ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
আগামি ২৭শে সেপ্টেম্বর সারা দেশে ধর্মঘটের আহবান জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। এই মোর্চার মধ্যে রয়েছে ৫০০টি কৃষক সংগঠন। ধর্মঘট সম্পর্কে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন থাকে, কিছু প্রশ্ন ইচ্ছাকৃত যোগান দেওয়া হয়। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদ নিজের রাজনীতি ছড়ায় – জনমানসে ধর্মঘট বিরোধী যুক্তি প্রচার করে। বিবিধ বাস্তবতা এবং সীমাবদ্ধতার কারনে ধর্মঘট ও তার প্রয়োজন সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে কিছু প্রশ্ন থাকে – একথা মনে রেখেই রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষ থেকে “কেন ধর্মঘট?” প্রসঙ্গে দুই পর্বে ধারাবাহিক নিবন্ধ প্রকাশ করা হল। প্রথম পর্বে কৃষক আন্দোলন কেন এবং কোন পথে সেই আলোচনা ছিল, দ্বিতীয় পর্বে ২৭শে সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটে জনসাধারনের অন্যান্য অংশেরও সক্রিয় সমর্থন সম্পর্কে আলোচনা রইল।
দ্বিতীয় পর্ব
বুর্জোয়া অর্থনীতিতে পন্ডিত এমন কেউ যুক্তি হাজির করতেই পারেন, লকডাউন পরবর্তী সময়ে ছোট বড় সংস্থাগুলি বাড়তি মুনাফা করতে চাইলে তা এমন কি অন্যায়! তারা সম্ভবত “নিচের দিকে চুঁইয়ে পড়া সম্পদ” তত্ত্বের (Trickle Down Economy) উল্লেখ করবেন। যদিও তাদের মনে রাখা উচিত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, EPF সংক্রান্ত ভুয়ো তথ্য জমা করে শ্রমিক কল্যান খাতে খরচ কমিয়ে এবং এমনই আরও অনেক দুর্নীতিকে সম্বল করে ছোট বড় সংস্থাগুলি যে বাড়তি মুনাফার ব্যাবস্থা করে তা দেশের বা জনগণের কোনও কাজেই লাগেনা, কারন সেই বিপুল মুনাফা আয়ব্যায়ের খাতায় লেখা থাকে না, ফলে বাড়টি মুনাফায় একটি পয়সাও বাড়তি কর দিতে হয় না – গোটাটাই চলে যায় ব্যাক্তিগত মালিকানার পকেটে, এতে যেমন এইসব সংস্থায় কর্মরত শ্রমিক – কর্মচারীদের কোনও সুবিধা নেই, উল্টে শোষণ বাড়ে – আবার অন্যদিকে দেশের রাজস্বখাতেও কোনও বাড়তি সংস্থান হয় না। ফলে আর্থিক ক্ষতির প্রভাব অবশ্যই সার্বিক, যদিও মুনাফা কামানোর পথে উৎপাদন করতে বা যোগান (পণ্য বা পরিষেবা) দিতে শ্রমের ভূমিকা এখনও সামাজিক! মুনাফার খোঁজে নির্লজ্জ পুঁজিবাদের চরিত্র বর্ণনা করতে ঠিক মার্কস যেমনটা বলেছিলেন। সেই লেখার ধাক্কায় পুঁজিবাদ তাই আজও কমিউনিজমের ভূত দেখছে বৈকি!
