প্রভাত পট্টনায়েক
সাধারণত উৎপাদনের পদ্ধতি নির্বিশেষে দারিদ্র্যকে একটি সমসত্ত্ব বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরাও দারিদ্র্যের এই সমসত্ত্বীয় ধারণায় বিশ্বাস করেন। তবে একথা সত্যি যে, পুঁজিবাদের অধীনে দারিদ্র্য, আর প্রাক-পুঁজিবাদী সময়ের দারিদ্র্য, এই দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি যদি পরিসংখ্যানগত উদ্দেশ্যেও দারিদ্র্যকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যে উৎপাদনের পদ্ধতি নির্বিশেষে ‘দারিদ্র’ হল জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য কিছু পণ্যের ব্যবহার মূল্য-কে ভোগ করার ক্ষেত্রে বঞ্চনা, তবে একথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই বঞ্চনা, পুঁজিবাদের অধীনস্ত, আগের থেকে আলাদা, অনন্য এক সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই নিহিত। পুঁজিবাদের অধীনে ‘দারিদ্র্য’ এইভাবে নিরাপত্তাহীনতা এবং অসম্মানের সাথে যুক্ত একটি নির্দিষ্ট রূপ নেয় যা এটিকে বিশেষভাবে অসহনীয় করে তোলে।
পুঁজিবাদের অধীনে ‘দারিদ্র্য’-এর মোটামুটি চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমটি ‘চুক্তির অলঙ্ঘনীয়তা’ থেকে উদ্ভূত হয়, যার অর্থ হল দরিদ্রদের বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে, তাদের যা কিছু দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হয় তা দিতে হবে; এটা দরিদ্রদের ব্যক্তিগত সম্পদের ক্ষতি বা নিঃস্বত্বের দিকে পরিচালিত করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাক-পুঁজিবাদী সময়ে, মুঘল-শাসিত ভারতে, ‘রাজস্ব চাহিদা’ ছিল উৎপাদিত পণ্যের অনুপাতে; এর অর্থ হল খারাপ ফসলের বছরগুলিতে, কৃষকদের উপর রাজস্ব দাবি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্রাস পেত; ভিন্নভাবে বললে, খারাপ ফলনের বোঝা উৎপাদক এবং মালিকদের মধ্যে ভাগ হয়ে যেত। কিন্তু ঔপনিবেশিক ভারতে, পুঁজিবাদী নীতি অনুসারে, জমির উপর কর আরোপ করা হয়েছিল; প্রযোজক এবং মালিকের মধ্যে চুক্তি-র পরিবর্তন হল: – প্রযোজককে একটি জমি চাষ করার অনুমতি দেওয়া হবে যদি সে রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করে। এর অর্থ হল একটি কম ফসলের বছরে, খারাপ ফলনের বোঝা ভাগ করা হয় না এবং একচেটিয়াভাবে উৎপাদকের উপরেই সেই বোঝা বর্তায়। অন্য কথায় চুক্তিটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের জন্য ছিল, পরিবর্তনশীল (পণ্যের একটি ভাগ বা অর্থ আকারে এর সমতুল্য) অর্থ প্রদানের জন্য নয়। এর ফলে, কৃষকদের নিঃস্বতা বৃদ্ধি পায়, অর্থাত্, কৃষকদের সম্পদ সুদখোর মহাজনদের কাছে হস্তান্তর হয়। সংক্ষেপে দারিদ্র্য, ‘বঞ্চনা’র সাথে সংপৃক্ত ছিল যার ফলে উৎপাদকদের উপর এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব পড়ে। ভিন্নভাবে বললে, উৎপাদকদের জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য কিছু পণ্যের ‘ব্যবহার মূল্য’-কে ভোগ করার ক্ষেত্রে বঞ্চনা, তাদের সঞ্চিত সম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার একটি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত, যার অর্থ সময়ের সাথে সাথে তাদের ‘দারিদ্র’ বৃদ্ধি পায়।
এইভাবে দারিদ্র্যের মধ্যেও একটি ক্রমবর্ধমান অবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দারিদ্র্যের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল এটি ব্যক্তি দ্বারা অনুভূত হয়, তা সে ব্যক্তি একজন লোকও হতে পারে বা একটি পরিবারও হতে পারে। প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে যেখানে লোকেরা একটি সম্প্রদায় হিসাবে বসবাস করত, অন্যান্য সম্প্রদায়ের সদস্যরা (একই বর্ণ গোষ্ঠীর অন্তর্গত বা কেবল একই গ্রামের) খারাপ ফসল বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিশেষ বছরগুলিতে দরিদ্রদের সাহায্য করতে আসতো। অন্য কথায়, তখন দরিদ্ররা ‘বিচ্ছিন্নতা’য় ভোগেনি। তবে, পুঁজিবাদের অধীনে, সিস্টেমের অযৌক্তিক যুক্তির কারণে যখন সম্প্রদায়গুলি ভেঙে ‘ব্যক্তি বা পরিবারে’ পর্যবাসিত হয়, এবং ব্যক্তি প্রাথমিক অর্থনৈতিক ইউনিট হিসাবে আবির্ভূত হয়, তখন এই ব্যক্তিটিও বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়।
