মোদী ও ট্রাম্পের সফরসঙ্গী হয়ে মোতেরা স্টেডিয়ামে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে গরিবদের লুকিয়ে রাখতে পাঁচিল তোলার মত অশ্লীল কার্যকলাপ দেখে শুনে দিল্লি ফিরেছিলেন অমিত শাহ। তারপর তিনদিন ধরে আগুন জ্বললো দিল্লি উত্তর পূর্ব জেলায়। নিখোঁজ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের কলামে বিজ্ঞাপন দেবার মতো অবস্থা! এমনই দক্ষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে দিল্লিতে ফিরে উচ্চপদস্থ আধিকারিক নিয়ে বৈঠকই করে গেলেন। কী হলো সেই সব বৈঠকে, জানার কোনও উপায় নেই। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল হিংসা। উত্তরোত্তর বেড়ে চলা হিংসার শিকার সরকারি ভাবে ৪৭। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে মর্গে রাখা লাশ আর সরকার ঘোষিত হিসাবের মধ্যে গরমিল রয়েছে।
ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ। প্রায় কয়েকশো মানুষ গুরুতরভাবে আহত। আক্রান্ত বেশ কয়েক হাজার। সম্পত্তি, বাড়ি, ঘর, দোকান, যানবাহন, স্কুল, রুজি কি পরিমাণ বিপন্ন, প্রত্যক্ষদর্শীদের এবং সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে তার নৃশংস চেহারা ধীরে ধীরে সামনে আসছে।
উত্তর পূর্ব জেলা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা জানিয়েছেন সাব ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে তৈরি ১৮টি দলের পেশ করা তথ্যের ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। দিল্লির সরকারের নির্দেশে এই দলগুলি উত্তর পূর্ব দিল্লির হিংসা বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন সমীক্ষা চালিয়েছে। এখনও পর্যন্ত এই হিংসায় প্রাণ হারিয়েছেন বলি হয়েছেন ৪৭জন। আহত ৩৫০-র বেশি।
দিল্লি ফায়ার সার্ভিসের ফাইল করা রিপোর্ট অনুযায়ী গত সপ্তাহে সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে ৭৯টি বাড়ি, ৫২টি দোকান, পাঁচটি গোডাউন, চারটি মসজিদ, তিনটি কারখানা এবং দুটি স্কুল। ৫০০-র বেশি গাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছে। স্বভাবতই চূড়ান্ত রিপোর্টে ক্ষয়ক্ষতির আরো বেশ কিছুটা বাড়বে।
হিংসা চলাকালীন সময়ে তো নয়ই, এমনকি এখনও অমিত শাহ ঘটনাস্থলে গিয়ে উঠতে পারেননি। সিএএ বোঝাতে আর পশ্চিমবাংলায় নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বিজেপি এই প্রচার তুলতে শহীদমিনারে পৌঁছাতে অবশ্য কোনো খামতি নেই!
এই সবের মাঝখানেই দিল্লির দাঙ্গা নিয়ে শাহ নিদান দিয়ে ফেলেছেন! নিখোঁজ থাকার পরে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব এতোটাই যে নিজের বক্তব্য হাজির করতে পেশাদারী মূল্যায়নের অজুহাত খাড়া করতে হয়েছে। কি নিদান? বাহাত্তর ঘন্টা ধরে চলা সাম্প্রদায়িক ধ্বংসলীলা নাকি ‘স্বতঃস্ফূর্ত’! এই দাবি শুনে, ঢাকাই কুট্টিদের অননুকরণীয় সংলাপে, ‘ঘোড়াও হাসবো’!
আসলে আদ্যোপান্ত আরএসএসের রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই আসে না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। এই হিংসা, খুনখারাবি যে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে মেরুকরণের রাজনীতিরই পরিণতি তা কিছুতেই লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। নাগরিকত্বের প্রশ্নে দেশজুড়ে সংবিধান রক্ষার শপথে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তা গত ছ’বছরের মধ্যে প্রথম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে এই রাজনীতির সামনে।
অতএব হিংসা, খুন, রাহাজানি,ধ্বংসযজ্ঞ। গত বেশকিছু সময় ধরেই যেভাবে আরএসএসের রাজনীতি এগিয়েছে সরকারের সংবিধানবিরোধী ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে। ঘৃণা এবং বিভাজনের যে আবহ আজকে, এটা যে তারই অনিবার্য পরিণতি তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় মোদী সরকার গঠনের পর হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের সক্রিয় উদ্যোগ। দিল্লির ঘটনাবলি সেই চিত্রনাট্যের ট্রেলারমাত্র। ফলে প্রকল্প সম্পূর্ণ হতে যেহেতু বেশকিছুটা সময় লাগবে সুতরাং মূল উদ্দেশ্যকে আড়ালে রাখতে, বলতেই হবে এই ধ্বংসযজ্ঞ ‘স্বতঃস্ফূর্ত’!
