WB SSC Scam

The Inertia Of Suspension: A Report

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

মোট কত টাকা উদ্ধার হয়েছে? আগামিদিনে এই তথ্য যেকোনো জনপ্রিয় ক্যুইজ শো’র প্রশ্ন হবে।

এত টাকা এলো কোথা থেকে? এটাই আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রধান ইস্যু।

শাসকের ধামাধরা মিডিয়াকূল, বিবিধ সুবিধা আদায় করে ফুর্তিতে মোচ্ছবে অংশগ্রহণকারী সুশীলবৃন্দেরা অনবরত আমাদের বোঝাতে চাইছেন, চাইবেন- প্রথম প্রশ্নটাই প্রধান। আমাদেরই বারে বারে বলতে হবে হিম্মত থাকলে দ্বিতীয় প্রশ্নের সঠিক জবাব দিক তৃণমূল সরকার, জবাব দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

খাতায় কলমে একটা দক্ষিনপন্থী-জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল। নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে যাদের একটিও কর্মসূচী নেই। এমন একটা দল যে দুর্নীতির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে একথা স্কুলের শেষ অথবা কলেজের শুরুর দিকেই সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি কিংবা রাজনৈতিক ইতিহাসের পাঠ্যবইতে লেখা থাকে। সেই কারনেই কি আমাদের রাজ্যে শেষ কয়েক বছর ধরে স্কুলে, কলেজে শিক্ষকতার কাজে শুন্যপদে নিয়োগ নেই? পলিটিক্যাল অ্যান্ড ফিলজলিফিক্যাল (অবশ্য আদৌ তেমন কিছু যদি তৃণমূল কংগ্রেসের মাথায় থাকে) পপ্যুলিজম সবশেষে জনসাধারণের জন্য অভিশাপ ডেকে আনে এই সারকথাটুকু যাতে আগামী প্রজন্ম শিখতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যেই পার্থ চ্যাটার্জিরা শিক্ষক নির্বাচনের পরীক্ষায় ‘সাদা’ খাতা জমা দেনেওয়ালাদের ‘নীল’ চিহ্নে পাশ করিয়েছেন?

জবাব চাই ঠিক এই প্রশ্নেই। কলকাতায় গান্ধীমূর্তির সামনে পাঁচশো দিন ধরে মাথার উপরে রোদ, ঝড়-জল এবং পিথের উপরে পুলিশের নির্যাতন সহ্য করেও ধর্নারত যোগ্য চাকরি প্রার্থীরাই যথেষ্ট প্রমান- এই রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে বেনজির দুর্নীতি হয়েছে। সিবিআই, ইডি এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সেই দুর্নীতির মাত্রাটুকু খুঁজে দেওয়ার কাজ করছে।

তৃণমূল কংগ্রেস সরকার পার্থ চ্যাটার্জিকে মন্ত্রীর পদ থেকে রিলিফ দিয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকালের দিকে নবান্ন থেকে রিলিজ হওয়া সরকারী বয়ানে তাই লেখা রয়েছে। আরও কিছু সময় পরে দলীয় সদস্যপদ থেকেও তাকে সাসপেন্ড করার ঘোষণা হয়েছে। অত্যন্ত হাস্যকর অবস্থান, পার্থ নিজেই তৃণমূল কংগ্রেসের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, দলের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। পার্থ নিজে চুরির টাকা রাখার দোষ এখনও স্বীকার করেন নি, যদিও ইডি’র হলফনামায় (অ্যারেস্ট মেমো) রয়েছে গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে মোবাইলে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছেন।

তৃণমূল কংগ্রেসে সাসপেন্ড হওয়াটা কোন ব্যাপারই না, ইদানিং সেই দলেরই মুখপাত্র কুনাল সারদা চিটফান্ড মামলায় হাজতবাস করেছেন, তিনিও সাসপেন্ডেড ছিলেন! ৫০ হাজার কোটি টাকার চিটফান্ড কেলেঙ্কারির ঘটনায় তখন সারদা মিডিয়ার সিইও এবং তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর বলেছিলেন, ‘চিটফান্ডের দয়ায় যারা ক্ষমতায় আছেন, মুখ্যমন্ত্রী, আটজন এমপি এবং ছয়জন মিনিস্টার, এরা সরাসরি দোষী, তারা ওখানে কী আলোচনা করবে…’ বুঝে নিতে কষ্ট হয়না কেন এইমস বলছে পার্থ’র কোনও গুরুতর শারীরিক সমস্যা নেই।

সারদা চিটফান্ড মামলার নিস্পত্তি হয় নি, এখনও অবধি সেই মামলায় তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক সাংসদের জেল হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে তারা স্বছন্দে দলীয় মর্যাদায় ফেরত এসেছেন। কিছুদিন আগেই স্বনামধন্য শিক্ষামন্ত্রী পরেশ অধিকারী সিবিআই’র জিজ্ঞাসাবাদ সেরে নিজের এলাকায় ফিরেই বলেছিলেন ‘দল পাশে আছে’। আমরাও তাই বলছি, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় উন্নিত করে ফেলা তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের দাগী নেতা-মন্ত্রীদের পাশেই আছে। আপাতত কাজের চাপ কমাতে পার্থ’কে রিলিফ দেওয়া হয়েছে। আসলে এই সরকারকেই ‘রিলিজ অর্ডার’ ধরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, নারদ ঘুষ মামলা, অবৈধ কয়লা পাচার, গরু পাচার, স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ- চুরি বলুন, জোচ্চুরি বলুন আর ভালো কথায় দুর্নীতি বলুন এমন একটা মামলাও নেই যার নিস্পত্তি হয়েছে। প্রতিবার এইসব মামলার অগ্রগতি মুখ্যমন্ত্রীর আচমকা রাজধানী সফরের খরচের জন্য দায়ী থেকেছে। তবু কেউ কেউ পণ্ডিতি দেখিয়ে বলতে চেষ্টা করেন- অন্তত বিজেপি’কে আটকানো গেছে! মানুষের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হিম্মত লাগে, পায়ের পাতায় সাপের কামড়ে মৃত ব্যক্তির শবদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ‘যাক! তবু চোখ দুটো অক্ষত রয়েছে’ বলাটা অসামান্য ‘সেন্স অফ হিউমর’ হতেই পারে, কার্যকরী রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় নয়। তাই রাজপথে হাজার কন্ঠে দাবী উঠেছে ‘চোর ধরো, জেল ভরো’, মমতা সরকারের পুলিশ নিজেদের কানে সেই আওয়াজ শুনেছে। ঐ স্লোগানের দাপটই সাসপেন্ড করতে বাধ্য করেছে। কয়েক ঘণ্টা আগেও তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে সরকারী বয়ান ছিল প্রথমে ‘ষড়যন্ত্র’ এবং পরে ‘দোষী প্রমান হলে দল পাশে থাকবে না, নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হবে’।

পার্থ’কে পাশে রেখেই ‘দায়’ এবং ‘দায়িত্ব’ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একদিকে ভাবমূর্তি (যদি এখনও কিছু থেকে যায় তবেই) সামলানোর কৌশল যাকে মিডিয়া কিছুদিনের মধ্যেই সততার প্রতীক বলে ‘এনডোর্স’ করতে শুরু করবে, আরেকদিকে কয়লা সহ অন্যান্য পাচার কাণ্ডের তদন্তে গোয়েন্দা সংস্থার কাজে উপযুক্ত সহায়তা দিতে ‘কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস’ হবে। আমরা প্রথমেই বলেছিলাম বারে বারে কান টেনে জনসাধারণের মাথা ব্যথা বাড়িয়ে লাভ নেই, মাথাকেই জবাব দিতে হবে- এসব কাদের টাকা? হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা ঝুলে আছে তৃণমূল কংগ্রেসের মাথার উপরে, সেইসব ভুলিয়ে দিতে চাইলেই মানুষ ভুলবেন না।

আমাদের বক্তব্য সহজ, নিয়োগের নামে লক্ষ লক্ষ টাকায় যাদের চাকরি বিক্রি করা হয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে, যারা সেই বিকিকিনির হাট সাজিয়েছিলেন তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকাতে হবে। ফোঁড়া কেটে বাদ দেওয়ার অজুহাতে ক্যান্সারের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না।

মুখ্যমন্ত্রী নিজের পাড়ায়, বাড়ির চারদিকে ইডি’র আধিকারিকদের চলাফেরার গল্প শোনাচ্ছেন- যাদের নাম পাশের তালিকায় রয়েছে তারা কবে নিয়োগপত্র হাতে পাবেন? রাজ্যে হাজারের উপরে স্কুলে শিক্ষক নেই, অনেক স্কুল বন্ধ হয়েছে, আরও অনেক বন্ধ হওয়ার মুখে। কবে আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েরা নিশ্চিন্তে স্কুলে যাবে যেদিন তাদের পড়াবেন এমনসব শিক্ষক-শিক্ষিকারা যারা পরীক্ষায় ফাঁকা খাতা জমা দেন নি? কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নয়া শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাকেই তুলে দিতে চাইছে, আমাদের রাজ্যে কি মমতা সরকার সেই কর্তব্য সাধনেই নিয়োগ বন্ধ রেখেছে?

তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের হাতে একটা প্রশ্নেরও উত্তর নেই।

কেন?

এখন যিনি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী, সেই ব্রাত্য বসু কিছুদিন আগেই পুরসভা নির্বাচনের প্রচারে প্রকাশ্যে মাইক ধরে বলে এসেছেন ‘স্কুলে পড়ানোর চাকরি শুধু তৃণমূলের লোকজনই পাবে’। তৃণমূল সমর্থকেরা বিদ্রোহে ফেটে পড়তে পারেন। কারণ ব্রাত্যর কথার অর্থ হবে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি (অর্পিতার নাম উল্লেখে বিশেষ সুবিধা নেই, উনি এই খেলায় বোড়ে মাত্র) তৃণমূল কর্মীদের চাকরি দিতে গিয়েও এত টাকা তুলেছেন? রাজ্যের সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের কি হবে?

আগামী কয়েকদিন মিডিয়া রাজ্যের মানুষকে অর্পিতা মুখার্জির গয়নাগাটির বিজ্ঞাপন দেখিয়ে যাবে। ঐ বিপুল টাকা কত পরিবারের গয়না বেচে চাকরি পাওয়ার আশায় জমা করা হয়েছে সেই হিসাব চেপে যাওয়ার চেষ্টা হবে। এরই বিরুদ্ধে আমাদের সজাগ থাকার লড়াই, চোরেদের এক মুহূর্ত ঘুমোতে না দেওয়ার লড়াই।

যারা চাকরি পেতে টাকা দিয়েছেন, মেনে নিতে অসুবিধা নেই তাদের এক বিরাট অংশই পরিস্থিতির চাপে পড়ে এমন অন্যায় কাজ করেছেন। আদালতের রায়ে তারা কর্মচ্যুত হবেনই, আজ অথবা কাল। নিজেদের আত্মসম্মানটুকু বজায় রেখে তারাও এই লড়াইতে এগিয়ে আসুন। মুখ্যমন্ত্রী যতই চুপ থাকুন- আপনি, আপনারা প্রত্যেকে যারা চাকরি পেতে ঘুষ দিয়েছেন, দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা সোচ্চার হন। ন্যায়বিচার পেতে জনতার সংগ্রামে সামিল হন, মানুষ অন্তত এটুকু নিশ্চিত বুঝবেন ক্ষণিকের মোহে অন্যায় করলেও আপনারা সবাই চোর নন, আপনারা সকলেই তৃণমূল কংগ্রেস নন। যোগ্য প্রার্থীরা সকলে কাজ ফিরে পেলে আপনাদের গ্লানিও মুছে যেতে বেশি দেরি হবে না।

মুখ্যমন্ত্রী কি বলবেন? ধীরে ধীরে চাপ রিলিজ হওয়ার অপেক্ষা করছেন, সকলেই বুঝছে। জেনে রাখুন, সেই চাপ ক্রমশ বাড়াতে আমরা সক্রিয় আছি, থাকবো। মানুষের দরবারে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা করার কি জবাব দেবেন?

ইডি, সিবিআই বিজেপি’র হাতে থাকা গোয়েন্দা সংস্থা?

উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি টাকা আসলে ষড়যন্ত্র?

বাংলার মানুষ বিজেপি’কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। বিধানসভায় ওদের ৭০টি আসনের কোনজন কখন বিজেপি, কখন তৃণমূল তারা নিজেরাও জানে না।  

তাই ওসবে আর কাজ দেবে না। আদালতের রায় আছে, চুরি খুঁজে বের করার কাজও এখনও অনেকটা বাকি আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে প্রতিদিন নতুন বন্ধু যুক্ত হচ্ছেন, আরও হবেন।

এখন পার্থ আর নেই ঠিকই, কিন্তু এখনও মমতা রয়েছেন।

তার নিজেরই ক্যাবিনেটের প্রাক্তন মন্ত্রী-আইপিএস অফিসার এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তে সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন।

আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যদি তৃণমূল জমানায় মানুষের দুর্দশা উপলব্ধি করে এমনই আরও কোন বন্ধু ব্রুটাসের মতো “Not that I loved Caesar less, but that I loved Rome more” ভেবে বসেন।

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

Spread the word

Leave a Reply