অর্থনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে অ-মার্কসবাদী ঐতিহ্যের অনুসরণকারিরা এই মৌলিক পরিবর্তন দেখতে ব্যর্থ হয় কারণ তারা ইতিহাস সম্পর্কিত কোনো বোধ থেকে বঞ্চিত। মার্কস, ইতিহাসের প্রতি এই অন্ধত্বের জন্য ধ্রুপদী অর্থনীতিকে অভিযুক্ত করেছিলেন এই বলে: – ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে ‘ব্যক্তি’ আবির্ভূত হয়েছিল তাকে ঐ ধ্রুপদী অর্থনীতির লোকেরা ‘সর্বদাই বিদ্যমান ছিল’ বলে ধরে নিয়েছিলেন। নব্য-শাস্ত্রীয় অর্থনীতির সূচনাতে (যা ১৮৭০ সালের দিকে শুরু হয়েছিল) কার্ল মেঙ্গার এবং স্ট্যানলি জেভনসের মত অর্থনীতিবিদেরা ব্যক্তিকেই মহিমাণ্বিত করেছিলেন, ব্যক্তিকে একটি চিরন্তন শ্রেণী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য ব্যক্তিকেই মূল বলে মেনে নিয়েছিলেন। উভয়ের মতবাদই তাই পুঁজিবাদী দারিদ্র্য এবং প্রাক-পুঁজিবাদী দারিদ্র্যের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য বর্তমান তাকে অবজ্ঞা করেছে। প্রথম ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি হিসাবে বঞ্চনার সন্মুখীন হয়, এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বঞ্চনার ভাগ হয়।
এই সত্য যে পুঁজিবাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি (যতক্ষণ না তারা ‘সংমিশ্রণ’ বা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে যেটা তাদের সিস্টেমের বিরুদ্ধে সাধারণ সংগ্রামে একত্রিত করে) এবং এই ব্যক্তিরাই দারিদ্র্য অনুভব করে, দারিদ্রকে একটি অতিরিক্ত মাত্রা দেয়; পুঁজিবাদী দারিদ্র্য কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে বঞ্চনা নয় বরং এই বঞ্চনার সাথে একটি মানসিক আঘাতও রয়েছে।
পুঁজিবাদী দারিদ্র্যের তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। এটি দুটি কারণে উদ্ভূত হয়: একটি হল কর্মরত ব্যক্তিদের কম মজুরি, এবং অন্যটি হল কর্মসংস্থানের অনুপস্থিতি। পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী ফল হলো ‘শ্রমের সংরক্ষিত বাহিনী’ (Reserve army of labour) তৈরী হওয়া, যারা বিশেষ করে দারিদ্র্য দ্বারা পীড়িত হয়। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের মতো অর্থনীতিতে যেখানে ‘কর্মসংস্থান’ এবং ‘বেকার’ দুটি পৃথক বিভাগ নয়, তবে বেশিরভাগ শ্রমিকরা (একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সংখ্যা ব্যতীত) সপ্তাহে কয়েক দিন বা দিনে কয়েক ঘন্টা বেকার থাকে, এই কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে অক্ষমতা থেকে আরো ব্যাপক হয় দারিদ্র্যের সাথে সম্পর্কিত মানসিক আঘাত। কর্মসংস্থানের অভাব ব্যক্তির পক্ষ থেকে ‘ব্যক্তিগত ব্যর্থতা’ হিসাবে দেখা হয়, এটা এক ব্যক্তির আত্মমর্যাদাকে হ্রাস করে। এটাই বঞ্চনার থেকে উদ্ভূত মানসিক আঘাত।
পুঁজিবাদী দারিদ্র্যের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হল এই ব্যবস্থার ক্ষতিকর দিকগুলি, ক্ষতিগ্রস্তদের থেকে আড়াল করে রাখা। প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে একজন দরিদ্রের কাছে এটা স্পষ্ট যে তার উৎপন্ন ফসলের ভাগ আরেকজনকে দিতে হচ্ছে বলেই সে দরিদ্র। প্রকৃতপক্ষে, এটি প্রত্যেকের কাছে দৃশ্যমান। একটি কম ফসলী মরশুম তাদের উৎপাদনকে কমিয়ে দিতে পারে এবং তারা আরও দরিদ্র হয়ে পড়ে (যদিও তখন তাদের কম ভাগ দিতে হয়)। একইভাবে, একজন প্রবল পরাক্রান্ত শাসক উৎপাদকদের কাছ থেকে এত বেশি ছিনিয়ে নিতে পারে যে তাদের অনেককে সাধারণ ফসলের বছরেও দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু পুঁজিবাদী পরিস্থিতিতে কেন একজন ব্যক্তি বেকার থাকে এবং সেইজন্য দরিদ্র থাকে তা সেই ব্যক্তির নিজের কাছেই রহস্য থেকে যায়। একইভাবে, কেন হঠাৎ করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, যেটা আরও বেশি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়, তা দুর্দশাগ্রস্তদের কাছে রহস্যই থেকে যায়।