উত্তর-পূর্ব দিল্লি: সমাজ অর্থনীতি
২০১১-এর জনগণনা অনুযায়ী উত্তরপূর্ব দিল্লি জেলার ৬২ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বসবাস করেন ২২.৪২ লাখ বাসিন্দা। জনঘনত্বের হিসাবে জাতীয় রাজধানী ক্ষেত্রের গড়ের তিনগুণ। দিল্লির মধ্যে এই জেলাতেই জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুততম গতিতে। বিশেষ করে গত তিন দশকে। গত জনগণনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩.৪% হারে। যদিও নয়াদিল্লির জনসংখ্যা কমেছে।
যদিও এই এলাকা সম্পর্কে পরিকল্পনা ছিল, যে শিল্পাঞ্চল হিসাবেই এটা গড়ে উঠবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দিল্লির অন্যত্র কলকারখানা রয়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যায়। এমনকি পাইকারী বাজারও উত্তরপূর্ব দিল্লিতে নেই। সুতরাং উত্তরপূর্ব দিল্লির অর্থনৈতিক চালচিত্র ছোট অসংগঠিত ইউনিটগুলিকে ঘিরেই।
পশ্চিমে যমুনা এবং পূর্বে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ। সুতরাং পরিযায়ী শ্রমিক এবং অন্যত্র থেকে আসা জনসংখ্যাই বেশি। ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী ২২.৪২ লাখের মধ্যে ৮.২৩ লাখেরই জন্ম দিল্লির বাইরে। উত্তরপূর্ব দিল্লির জনসংখ্যার সামাজিক গঠনও উল্লেখযোগ্য। ৬.৫৮ লাখ মুসলিম (২৯.৩%) এবং ৩.৭৪ লাখ (১৬.৭%) দলিত। সুতরাং সংখ্যাতত্ত্বে এটা স্পষ্ট যে রুটিরুজির খোঁজে আসা মানুষগুলো ছোট ছোট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে রয়েছে। এমনকি ২১৮ ফ্যাক্টরিতেও শ্রমজীবীর গড় সংখ্যা ৯.৫ জন। মূলত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ জনসংখ্যার ঘনত্বে এই এলাকা। এখানকার উন্নয়নও অনেকটাই অপরিকল্পিত। সাধারণভাবে এই এলাকায় অতীতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ইতিহাসও নেই। বরং এই সাম্প্রতিক হিংসার আবহতেও অসংখ্য উদাহরণ সামনে এসেছে , যেখানে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই একে অপরকে হিংসার আঁচ থেকে বাঁচাতে অননুকরণীয় সাহস, মানবিকতা এবং সহমর্মিতার সাক্ষ্য রেখেছে।
যেহেতু বেশিরভাগই গরিব নিম্নবিত্ত এবং এদের জীবনযাপনেও পরস্পর নির্ভরশীলতা এই প্রতিক্রিয়াও খানিকটা স্বাভাবিক। মুসলিমরা মন্দির রক্ষা করেছেন, হিন্দুরা মসজিদ রক্ষা করেছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে। যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন উদারভাবে নিজেদের বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছেন আক্রান্তদের আশ্রয় দিতে। উজাড় হস্তে তাদের বেঁচে থাকার জন্যে খাবার জুগিয়েছেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের ভূমিকা। তাদের মধ্যে ১৯৮৪-এর দাঙ্গা সহমর্মিতার একটা স্বাভাবিক পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল।
রাজনীতি আর সংগঠন: হিংসার অনুঘটক
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে কেন এই ভয়ংকর হিংসা!
