The Nature of Investment Capital and the Organization of Corporate Production are Changing

সাত্যকি রায়

নেট ওয়ার্থ অনুযায়ী পৃথিবীর দশটা সবচেয়ে ধনী সংস্থার মধ্যে সাতটি সংস্থার নাম হল অ্যাপল, অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, টেনসেন্ট এবং আলিবাবা। খেয়াল করলে দেখা যাবে এই সংস্থাগুলির কোনটাই উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। শুধু তাই নয় উৎপাদনের প্রথাগত উপকরণ গুলির উপরে তাদের কোন মালিকানা নেই। পুঁজিবাদের সবচেয়ে আধুনিক চেহারা হল উৎপাদনে অংশগ্রহণ না করে মুনাফার পাহাড় তৈরি করার সম্ভাবনাকে ব্যবহার করা। পুঁজিবাদের ইতিহাসে আমরা পুঁজি সংগ্রহের ও কেন্দ্রীভবনের কতগুলো পর্যায় দেখতে পাব। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে এগুলি এক একটি ‘রেজিম অফ একুমুলেশন’ এর সঙ্গে যুক্ত।এই প্রতিটি পর্যায়ের সাথে কর্পোরেট সংগঠনেরও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে থাকে। দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় যাকে পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয় সেই সময়ের পুঁজির প্রধান রূপটি ছিল বৃহৎ শিল্পে কেন্দ্রীভূত পুঁজি। জেনারেল মোটরস, ফোর্ড এরা হচ্ছে সেই সময় পুঁজিবাদের উৎপাদন সংগঠনের আইকন। সাধারণভাবে একে স্টেক-হোল্ডার ক্যাপিটালিজম বলে অভিহিত করা হয়। এই সময় আর্থিক বৃদ্ধির গতি মূলত বড় কারখানা তৈরি হওয়ার উপরে নির্ভর করতো। মূলত পুঁজির মালিক, ম্যানেজার ও শ্রমিকদের স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষা করাই এই পর্যায়ের পুঁজিবাদের গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক বৃদ্ধিই অগ্রগতির লক্ষণ হিসেবে ধরা হত।

এর পরবর্তী পর্যায়ে পুঁজিবাদের চেহারাটা বদলে গেল। যা এলো তাকে এক কথায় বলা চলে শেয়ার-হোল্ডার ক্যাপিটালিজম। দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের চাইতে, শেয়ার হোল্ডারদের আশু লাভ গুরুত্ব পেতে শুরু করল। পুঁজিবাদের এই পর্যায়তেই লগ্নিপুজির আধিপত্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। পৃথিবীব্যাপী পুঁজির সচলতা স্বল্পমেয়াদি মুনাফার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিনিয়োগে নিযুক্ত হতে শুরু করল। সাথে সাথে উৎপাদন সংগঠনেরও বড় পরিবর্তন ঘটে গেল। বৃহদাকার কারখানার পরিবর্তে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিভিন্ন উৎপাদনের বিভিন্ন অংশ নানা জায়গায় সংগঠিত করা কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রধান উৎপাদন সংগঠন হিসেবে উপস্থিত হল। এই সময় পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বিশ্বায়ন এবং বিশেষত তথ্য প্রযুক্তির বিপুল অগ্রগতি উৎপাদনকে পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত করার সুযোগ তৈরি করল। বহুজাতিক সংস্থাগুলি গবেষণা ও প্রযুক্তির মূল কেন্দ্র গুলি উন্নত দেশে সীমিত রাখলেও উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়গুলি বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত করতে শুরু করল। অর্থাৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি ব্যাপকভাবে আউটসোর্সিং ও অফশোরিং এর উপরে নির্ভর করতে শুরু করল। একদিকে যেমন এই প্রবনতা পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলিতে শিল্প উৎপাদন বিস্তৃত করায় কিছুটা সাহায্য করল, আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পুঁজি এর মধ্যে দিয়ে সহজলভ্য শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে কম খরচে উৎপাদন করার সুযোগও গ্রহণ করতে পারল। বৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্র গুলি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায় অনুসারী ক্ষুদ্র সংস্থায় স্থানান্তরিত করে দিয়ে উৎপাদন খরচ কমাবার চেষ্টা করল। একদিকে যেমন এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে তারা বিশ্বব্যাপী শ্রমের মজুদ বাহিনীকে ব্যবহার করার সুযোগ পেল, আবার অন্যদিকে ট্রান্সফার প্রাইসিং ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশীয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিধি নিষেধকে উপেক্ষা করার সুযোগ পেল। বহুজাতিক সংস্থাগুলির উপর বিভিন্ন দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ এর ফলে কমতে থাকলো। নেটওয়ার্ক ক্যাপিটালিজম এর যুগে বরং জাতিরাষ্ট্র গুলির অর্থনৈতিক নীতি মূলত আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হতে লাগল।

