South 24 PGS GE 24 Cover

‘Where The Mind is Without Fear’ – Part (II): Jadavpur

অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

যদিও অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর লোকসভা আসনে বামফ্রন্ট মনোনীত,জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী সর্বভারতীয় ছাত্রনেতা কমরেড সৃজন ভট্টাচার্য, কিন্তু নিবন্ধের শীর্ষনাম কেবলমাত্র ব্যক্তি প্রার্থীকে ঘিরে নয়। এ হল প্রকৃত অর্থেই যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের আপামর মানুষের মনের কথা। তাঁরা এবারে এমন একজন প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠাতে চান যিনি সত্যি সত্যিই যাদবপুর কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের জন্য নতুন কিছু ভাবনা, নতুন কিছু কথা ‘সৃজন’ করবেন এবং তা সংসদে তুলে ধরে আইন প্রণয়নের দাবি জানাবেন।

বিগত তিন দফায় পনেরো বছর ধরে সাধারণ মানুষ যাদবপুর কেন্দ্রে তাবড় তাবড় সাংসদ দেখেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী, দুনিয়াজোড়া  খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক এবং গ্ল্যামারসম্পন্না অভিনেত্রী। কিন্তু এঁরা মানুষের ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে নিজ নিজ পেশা ও কাজেই ব্যস্ত থেকেছেন বেশি। যাদবপুরের মানুষের সমস্যার কথা সংসদে তুলে ধরার প্রশ্নে কিম্বা জনস্বার্থে নতুন ভাবনা সৃজনের প্রশ্নে কোনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় তাঁদের দেখা যায় নি। শেষোক্ত জন তো মাত্র কয়েকদিন ছাড়া সংসদে গিয়েই উঠতে পারেন নি।হয়তো তাঁর পেশাগত ব্যস্ততার কারণে। আর যে কদিন গেছেন সেলফি তোলায় ব্যস্ত থেকেছেন বেশি বলে শোনা যায়।। তাই যে দলের প্রতিনিধিত্ব তাঁরা করেছিলেন, সেই তৃণমূল কংগ্রেস দল প্রত্যেক পাঁচ বছর অন্তর প্রার্থী বদল করেছে। কাউকে রিপিট করার দুঃসাহস দেখাতে পারে নি। এবারও তারা অন্য একজন অভিনেত্রীকেই প্রার্থী করেছে। তাই এবার জনতা মনস্থির করে ফেলেছে প্রতীক বদলের। অর্থাৎ ফুল বদলের। কারণ তারা ঠেকে শিখেছে যে, সংসদ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জায়গা নয়। তাদের জায়গা তাদের নিজস্ব জগত, অভিনয় জগত। এছাড়া রাজ্য ও দেশ পরিচালনার বহর দেখে তৃণমূল ও বিজেপি দল তথা কোনও ফুলের প্রতিই আর মানুষের আস্থা দেখা যাচ্ছে না। তারা এবার যাদবপুরে সৃজন চায়।

যাদবপুর জনবিন্যাস ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যগত কারণে এক বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। এই লোকসভা আসনের অন্তর্ভুক্ত সাতটি বিধানসভা এলাকা হল যাদবপুর, টালিগঞ্জ, ভাঙড়,সোনারপুর উত্তর, সোনারপুর দক্ষিণ, বারুইপুর পশ্চিম ও বারুইপুর পূর্ব। এর মধ্যে যাদবপুর ও টালিগঞ্জ সম্পূর্ণ শহর এলাকা। ভাঙড় মূলত কৃষিপ্রধান ও গ্রামাঞ্চল হলেও এখানেও শহর ছুটে আসছে দ্রুত। বারুইপুর পূর্ব ছাড়া বাদবাকি বিধানসভা এলাকার অধিকাংশই এখন নগরায়িত ও মফস্বলের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তবে পরিকল্পিত নগরায়ন হয়েছে একথা বলা যাবে না। ফলে সমস্যাও অনেক। আবার বারুইপুর পূর্ব মূলত মফস্বল ও গ্রাম এলাকা এবং তপশিলী জাতি সংরক্ষিত বিধানসভা আসন। সমগ্র যাদবপুর লোকসভা নির্বাচন ক্ষেত্রের জনবিন্যাসে হিন্দু জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মুসলিম জনসংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের ঐতিহ্য রক্ষা করেই চলেছেন এই সমস্ত এলাকার মানুষ। সেই ঐতিহ্য বিনষ্ট করার সূক্ষ্ম প্রয়াস সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক মদতে বাড়ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আগামী দিনে যাদবপুরের মানুষের সৃজন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার কাজ সামনে এসেছে। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই এগোতে হচ্ছে বামফ্রন্ট মনোনীত, জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যকে।

