কৃষকের কুচকাওয়াজে সাধারনতন্ত্রের স্বপ্ন - চন্দন দাস...

২৬ জানুয়ারি ,২০২১ মঙ্গলবার

‘স্বাধীন ভারতে স্বাধীন গ্রাম চাই।’ ১৯৪৬’র জানুয়ারি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি হাজির করেছিল এই দাবি।

নির্বাচন ছিল সামনে। সেই উপলক্ষ্যে পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল পার্টি। শিরোনাম ছিল — ‘সকলের স্বাধীনতা চাই।’ দেশ তখন স্বাধীনতার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সাধারনতন্ত্র ছিল দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামলালিত এক স্বপ্ন।

শুধু ‘স্বাধীন ভারতে স্বাধীন গ্রাম’র

কথাই সেখানে ছিল, তা নয়। শহরের পরিচালনা স্বাধীন ভারতে কেমন হওয়া উচিত, কেমন হওয়া উচিত আইন ব্যবস্থার চেহারা, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি কী হওয়া দরকার — এমন অনেক কিছুরই রূপরেখা সেখানে উচ্চারিত হয়।

কমিউনিস্টরা দাবি করেছিল
‘স্বাধীন ভারতে জনগনের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা।’ সাধারনতন্ত্রের সেই ব্যাখ্যায় গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল গ্রামের কথা।

গ্রাম তখনও প্রধানত কৃষিনির্ভর ছিল। কৃষকের সঙ্কট, ফসলের বিপণন, খেতমজুরের মজুরি, সুদখোর মহাজনের দৌরাত্ম তখনও ছিল।

স্বাধীনতা আন্দোলনে কৃষকদের অনবদ্য ভূমিকার উল্লেখ করে কমিউনিস্ট পার্টি লিখলও, ‘‘(আজ) কৃষকের কোনো জমি নিরাপদ নয়। কোনো কৃষক জানেন না, তাঁহার ফসলের কি দর তিনি পাইবেন এবং কি করিয়াই বা তিনি পরের মরসুম চালাইবেন।’’

দাবিগুচ্ছের মধ্যে দু’নম্বরেই ছিল —

‘ক্ষেতমজুরদের ন্যূনতম মজুরি বাঁধিয়া দিতে হইবে।’

স্বাধীন ভারতে মুক্তি মিলবে — এই ছিল ভারতবাসীর আশা। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা কোন পথে এলো, ক্ষমতা কাদের হাতে পৌঁছোল, কাদের স্বার্থ স্বাধীন ভারতে শাসকদের কাছে প্রধান অগ্রাধিকার হয়ে উঠলো — তার উপর সাধারনতন্ত্রের সাফল্য, ব্যর্থতা নির্ভরশীল। তাই ছিল এবং আছে। থাকবেও। কারন, স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে। তাই সাধারনতন্ত্র শপথ গ্রহণের দিবস হয়ে উঠেছে স্বাধীন ভারতে।

সেদিন কমিউনিস্ট পার্টি গ্রামে কৃষক-খেতমজুরদের রক্তচোষা

‘তিনটি জোঁক’-র

উল্লেখ করেছিল। ইতিমধ্যে ৭৫ বছর পার হয়েছে ওই ঘোষণার। অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে দেশের অর্থনীতির, গ্রামীণ জীবনের। ‘নিষ্কর্মা জমিদার’, ‘সুদখোর মহাজন’ এবং ‘ধড়িবাজ ব্যবসায়ী’ — সেদিনের ‘তিনটি রক্তচোষা জোঁক’ আজ একই অবস্থায় নেই। বরং অর্থনীতির বদলের সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক কুমির হিসাবে কর্পোরেট হাজির হয়েছে। কৃষকের সামনে সেদিনের সঙ্কটগুলি আজ আরও বিপুল।

সেদিনের ‘রক্তচোষা জোঁক’ কিংবা আজকের কর্পোরেট কুমির — বরাবর এদেরই পক্ষে থেকেছে হিন্দুত্ববাদীরা।

কমিউনিস্ট পার্টি যখন সকলের স্বাধীনতা, জনগনের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতার দাবি জানাচ্ছে,

তখন হিন্দু মহাসভা, আরএসএস কী করছে? ’৪৪ কিংবা ’৪৬-এ, জাতপাত নির্বিশেষে হিন্দু জোতদার আর ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ দলবেঁধে কিছুদিন হিন্দু মহাসভাকে টাকা দিয়েছিল। নেতাজীর উপর তাদের খুব গোঁসা ছিল। কমিউনিস্টরা ছিল দু’ চক্ষের বিষ। তারপর দেশভাগ হলো। নাথুরাম গুলি করলো গান্ধীকে। হিন্দু মহাসভা উধাও। আরএসএস ফিরে গেলো পুরোন ক্ষমাভিক্ষা, মুচলেকার পথে। ‘হিন্দুত্ব’ স্রেফ ‘ফুটে গেলো’কিছুদিনের জন্য।