২৭শে সেপ্টেম্বর সারা ভারত ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। সেই লড়াইতে যুক্ত হয়েছে সারা দেশের সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ। এই সংগ্রামে যুক্ত হবে ছাত্রছাত্রীরা, যুক্ত হবে কাজের দাবীতে লাগাতার আন্দোলন করে যাওয়া যুবসমাজ। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন ছাত্রছাত্রী কিংবা যুব সমাজের এহেন ধর্মঘটে জূড়ে থাকার কারন কি? কারন দেশের ভবিষ্যৎ। যখন কর্পোরেটদের হাতে এদেশের কৃষিক্ষেত্র, জাতীয় সম্পদ, সরকারী সংস্থাসহ শিক্ষাক্ষেত্র সবই বেচে দিতে চাইছে এদেশের সরকার তখন নিজেদের ভবিষ্যতের দাবী নিয়েই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শ্রমজীবী মানুষের পাশে থেকে লড়াই আন্দোলনে যুক্ত হবেন এমনটাই স্বাভাবিক।
আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি কিভাবে নয়া কৃষি আইনের সাহায্যে দেশের কৃষিব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে বিজেপি সরকার। এই পর্বে আমরা শ্রম আইন সংশোধনের নামে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেটদের প্রতি হৃদ্যতার আলোচনা করব। দেশের শ্রমজীবী, চাকরিজীবীদের কাজের জায়গায় অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে সরকার – এই প্রসঙ্গ শুধুই আজ যারা কাজের সাথে যুক্ত তাদের বিষয় নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্যেও সমান গুরুত্বের। দেশের যুবসমাজ, ছাত্রছাত্রীরা সেই কারনেই এই আন্দোলন সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এই ধর্মঘটে তাই জনসাধারনের সব অংশের যুক্ত হওয়া আবশ্যিক। তা হবেও।
প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা বাতিল করতে চায় সরকার
২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পাশ করেছে কোড অন ওয়েজেস। ২০২০ সালের বাদল অধিবেশনে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে আরও তিনটি শ্রম আইন – ক) দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোড, খ) দ্য অক্যুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন্স কোড এবং গ) কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি। এই সবকটি শ্রম আইনের দ্বারা একদিকে মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষা যেমন সুনিশ্চিত করা হল তেমনই অন্যদিকে ভারতে সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীদের যাবতীয় অধিকারকেই বাতিল করা হয়েছে, খারিজ করে দেওয়া হয়েছে ২৯টি শ্রম আইন। প্রভিডেন্ট ফান্ড এমনই একটি সুবিধা যার সাহায্যে অবসর গ্রহনের পরে শ্রমিক কর্মচারীরা নিজেদের দিনগুজরান করার মতো আর্থিক সংস্থানের সুবিধা পেতেন। মোদী সরকার সেই সুযোগ তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। পাশ করিয়ে নেওয়া নতুন চার শ্রম আইনের মধ্যে শেষ অর্থাৎ কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মধ্যে দিয়ে ৯টি শ্রম আইন খারিজ করা হয়েছে। সেই আইনগুলি হল ১) এমপ্লয়িজ কম্পেন্সেশন অ্যাক্ট, ২) এমপ্লয়িজ স্টেট ইন্স্যুরেন্স অ্যাক্ট, ৩) এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যান্ড মিস্লেনিয়াস প্রভিশন্স অ্যাক্ট, ৪) এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ (কম্পালসরি নোটিফিকেশন অফ ভ্যাকেন্সি) অ্যাক্ট, ৫) মেটারনিটি বেনিফিট অ্যাক্ট, ৬) পেমেন্ট অফ গ্রাচ্যুইটি অ্যাক্ট, ৭) সিনে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড অ্যাক্ট, ৮) বিল্ডিং অ্যান্ড আদার কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার সেস অ্যাক্ট এবং ৯) আন- অর্গানাইজড ওয়ার্কার্স সোশ্যাল সিক্যুরিটি অ্যাক্ট। বাতিল হওয়া এই ৯টি বিভিন্ন আইনের নাম থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় শ্রমিক- কর্মচারীদের কল্যানে যাবতীয় আইনকেই সংস্কারের লক্ষ্য করা হয়েছে। আসলে মালিকপক্ষ চায় মুনাফার নিশ্চয়তা, সেই কাজে সবচেয়ে সহজ উপায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের শোষণ। হায়ার অ্যান্ড ফায়ার মানে যখন খুশি নিয়োগ, যখন খুশি ছাঁটাই পুঁজিবাদের খুবই পছন্দের পরিকল্পনা। উৎপাদন বাড়িয়ে নেবার সময় মর্জিমাফিক মজুরির ভিত্তিতে চুক্তিতে নিয়োগ করে পরে ইচ্ছামতো ছাঁটাই – এই হল পুঁজিবাদের মতে অবাধ বাণিজ্যের শর্ত। পুঁজিবাদ এমন শোষণের ব্যবস্থাকেই জায়েজ এবং উপযুক্ত বলে যুক্তি হাজির করে কারন এতে মুনাফা বাড়িয়ে নেবার সবচেয়ে সহজ রাস্তাটা খোলা থাকে – সেই রাস্তা হল ১) শ্রমিকদের মজুরি কমানো, ২) খুবই কম অথবা বিনা মজুরিতে শ্রমসময় বাড়িয়ে নেওয়া এবং ৩) স্থায়ী শ্রমিকের বদলে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শ্রম আইন সেই লক্ষ্যেই কাজ করেছে। আজকের কর্পোরেটরা শোষণের ঐতিহাসিক সমস্ত চেহারাকেই ছাপিয়ে উঠে নতুন নজীর তৈরি করেছে – লকডাউনের ধাক্কায় সারা দেশে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭.৭ মিলিয়ন অথচ সেই সময়েই দেশের কর্পোরেটগোষ্ঠীর মুনাফা বেড়েছে! শোষণের এই ব্যবস্থাকেই পাকা চেহারা দিতে প্রচলিত শ্রম অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া প্রয়োজন, তাই নয়া শ্রম আইন প্রণয়ন হয়েছে।
Employees’ Provident Funds & Miscellaneous Provisions Act, 1952 নামে যে আইন এতদিন কার্যকর ছিল, শ্রমিক – কর্মচারী তার বুনিয়াদী বেতনের (Basic Salary) ১২ শতাংশ, মালিকের পক্ষে একই খাতে ১০ কিংবা ১২ শতাংশ হারে প্রতি মাসে অর্থ জমা হত নির্দিষ্ট ব্যাক্তির প্রভিডেন্ট ফান্ড তহবিলে। জমা অর্থে শ্রমিক – কর্মচারী ৮.৬৫ শতাংশ হারে সুদ পেতেন। প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যান্ড মিসলেনিয়স প্রভিশন্স অ্যাক্ট সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় অছি পরিষদের (The Central Board of Trustees, EPF) সুপারিশ ছিল ঐ আইনের পরিসর আরও বাড়ানোর। আগে কোন সংস্থায় ন্যুনতম ২০ জন কর্মরত হলে তবেই ইপিএফ(EPF)-এর সুবিধার সুযোগ ছিল, অছি পরিষদ বলে আরও বেশী শ্রমিক – কর্মচারীদের এই আইনের সুবিধা দিতে আইন পরিবর্তন করে কর্মরত শ্রমিক – কর্মচারীর ন্যুনতম সংখ্যা ১০ করা হোক। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সেই সুপারিশ খারিজ করে দিয়েছে। আসলে লকডাউনে অনেক ছোট, মাঝারি কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, লকডাউনের বিধি শিথিল হবার পরে একসাথে ২০ জন কর্মরত নন এমন ছোট সংস্থগুলিতে অনেকেই কোনমতে নিজেদের পেটের সংস্থানটুকু জূটিয়ে নিচ্ছেন। এমন প্রচুর সংস্থায় কাজ করা মানুষের ভবিষ্যতের দায় নিতে চায় না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, তাই আইনের পরিসর বাড়ানোর দাবী থাকা স্বত্বেও তা মানা হল না। বহু শ্রমিক – কর্মচারীরা এই সুযোগের বাইরে রয়ে গেলেন। নতুন আইনে প্রভিডেন্ট ফান্ডে দেয় অর্থের পরিমান ১২ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে, অর্থাৎ মালিকের দায় আরও কমিয়ে দেওয়া হল। নয়া আইনের 16(1) ধারা অনুযায়ী সরকার নিজের প্রয়োজনমতো ইপিএফ’এর দেয় অর্থের পরিমান আরও কমাতে পারবে, 15(I)(E) ধারায় সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় অছি পরিষদ (The Central Board of Trustees, EPF)কে সুপারিশকারী সংস্থায় পরিণত করা হল যাতে, ভবিষ্যতে সরকার নিজের ইচ্ছামতো প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন এবং ডিপোজিট নির্ভর বীমা প্রকল্পগুলিকে পুনর্গঠন (ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পগুলিকে ডিফাইন্ড কন্টিবিউশন স্কিমে রুপান্তর করার প্রস্তাব সরকার করেছে) করতে পারে। নয়া আইনের 20(2) ধারায় বলা আছে সরকার চাইলে যে কোন সংস্থাকে EPF সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার আইনের বাইরে পাঠাতে পারবে। কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের 1(5) ধারায় উল্লেখ রয়েছে মালিকপক্ষ যদি অধিকাংশ শ্রমিক – কর্মচারীদের সাথে যৌথভাবে EPF প্রকল্পের সুবিধা না নিতে চায় তবে সেই সংস্থাকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। যেখানে সারা দেশে আরও বেশী সংস্থাকে এই আইনের আওতায় আনার প্রয়োজন ছিল সেখানে নয়া আইনের সাহায্যে ছোট, বড় সুযোগসন্ধানি (ধান্দাবাজ) সংস্থাগুলিকে লাগামহীন মুনাফার রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হল। ছোট, বড় বহু সংস্থাগুলি খুব সহজেই নিজেদের শ্রমিক – কর্মচারীদের চাপ দিয়ে, অথবা ভুয়ো তথ্য সরবরাহ করে EPF প্রকল্পের বাইরে চলে যেতে পারবে, এতে মজুরি এবং শ্রমিককল্যান খাতে মালিকদের খরচ কম হবে, মুনাফা বাড়বে।
স্থায়ী কাজের সুযোগ ধ্বংস করতে চাইছে সরকার