এখানেই ফিরে আসতে হবে অমিত শাহের পূর্বপরিকল্পিত কৈফিয়তে। সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না এটা বোঝার জন্যে জ্যোতি বসু হওয়ার দরকার নেই। সমাজে হিংসার সম্পর্কে মানুষের স্বাভাবিক মনোভাব বুঝলেই এই সিদ্ধান্তে আসা কষ্টকর নয়। ২০০২ সালের গুজরাটের গণহত্যার সময় প্রশাসনে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে তো নয়ই। কাজেই হিংসা যে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না সেটা শাহের চেয়ে কেউ ভালোভাবে বোঝেন না। তাই এই মিথ্যাচার আর হিংসার চরিত্রও প্রায় ২০০২ সালের কার্বন কপি! অনেকেই সাদৃশ্য দেখে বলছেন ২০২০ সালের উত্তর-পূর্ব দিল্লি, ২০০২’র গুজরাট মডেল। কিন্তু একটা বড় তফাৎ আছে।
রাষ্ট্রক্ষমতা। সব কিছু বাদ দিলেও ২০০২ সালের মোদী সরকার তখন সবেমাত্র ক্ষমতায়। হাত পাকেনি। গোটা দেশে বিজেপি’র উপস্থিতি এতোটা সর্বব্যাপী নয়। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকার থাকলেও কোয়ালিশন। চাপে পড়ে বাজপেয়ী রাজধর্মের কথা উঠিয়েছিলেন। বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনের উপর নিয়ন্ত্রণও এতটা নিরঙ্কুশ নয়। বিচারব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য অনেক বেশি স্পষ্ট।
আর মিডিয়া। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এবং অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ সোশ্যাল মিডিয়া। আইটি সেলের প্রশ্নাতীত ক্ষমতা। হোয়াটসঅ্যাপ সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক, মিথ্যা ও বিকৃত খবর দিয়ে দিনকে রাত করছে, রাতকে দিন; উত্তর সত্যের নির্মাণ। কিছুদিন আগেই অমিত শাহ নিজেই দাবি করেছেন এক ঘন্টার মধ্যে বিজেপি’র আইটি সেল গোটা দেশে সোশ্যাল মিডিয়া পরিবেশে যে কোনও খবরকেই, সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন, এক ঘন্টার মধ্যে সর্বত্রগামী ভাইরাল করে তুলতে পারে। সুতরাং আরএসএস বিভাজন ও মেরুকরণের সাথে সংগঠিত হিংসার সংগঠন চোখের পলকে সমাবেশ করতে পারে। এই দানবীয় শক্তির সাথে যুক্ত হচ্ছে মূলত পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিরোধীদের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের কন্ঠরোধ করা। আর, অন্যদিকে যারা এই ঘৃণা এবং বিভাজনের রাজনীতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আইনের তোয়াক্কা না করে তাদের সুরক্ষা দেওয়া।
এর সঙ্গে বাড়তি, বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ। কতটা ভয়ংকর হতে পারে এই অপচেষ্টা তা স্পষ্ট হয়ে গেছে বিচারপতি মুরলীধরের মধ্যরাতে বদলির সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে। বিচারপতি মুরলীধরের বেঞ্চ মাঝরাতে দিল্লি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল তারা যাতে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সুনিশ্চিত করে আর ভরা আদালতে অনুরাগ ঠাকুর, পরবেশ ভার্মা এবং কপিল মিশ্রদের হিংসায় প্ররোচনার ভিডিও দেখিয়ে সলিসিটর জেনারেল এবং সর্বোচ্চ পুলিশ কর্তাদের বাকরুদ্ধ করে এই সমস্ত বিজেপি নেতাদের নামে এফআইআর দাখিল করার নির্দেশ দেন। সেদিনই রাতের অন্ধকারে বদলি করা হয় তাঁকে। আর পরদিনই বদলে যায় আদালতের নির্দেশ।
দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা কতটা নিষ্ক্রিয় ছিল তার নির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণও সামনে এসেছে। হিংসা ও তাণ্ডব চলাকালীন চারদিন (২৪ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে) আক্রান্ত ও সন্ত্রস্ত মানুষের থেকে হিংসা কবলিত এলাকাগুলি থেকে ১৩২০০ জরুরি সাহায্যের জন্যে ফোন এসেছিল। কিন্তু সাহায্য করতে পারা তো দূরে থাক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের লগবুকে প্রতিক্রিয়ার কলমে লিখিতভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এগুলো বকেয়া।
