Chandan Das on File WB

Who’s Lying Ma’am CM? A Report

চন্দন দাস

তখনও সেপ্টেম্বর ছিল।

২০০৮-র ১৭ সেপ্টেম্বর। সেদিন মহাকরণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, সিঙ্গুরের ওই ৯৯৭ একর থেকে অনুসারী শিল্প সরিয়ে নিয়ে যাওয়া কী সম্ভব? তৃণমূল বলছে অনুসারী শিল্পের নামে টাটারা সুইমিং পুল করবে? ভট্টাচার্য এর উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওই কথা বাদ দিন। বৈঠকে আমাকে শুনতে হয়েছে অনুসারী মানে ওয়াইন শপ এবং বিউটি পার্লার। অত্যন্ত নিচু স্তরের কথাবার্তা।’

মমতা ব্যানার্জি নিশ্চই জানতেন সিঙ্গুরে কোথায় মদের দোকান আর বিউটি পার্লার হবে। তার ‘কাগজ’ নিশ্চই তিনি পেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেই।

কিন্তু ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। সিপিআই(এম) সিঙ্গুরের কোথায় কোথায় মদের দোকান, সুইমিং পুল আর বিউটি পার্লার বানানোর জন্য জমি ঠিক করেছিল, মমতা ব্যানার্জি আজও প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি।
তাহলে মমতা ব্যানার্জি কী প্রমাণ করলেন? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একশো শতাংশ ঠিক ছিলেন। সত্যিই ‘অত্যন্ত নিচু স্তরের কথাবার্তা’ বলেছিলেন তৃণমূলের নেতারা।

mamatabbanerjee

আরও কী বলেছিলেন তৃণমূল নেত্রী?

‘সরকারে এসেই সিঙ্গুর চুক্তি প্রকাশ করব।’ কেন বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি? তৃণমূলসহ বামফ্রন্ট বিরোধী সব শক্তির অপপ্রচারে বাড়তি মাত্রা জুড়তে। দেশে সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে ভুল বার্তা ছড়িয়ে দিতে। সেই সময় তৃণমূল প্রচার করেছিল ‘সিপিএম টাটাদের দালালি করেছে। টাটাদের সুবিধা করে দিয়েছে নিজেদের ধান্দায়। কৃষকদের ক্ষতি করে।’
১১ বছর বয়স হয়ে গেছে তৃণমূল নেত্রীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের। সিঙ্গুরের সেই ৯৯৭ একর জমি এখন খণ্ডহর— চাষ হয় না। সরকারও ভুলতে বসেছে।

কিন্তু ‘সিঙ্গুর চুক্তি?’ ‘সিপিএম-র ধান্দার’ নথি? আজও প্রকাশ করেননি মমতা ব্যানার্জি। চুক্তির কাগজ সরকারের কাছেই আছে। বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তির কাগজ তো আর বগলদাবা করে সরিয়ে ফেলা যায় না!
২০১১-র মে-র পরে যিনি শিল্পমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি এখন জেলের ভাত খাচ্ছেন— পার্থ চ্যাটার্জি। সিঙ্গুর-চুক্তি আজও মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ করেননি। কারন? বামফ্রন্ট গরিব কৃষক আর রাজ্যের কাজের অপেক্ষায় থাকা যুবকদের কথা ভেবে সেই চুক্তি করেছিল। সিঙ্গুরে কারখানা করতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কমরেড নিরুপম সেনরা।
মমতা ব্যানার্জি তা জেনেছেন। কাঙ্খিত মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে বুঝেছেন— সেই ‘কাগজ’ প্রকাশ করলে তাঁর মিথ্যাচার প্রকাশ হয়ে পড়বে।

সিঙ্গুর এলে নন্দীগ্রাম আসবেই। ‘নন্দীগ্রামে মহিলাদের স্তন কেটে নিয়েছিল সিপিআই(এম) কর্মীরা। শিশুদের পা চিড়ে তালপাটি খালে ভাসিয়ে দিয়েছিল হারমাদরা।’

মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন। ২০০৭-র মার্চে। পরেও অনেকবার বলেছেন। নিশ্চয়ই ‘প্রমাণ’ আছে— রাজ্যের অনেকে ভেবেছিলেন। বিশ্বাস করেছিলেন— সিপিআই(এম) কী ভয়ঙ্কর!