“অক্যুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন্স কোড” ব্যাপারটা কি দেখে নেওয়া যাক। ২০২০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে এই আইন সম্পর্কে An Act to consolidate and amend the laws regulating the occupational safety, health and working conditions of the persons employed in an establishment and for matters connected therewith or incidental thereto বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কাজের সময় শ্রমিক- কর্মচারীদের স্বাস্থ্যহানী, স্বাস্থ্যবিষয়ক সাধারণ সুযোগ- সুবিধাসমূহ এবং কাজের জায়গায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এই হল উপরোক্ত আইনের পরিসর। যদিও ছিয়াশি পৃষ্ঠার সেই বিজ্ঞপ্তিতে অনেক জায়গাতেই বিভ্রান্তি রয়েছে। সেইসব বিভ্রান্তির উদ্দেশ্য যদিও স্পষ্ট, মালিকপক্ষকে আইনী জটিলতার সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং করে না দুটি ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের সংখ্যা আগে যা ছিল তার দ্বিগুন করে দেওয়া হয়েছে। গোটা দেশে ২০ জনের কম শ্রমিক নিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করা ছোট ফ্যাক্টরি বা কাজের জায়গা প্রচুর। নয়া আইনে তারা সকলেই স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। ফ্যাক্টরিতে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় এবং মোট শ্রমিক – কর্মচারীর সংখ্যা চল্লিশের কম এমন কারখানার সংখ্যাও ভারতে অনেক – এদের সকলকেই জোর করে সুযোগ সুবিধা থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। এতে কার সুবিধা হবে? কার উন্নয়ন হবে?
নয়া আইনে অবাধে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পে মোট শ্রমিক – কর্মচারীর পঞ্চাশ শতাংশই অস্থায়ী বা ঠিকায় নিযুক্ত। এমনকি বহু স্থায়ী পদেও এদের কন্ট্র্যাক্টরের অধীনে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়। আগে ২০ জনের কম শ্রমিক নিয়োগ করে এমন কোন কন্ট্র্যাক্টরের লাইসেন্স প্রয়োজন হতো না, এখন ৫০ জন অবধি নিয়োগে লাইসেন্সের প্রয়োজন হবে না। এতে কন্ট্র্যাক্ট্রদের হাতে আরও বেশী শ্রমিক শোষণের শিকার হবেন – অথচ দাবী ছিল স্থায়ী কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ না করার, স্থায়ী কাজে নিযুক্ত ঠিকা শ্রমিকের বেতন স্থায়ী কর্মীর দেতনের সমান করার। আইনসম্মত বেতন এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধাসহ শ্রমিকদের কল্যানে (ওয়েলফেয়ার) মূল কারখানার মালিক (প্রিন্সিপ্যাল এমপ্লয়ার)-দের যে দায় এতদিন বলবৎ ছিল তাকে নয়া আইনে লঘু করা হল – আইন প্রণয়নের দ্বারা শ্রেণীস্বার্থ চরিতার্থের জ্বলন্ত উদাহরন। পেরেনিয়াল ওয়ার্ক মানে সারা বছর কাজের সুযোগ থাকে এমন কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে আগে ঠিকা শ্রমিক যুক্ত করতে আইনি বাধা ছিল, এখন কোর অ্যাক্টিভিটির আড়ালে সেই বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হল।
নয়া আইনের নামে একদিনের বৈধ শ্রমসময়কে অনেকটাই বাড়িয়ে দিতে চাইছে সরকার, এতে শ্রমিকদের আরও সহজে কম পয়সায় বাড়তি কাজ করিয়ে নিতে আইনি বৈধতা পাবে মালিকপক্ষ। ওভারটাইমের পয়সাও খরচ হবে না কেননা শ্রমসময় বাড়িয়ে নিতে পারলে ওভারটাইম বলে কিছু থাকবেই না। আইনের ভাষ্যে ওভারটাইমের কোন সীমার উল্লেখ নেই। এর সাথে সব ধরণের কাজেই যদি ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা যায় তাহলে স্থায়ী কাজ, স্থায়ী বেতন এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা দিতে মালিকদের কোন দায় থাকবে না। সারাদিন খাটিয়ে নেবার পরেও খুব সহজেই কারখানায় ফুল টাইম ওয়ার্কার প্রয়োজন নেই খাতায় কলমে দেখিয়ে প্রাপ্য মজুরির অনেক কম খরচে কাজ চালানো হবে। আইনের ভাষ্যে একটি অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে সপ্তাহে একদিন ছুটি কিংবা ছয় দিন কাজের কথা, যদিও ঠিক পরের অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিধির ক্ষেত্রে সরকার সিদ্ধান্ত বদলে দিয়ে বিনা ছুটিতে একটানা কাজ করার হুকুম জারী করতে পারে, সেক্ষেত্রে আগামী দুই মাসের মধ্যে কম্পেন্সেটরি ছুটির বন্দোবস্ত করা হবে – নরক গুলজার আর কাকে বলে! মোদী সরকারের আমলে এরই নাম “আচ্ছে দিন”!