‘হিন্দুত্ব’ একটা প্রয়োজন। সবসময়। ‘হিন্দুত্ব’ দুধ দেয়। তবে সোনার দুধ নয়। সঙ্কটে যারা ধান্দা করে তাদের বখরার পোক্ত হিসাবের দুধ জোটায় ‘হিন্দুত্ব।’ আজ নয়। বরাবর। সাধারনতন্ত্রের ধারনায় বিশ্বাস নেই আরএসএস’র। বিশ্বাস নেই সংবিধানেই। অনেক আগে কমিউনিস্টসহ বিভিন্ন সংগ্রামী অংশ দাবি উত্থাপন করলেও কংগ্রেস নামক মঞ্চ ১৯৩০’র ২৬ জানুয়ারি পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে দেশবাসীকে শপথ নিতে আহ্বান জানায়। এই দিনটিকেই সংবিধান বলবৎ করার ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র আত্মপ্রকাশ করার দিন হিসাবে ধার্য করা হয়। বিপজ্জনক ব্যতিক্রম ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংগঠন। অর্থাৎ আরএসএস। ব্রিটিশকে বারবার মুচলেকা দেওয়া আরএসএস তার মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকায় ১৯৪৯র ৩০ নভেম্বর সম্পাদকীয়তে প্রকাশ করে সংবিধান সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি। তারা দলিত-বিরোধী, মহিলা-বিরোধী, গণতন্ত্র-বিরোধী ‘মনুস্মৃতি’কেই ভারতীয় সংবিধান করার দাবি জানায়।

মোদীদের ‘গুরুজী’ এমএস গোলওয়ালেকার দেশের সংবিধানকে প্রত্যাখান করে লেখেন: ‘‘আমাদের সংবিধান সত্যিই ভারী ও পাঁচমিশেলি, পশ্চিমী দেশগুলির বিভিন্ন সংবিধানের বিভিন্ন ধারা এখানে জোড়া লাগানো হয়েছে। এখানে একেবারেই এমন কিছু নেই যেটাকে আমাদের নিজস্ব বলা যায়। আমাদের জাতীয় লক্ষ্য কি এবং আমাদের জীবনের মূল মর্মবস্তু কি সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিতে তার কি একটি শব্দও উল্লেখ আছে?’’

এই লেখা কবে? কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে ১৯৪৯’র ২৬ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হওয়ার ৩ দিন পর।

ভারতের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, কাজ, শিক্ষা নিয়ে তাদের কোনও বক্তব্য নেই — তাদের মনুস্মৃতি চাই। চাই ‘এক পতাকা, এক ভাষা, এক নেতা, একটিই আদর্শ — হিন্দুত্ব’। অথচ দেশের প্রয়োজন জনগনের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা —
সাধারনতন্ত্র। সংবিধান গৃহীত হওয়ার ৭১ বছরে দেশের তখ্‌তে সেই হিন্দুত্ববাদীরা। রক্তচোষা জোঁকের জায়গায় সর্বগ্রাসী শ্বাপদ — কর্পোরেট। এবারও তাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, সহায়ক শক্তি সংবিধান-বিরোধী, সাধারনতন্ত্রের ধারনার বিপ্রতীপে দাঁড়ানো সাম্প্রদায়িক শক্তি। এখন, এই পরিস্থিতিতে ‘স্বাধীন ভারতে স্বাধীন গ্রাম’র ধারনা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়া ভারতে সাধারনতন্ত্র দিবসেই এবার

কৃষকদের কুচকাওয়াজ!

সেদিন যে লক্ষ্য কমিউনিস্টরা ঘোষণা করেছিল, যে কথা ধারাবাহিকভাবে বামপন্থীরা বলে এসেছে, তার অনেক কথাই আজ নয়াদিল্লির দ্বারপ্রান্তে সোচ্চার শোনা যাচ্ছে। এই সাধারনতন্ত্র দিবসে, অখন্ড আকাশের নিচে শক্তির নতুন ভারসাম্য উপস্থিত। পৃথিবীর বিভিন্ন মহলে তরঙ্গ তোলা আজকের ভারতের কৃষক আন্দোলনে সমবেত অনেক ধারার মতাদর্শ। তাঁদের উদ্বেগের চরিত্র নানা। গ্রামীণ ভারত নানা বিভাজনে বিভক্ত থেকেছে এবং থাকে। সেখানে কোথাও জাতের ভেদরেখা দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড়ের মত। কোথাও ধর্মীয় নিপড়ন হয়ে থাকে আপাতদৃষ্টিতে অলঙ্ঘ্যনীয় কাঁটাতারের মত। কিন্তু

মোদী সরকারের তিনটি কৃষি আইন, যা সংসদে শক্তির জোরে পাশ করিয়ে নিয়ে গেছে হিন্দুত্ববাদী শাসক, সেই তিনটি আইনই আটকে গেছে যাবতীয় বিভাজনরেখা অতিক্রম করে সংগঠিত হওয়া কৃষক সমাজের ঐক্যের সামনে।