১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ (অশনি সঙ্কেত) নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের চলচিত্রে আমরা দেখি, দুর্ভিক্ষের সময়, জাপানী সৈন্যরা সিঙ্গাপুর দখল করলে বাংলায় চালের দাম বেড়ে যায়। ইউক্রেনের যুদ্ধ আজ অবশ্যই বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখে যা প্রত্যন্ত আফ্রিকান বা ভারতীয় গ্রামেও দারিদ্র্যকে বাড়িয়ে তোলে। পুঁজিবাদী দারিদ্র্যের মূল কারণের এই আপাত অস্বচ্ছতা পুঁজিবাদের অধীনে বিশ্বব্যাপী আন্তঃসংযোগের ঘটনার সাথে যুক্ত; অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন, দূরবর্তী অঞ্চলের উন্নয়ন, প্রতিটি গ্রামের (তা যতই দূরবর্তী হোক না কেন) উপর প্রভাব ফেলে।
পুঁজিবাদী দারিদ্র্যের এই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে, যার মধ্যে আমি শুধুমাত্র একটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব। অনেক সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যক্তি, যারা দারিদ্র্য হ্রাস বা দূর করতে চান, পরামর্শ দেন যে সরকারী বাজেট থেকে কিছু অর্থের বরাদ্দ করা উচিত যাতে সমাজের প্রত্যেকের একটি মৌলিক ন্যূনতম আয় থাকে। এটি অবশ্যই প্রয়োজনীয় স্কেলে কোথাও ঘটেনি, তাই দারিদ্র্য একটি সামাজিক ঘটনা হিসাবে অব্যাহত রয়েছে এবং এমনকি নয়া-উদারবাদী পুঁজিবাদের কারণে সৃষ্ট মন্দার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্যের মূল্যস্ফীতির কারণেও এটি উচ্চারিত হচ্ছে; যদিও এই অর্থ বরাদ্দের জন্য পরামর্শগুলিও কিছুমাত্র সামান্য পরিমাণের জন্যই। কিন্তু এই সমস্ত কিছু ঐ বঞ্চনাসৃষ্ট দারিদ্র্য এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সৃষ্ট মনস্তাত্বিক আঘাত বোঝায় না, অর্থাৎ পুঁজিবাদী দারিদ্রকে বিশেষভাবে উল্লেখ করে না। এমনকি যদি পর্যাপ্ত অর্থও বরাদ্দ করা যায় এবং ব্যবহার-মূল্যের অ্যাক্সেসের অভাবের অর্থে দারিদ্র্যকে কাটিয়ে উঠতে পারে, তবে সেটা এখনও পুঁজিবাদী দারিদ্র্যকে কাটিয়ে উঠতে পারে না, যেটা কিনা একটি মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা, এবং বেকারত্বের মাধ্যমে আত্মমর্যাদাকে লুণ্ঠন করে।
প্রকৃত অর্থে পুঁজিবাদী দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে সর্বজনীন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা প্রয়োজন। কেইনস ভেবেছিলেন পুঁজিবাদের অধীনে এটি করা যেতে পারে, কিন্তু সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে অর্থ বরাদ্দ করা উচিত নয়; কিন্তু সেই ব্যবস্থা কেবলমাত্র অপর্যাপ্তই নয়, সাময়িক মাত্র এবং সমস্যার মূলে কুঠারাঘাতের জন্য যথেষ্ট নয়।
ভারতে একইভাবে, বর্তমানে প্রায় ৮০ কোটি উপকারভোগীকে প্রতি মাসে মাথাপিছু পাঁচ কিলোগ্রাম বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হচ্ছে। এর কতটা তাদের কাছে পৌঁছায়? এবং কতদিন এই স্কিমটি চলবে? (এটি মহামারীর কারণে শুরু হয়েছিল) মূল পয়েন্ট। কিন্তু যদি কেউ বিশ্বাস করে যে সমসাময়িক ভারতে দারিদ্র-দূরীকরণের জন্য এই ধরনের স্কিমগুলিই একমাত্র ব্যবস্থা, সেটা দুঃখজনকভাবে ভুল হবে। যেটা প্রয়োজন তা হল কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বার্ধক্যের নিরাপত্তা এবং খাদ্যের সার্বজনীন ব্যবস্থা, যা জনগণকে গণতান্ত্রিক সমাজের নাগরিক হওয়ার মর্যাদা ফিরিয়ে দেবে; কিন্তু এর জন্য নয়া-উদারবাদী পুঁজিবাদের ধারণার থেকে বেরিয়ে গিয়েই করতে হবে।
৩০শে জুন ২০২৪তারিখে পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকায় প্রকাশিত
ভাষান্তরঃ অঞ্জন মুখোপাধ্যায়