দেখে নেওয়া যাক Grievances অর্থাৎ শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে নয়া আইন কি পথ দেখিয়েছে। এতদিন লেবর ইন্সপেক্টর নিজের মতো কোন কারখানা পরিদর্শন করতে পারতেন, এখন থেকে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার! আগাম নোটিশ না দিয়ে কেউ পরিদর্শনে আসতে পারবেন না। নয়া আইনে পরিদর্শকেরা “ইন্সপেক্টর কাম ফেসিলিটেটর” বলে চিহ্নিত হয়েছেন। এরাই পরিদর্শনে আসবেন ঠিকই, কিন্তু সরকারী পোর্টালে প্রাপ্ত তালিকা থেকেই কোথায় যাবেন তা ঠিক করতে হবে। বাস্তব হল সরকারী পোর্টালে নথিভুক্ত রয়েছে সারা দেশে মোট কারখানার মাত্র চল্লিশ শতাংশ সংস্থা। এর বাইরে থাকা বিরাট সংখ্যার শ্রমিক – কর্মচারীরা শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিজেদের অসন্তোষ জানাবেন কোথায়? নয়া আইনে নির্দিষ্ট কোডে উল্লিখিত শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে সিভিল কোর্টে শুনানিতে বাধা রয়েছে। অর্থাৎ শ্রমিক – কর্মচারীরা কাজের জায়গায় পরিদর্শককে পাবেন না, আবার প্রয়োজনে আদালতেও যেতে পারবেন না, এমনকি শ্রমিক সংগঠনও কোন ভূমিকা পালন করতে পারবে না! কোন স্বাধীন দেশে শ্রমিকদের অধিকার এভাবে কেড়ে নেওয়া হয়!
কাজের পরিসর বাড়িয়ে নেবার অজুহাত দিয়ে মহিলাদের সবধরণের কাজে যুক্ত করার ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি রাতে কাজ করতে হয় সেইসব ক্ষেত্রেও মহিলাদের নিয়োগ করা যাবে। যদিও আইনে লেখা রয়েছে সংশ্লিষ্ট কাজে ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে হলে মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করতে হবে সংস্থাকেই। ধরে নেওয়া যায় এই অজুহাতে বেশিরভাগ সংস্থাই বাড়তি সমস্যা কিংবা বাড়তি খরচের দোহাই দিয়ে মহিলাদের নিয়োগ আটকে দেবে, আবার কাজের দোহাই দিয়েই সেইসব পদে পুরুষদের নিয়োগ করবে। ফলে আখেরে এতে মহিলাদের কাজের সুযোগ বাড়ল না, বরং সরকার নিজের দায় ঝেড়ে ফেলায় উপযুক্ত যোগ্যতা থাকা সত্বেও মহিলাদের কাজের সুযোগ কমে গেল, ফলে সমান কাজে সমান বেতনের ন্যায্য দাবিও দুর্বল হল।
একদিকে পঞ্চাশজন অবধি শ্রমিক নিয়োগে লাইসেন্সের বাধ্যতা না থাকা, আরেকদিকে নিয়োগ সম্পর্কিত কোন তথ্য় নিরীক্ষণের ব্যবস্থা নেই – বোঝাই যায় মালিক এবং কন্ট্র্যাক্টররা শ্রমিকদের স্বার্থে কেমন ডিউটি পালন করবে। আসলে শ্রম আইনের নামে আগাগোড়া ব্যাবস্থাটাই মালিকদের স্বার্থ চরিতার্থ করা হয়েছে। এ হল সেই শ্রেণীস্বার্থ যাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এঙ্গেলস বলেছিলেন “Actually, each mental image of the world system is and remains limited, objectively by the historical situation and subjectively by its author’s physical and mental constitution.”… মোদী সরকার কেন শ্রমিক-মজুর-গরিব মানুষের সরকার নয় তা বুঝতে পন্ডিত হতে হয় না, অন্য দল থেকে বিধায়ক কিংবা সাংসদ কেনার উদ্দেশ্যে বিজেপি যেভাবে বিপুল অর্থব্যায় করে সেই টাকার সংস্থান কোথা থেকে হয় এটুকু জানলেই চলে। অন্তত সেই ব্যাপারে এই সরকারকে সৎ এবং নিষ্ঠাবান তো বলতেই হয়!
বেতনকাঠামো বাতিল করতে আইন করেছে সরকার
সরকার কীভাবে বেতন এবং মজুরির গড় মাপকাঠি ঠিক করে? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরে ১৯৪৮ সালে ভারতে “দ্য মিনিমাম অয়েজেস অ্যাক্ট” বা ন্যুনতম মজুরি বিধি লাগু হয়। ফেয়ার ওয়েজ নামের একটি কমিটি ন্যুনতম মজুরি সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করে। যদিও এই কমিটি কীভাবে সেই মজুরি হিসাব করা হবে কিংবা সময়োপযোগী করা হবে সেই নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারেনি। পরে ১৯৫৭ সালে ইন্ডিয়ান লেবর কংগ্রেসের অধিবেশনে সেই কাজ করা হয়। ন্যুনতম মজুরির উদ্দেশ্য কি? সরকারী বয়ান বলছেঃ
The scope of the Minimum Wages Act is to prevent employers from exploiting the employees. It ensures the worker is sufficiently paid to provide enough for his/her basic needs such as food, shelter and clothing. The core objectives of the Act are listed below.
- Provide minimum wages to employees in the organized sector.
- Prevent exploitation of employees.
- Empower the government to fix and revise minimum wages promptly.
- Apply this order for most of the sections in the organized sector.
অর্থাৎ শ্রমিকদের বা বলা চলে মেহনতি জনগণের কল্যানে এই ব্যবস্থা একটি রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে। এই আইনে মালিকপক্ষের দায়কেও আইনানুগ করা হয়।
মোদী সরকার ২০১৯ সালেই মজুরি সংক্রান্ত আইন সংস্কার করেছিল। সেইসময় সরকারের প্রস্তাবে সংশোধনের দাবী করেছিল বামপন্থী সাংসদেরাই, সংশোধনী চেয়ে আইনসভায় ৮টি ভোট পড়েছিল যার ছটিই বামপন্থী সাংসদদের। এর আগে ২০১৮ সালে শ্রম সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি কিছু প্রস্তাব করেছিল, মোদী সরকার সেইসব সুপারিশে কোন আমলই দেয় নি।
১৯৫৭ সালে ইন্ডিয়ান লেবর কংগ্রেসের অধিবেশনে ন্যুনতম মজুরি ঠিক করতে পাঁচটি ভিত্তি চিহ্নিত করেছিল – কিছু বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট সেগুলিতে কিছু কথা যুক্ত করে, তবে ১৯৫৭ সালের প্রস্তাবসমূহই এখনও অবধি প্রামান্য। দেখে নেওয়া যাক কোন কোন বিষয়ের উপরে ন্যুনতম মজুরি নির্ধারিত হয় –
১) একজন রোজগেরে মানুষকে তিনজনের জন্য পণ্য / পরিষেবার সংস্থান করতে হয়।
২) একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে ২৭০০ ক্যালরির উপযুক্ত খাদ্য গ্রহনের প্রয়োজন হয়।
৩) আমাদের দেশে একটি পরিবারে বছরে ৭২ ইয়ার্ড অথবা ৬৫.৮৩৬৮ মিটার কাপড়ের প্রয়োজন হয়।
৪) বাড়িভাড়া (বাসস্থান সংক্রান্ত) খাতে ন্যুনতম খরচকে সরকারী আবাসন প্রকল্পের খরচের সাথে সমানুপাতিক ধরা হয়।
৫) ন্যুনতম মজুরির অন্তত ২০ শতাংশ জ্বালানি এবং বিবিধ খরচ ধরতে হয়।
উপরের পাঁচটি পরিমাপকের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায় ভর্তুকিহীন রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে ৮৪৫ টাকা প্রতি সিলিন্ডার হলে কেন মানুষের দুর্দশার শেষ থাকে না অথবা পেট্রোপণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে সবকিছুর (পণ্য এবং পরিষেবা) দাম বাড়লে কেন তা জনজীবনে দুর্ভোগ নামিয়ে আনে। ২০১৯ সালে মোদী সরকার বেতন সংক্রান্ত কোড অন ওয়েজেস নিয়ে এসে একধাক্কায় চারটি আইন ক) পেমেন্ট অফ ওয়েজেস, খ) মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট, গ) পেমেন্ট অফ বোনাস অ্যাক্ট এবং ঘ) ইক্যুয়াল রেমুনারেশন অ্যাক্ট বাতিল করে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য বেতন সংক্রান্ত সমস্ত আইনকে একটি আইনের আওয়তায় নিয়ে আসাই সরকারের উদ্দেশ্য। এতকিছু বলার পরে ২০১৯’এর জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দিন প্রতি ১৭৮ টাকা ন্যুনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে! এই মজুরির নাম দেওয়া হয়েছে ফ্লোরলেভেল ওয়েজ! ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং অন্যান্য ৩১টি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ন্যুনতম মজুরিও এর চাইতে অনেকটা বেশী! বুঝতে সমস্যা হয় না এই সরকার কাদের কথা ভেবে কাজ করছে।
