অবসান চাই অঘোষিত জরুরী অবস্থার – শমীক লাহিড়ী

২৫ জুন ২০২৩ (রবিবার)

দ্বিতীয় পর্ব

আয়কর আইন


এমনকি আয়কর আইনকেও বিরোধী কন্ঠ স্তব্ধ করার কাজে নির্লজ্জভাবে প্রয়োগ করছে মোদী সরকার। এই আইনের ৬৬-এ ধারায় বলা আছে, কেউ যদি আপত্তিকর, ক্ষতিকর, অসত্য সংবাদ পরিবেশন করে বা মানুষকে প্রতারনা করার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে কোনও কাজ করে তাহলে তা বেআইনী এবং এর জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এই আইনের অপব্যবহার করার চুড়ান্ত উদাহারণ, কেরালার আলেনচেরী অঞ্চলের সিপিআই(এম) কর্মী রাজেশ’কে গ্রেপ্তার করা হয় নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে মন্তব্য করায়।

টুকরে টুকরে গ্যাং তত্ত্ব


দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সকল নাগরিকের সমান অধিকারকে অস্বীকার করে মোদী সরকার CAA-NRC সংক্রান্ত বৈষম্য মূলক নাগরিকত্ত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়ন করে। এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠে আসমুদ্র হিমাচল ভারতীয় নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে। এই আন্দোলনকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ এর ‘দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র’ বলে বর্ণনা করেন। দেশজুড়ে ব্যাপক দমনপীড়ন নামিয়ে আনার চেষ্টা করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলি। দিল্লীর জামিয়া-মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ক্লাসরুমে ঢুকে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকমন্ডলী-কর্মচারীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায় বিজেপি নিয়ন্ত্রিত দিল্লী পুলিশ। একইভাবে দিল্লীর শাহিনবাগ সহ দেশের নানা প্রান্তে পুলিশ নামিয়ে ভয়াবহ অত্যাচার চালানো হয় এই আন্দোলন ভাঙতে।

ব্রিটিশ আইনের ব্যবহার


কোভিড পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ আমলে ১৮৯৭ সালে তৈরী ‘মহামারী রোগ প্রতিরোধ আইন’ আনা হয় প্লেগ রোগ ছড়াতে যাতে না পারে, এই অজুহাতে। কিন্তু এই আইন ব্যবহার করা হত মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করার উদ্দেশ্যেই। এই আইনকে কোভিড পরিস্থিতিতে কাজে লাগায় মোদী সরকার সরকার, বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামকে স্তব্ধ করার জন্য। ২০০৫ সালে তৈরী হয়েছিল Disaster Management Act এই ধরণের বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্যই। কিন্তু এই আইনের পরিবর্তে ব্রিটিশদের আইনকেই হাতিয়ার করে মোদীর সরকার উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই, কোডিভ মোকাবিলায় ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে যাতে কোনও আন্দোলন বিরোধীরা করতে না পারে।


FCRA আইন


ইন্দিরা গান্ধী জরুরী অবস্থার সময় বিদেশী আর্থিক সাহায্য গ্রহণ সংক্রান্ত আইন FCRA-1967 প্রণয়ন করেন। এই নিয়ে তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল RSS| মনমোহন সিং-এর দ্বিতীয় দফার মন্ত্রীসভা এই আইনে কিছু সংশোধনী আনে বিদেশী আর্থিক সাহায্য গ্রহণে স্বচ্ছতা আনার জন্য। কিন্তু এই আইনকে আবার সংশোধন করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কার্যত তার সরকারের বিরোধী কেউ যাতে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করেছেন। প্রখ্যাত গবেষণা কেন্দ্রিক ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ‘অক্সফ্যাম’ কয়েক বছর ধরে ভারতবর্ষের করুণ আর্থিক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে মোদী সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট দেখিয়ে দেওয়ার জন্যই এই সংশোধিত আইনকে ব্যবহার করে, তাদের সংস্থার ভারতীয় শাখাকে বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।

কেন্দ্রীয় এজেন্সি’র অপব্যবহার


বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি যেমন – আয়কর দপ্তর, ইডি, সিবিআই ইত্যাদিকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে। যে রাজনৈতিক দল বা বিরোধী নেতা বা সংবাদমাধ্যম মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সামান্যতম সমালোচনা করছে তাদের বিরুদ্ধে এই এজেন্সিগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মোদীর আমলে সরকারী ব্যাঙ্ক থেকে সাড়ে আট লক্ষ কোটি টাকা যারা লুঠ করল তাদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে না মোদীর সরকার, অথচ বিরোধীদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করানো হচ্ছে এই এজেন্সিগুলিকে দিয়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সরকারের কেষ্ট-বিষ্টুদের বিরুদ্ধে সবকটি তদন্তই কিন্তু হচ্ছে আদালতের নির্দেশে। অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রে নিজস্ব উদ্যোগেই দমন পীড়নের জন্যই মূলত এজেন্সিগুলি নিজেরাই সাধারণ ভাবে তদন্ত করছে।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো


১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে শিক্ষাকে রাজ্যের তালিকা থেকে যুগ্ম তালিকায় নিয়ে আসেন শ্রীমতি গান্ধী। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর এই আঘাতের বিরুদ্ধে সবকটি বিরোধী দল ও শিক্ষাবিদরা প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে বিজেপির পূর্বসূরী জনসঙ্ঘ দলও সামিল হয়েছিল। অথচ ২০২০ সালের ৭ই আগষ্ট সম্পূর্ণ একতরফাভাবে নরেন্দ্র মোদী ,জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ ঘোষণা করে দিলেন, রাজ্য সরকার-সংসদ-শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কারুর সাথে কোনও আলোচনা না করেই। ২০১৯ সালের ১লা জুন এই শিক্ষানীতির খসড়া প্রকাশ করেছিল সরকার। অথচ নরেন্দ্র মোদী দাবী করলেন – বিগত ৪ বছর ধরে নাকি তার সরকার এই শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা করেছে এবং তার ভিত্তিতেই এই শিক্ষানীতি তৈরী হয়েছে। এই নির্জলা অসত্য ভাষণের মধ্য দিয়েই সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী কায়দায় দেশের সবকটি রাজ্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল এমন এক শিক্ষানীতি, কার্যত শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে শিক্ষা তুলে দেওয়ার জন্য ও চূড়ান্ত কুসংস্কার যুক্ত বিজ্ঞান ও ইতিহাস বিরুদ্ধ সাম্প্রদায়িক শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য।


জম্মু-কাশ্মীর আইন


মোদী সরকারের চূড়ান্ত স্বৈরাচারী কাজের অন্যতম একটি হলো ‘জম্মু ও কাশ্মীর পুর্নগঠন আইন-২০১৯’। এই আইনের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা ও সাধারণ মানুষের কোনও মতামত না নিয়ে গায়ের জোরে রাজ্যকে দু’ভাগে ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সংসদে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে হয় গৃহবন্দী অথবা জেলবন্দী করে রাখা হয় মাসের পর মাস। সংবাদমাধ্যমের ওপর জারি করা হয় সেন্সরশিপ। জাতীয়তাবাদের আবেগ তুলে, জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের সমস্ত অধিকার কেড়ে কুক্ষিগত করে রেখেছে মোদী সরকার। এই আইন ভয়ংকর বিপজ্জনক এই কারনেই যে, একইভাবে নিজেদের ইচ্ছামত যে কোনও রাজ্যের বিধানসভা ভেঙে দিয়ে রাজ্যকে ২/৩ টুকরো করে দেওয়ার অধিকার কেন্দ্রীয় সরকার নিজের হাতে তুলে নিতে পারে এবং নির্বাচিত রাজ্য সরকারের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারই রাজ্য পরিচালনা করতে পারে।

ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছাড়ানো


দিল্লীর দাঙ্গা সহ সমগ্র দেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে মোদীর সরকার। তার মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলছে – ‘দেশকে গদ্দারোকো, গোলি মারো শালোকো’। ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানেই দেশদ্রোহী, এই কুৎসিত অসত্য প্রচার করে দাঙ্গা লাগানো হচ্ছে দেশের সর্বত্র। ২০২১ সালে ডিসেম্বর মাসে হরিদ্বারে ৩ দিনের ‘ধর্ম সংসদ’ থেকে ঘৃণার ভাষনের মাধ্যমে মুসলমানদের গণহত্যা করার ডাক দেওয়া হয়। গোরক্ষার নামে প্রকাশ্য দিবালোকে অবাধে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে, এমনকি হত্যাও করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ-আসামে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়েই বিজেপি ক্ষমতা দখল করেছে। এইভাবে দিনের আলোয় মানুষ খুন করার ও গণহত্যাকে প্রকাশ্যে মদত দেওয়ার ঘটনা জরুরী অবস্থার সময়ও ছিল না। দেশের প্রধানমন্ত্রী নীরব দর্শক – মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ


মোদীর আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কার্যত জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। Reporters Sans Frontiers এর প্রকাশিত ‘বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক’ অনুযায়ী ভারতবর্ষের বর্তমান স্থান ১৪২ নম্বরে। ২০১৭ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১৩৬ নম্বরে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ দুই শিল্প গোষ্ঠী আদানি এবং আম্বানীর মাধ্যমে দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যমগুলিকে নিয়ন্ত্রন করে ফেলছে বিজেপি। কিভাবে NDTV-র পরিচালক প্রণয় রায়ের বিরুদ্ধে আয়কর দপ্তর, ইডি-সিবিআই ইত্যাদি এজেন্সিকে ব্যবহার করে, তাঁকে এই চ্যানেল আদানিদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করা হলো, তা সবাই দেখেছে। কিভাবে হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার সম্পাদক ববি দাস’কে সরিয়ে দিতে বাধ্য করলো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও তার মন্ত্রীসভার কয়েকজন সদস্য – তাও কারোর অজানা নয়। ‘স্ক্রল’, ‘দ্য ওয়ার’, ‘নিউস ক্লিক’ ইত্যাদি নামকরা ওয়েব পোর্টালগুলির বিরুদ্ধে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহার করে তাদের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছে, তাও দেশের মানুষ দেখেছে।
উত্তরপ্রদেশের উন্যাও’তে সাংবাদিক সুরজ পান্ডে অথবা শোনভদ্রে সাংবাদিক উদয় পাশোয়ানকে নির্মমভাবে খুন করা হয় যোগী সরকারের বিরুদ্ধে খবর করার জন্য। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার রিপোর্ট করার জন্য হিমাচল প্রদেশের তৎকালীন বিজেপির সরকার সাংবাদিক অশ্বিনী সাইনি অথবা ওম শর্মা’র বিরুদ্ধে FIR দায়ের করা হয়। শুধুমাত্র ২০২১ সালের ২৫-৩১শে মার্চ এইসময় ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে FIR দায়ের করে বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার। ২০১৮ সালের ১লা অক্টোবর ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির মুখপত্র ‘ডেইলি দেশের কথা’ পত্রিকাকে বেআইনি ঘোষণা করে সেখানকার বিজেপি সরকার। মোদী সরকারের নীতি হলো – হয় মোদীর স্তুতি গাওয়ার জন্য ‘গোদি মিডিয়া’য় পরিণত হও, নতুবা জেলে যাও।
একইভাবে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম অর্থাৎ ফেসবুক, ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য আইনি-বেআইনি সব ধরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মোদী সরকার। সম্প্রতি ট্যুটারের মালিক এলন মাস্ক বলেছেন – ভারতে মোদী বিরোধী সব মন্তব্য মুছে দেবার জন্য তাদের কাছে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে বহুবার। একইভাবে মুকেশ আম্বানীর ‘জিও’ও ‘ফেসবুক’ মধ্যে গাঁটছড়া বাঁধার মাধ্যমে তাদেরও নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসেছে মোদী সরকার। এইসব সামাজিক মাধ্যমগুলিকে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক ও নির্লজ্জ অসত্য প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
সমগ্র দেশজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে সব প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহী তকমা এঁটে দেওযা হচ্ছে। এইভাবেই এক অঘোষিত এবং আরও ভয়াবহ জরুরী অবস্থা জারি করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা হরণকারী জরুরি অবস্থা জারির যারা করেছিল তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিল দেশের সাধারন মানুষই। আজ এই অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারির নায়ক মোদি’র বিজেপি সরকারকেও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, দেশের মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই শুরু হয়েছে লড়াই।

Spread the word

Leave a Reply