শমীক লাহিড়ী
রাজশেখর বসু’র এক অনবদ্য গল্প ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’। যারা পড়েছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেই কুখ্যাত চরিত্র গন্ডেরিরাম বাটপারিয়াকে। গন্ডেরিরাম শুধু প্রতারকই নয়, অন্যদের তুলনায় সে অনেক বেশি ঝুঁকিও নিতে পারে। এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল এইভাবেই – “দুঃসাহসিক ব্যবসায়ী গন্ডেরিরাম আসরে অবতীর্ণ হওয়া মাত্র নিমেষ মধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা জমকালো হইয়া উঠিল, আকাশে যেন তড়িৎ প্রবাহ খেলিয়া গেল এবং দুই-চার হাজার হইতে আমরা এক লাফে দুই-চার লাখের জগতে উন্নীত হইলাম।“
ধর্ম ব্যবসায়ীদের এমন লোভী চকচকে চোখ আর উল্লাসের বর্ণনা আর কোন গল্পে করা আছে জানিনা।
আজ এই গল্প লিখলে ‘মোদী’ বা ‘আদি’ ওনাকে নিঘঘাত UAPA ধারায় ‘যাবজ্জীবন ফাঁসী’ই দিত।
বাটপারিয়ারা কিন্তু এখনও বহাল তবিয়তেই আছে, শুধু নামগুলো আলাদা।
৩বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে এযুগের গন্ডেরিরাম, গৌতম আদানীর। ঠিক যেভাবে শুধু শেয়ারের ভেলকিবাজিতে গন্ডেরিরাম বাটপারিয়া বিপুল অর্থ কামিয়ে সরে পড়েছিল, তেমনই কাজে সিদ্ধহস্ত আদানী ভাইয়েরা। আর আদানী ভাইদের রকেট গতিতে উত্থান মোদী ভাইয়ের দাক্ষিণ্যেই। এই দুই ‘ভাই’ (নাকি ভাইরাস!) এখন দেশের সম্পদের বিক্রেতা ও ক্রেতা।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ টীমের ১০০রও বেশি পাতার রিপোর্ট, তার উত্তরে আদানী ভাইদের ৪শতাধিক পাতার ধোকলা উত্তর, আবার তার উত্তরে হিন্ডেনবার্গের প্রেস বিবৃতি, যাতে বলা হয়েছে আদানী ভাইদের বিরুদ্ধে ওঠা ৮৮টি প্রশ্নের ৬৬টিরই উত্তর দিতে পারেননি আদানী ভাইয়েরা – এইসব পড়ে যে কারোরই মাথাটা ঘুরে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই ভালো করে বোঝার জন্য পরশুরামের অমর সৃষ্টি এই গল্পটা আর একবার পড়া খুবই জরুরী। ঠিক ১০১ বছর আগে কিভাবে হর্ষদ মেহেতা, আদানী ভাইদের চিনেছিলেন রাজশেখর বসুর মতো এক রসায়নবিদ, এটা বোঝা খুবই দুষ্কর।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ কোম্পানি কারা?
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আমেরিকার নিউইয়র্কের একটি সংস্থা। নাথান এন্ডারসন ২০১৭ সালে এই কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানিটি মূলত শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত গবেষণার কাজ করে। ১৯৩৭ সালের ৬ই মে আমেরিকার নিউজার্সির কাছে একটি জার্মান উড়ো জাহাজ ভেঙে পড়ে। সেই সময় অভিযোগ উঠেছিল এই দুর্ঘটনা আসলে একটি অর্ন্তঘাত। এই অন্তর্ঘাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কোম্পানির নামকরণ করা হয়েছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ।
এই কোম্পানি দাবী করে যে, তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই মূলত কাজ করে। কর্পোরেট কোম্পানি এবং শেয়ার বাজারের মধ্যে যে সব সন্দেহজনক প্রতারণার ঘটনা ঘটে, তাদের উপর নজরদারী চালায় এই কোম্পানি।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই সংস্থা আমেরিকার ‘নিকোলা কর্পোরেশন’ নামে একটি কোম্পানির শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করে প্রতারণার ঘটনা প্রকাশ করে। প্রথমে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠতা ট্রেভর মিলটন অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরবর্তী তদন্তে প্রমানিত হয়, এই প্রতারণার ঘটনা সত্য।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চিকিৎসা সংক্রান্ত কর্মসূচী ‘ক্লোভার হেল্থ’ নিয়ে আর একটি শেয়ার বাজারের প্রতারণার ঘটনা প্রকাশ করে এরা। আমেরিকার শেয়ার বাজারের অত্যন্ত প্রভাবশালী ধনী দালাল চামাথ প্যালিহ্যাপিশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে বিনিয়োগকারীদের ভুল পথে পরিচালিত করেছেন, এই অভিযোগ আনে হিন্ডেনবার্গ। ‘ক্লোভার হেল্থ’ এর পরিচালকমন্ডলী এই অভিযোগ প্রথমে অস্বীকার করলেও, একথা স্বীকার করেছে তারা সে দেশের ‘স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশন’ এর কাছ থেকে এই সংক্রান্ত নোটিশ পেয়েছেন।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ‘অন লাইন বেটিং অপারেটার ড্রাফটকিংস’, ভূ-তাপীয় শক্তি উৎপাদন কোম্পানী (Geothermal Power) ‘অরম্যাট টেকনোলজিস’, বৈদ্যুতিক গাড়ী তৈরীর কোম্পানি ‘মূলেন টেকনোলজিস’সহ বিভিন্ন কোম্পানি শেয়ার বাজারকে অন্যায়ভাবে প্রতারিত করার চেষ্টা করেছে – এই সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এলেন মাস্ক যখন ট্যুইটার কোম্পানি অধিগ্রহণ করছিলেন, তখন বেআইনি ভাবে শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন – এই সংক্রান্ত রিপোর্টও এরা প্রকাশ করেছে।