আইনে শ্রমিকদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অংশটি মোদী সরকারের শ্রেণীচরিত্র স্পষ্ট করে দেয়। একদিন ধর্মঘটের শাস্তি হিসাবে আটদিনের মজুরি কেটে নেবার নিদান দেওয়া আছে। দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখেছিলাম লেবর ইন্সপেক্টরকে কীভাবে নয়া শ্রম কোডে হাত পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলে একদিকে শ্রমিকদের আইনি পথে অসন্তোষ জানানোর উপায় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে আরেকদিকে প্রতিবাদ জানানোর শেষ অস্ত্র হিসাবে ধর্মঘটের জবাবে চড়া শাস্তির নিদান স্থির করা হচ্ছে। সন্দেহ নেই এরা কাদের ধামা ধরতে চাইছেন! শ্রেণীস্বার্থের সেই প্রত্যাশা পূরন করতে চেয়েই বোধহয় কেন্দ্রের সরকার গোটা পৃথিবীতে “ইস্ট ফোর ড্যুইং বিজনেস” বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে!
মুনাফার লোভে পুঁজিবাদ কতটা নির্লজ্জ হতে পারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেনিন বলেছিলেন “মুনাফার গন্ধ পেলে এরা পারে না এমন কোন কাজ নেই, প্রয়োজনে মরা মায়ের চামড়া ছাড়িয়ে ডুগডুগি বাজাতেও এরা পিছপা হবে না।” – আজকের ভারতে সরকারের ভূমিকা দেখলে তিনি কি বলতেন সেই কথা উপলব্ধি করতে পন্ডিত হতে হয় নাকি!
সংস্কারের নামে আসলে স্থায়ী কাজকেই তুলে দিচ্ছে সরকার
শ্রম সম্পর্ক বিষয়ক প্রচলিত তিনটি আইনকে বাতিল করে একটি আইন প্রণয়নের আসল উদ্দেশ্য আরও অনেক বেশি রাজনৈতিক। নয়া আইনে সরকার “ফিক্সড টার্ম এম্পলয়মেন্ট” মানে চুক্তি ভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের কাজে নিয়োগকে বৈধতা দিয়েছে। এর ফলে যে কোনও কাজে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করার প্রয়োজন নেই বলে দেখানো যাবে, আবার নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিযুক্ত শ্রমিককে বদলে দিয়ে কিংবা বারে বারে একই লোককে নিয়োগ করে খালি পদ নেই দেখিয়ে দেওয়া যাবে। অর্থাৎ সারা দেশে কোটি কোটি বেকারদের কাজের ন্যায্য দাবীকে সহজেই নস্যাৎ করতে চাইছে সরকার। এর সাথে অস্থায়ী কর্মচারী, মজদুরদের কাজ হারানোর ভয় দেখিয়ে কোনোরকম ন্যায্য দাবী, অধিকার থেকেও সরিয়ে রাখা সহজ হবে। নিস্কন্টক মুনাফার লক্ষ্যে কর্পোরেটরা তাই চায়, মোদী সরকার সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছে। মনে রাখতে হবে চুক্তি ভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের কাজে নিয়োগকে আইনি বৈধতা দেবার বিষয়টি হঠাৎ করে বিজেপি’র মাথায় আসেনি, ২০০৩ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ির নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার প্রথম এমন আইনের প্রস্তাব করেছিল। তখন সারা দেশে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির চাপে পড়ে তারা সেই আইন লাগু করতে পারেনি, এতদিন পরে মোদী সরকার সেই কাজ সম্পূর্ণ করছে। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী নির্লজ্জের মতো দাবী করছেন এই নয়া শ্রম আইন প্রণয়নের পূর্বে তারা সবার সাথে আলোচনা করেছেন, দেশের মানুষ জানতে চায় এমন শ্রম কোডে সম্মতি দেন সেইসব আলোচক কারা?