আগের যে কোনও কৃষক আন্দোলনের থেকে এবারের আন্দোলনের চরিত্র আলাদা। কৃষক সমাজ বলতে এতদিন যে কথা আমরা বলে এসেছি, তার অনেকটাই সম্মিলিত ভাবে হাজির হয়েছে রাজধানীর চারিদিকে। আক্ষরিক অর্থেই রাজধানীর দ্বারপ্রাপ্তে হাজির হয়েছে

‘জনগনমন অধিনায়ক’।

সিঙ্ঘু এবং টিকরি একটি ক্ষেত্র। দিল্লির এই সীমানায় রয়েছে বড় জমায়েত। এখানে আছেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা। টিকরিতে মাঝারি, ছোট কৃষিজীবীরা আছেন যথেষ্ট সংখ্যায়। মেওয়াট আর একটি প্রান্ত। সেখানে যাঁরা আছেন তাঁরা প্রধানত প্রাণীসম্পদ পালন, বিকাশে যুক্ত। এদের বড় অংশ মুসলমান। গাজীপুরে উত্তর প্রদেশের পশ্চিমে যে এলাকায় আখের চাষ হয় এবং উত্তরাখন্ডের কৃষকরা আছেন। পালওয়াল সীমানায় আর অংশের কৃষকরা আছেন। তাঁরা এসেছেন মূলত মধ্যপ্রদেশ থেকে। নয়াদিল্লি থেকে সবচেয়ে দূরের সীমানা শাহজাহানপুরের শিবির। এটি রাজস্থান-হরিয়ানা লাগোয়া। এখানেও অনেক কৃষক রয়েছেন। প্রতিদিনই বাড়ছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা।



আরও একটি দীর্ঘ লালিত বিভাজন এবারের কৃষক আন্দোলন ভেঙে ফেলেছে। গ্রামীণ ভারত আর নাগরিক ভারতের একটি সীমারেখা বরাবরই দেশে দেখা গেছে। যার নানা ধরনের প্রাব আন্দোলনে নজরে পড়ত। কিন্তু এবার তা অনেকটাই অন্তর্হিত। কেন? দেশের খাদ্যশস্যের স্বনির্ভরতা বিপন্ন, মজুতদারদের পোয়াবারো হবে, আম্বানি-আদানীরা বিপুল সুবিধার অধিকারী হবে এবং খাদ্য সরবরাহ যাবে বেসরকারি হাতে, বাড়বে জিনিসের দাম — এই আশঙ্কা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। তিনটি কৃষি আইনের প্রভাব শুধু গ্রামীণ সমাজের বৃত্ত ভেঙে অন্যান্য অংশের জীবনযাপনকেও বিধ্বস্ত করবে প্রবল — এই আশঙ্কা যত স্পষ্ট হয়েছে, তত কৃষক আন্দোলন হয়ে উঠতে শুরু করেছে জনগনের আন্দোলনে।



প্রশ্ন উঠেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার তিনটি বিপজ্জনক কৃষি বিল এখনই এনেছিল কেন? আরও অন্তত তিন বছর তাদের হাতে সময় ছিল। দেশের দুর্দশার সুযোগ নিতে চেয়েছিল কর্পোরেট-বন্ধু হিন্দুত্ববাদীরা। করোনা, লকডাউনের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কোনও প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে না, এই ছিল শাসকের ধারনা। উল্লেখ্য, নীতি আয়োগ বলেছে ‘মহামারী সুযোগ এনে দিয়েছে।’ ‘কাট দি ক্লাটার’ অনুষ্ঠানে নয়া উদারনীতি ও বাজারের হাতে সর্বস্ব তুলে দেওয়ার অন্যতম প্রবল সমর্থক সাংবাদিক শেখর গুপ্তের মুখে শোনা গেছে, দারুণ সুযোগ সামনে। এই ভালো সঙ্কটকে অপচয় করলে হবে না।

কিন্তু মহামারীর আবহে দেশের বিশাল সম্পদের মালিকদের সম্পদ আরও বাড়তেই পারে। সরকার তার সহায়ক, এজেন্টের ভূমিকা পালন করতেই পারে। কিন্তু সাধারনতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা ভারতে প্রতিরোধের শক্তিকে আটকানোর সামর্থ্য মহামারী অর্জন করতে পারেনি। বরং প্রতিরোধের চরিত্র আরও ব্যপক হয়ে উঠেছে। বিভাজন চূর্ণ প্রতিরোধের সাধারনতন্ত্রে। পরিস্থিতির এবং আন্দোলন, প্রতিরোধের এই গুণগত বদলের সাক্ষী আজকের সাধারনতন্ত্র দিবস।



রাজধানীকে ঘিরে ফেলা কৃষক সমাজ আজ কুচকাওয়াজ করবেন। সতর্ক আছেন তাঁরাও — ঐক্য ভাঙার সর্বোত অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শাসক। হিন্দুত্ব তাদের ঢাল। আসল লক্ষ্য নতুন কুমিরের মুখে কৃষক সমাজকে ঠেলে দেওয়া



ছবি : সোশ্যাল মিডিয়া ও গুগল ইমেজ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন