Fascism and India II

চাই আন্দোলনের সঠিক সূচীমুখ আর দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের প্রস্তুতি (২য় পর্ব)

শমীক লাহিড়ী

সঙ্কটে লগ্নি পুঁজি, চাই দক্ষিণপন্থা

কিন্তু সম্পদের ক্রমবর্দ্ধমান কেন্দ্রীভবন এবং সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ক্রমহ্রাসমান সম্পদের পরিমাণ, বাজারের চাহিদা কমায়। যার অবশ্যম্ভাবি ফল হিসাবে অর্থনৈতিক সংকট গভীরতর হতে থাকে। এর ফলে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে। বাজার ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। লগ্নি পুঁজি তখন নিজেদের ক্রমবর্দ্ধমান মুনাফার হার বজায় রাখার জন্য সরকার এবং রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে। তখনই তাদের কাছে দক্ষিণপন্থীদের সরকারে বা রাষ্ট্রক্ষমতায় আনা জরুরী হয়ে পড়ে।

তাই এদের পছন্দ বিজেপি’র মতো দলই এবং  নরেন্দ্র মোদি’র মতো নেতা নির্মাণ ক’রে তাদের ক্ষমতায় আনা ও রাখার জন্য মরিয়া হ’য়ে কাজ করে।

কর্পোরেট ফ্যাসিবাদের গলাগলি

কর্পোরেট পুঁজিবাদ বা লগ্নি পুঁজির সমর্থন ছাড়া ফ্যাসিবাদী কোনও দল পৃথিবীর ইতিহাসে কখনই ক্ষমতায় আসেনি।   ফ্যাসিবাদ ও কর্পোরেটের গলাগলি সাব হেডিং এর ২ য় ও ৩য় বাক্য দুটি পরিবর্তন করে নীচের বাক্য দুটি লেখা হবে।

মিঁশ্যল কালেকি নামে একজন প্রখ্যাত পোলিশ মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত একটি তত্ত্বের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন কিভাবে ১৯৩০ এর সময়ে বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠী গুলি ফ্যাসিবাদের উত্থানে সাহায্য করেছিল। তিনি তথ্য সহ ব্যাখ্যা ক'রে দেখিয়েছিলেন, কি ভাবে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি ফ্যাসিস্ট দলগুলিকে সরকার গঠন করতে সাহায্য করেছিল এবং বিনিময়ে কিভাবে তারা নিজেদের অবাধ লুঠকে নিশ্চিত করেছিল বিভিন্ন সরকারী বরাতের চুক্তি হাতিয়ে অথবা সরকারী অনুদান বা কর ছাড়কে ব্যবহার করে। এটা ঠিক সব একচেটিয়া পুঁজির মালিকরাই স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অবাধ লুঠের সুযোগ পায়, কিন্তু সব পুঁজিপতি সমান সুযোগ পায় না। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মধ্যেও শাসকের অতিরিক্ত আনুকুল্য পায় অল্প সংখ্যক কিছু পুঁজিপতি, বিশেষ করে যারা ফ্যাসিস্ট দলকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করে অথবা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে।

এক ফরাসি বামপন্থী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল গুয়েরিন ১৯৩৬ সালে একটি বই লেখেন - Fascism and Big Business। এই বইতে তিনি দেখিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদী দল ক্ষমতায় আসার আগে যারা একচেটিয়া পুঁজিপতি রূপে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান যেমন - বস্ত্র শিল্প বা অন্যান্য ভারী শিল্প পরিচালনা করত এবং নতুন একচেটিয়া পুঁজিপতি যাদের বিকাশ ঘটে ছিল ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় আসার পর, তাদের মধ্যে অনেক তারতম্য ছিল। এরা মূলত বিশাল বিশাল শিল্প যেমন - যুদ্ধাস্ত্র তৈরীর কারখানা, বিশাল খনি শিল্পের বরাত পেয়েছিল। যেমন - জাপানের ক্ষেত্রে পুরানো শিল্প গোষ্ঠী বা ‘জাইবাৎসু’ এবং নতুন শিল্প গোষ্ঠী যাদের ‘নিও জাইবাৎসু’ বলা হত, তাদের মধ্যে বিস্তর তারতম্য তৈরী হয়েছিল। পুরানো জাইবাৎসু যেমন - মিৎসুই, মিৎসুবিশি, সুমিতোমো, ইয়াসুদা ইত্যাদি শিল্প গোষ্ঠীগুলি নানা ধরণের প্রথাগত শিল্প পরিচালনা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু নিও জাইবাৎসু যেমন - নিশান কোম্পানী, বিশাল ভারী শিল্প অর্থাৎ যুদ্ধাস্ত্র তৈরী, কোরিয়ার খনি খনন ইত্যাদি শিল্পের বরাত পেয়েছিল কোনও আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই।