এতদিন উৎপাদন কিংবা পরিষেবা মূলক যে কোনও সংস্থায় একশো জনের বেশি শ্রমিক – কর্মচারী থাকলে তাকে শিল্পসংস্থা হিসাবে চিহ্নিত করা হত, এবং সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন সমূহ প্রযোজ্য হত। যাতে আরও বেশি সংখ্যায় শ্রমিক – কর্মচারী শ্রমিক অধিকার আইনের সুবিধা পেতে পারেন তাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির দাবী ছিল শিল্পসংস্থায় ন্যুনতম শ্রমিক সংখ্যা ৫০ করার দাবী জানিয়েছিল। মোদী সরকারের যুক্তি ১০০ জন শ্রমিক থাকার আইনের কারনেই নাকি ছোট সংস্থাগুলি বড় হতে পারছেনা! এই অজুহাতে নয়া আইনে শিল্পসংস্থা হতে গেলে ন্যুনতম শ্রমিক- কর্মচারীদের সংখ্যা একধাক্কায় ৩০০ করে দেওয়া হয়েছে! এতে কি হল! আগে যা ছিল তার চেয়েও কম শ্রমিক এখন শ্রমিক অধিকার আইনের সুযোগসুবিধা পাবেন, বাকিরা সকলেই বঞ্চিত হবেন।
এখন ছোট, বড় কোনও সংস্থায় ট্রেড ইউনিয়ন নথিভুক্ত করতে হলে মোট শ্রমিকের ১০ শতাংশ অথবা ১০০ জনকে (যে সংখ্যাটি কম হবে) ঐ ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হতে হবে, যদিও শেষ অবধি নথিভুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত নিতে সরকারই একমাত্র নির্ধারক শক্তি! অর্থাৎ ঘুরপথে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হতে বাধা দেওয়া হবে। নয়া আইনে সংগঠিত ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নে কর্মকর্তাদের মোট সংখ্যার একের তিনভাগ অথবা ৫ জনকে (যেটি সংখ্যায় কম হবে) সংস্থায় কর্মরত হতে হবে – এর উদ্দেশ্য কি? ট্রেড ইউনিয়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সর্বক্ষণের সংগঠকরা কাজ করেন, মালিকরা এদের ভয় দেখিয়ে ভুল অথবা অন্যায় কোনও সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করতে পারে না। সারা দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে এইসব সর্বক্ষণের সংগঠকরা অনেক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। এদের সংখ্যা কমাতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের ৫০ শতাংশ কর্মীকে বাইরে থেকে নেওয়ার নিদান রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি সংক্রান্ত প্রক্রিয়ায় এতদিন অবধি গণতান্ত্রিক প্রকরণ হিসাবে শ্রমিকদের ভোটদানের সময় গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা ছিল, এখন তা তুলে দেওয়া হল। ৫১ শতাংশ শ্রমিকদের সমর্থন আছে এমন ট্রেড ইউনিয়নকেই স্বীকৃতি দেবে সরকার – অথচ সেই প্রক্রিয়ায় গোপন ব্যালটে ভোট দেওয়া যাবে না! মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর সময়সীমা পূর্বে ছিল ৩ বছর, এখন করা হয়েছে ২ বছর! লেবর কোর্ট বাতিল হয়েছে, কোনও সমস্যায় মীমাংসা না হলে তাকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর বন্দোবস্ত ছিল আগের আইনে – নয়া আইনে সরকারের সেই বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এমনকি যে সমস্ত মামলা ট্রাইব্যুনালে চলছে সেগুলির ক্ষেত্রে কার্যক্রম শেষ হবার ৬০ দিন পরে ধর্মঘটের সুযোগ রয়েছে। শ্রম দপ্তরে আলোচনা চলছে এমন সংস্থার ক্ষেত্রে আলোচনা শেষ হবার ৭ দিনের আগে ধর্মঘট করা যাবে না। এছাড়াও ন্যুনতম শ্রমিক সংখ্যার অজুহাতে শিল্পসংস্থা হিসাবে সরকার যে সংস্থাকে চিহ্নিত করতেই রাজি নয় সেখানেও ধর্মঘট করতে গেলে ৬২(১)(এ) ধারা অনুযায়ী ৬০ দিন আগে আবার ৬২(২) ধারায় ১৪ দিন আগে আগাম নোটিশ দেওয়া নয়া আইনের বলে বাধ্যতামূলক। দুই রকম সময় কেন? যাতে মালিক আইনের ফাঁক ব্যবহার করে ধর্মঘটকারী শ্রমিকদের ইচ্ছামতো শাস্তি দিতে পারে। এই সবকিছুই নমনীয় শ্রমসম্পর্কের বাস্তবতা। আজকের পৃথিবীতে একটি স্বাধীন দেশে শ্রমআইনের কি অসাধারণ সংস্কার!