রামফল’ আন্দোলনের কথা এখন বিশ্ববিদিত। এ ছাড়াও পাওয়ার প্লান্ট বাংলাদেশে করলে আদানীরা ভারতের মতো বাংলাদেশে সেজ তকমা পেত না। কর ফাঁকি দিতে পারতো না। আর মোদীর বদান্যতায় ব্যাংকের ধার শোধ না করার সাহস পেতনা।
গোড্ডাতে আদানি প্ল্যান্ট করার ক্ষেত্রে পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে সরকারের কাছে থেকে কোনো ছাড়পত্র (No objection) নেয়নি এবং যথেচ্ছ ভাবে পরিবেশের বিনাশ করছে। ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে আদানিরা নিষ্ঠুর ভাবে এই এলাকার গাছপালা সব ধ্বংস করতে লেগেছে। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পুলিশ এদের সহায়তা করছে। এখানকার আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার চেষ্টাও চলছে। তবে এখানের লোকেরা আদানিদের কাছ থেকে ক্ষতিপুরন পেয়ে জমি ছেড়ে দিতে রাজি নয় বলেই জানা যাচ্ছে। আবার মুর্শিদাবাদ, মালদাতে বাংলাদেশের জন্য বিদ্যুত পাঠানোর লাইন তৈরী করতে নির্মম ভাবে বৃক্ষচ্ছেদন সহ নানা অসামাজিক কাজ করছে আদানীরা, যাকে তৃনমুলের সরকার সমর্থন করছে। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। কিন্ত রাজ্য সরকার পুলিশ পাঠিয়ে অত্যাচার করে মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করছে। এটা মোদি সাহেবের বিজেপি এবং আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর দলের নিজ নিজ শ্রেণিস্বার্থবাহী কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়
এই পাওয়ার প্লান্টের জন্য রাজমহলের কাছে গঙ্গা নদী থেকে খাল কেটে জল আনবে আদানীরা। আবার ফারাক্কা তার জল হারাবে। কলকাতার গঙ্গা হারাবে নাব্যতা। কলকাতা বন্দর শুকিয়ে মরবে। রাজ্য সরকার মুখে আমড়ার আঁটি গুঁজে বসে আছে। আর আদানিরা গঙ্গার যেখান থেকে জল যেখান থেকে জল আনবে সেটা ‘ডলফিন জোন’। 'ইরাবতী ডলফিনরা' এখানে ঘুরে বেড়ায়। ভাবুন কি আক্রমন আসবে প্রকৃতির উপর।
অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আনার অনেক সমস্যা। ওদিকে বিদেশী ধারের দায়ও অনেক! আদানিকে বিদ্যুত কারখানা আগামী বছরে চালু করতেই হবে। না হলে সেজ তকমা হারাবে আদানীদের গোড্ডা বিদ্যুত কারখানা। সেক্ষেত্রে খুবই বড় বিপদে পড়বে আদানীদের বিদ্যুত কারখানা। অতএব ঢুঁ মারো ডেউচা-পাঁচামীতে। ডেউচা থেকে গোড্ডার দুরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটার। এখান থেকে কয়লা পেলে অনেক সমস্যা কমে যাবে। সেজ স্টেটাস বজায় রেখেই লুঠ করা যাবে। নিদেন পক্ষে এ কয়লা তোলা অসম্ভব হলেও লোক দেখানো হিসাবে বলা তো যাবে, "এই দেখো আমরা খাদান পেয়েছি - কিছু দিনের মধ্যেই কয়লা তুলব।"
সরকারের টাকা মারাও যাবে। জমিও দখল হবে। আদিবাসীদের উচ্ছেদও হবে। আর পাথর বেচে কোটি কোটি টাকার কামাই চলবে এখন বছর ত্রিশ। ফুলে ফেঁপে ঢোল হবে মোটা আর মোটার দিদির কোম্পানি। মরবে সাধারন মানুষ। তাতে সিঙ্গুর বা তাজপুর শ্মশান হলেও মোদি আর দিদির কিছু যায় আসেনা। আদানীদের তো লাভ হবে - ফিনান্স ক্যাপিটাল তো কোভিড পরবর্তী সংকট থেকে পার পাবে। অতএব বাজাও ফিনান্স ক্যাপিটালের ঢোল।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার -
২০২১ সালে যখন বীরভুম জেলার ডেউচা -পাঁচামীর খোলা মুখ কয়লা খনি নিয়ে লিখছিলাম তখন স্যোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রয়াত বিদ্যুত গুছাইতের সাথে বেশ কিছু আলোচনা হয়।
ওনার কাছেও ধামড়া এবং ঝাড়খন্ডে আদানিদের সেজ তকমা প্রাপ্ত বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। সেখান থেকেও লেখকের অনুসন্ধিৎসা এই লেখা লিখতে অনেক সহায়তা করেছে।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া