Peru Cover

Peru’s Lesson: An Introspect

শান্তনু দে

দেড়-বছরে তাঁকে তিনবার সংসদে ভর্ৎসনা প্রস্তাবের মুখে পড়তে হয়েছে। চার-চারবার মন্ত্রিসভা রদবদল করতে হয়েছে। পরিবর্তন করতে হয়েছে ৭২ জন মন্ত্রীকে। এবং শেষে পেদ্রো কাস্তিও নিজেই রাষ্ট্রপতি থেকে অপসারিত। আপতত আটক। মেক্সিকো তাঁকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। নতুন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন উপরাষ্ট্রপতি দিনা বলুয়ার্ত, যিনি কাস্তিওর সময় ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি।

জুলাই, ২০২১: ২০০-বছরের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে পেরুতে নির্বাচিত প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি। এই প্রথম, পেরু নির্বাচিত করে আন্দিজের প্রত্যন্ত গ্রামের এক নিরক্ষর হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানকে। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক পেদ্রো কাস্তিও সেকারণে শুধু দেশের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতিই নন, প্রথম কৃষক রাষ্ট্রপতি-ও। একসময় রাজধানী লিমায় কাগজ ফিরি করতেন। কখনও বিক্রি করতেন আইসক্রিম। আবার কখনও হোটেলের শৌচাগার সাফাইয়ের কাজ।

স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেননি দেশের ধনীরা। কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করে কাস্তিওর বিরুদ্ধে। ভোট গণনা থেকেই তৎপর ছিল উগ্র দক্ষিণপন্থীরা। ভোটের পর টানা ছ’-সপ্তাহ। গণনা-পুনর্গণনার দীর্ঘ টালবাহানার শেষে বামপন্থী প্রার্থী কাস্তিও’র সমর্থনের হার ৫০.১৩ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণপন্থী প্রার্থী, কট্টর উদার বাজার নীতির সমর্থক কেইকো ফুজিমোরির পক্ষে ৪৯.৮৭ শতাংশ।

এই ভোট ছিল নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে এক স্পষ্ট জনাদেশ। বহুজাতিক সংস্থাকে অবাধ লুটের মৃগয়া ক্ষেত্র করে দিতে কেইকোর বাবা স্বৈরাচারী আলবার্তো ফুজিমোরি (১৯৯০-২০০০) যে নয়া উদার ধারনা নিয়ে সংবিধান তৈরি করেছিলেন, তা এখনও বলবৎ। গ্রুপো কোলিনা ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে অসংখ্য সমাজকর্মী এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী-নেতার হত্যা ও অপহরণের দায়ে আলবার্তো এখন জেলে। ২৫ বছরের কারাদণ্ড। ২,৭২,০২৮ জন মহিলাকে বন্ধাত্বকরণে বাধ্য করেছিলেন তিনি। যাঁদের অধিকাংশই আদি জনগোষ্ঠীর। মেয়ে কেইকোর বিরুদ্ধে রয়েছে ব্রাজিলের নির্মাণ সংস্থার থেকে ১২ লক্ষ ডলার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ।

এদিকে অপার খনিজ সম্পদে ভরপুর পেরু এখনও লাতিন আমেরিকার গরিব ও অনুন্নত দেশগুলির একটি। তীব্র অসাম্য। আন্দিজের গ্রামাঞ্চল আর উত্তরে উপকূলীয় শহরাঞ্চলের মধ্য অসাম্য প্রকট। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই গরিব। এক শতাংশ ফার্মের দখলে ৭৭ শতাংশ জমি। মানে তাদের হাতে বাকি ৯৯ শতাংশের চেয়ে বেশি জমি। ৬২ শতাংশেরই নেই কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। ২০২০, পেরুর জিডিপি পড়েছে ১১.১ শতাংশ। শেষ ৩০-বছরে সবচেয়ে শোচনীয় মন্দার মুখে দেশ। একরত্তি দেশে কাজ হারিয়েছেন ২০ লক্ষ মানুষ। বেকারত্বের হার দ্বিগুণ বেড়ে ১৪.৫ শতাংশ। যদিও, এটি শুধুই সংগঠিত ক্ষেত্রের হিসেব, যে দেশে শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশই চুক্তির বাইরে। দারিদ্রের হার ২০১৯ থেকে ৬ শতাংশ বেড়ে ২৭.৫ শতাংশ। কারণ, বিদেশী পুঁজির প্রবল দাপট। তাবৎ খনির মালিক দেশ-বিদেশের কর্পোরেট। খনিজ সম্পদের অবাধ লুটে বেড়েই চলেছে কর্পোরেটের মুনাফার পাহাড়। অর্থনীতিতে নেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ। দেশের খনিজ সম্পদে নেই রাষ্ট্রের অধিকার। অথচ, তা জাতীয় সম্পদ। ব্যবহার করার কথা জনগণের স্বার্থে। নয়া উদার নীতিতে সম্পদের অসম বন্টনে সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকায় বেড়ে চলেছে গরিব-বড়লোকের ব্যবধান।