সাম্প্রতিককালে লগ্নি পুঁজির রূপ ও কর্পোরেট সংগঠন আরও গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। শুধু মাত্র নেটওয়ার্ক এর উপরে নির্ভরশীলই নয় ক্রমাগত প্ল্যাটফর্ম নির্ভর বৃহৎ পুঁজির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই ধরনের কোম্পানিগুলি কোন জিনিস উৎপাদন করে না বরং এরা উৎপাদিত জিনিস বিক্রি করার বাজার তৈরি করে। এদের প্রধান কাজ হল ক্রেতা এবং বিক্রেতাকে এক জায়গায় নিয়ে আসা। অ্যামাজন ক্রেতা এবং বিক্রেতাকে এক জায়গায় নিয়ে আসে, ফেসবুক দুই বন্ধুর মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে, উবার প্যাসেন্জার ও চালকের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে অথবা নেটফ্লিক্স ক্রিয়েটিভ কন্টেন্ট প্রডিউসার ও দর্শকের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে। এই ধরনের সংস্থাগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা কম খরচে জিনিস উৎপাদন করার মধ্যে দিয়ে হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন কোন থেকে কে সবথেকে কম পয়সায় জিনিস ও পরিষেবা জোগাড় করতে পারবে সেটাই মুনাফার প্রধান উৎস। এই উৎপাদকের সন্ধান ও সম্ভাবনা খুঁজে বার করাটাই প্রধান কাজ। আবার ক্রেতা ও বিক্রেতার আদান-প্রদান বিপুল পরিমাণ তথ্যসম্ভার তৈরি করে থাকে,তার উপর মালিকানা স্থাপন করাই এই সংস্থাগুলির প্রধান লক্ষ্য। সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ তথ্য প্রসেস করে উপযুক্ত অ্যালগরিদম এর সাহায্যে ক্রেতার পছন্দের হদিস পাওয়াটাই প্রধান লক্ষ্য।এই পছন্দের প্রকৃতি উৎপাদকের কাছে পৌঁছে দেওয়া ছাড়াও এর মধ্যে দিয়ে তারা মানুষের ভবিষ্যৎ পছন্দকেও প্রভাবিত করতে শুরু করে। অর্থাৎ আজকের পুঁজিবাদ শুধু জিনিস বিক্রি করেই ক্ষান্ত থাকে না। আমার আপনার ভবিষ্যৎ পছন্দকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।