ভারতেও একই রূপ

একইভাবে আমাদের দেশেও বিশেষ করে জরুরী অবস্থার সময় বা আগে পরে বিশেষ একটি শিল্প গোষ্ঠী (ধীরুভাই আম্বানি) শাসকদের আনুকুল্যে ফুলেফেঁপে উঠেছিল। এরা চিরাচরিত একচেটিয়া পুঁজির তুলনায় অনেক বেশি আগ্রাসী ছিল এবং মুনাফা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও তীব্র আগ্রাসী ভুমিকা নিয়েছিল। তবে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা সেই সময়ে দীর্ঘস্থায়ি না হওয়ায় অন্যান্য একচেটিয়া পুঁজিপতিদের তুলনায় বিপুল মুনাফার সুযোগ দীর্ঘদিন ধরে পায়নি।

পরবর্তিতে বাজপেয়ী সরকারের আমলে আবার এই শিল্পগোষ্ঠীর রমরমা দেখতে পাওয়া যায়। একইভাবে ২০১৪ সালে মোদীকে ক্ষমতায় আনার প্রশ্নে যে দুটি গুজরাটি শিল্পগোষ্ঠী মুখ্য ভুমিকা নিয়েছিল, তারাই আজ দেশের মানুষকে এবং সম্পদকে ব্যাপক লুঠ করছে। ২০১৪ সালের প্রাক্কালে একটি আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলনে এই দুই গোষ্ঠী পরবর্তি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর নাম প্রস্তাব করে। বিজেপি দলের অভ্যন্তরে মোদি’র নাম নিয়ে তীব্র মতানৈক্য থাকা সত্বেও এরাই মূখ্য ভুমিকা নিয়েছিল মোদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী রূপে তুলে ধরতে।

২০১৯ সালে দিল্লীর একটি অসরকারী সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বিজেপি সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে নাকি ২৭০০০ কোটি টাকা খরচ ক’রেছিল। এর মানে লোকসভার আসন পিছু গড়ে তারা ৪৯.৮২ কোটি টাকা খরচ করেছিল। এই বিপুল অর্থের সামনে মানুষের মতামতের কোনও মূল্য থাকে?

দেবে আর নেবে

আর এই দুই শিল্প গোষ্ঠীও মোদি’কে প্রধানমন্ত্রী বানাতে যা অর্থ খরচ করেছে তার কয়েকগুন অর্থ তুলে নিয়েছে গত ৮বছরে। গত ৮বছরে আদানি গোষ্ঠীর সম্পদ ২০ গুণ বেড়েছে। ২০১৪ সালের ছিল ৭.৩বিলিয়ন ডলার আর ২০২২ সালে হয়েছে প্রায় ১৪০বিলিয়ন ডলার। গত বছরে আম্বানি প্রতিদিন ২১০কোটি টাকা আয় করেছেন, আর আদানির প্রতিদিন আয় ছিল ১৬১২কোটি টাকা।

এই বিপুল মুনাফা বৃদ্ধির হার বজায় রাখার জন্যই ন্যূনতম মজুরি আইন, চাকরির নিরাপত্তা, কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা বাতিল ক’রে নতুন ৪টে শ্রম কোড চালু করা। এদের পেট মোটা করার জন্যই মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা আইন শেষ করার উদ্যোগ, কৃষকের ফসলের নূন্যতম দামের গ্যারান্টি তুলে দেওয়া, ওষুধ সহ নিত্য প্রয়োজনীয়পত্রের ইচ্ছা মতো দামে বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া। এদের মুনাফার জন্যই শিক্ষা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঢালাও বেসরকারিকরণ। এদের মুনাফার ঝুলির ওজন বাড়াবার জন্যই ধনীদের জন্য কর্পোরেট কর বা ব্যাঙ্ক ঋণে বিপুল ছাড় আর আটা-নুন-চাল-ডালের ওপরে স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথম কর চাপানো। পেট্রোল-ডিজেল-কেরোসিনের ওপর লাগাম ছাড়া কর চাপানো।

লড়াইয়ের রাস্তা

তাই আজ আমাদের দেশের ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই এর অর্থ – সংগ্রামের সূচীমুখ স্থির রাখতে হবে লুঠেরা কর্পোরেটের বিরুদ্ধে আর রুটি-রুজি-গণতন্ত্রের দাবিতে রাস্তা দখল করে চালাতে হবে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই। আর প্রয়োজন – প্রকৃত বিজেপি বিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-এর সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহণ।

ঋণঃ প্রভাত পট্টনায়ক ও সীতারাম ইয়েচুরির প্রবন্ধ সমূহ,  Corporatism and Fascism : Antonio Costa Pinto


শেয়ার করুন

উত্তর দিন