আর শুধু নিষ্ক্রিয়তাই নয়। পুলিশের সক্রিয় অংশগ্রহণেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটি বীভৎস। একটিতে দেখা যাচ্ছে, মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে রাস্তায় ফেলে পিটছে পুলিশ এবং লাঠির ডগায় বাধ্য করছে জনগণমন গাইতে। তাদের মধ্যে একজন ফয়জান পরে মারা যায়। পরিবারের লোকদের অভিযোগ তাদের হেপাজতে থাকাকালীন পুলিশ আরো মারধর করেছে। অন্যত্রও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেও পুলিশের হাতে হেনস্তা হওয়ার একাধিক ঘটনাও সামনে এসেছে।
হিংসার ব্যপকতা এবং আগেয়াস্ত্রর ব্যবহার দেখে প্রত্যক্ষদর্শী এবং মিডিয়া জানিয়েছে, স্থানীয়ভাবে এই পরিমাণে অস্ত্র সমাবেশ ঘটতে পারে না। হিংসাবিধ্বস্ত এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে মানুষ এবং অস্ত্রের আমদানি যথেষ্ট সহজ। মিডিয়া এরকমও খবর দিয়েছে যে আরএসএস লেখা উল্কিকে এই অনুপ্রবেশের কাজে অবাধ লাইসেন্স হিসাবেই দেখেছে পুলিশ।
রাজনীতির কার্যকারণ
দিল্লি নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার দু’সপ্তাহ কাটার আগেই সংগঠিত হলো এই হিংসার ধ্বংসযজ্ঞ। আসলে নির্বাচনের প্রচারের মধ্যেই মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়েছে বিজেপি, বিভাজনের মেরুকরণের। কিন্তু তা মূলত ব্যর্থ হলেও বিজেপি’র ভোট বেড়েছে গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ৭%। যদিও এই সমর্থন ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় অনেকটাই কম।
আরেকটি তথ্য উল্লেখযোগ্য। বিধানসভা ভোটে, বিজেপির জেতা ৮টি আসনের মধ্যেই পাঁচটিই হচ্ছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির এই হিংসা কবলিত এলাকায়। সুতরাং সিদ্ধান্ত করাই যায়, যেহেতু নির্বাচন প্রচারে মেরুকরণ ছাড়া অন্য কোনো এজেন্ডাই ছিল না, সুতরাং নির্বাচনী ফলাফলও আরএসএস ও হিন্দুত্বের রাজনীতির পক্ষে সংহত হওয়ার প্রবণতাও স্পষ্ট। নির্বাচনে বিপুলভাবে হেরে যাওয়ার পর এই জনভিত্তিকে রক্ষা করার জন্যে গেরুয়া বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে।
এই কাজে নির্বাচন চলাকালীনও যেমন এই সাম্প্রতিক হিংসাশ্রয়ী ঘটনাক্রমেও, সিএএ-এনআরসি বিরোধিতাকেই সাম্প্রদায়িক প্রতিরোধ হিসাবে চিহ্নিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা ছিল। এই রকম চিত্রায়ণের চেষ্টা যে ভিত্তিহীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা ঠিক যে দিল্লিতে সিএএ-এনআরসির প্রতিরোধ হয়েছে তীব্র এবং ব্যাপক; খানিকটা দিল্লির রাজনৈতিক সক্রিয়তার ঐতিহ্যের সঙ্গে অনেকটাই ব্যতিক্রমী। কিন্তু প্রতিরোধের বিবর্তনের এই রেখাচিত্র সূত্রপাত ঘটিয়ে ছিল তরুণ এবং ছাত্ররা। জেএনইউ-জামিয়া মিলিয়াতে শুরু হলেও দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলিতেও। এমনকি সংগঠিত আন্দোলনের ঐতিহ্য নেই, এমন প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরাও রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ১৯ডিসেম্বর দেশব্যাপী সিএএ-এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদ এবং ৮ জানুয়ারির ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘটেও ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটে। সেন্ট স্টিফেন্সের মতো কলেজ যেখানে কস্মিনকালেও ছাত্রদের আন্দোলনের কোনো ইতিহাস নেই, তারাও বিপুল সংখ্যায় ৮ জানুয়ারি ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। দিল্লির রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চেতনার এই স্ফূরণ স্বভাবতই আরএসএস বিজেপি-কে আতঙ্কিত করে তুলেছিল।
শাহিনবাগে মহিলাদের সিএএ-এনআরসি বিরোধী লাগাতার ধর্না এর কিছুদিন পরে শুরু হয়েছিল। প্রথমে মূলত মুসলিম মহিলারাই ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সমস্ত অংশের ব্যাপক উপস্থিতি এই অবস্থানকে একটা স্বতন্ত্র গণ আন্দোলনের চেহারা দেয়। দিল্লির মধ্যেও অন্যত্র একাধিক ধর্নাও শুরু হয়ে যায়; আর দেশের একাধিক শহরেও শাহিনবাগের ধারাতেই আরও গণঅবস্থান ছড়িয়ে পড়ে।