পেদ্রো কাস্তিও’র দল ‘ফ্রি পেরু’ চেয়েছিল এই সংবিধান বদলে এক নতুন সংবিধান। আর সেই খসড়া সংবিধান লিখতে গণপরিষদ। খসড়া সংবিধান অনুমোদনে গণভোট। যাতে পুনরুদ্ধার করা যায় দেশের স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র-সহ তাবৎ জাতীয় সম্পদকে। ব্যবহার করা যায় দেশের মানুষের জন্য, বিশেষ করে হতদরিদ্র, গরির মানুষের জন্য।

পেরুর সংবাদপত্রগুলির ৮০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ যে মিডিয়া টাইকুনের হাতে— সেই ‘গ্রুপো এল কমার্সিও’ তাই স্বাভাবিকভাবেই ছিল কাস্তিও’র ঘোর বিরোধী। শুধু পেরুতে নয়, এমনকি ব্রিটিশ দ্য টেলিগ্রাফে পর্যন্ত কাস্তিওকে নিয়ে শিরোনাম: ‘মার্কসবাদী শাইনিং পথ গেরিলার প্রত্যাবর্তন’ পেরুতে। ভোটের মুখে রয়টার্সের শিরোনাম ছিল, ‘নয়া উদারবাদ না মার্কসবাদ?’ পেরুর রাস্তার বিলবোর্ডে ছড়ানো হয়েছিল আতঙ্ক। ক্যাস্তিওকে জিতিয়ে আপনারা কি ‘পেরুকে ভেনেজুয়েলা, কিউবা করতে চান!’, ‘কমিউনিজম মানে দারিদ্র!’

শপথ নিয়ে প্রথমে ১৯-সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন ফ্রি পেরু দলের সাংসদ গুইদো বেল্লিদোকে। যিনি কিউবার ঘোর সমর্থক। দলের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির সেরনের ঘনিষ্ঠ। নিউরোসার্জেন সেরন ১৯৯৭-তে কিউবা থেকে মেডিসিনে ডক্টরেট করেন। পরে কিছুদিন ক্যামাগুয়েতে প্র্যাক্টিসও করেন। খনিজ ক্ষেত্রের জাতীয়করণের ডাক দিয়ে ২০১২-তে তৈরি হয় ফ্রি পেরু। নিজেদেরকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মারিয়ের্তাগি বলে ঘোষণা করে। হোসে কার্লোস মারিয়ের্তাগি ছিলেন ১৯২৮ সালে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। ফ্রি পেরু বলে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, লাতিন আমেরিকার ঐক্যের কথা। নয়া উদার সংবিধান বদলে চায় নতুন সংবিধান। মহিলাদের অধিকারকে সম্মান। দলের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট উচ্চারন: ‘যে কোনও ধরনের সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ও বিদেশী নির্ভরতার নিন্দা করে’ ফ্রি পেরু।

কাস্তিও শুরুতে বিদেশমন্ত্রী করেন হেক্টর বেজারকে। তাঁর বয়স যখন ২৭, তখন তিনি গিয়েছিলেন কিউবায়। গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে। দেখা করেছিলেন ফিদেল, চে গুয়েভারার সঙ্গে। ফিরে এসে যোগ দিয়েছিলেন পেরুর গেরিলা গ্রুপ রেভেলিউশনারি লেফট মুভমেন্টে (এমআইআর)। মাঝে গ্রেপ্তার হন। পরে মুক্তি পান। স্বাভাবিকভাবেই শুরুতেই বেজার ঘোষণা করেন লিমা গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসবে পেরু। নতুন করে যোগ দেবে ইউনাসুর ব্লকে। কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিরোধী পেরু। ‘মতাদর্শগত স্বাতন্ত্র ব্যতিরেকেই পেরু জোরদার করবে লাতিন আমেরিকার ঐক্য আর সহযোগিতাকে। পেরুর বিদেশনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সুবিধার ভিত্তিতে লাতিন আমেরিকার ঐক্যের নীতি।’

যথারীতি দেশী-বিদেশী পুঁজির প্রবল চাপ। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির পাততাডি গোটানোর হুমকি। শেষে ১৯ দিনের মাথায় তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। লগ্নী পুঁজির এহেন চাপের মুখে কাস্তিও অর্থমন্ত্রী করেন একজন ‘মডারেট’ অর্থনীতিবিদ পেদ্রো ফ্র্যাঙ্কেকে, যিনি একসময় ছিলেন বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ।

কাস্তিও’র সামনে তাই ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির সঙ্গে দর কষাকষির চ্যালেঞ্জ। ‘নতুন দেশ’ হিসেবে পেরুর পুনর্জন্মের জন্য কাস্তিওকে লড়তে হয়েছে গেঁড়ে বসা শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রে তাদের বিভিন্ন শাখার বিরুদ্ধে। লড়তে হয়েছে মিডিয়ার একপেশে কুৎসা প্রচারের বিরুদ্ধে। সংসদ, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