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ১১ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। ‘স্তনকাটা’ মহিলা একজনকেও দেখাতে পারেনি ‘সততার প্রতিক’- র সরকার।

২০০৭-র মার্চের পর নিখোঁজ হয়েছে সেই সব শিশু— এমন প্রমাণও হাজির হল না! নন্দীগ্রামে এমন অনেক ‘সত্য’ আছে। আলমারি বোঝাই হয়ে যাবে।

আসুন তার বদলে ২০১১-র দেওয়ালগুলির সামনে দাঁড়াই। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়েছিল, ‘বামফ্রন্ট আমলে ৫৬০০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে।’

singur tata nano

মমতা ব্যানার্জি তাঁর ২০১১-র নির্বাচনী ইশ্‌তেহারের ২৫-নং পাতায় দাবি করেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ৫৬ হাজার কারখানা বন্ধ। তার জমির পরিমাণ ৪৪ হাজার একর।’

মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কী বললেন?

বিধানসভায় ২০১১-র ২৩ ডিসেম্বর বিধায়ক যোশেফ মুণ্ডার প্রশ্নের জবাবে মমতা ব্যানার্জির সরকার লিখিত আকারে জানিয়েছিল, ২০১১-র ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত রাজ্যে বড় এবং মাঝারি মাত্র ৮৩টি কারখানা বন্ধ। তার মধ্যে ২৫টি বড় কারখানা। ৫৮টি মাঝারি কারখানা।

কোনও গল্পগাথা নয়। বিধানসভার প্রশ্নোত্তর পর্বের নথিতে তা লেখা আছে।

বামফ্রন্ট সরকার কাগজ, আলমারি রেখে গেছিল বলেই মমতা ব্যানার্জির প্রতিনিধি ওই তথ্য জানাতে পেরেছিল। এবং পরোক্ষে স্বীকার করেছিল তৃণমূল— তারা মিথ্যা কথা বলে সরকারে এসেছে।

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ১১ বছর সুখে, ভোগে কেটে গেল মমতা ব্যানার্জির। মন্ত্রী, বিধায়ক হিসাবে তাঁর দলবলের। ’৫৬ হাজার বন্ধ কারখানা’ আজও বের করতে পারলেন না!

কারণ— মিথ্যার কোনও কাগজ থাকে না।

rajbhavan Lefts with mamata

সোমবার মমতা ব্যানার্জি তবু দাবি করেছেন, বামফ্রন্ট কোনও কাগজ, আলমারি রেখে যায়নি। তিনি কিছু পাননি।

বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালের সব কাগজ তাঁর সরকার পেয়েছে। প্রমাণ দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জির সরকারের দপ্তরের মন্ত্রী, আমলারাই। যেমন হয়েছে গত শুক্রবার। তৃণমূলের নেতা, কর্মীরা দেদার চুরি করেছে গ্রামে। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না তাদের ধান্দার কারবার, লুট। তাই পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর বামফ্রন্ট সরকারের ২০০৪-র নির্দেশিকার ভিত্তিতেই পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছে।

অর্থাৎ পঞ্চায়েতে স্বচ্ছতা বজায় রাখার সরকারি কাগজ ছিল। মন্ত্রী হিসেবে সূর্য মিশ্র তখন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের দায়িত্বে। সেই নির্দেশ অনুযায়ী পঞ্চায়েতে বছরে চারবার পর্যালোচনা হত।

১১ বছর সে সব রাজ্যে বন্ধ।

এতদিন লুটের জন্য তৃণমূলের সরকার তা তুলে রেখেছিল। এখন বের করতে বাধ্য হয়েছে।

তাহলে ‘কাগজ পাননি’র মানে কী?