রাজনীতির মর্মবস্ততেও এই গণআন্দোলন বাঁধা ছক ভেঙেছে। যেহেতু, এই আন্দোলনে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বহু স্বরের উচ্চারণ ঘটছে এবং নাগরিকত্ব আর সংবিধানের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ আর হননের চেষ্টার প্রতিবাদেই গড়ে উঠেছে , তাই প্রকাশভঙ্গিতেও স্বাধীনতা আন্দোলনের চিত্রকল্পগুলি উঠে আসছে। সংবিধানের মুখবন্ধ , তেরঙ্গা, গান্ধী, আম্বেদকর, জাতীয় সঙ্গীত এই ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মুখপাত্র।
এই চরিত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএসের ব্রিটিশ বান্ধব ভূমিকার স্মৃতিকেও উসকে দিচ্ছে। তাই দিল্লির ভোটে স্থানীয় উন্নয়নের প্রশ্নকে পিছনে ঠেলে দিয়ে , মেরুকরণের লক্ষ্যে সিএএ -এনআরসি বিরোধিতা আর তার প্রতীক শাহিনবাগ আরএসএস- বিজেপির তোপের নিশানা। আর তাই ‘গোলি মারো সালোকো’র রণধ্বনি। ভোটের প্রচারে, ভোটের পরেও। সেই দিক থেকে এই সাম্প্রদায়িক হিংসাযজ্ঞ ছিল বেশ খানিকটা অনিবার্য।
আরএসএসের রাজনীতিও চ্যালেঞ্জের মুখে
৩৭০ ধারা, অযোধ্যা মামলার রায় এবং সিএএ সংসদ থেকে পাশ করানো— গৈরিক বাহিনী ধরেই নিয়েছিল হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু বাধ সেধেছে এই গণ আন্দোলনের প্রতিরোধ। আসলে বিভাজন-মেরুকরণের রাজনীতির লক্ষ্যে সিএএ-এনআরসি মোক্ষম তাস! এক ঢিলে দুই পাখি! বিধ্বস্ত অর্থনীতি আর রুটি রুজির সঙ্কট থেকে নজর ঘোরানো। একই সঙ্গে নাগরিকত্বকে ঘিরে ধর্মীয় পরিচিতির প্রশ্নে চূড়ান্ত আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা আর বিভাজন— এই ছিল রণকৌশল। হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সমাজ ভাবনার পুনর্নির্মাণ!
প্রথমত, সিএএ-এনআরসি প্রসঙ্গ। অমিত শাহ প্রবলভাবে ক্রোনোলজি বুঝিয়েছিলেন ভোটের আগে পরে। এনআরসি করে ‘উইপোকাদের’ তাড়ানো হবে দেশ থেকে। আসামের এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের তালিকা দেখে চক্ষু চড়কগাছ! ১৯ লাখের মধ্যে ১২ লাখই হিন্দু। তীব্র প্রতিক্রিয়া। বরাক উপত্যকার বাঙালি হিন্দুদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে বিজেপি গত ভোটগুলিতে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মিছিল বের করল আসাম সরকারের বাপ বাপান্ত করে। আসাম সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে এনআরসি নতুন করে করবার দাবি তুলল। এদিকে গোটা উত্তর পূর্ব সহ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জ্বলছে সিএএ’র বিরুদ্ধে। আর তারপর সারা দেশ জুড়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সিএএ-এনআরসি’র ত্রিফলার বিরুদ্ধে।
মোদ্দা কথাটা আসাম দেখিয়ে দিয়েছে। কাগজ দেখিয়ে নাগরিক প্রমাণ করাটা গরিব মানুষদের কাছে মৃত্যু পরোয়ানা! ১৯ লাখের পর্যালোচনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এরা প্রায় সবাই গরিব,সহায় সম্বলহীন। এদের মধ্যে কিছু ডিটেনশন ক্যাম্পের অমানবিকতার শিকার ; বাকিদেরও কী হবে, সরকারও বলতে পারছে না। অমিত শাহের হুমকি আর আসামের বাস্তব অভিজ্ঞতা মানুষকে আন্দোলনের রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছে। তাই শত অত্যাচারেও এই অনমনীয় দৃঢ়তা।
কৌশলী পশ্চাদপসরণ। এনআরসি নিয়ে আলোচনাই হয়নি! কিন্তু অতিচালাকিরও মাত্রা থাকে। কারণ এনআরসি আলাদা করে শুরু করবার দরকার নেই। এনপিআর তো শুরু হচ্ছে ১ এপ্রিল। আসলে এনপিআরের কোনো আইনি বৈধতা নেই। কারণ দেশের কোনো আইনেই এনপিআরের উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন কার্যকর করবার রুলসে এর উল্লেখ। এনপিআর এনআরসি’র প্রাথমিক ধাপ। এখানেই ২০১০’র সঙ্গে তফাৎ; তখন এনপিআর ছিল বাসস্থানের তথ্য সংগ্রহের জন্য, আর এখন নাগরিকত্ব প্রমাণের পয়লা ধাপ। তাই কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়া নেই, সম্পূর্ণ অসহযোগিতা !