গতবছর অক্টোবরে একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিংয়ে দেখা যায় দেশের অভিজাত, বিরোধী দক্ষিণপন্থী দলগুলিসহ শিল্পপতিদের একটি গোষ্ঠী কাস্তিওকে হটাতে প্রতিবাদ-ধর্মঘটে অর্থ যোগাচ্ছে। অবসর নেওয়া সামরিক কর্তাদের একটি গোষ্ঠী, ফুজিমোরির মতো উগ্র দক্ষিণপন্থীরা সরাসরি হিংসার পথ নেওয়ার ডাক দেন।

২০২০’র অক্টোবরে একটি পত্রিকার শারদ সংখ্যায় তাই লিখেছিলাম, ‘এইসব চ্যালেঞ্জের মুখে কাস্তিও ও তাঁর দল নিজেদের অবস্থান অটুট রেখে কতদিন তা মোকাবিলা করতে পারবে, সেটা বলতে পারে একমাত্র ভবিষ্যৎ।’

দু’বার ব্যর্থ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি পেদ্রো কাস্তিওর বিরুদ্ধে তৃতীয়বারের জন্য আনা হয়েছিল ভর্ৎসনা প্রস্তাব। সংসদে তা নিয়ে আলোচনার কথা ছিল ৭ ডিসেম্বর। আগের রাতে পৌনে ১২টায় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে কাস্তিও সংসদ সাময়িক সময়ের জন্য ভেঙে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ৯ মাসের মধ্যে নির্বাচন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়ার কথা বলেন।

কাস্তিও রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে থেকেই দেশের দক্ষিণপন্থীরা তাঁকে অপসারণের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কাস্তিও বরাবর বুর্জোয়া সংবিধান মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিলেও, বুর্জোয়ারা তাঁকে এক ছটাক জমি ছাড়তেও নারাজ ছিলেন, কারণ তিনি তাদের শ্রেণির নন।

সঙ্ঘাত ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার মুখে কাস্তিও সপ্তাহকয়েক আগে অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস (ওএএস)-র হস্তক্ষেপ চান। কে না জানেন ওএএস আসলেই চলে ওয়াশিংটনের নির্দেশে, চে’র কথায় ‘ইয়াঙ্কিদের মন্ত্রিসভা’! এই ঘটনায় প্রমাণিত তা কতটা যথার্থ। পরিস্থিতির চাপে শেষে কাস্তিও যখন সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হন, ওএএস তখন তাকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে বর্ণনা করে। আর এভাবেই ওএএস কাস্তিও’র অপসারণকে বৈধতা দেয়। সেইসঙ্গে নতুন রাষ্ট্রপতি দিনা বলুয়ার্তের পথ সুগম করে দেয়।

কাস্তিওর ঘোষণার পরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। দক্ষিণপন্থীরা মিডিয়া, সোস্যাল নেটওয়ার্ক ও সশস্ত্র বাহিনীকে আরও সংহত করে। দক্ষিণপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংসদ থেকে কাস্তিও নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও তা হিতে-বিপরীত হয়। ঘোষণার পরেই তাঁর প্রায় পুরো মন্ত্রিসভাই পদত্যাগ করে। বামপন্থী ফ্রি পেরু পার্টি, যারা কাস্তিও মনোনয়ন দিয়েছিল, তারা পর্যন্ত এই পদক্ষেপকে খারিজ করে। সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ প্রধানরা এই পদক্ষেপ খারিজ করেন। বিরোধী রক্ষণশীলরা বলতে শুরু করেন বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে কাস্তিও অভ্যুত্থানের ছক কষছেন। তারা একে সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের উপর আঘাত বলে বর্ণনা করে। তারা সংসদের অধিবেশন ডাকে। ভর্ৎসনার পক্ষে ১০১ জন ভোট দেন। বিপক্ষে মাত্র ৬ জন। ভোটদানে বিরত ছিলেন মাত্র ১০ জন। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দিনা বলুয়ার্তকে নিয়োগ করেন।

কাস্তিওর দুর্বলতা কোথায়? দক্ষিণপন্থীরা যখন তাকে হটাতে এককাট্টা, তখন তিনি সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি রাস্তা থেকে তোলেননি। সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে হয়নি কোনও মিছিল-সমাবেশ। কাস্তিওর সবচেয়ে বড় ভুল তিনি বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বোঝাপড়া করে তাদের সাহায্য-সমর্থন নিয়ে এগোতে চেয়েছিলেন। শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে নয়, যাঁরা তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিলেন। এই ঘটনা লাতিন আমেরিকার জন্য একটি বড় শিক্ষা: তুমি সরকারে আসতে পারো, কিন্তু তার অর্থ রাষ্ট্র ক্ষমতায় নয়।

কাস্তিওর সমর্থকরা বলছেন, তিনি অভ্যুত্থানের ষডযন্ত্রী নন। বরং দক্ষিণপন্থীদের ষড়যন্ত্রের শিকার। অনেকেই বলছেন, পেরুর অধিকাংশ মানুষ যাঁকে নির্বাচিত করল, তাঁকে এভাবে অপসারিত করা আসলেই এক ‘অভ্যুত্থান’।

Spread the word

Leave a Reply