এটা খেয়াল করলে দেখা যাবে যে অতীতেও একচেটিয়া পুঁজি কাঁচামাল ও বাজারের উপরে কর্তৃত্ব বজায় রাখত।কিন্তু আজকের দিনে এই কর্তৃত্বের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতে প্রথাগত রসদ যেমন জমি, বিদ্যুৎ, জল, কয়লা ইত্যাদির উপর একচেটিয়া পুঁজি কর্তৃত্ব স্থাপন করত অথবা বাজারে অন্য কোন প্রতিযোগীকে ঢুকতেই দিত না। এর মধ্যে দিয়েই তারা অন্য ছোট উৎপাদককে পরাস্ত করত। আজকে এই ক্ষমতার পার্থক্য এক অস্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছেছে। কোন ক্রেতা বা বিক্রেতা এককভাবে এই ধরনের প্লাটফর্ম ভিত্তিক বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে কার্যত কিছুই করতে পারে না। সে অর্থে তারা সম্পূর্ণ নিঃস্ব ও ক্ষমতাহীন। এ কারণেই দেখা যাবে যে অন্য উৎপাদন ক্ষেত্রে কিছু প্রতিযোগিতা থাকলেও ডিজিটাল প্লাটফর্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় চোদ্দটি বড় মোটর গাড়ি নির্মাণ সংস্থা রয়েছে, ছটি বৃহৎ অয়েল কোম্পানী রয়েছে, বেশ কিছু ইস্পাত উৎপাদক রয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল প্লাটফর্মএর বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি বা দুইটির বেশি সংস্থা পাওয়া যায় না।

এর সাথে সাথে এটাও লক্ষণীয় যে লগ্নি পুঁজিরও লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটছে। স্বল্পমেয়াদি লাভের পরিবর্তে লগ্নি পুঁজি এই ধরনের প্ল্যাটফর্ম নির্ভর কোম্পানিগুলির মধ্যে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছে। একথা অবশ্যই বলার চেষ্টা করা হচ্ছে না যে পৃথিবীর সমস্ত লগ্নিপুজী এই একই দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্ত মার্কস পুঁজিবাদের বিভিন্ন পর্যায়ে রেগুলেটিং ক্যাপিটলের একটি ধারণা উপস্থিত করেছিলেন। রেগুলেটিং ক্যাপিটাল অর্থাৎ নেতৃত্বদানকারী পুঁজি। প্ল্যাটফর্ম নির্ভর বহুজাতিক পুঁজিই সম্ভবত আজকের সময়ে রেগুলেটিং ক্যাপিটাল হিসেবে উঠে আসছে। পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ লগ্নিপুঁজির যোগান তৈরি হয়েছে তাদের বড় অংশ এখন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে প্রস্তুত এবং এদের মূল লক্ষ্য হলো প্রথমদিকে বিপুল ক্ষতি স্বীকার করার ক্ষমতা রাখা এবং আগামী দিনে বাজারের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ দীর্ঘ সময়ের বিচারে কোন একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কোন প্রতিযোগিতাই অবশিষ্ট না রাখা। অর্থাৎ মুক্ত প্রতিযোগিতার কথা বলে পুঁজিবাদ আসলে নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীভবনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই বিশ্বব্যাপী ক্রিয়াশীল বহুজাতিক কোম্পানিগুলি শুধুমাত্র এই সমস্ত সংস্থায় কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে তাই নয় পৃথিবীব্যাপী ক্রেতা এবং বিক্রেতারা নানা ভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হয়ে চলেছে এই বিশ্ববিস্তৃত লগ্নি পুঁজির যাঁতাকলে। আগামী ভবিষ্যতে মানব সভ্যতার সবরকম পছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যত বহুজাতিক পুঁজির এই অমানবিক সর্বব্যাপক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সংগ্রামের বাস্তব ভিত্তিও একই সাথে তৈরি হয়ে চলেছে। শ্রমিক, কৃষক, চাকুরীজীবি মধ্যবিত্ত, ছোটো ব্যবসায়ী, পেশাজীবি এই বৃহত্তর শ্রমজীবি জনগণ বৃহৎ পুঁজির আধিপত্যের সম অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ক্রমাগত এক জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে এবং আরও বৃহত্তর শ্রমজীবী ঐক্য তৈরির বাস্তব ভিত্তি রচনা করছে।

Spread the word

Leave a Reply