২০২১-র ২৬জুলাই মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় কী বলেছিলেন? মমতা ব্যানার্জি সেদিন বলেছিলেন, ‘২০১৩ সালের কেন্দ্রীয় লোকপাল আইন অথবা ২০০৩ সালের এরাজ্যের লোকায়ুক্ত আইন টোটো মেনে নিতে যাব কেন? আমি টোটো পার্টি নই। আমাদের নিজস্ব মতামত আছে। সেই অনুযায়ী আমরা আইন সংশোধন করে নিচ্ছি। কাল আপনাদের মেজরিটি এলে (বিধানসভায়) তখন আপনারা আইন সংশোধন করে নেবেন।’

২০০৩-এ কাদের সরকার ছিল? বামফ্রন্টের। বামফ্রন্ট একটি আইন করেছিল— ‘লোকায়ুক্ত আইন।’ সেই আইনের আওতায় মন্ত্রী, আমলা তো বটেই, খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে আনা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও ওঠা দুর্নীতির তদন্ত হতে পারত সেই আইনে।

মমতা ব্যানার্জি সেই আইন বদলে ফেলেন। ২০২১-র জুলাইয়ে। কেন? কারণ— ‘বামফ্রন্ট আমলের কাগজ’ তিনি পেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন ওই ‘কাগজ’-র লেখা বদলে না দিলে তাঁকেও চুরি, জোচ্চুরির তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে।

তাই সেই ‘কাগজ’-র লেখা পালটে মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী, আমলাদের তিনি ওই আইনের প্রায় বাইরে নিয়ে যান। কী আছে সেই সংশোধনীতে? তাতে বলা হয়েছে, ‘পাবলিক অর্ডার’-এর সঙ্গে যুক্ত বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত লোকায়ুক্ত তবেই করতে পারবে, যদি বিধানসভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য তাতে সম্মতি দেয়। বামফ্রন্ট আমলের কাগজ ছিল, তিনি দেখতে পেয়েছিলেন বলেই তো তা করতে মরিয়া হলেন। তাই না?

আরও উদাহরণ আছে। ভূরি ভূরি।

তৃণমূল সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি বইটি প্রকাশ হয়েছিল ২০১৪-র ২৬ মে। সেই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তাঁর সরকারের সেই বইয়ের নাম ছিল ‘লেট বেঙ্গল শো দ্য ওয়ে।’ বইয়ের ৩৬ নং পাতায় রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয় ২০০৯-’১০ থেকে রাজ্যে ২ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ শুরু হয়েছে। প্রথম থেকেই দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৭৫ লক্ষ দারিদ্র সীমার নিচে থাকা মানুষকে।

যদি ‘কাগজ’ই না পেতেন, দেখতেন, যদি আলমারিই না থাকত তাহলে মমতা ব্যানার্জির সরকার জানলো কী করে— ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে শুরু?

২০১২-র ৩ জানুয়ারি মহাকরণেই ছিল ‘মহাকরণ’। সেখানে সেদিন মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন,‘বামেরা দুর্নীতির আতুঁড়ঘর তৈরি করে গেছে।’ তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘বাম আমলে টেন্ডার না-ডেকে কাজ দিয়ে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। এ সব নিয়ে কয়েকটা অডিট করানো হয়েছে। প্রতিটিতে চূড়ান্ত দুর্নীতি ধরা পড়েছে। প্রমাণ ছাড়া প্রকাশ্যে বলব না। অর্থমন্ত্রীকে বলেছি, এ সব একটু একটু করে প্রকাশ্যে আনতে।’

১০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। অনেক কাগজ পেয়েছিলেন বলেই তো মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ‘প্রতিটিতে চূড়ান্ত দুর্নীতি ধরা পড়েছে।’ কিন্তু তারপর?

আজও একই কথা সভায় বলছেন। ‘প্রমাণ’ হাজির করতে পারছেন না।

গুজবের নথি থাকে না। মিথ্যার থাকে না ‘কাগজ’ কিংবা আলমারি।

বামফ্রন্ট সততার সঙ্গে সরকার চালিয়েছে— প্রমাণ করেছেন মমতা ব্যানার্জিই।

Spread the word

Leave a Reply