এই লোকসভা এলাকার জনবিন্যাসে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবি, মৎস্যজীবি, ছোটো ব্যবসায়ী, কৃষিজীবি সহ নানা অংশের শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে। যাদের মধ্যে অসংগঠিত শ্রমিক যেমন রিক্সা-টোটো-অটোচালক, নির্মাণ শ্রমিক,বিড়ি মজুররা রয়েছেন। রয়েছেন আই টি কর্মীরা, আবার আছেন পেয়ারা ও  লিচু চাষিরা। এত বিভিন্ন ধরনের পেশার মানুষের সমস্যাও বিভিন্ন। এই সমস্যার কথা মাথায় রেখে বাম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য ভবিষ্যতে যে কাজগুলিকে অগ্রাধিকার দেবার কথা বলেছেন সেগুলি হল বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য জলাধার নির্মাণ, ফল ও সবজি সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় জোর দেওয়া, আই টি কর্মীদের জন্য কাজের নিরাপত্তা বিধান করা এবং বিচিত্র জনবিন্যাসের মানুষের রুটি-রুজি-হকের জন্য এবং বিপুল কর্মহীনতার প্রেক্ষিতে কর্মসংস্থানের দাবিতে সংসদের অভ্যন্তরে লড়াই করা ও সেই দাবিগুলিকে তুলে ধরা। একথা উল্লেখ্য যে, যাদবপুরের উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের যেমন চাকরির প্রয়োজনে অন্য রাজ্যে গিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে অথবা দেশান্তরে যেতে হচ্ছে। একইভাবে ভাঙড়, বারুইপুর  পূর্ব ও পশ্চিম, সোনারপুর উত্তর ও দক্ষিণের  কম লেখাপড়া জানা ছেলেদের পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে অন্য রাজ্য ও দেশান্তরে যেতে হচ্ছে। মেয়েরাও একই পথের পথিক হতে বাধ্য হচ্ছে।  পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে দাবি রাখা হয়েছে, বারুইপুর পর্যন্ত মেট্রো রেলের সম্প্রসারণ, সাদার্ন বাইপাশে যথেষ্ট আলোর ব্যবস্থা ও গণপরিবহন বৃদ্ধি, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি, ক্যানিং ও জয়নগরের দিকে নতুন নতুন বাসরুট চালু, শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং, ডায়মন্ডহারবার ও নামখানার ট্রেন বাড়ানো, রাজপুর জগদ্দলে বামফ্রন্ট আমলের শেষ দিকে শিলান্যাস হওয়া হার্ডওয়ার পার্ক গড়ে তোলা, ভাঙ্গড়ের জলাভূমি রক্ষায় রামসার প্ল্যান বজায় রাখার দাবি ইত্যাদি।

যাদবপুর-টালিগঞ্জের ঝাঁচকচকে আবাসনের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মানুষজন থেকে শুরু করে শিক্ষক-অধ্যাপক-কর্মচারি অংশের মানুষের পছন্দের মানুষ হয়ে উঠেছেন  বাম প্রার্থী সৃজন তাঁর তারুণ্য ও বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্য, রুচি ও শালীনতা বোধের কারণে। আর এই কারণেই তিনি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ইতিমধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রার্থীর পুরস্কার পেয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি আস্থা অর্জন করছেন উদ্বাস্তু এলাকার মানুষ, কলকাতার যাবতীয় নোংরা বহনকারী নোংরা জলের খাল বিধৌত ভাঙ্গড়ের সবজি চাষি ও মৎস্যজীবিদের। আবার বারুইপুরের বিড়ি মজুর, ফলচাষিরাও তাঁর দিকে অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সৃজনকে ঘিরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সেখানে ছাত্র আন্দোলন করেছেন।পরবর্তী সময়ে হয়েছেন রাজ্য এস এফ আই-এর সম্পাদক।বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র মর্যাদা তথা পঠনপাঠনের উৎকর্ষ রক্ষায় তাঁর ভূমিকা কী হবে? একইসঙ্গে রয়েছে বৃহত্তর আঙিনায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিতে ডুবতে বসা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা রক্ষা তথা সাধারণের শিক্ষার অধিকার রক্ষার চ্যালেঞ্জ।

এই এতসব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার মেলবন্ধন ঘটানোর ইচ্ছাশক্তির চাবিকাঠি কী? সৃজন যে দলের প্রার্থী সেই সিপিআই(এম) দলের মতাদর্শ ও দায়বদ্ধতা। যে দায়বদ্ধতার প্রতি যাদবপুর লোকসভা ক্ষেত্রের স্বচ্ছল থেকে অভাবী সব অংশের মানুষের আস্থা ক্রমবর্ধমান বলেই মনে হচ্ছে। কারণ গত পনেরো বছরে তৃণমূল থেকে নির্বাচিত সাংসদদের উদ্যোগহীনতা ও কাজ না করার অভিজ্ঞতা এবং একইসঙ্গে এবারের বামফ্রন্ট মনোনীত ও জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা। এই গ্রহণযোগ্যতা গড়ে উঠেছে ছাত্র আন্দোলনের নেতা হিসেবে তাঁর অকুতোভয় ভূমিকায়, তাঁর হাসিমুখের ও তারুণ্যের দীপ্তিতে। সর্বোপরি রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও দায়বদ্ধতায়। ফলাফল কী হবে তা জানতে ৪ঠা জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। তবে মাঝের কদিন যাদবপুর-টালিগঞ্জের উদ্বাস্তু  কলোনির মানুষ, ভাঙড়ের ভেড়ি শ্রমিক, বারুইপুরের বিড়ি মজুর, সোনারপুরের কলেজ ছাত্র সহ সকল স্তরের নারী-পুরুষের আওয়াজ ক্রমশ জোরালো হবেই হবে—যাদবপুর সৃজন চায়।

Spread the word

Leave a Reply