আসল কথাটা অমিত শাহ যেমন বোঝেন আমরাও বুঝি। আলাদা করে সিএএ কারুর নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারে না, শুধু দিতে পারে। নাগরিকত্ব কাড়বে এনআরসি আর অমুসলিমদের সেটা ফিরিয়ে দেবে সিএএ। তাহলে দাঁড়ালো কী? সংবিধানের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার ; মাঠের বাইরে ছক্কা! আর যদি তর্কের খাতিরে এইসব মিথ্যাচার মেনেও নেওয়া যায় যে গরিব অমুসলিমরা ছ’বছর পর আজকের মতো নাগরিক অধিকার ফিরে পাবে, এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে ছ’বছরের অনাগরিক জীবনে তারা আজকের তুলনায় কী কী হারাবে !
বিজেপি’র চ্যালেঞ্জ শুধু রাস্তার প্রতিরোধেই নয়; একাধিক রাজ্যের বিধানসভা সিএএ বিরোধী প্রস্তাব পাশ করেছে। একাধিক রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে তারা এনআরসি কার্যকর করবে না। এই অবস্থান মূল্যহীন হয়ে যাবে এনপিআর নিয়ে এগোলে। কারণ রাজ্য সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এনপিআর কার্যকর করা অসম্ভব। যারা এইসব অবস্থান নিচ্ছে , তার মধ্যে অনেক এমন দলও আছে যারা সংসদে সিএএ সমর্থন করেছিল।
আর সাম্প্রতিকতম চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক বিরোধিতা। এটা আরো মুখর হয়েছে দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার পর। অভূতপূর্ব ঘটনা ; রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা সুপ্রিম কোর্টে সিএএ নিয়ে মামলায় হস্তক্ষেপ করবার জন্যে আবেদন জানিয়েছে। হিংসা এবং বিভাজনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আরো জোরদার হবে এই নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, অবশ্যই জনসমর্থন। রুটি রুজির সঙ্কটের থেকে মানুষের নজর ঘোরানো যায়নি। দ্বিতীয় মোদী সরকারের আমলে চারটে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এটা দেখিয়ে দিয়েছে।
লড়াই চলবে। দুই ফ্রন্টেই। দিল্লিতে ধর্ম নির্বিশেষে যে ৪৭ জন প্রাণ হারালেন, তাঁদের কসম। যে মানুষ রুটি রুজি ঘরবাড়ি সবকিছু হারালেন, তাঁদের কসম।
একটা কথা বলে দেওয়া ভালো । হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও প্রাণ হারিয়েছেন , তাঁরাও সর্বস্বান্ত হয়েছেন। দুজন পুলিশ কর্মীও প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু বুঝে নেওয়া ভালো এই অমূল্য ক্ষতির জন্য কোন সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে দায়ী করা যায় না।
সংবিধানের বাঁচানোর লড়াইয়ে সিএএ- এনআরসি’র ত্রিফলাকে পর্যুদস্ত করতে যে আক্রমণ শুরু করেছিল আরএসএস-বিজেপি সরকারি প্রশাসন আর মিডিয়াকে সঙ্গে করে, ঘৃণার তীব্র অভিযানে তার পরিণতিতেই এই ট্র্যাজেডি। সংবিধানের উপর আক্রমণের প্রমাণও বিচার ব্যবস্থার অন্তর্ঘাতে।
কাজেই বিকল্প কিছু নেই। বিপন্ন মানুষ, বিপন্ন মানবতা, বিপন্ন সংবিধানকে রক্ষা করবার লড়াই ছাড়া। তার জন্য ব্যাপকতম ঐক্য আর বিপুলতর আন্দোলনের তরঙ্গ। জয় অনিবার্য।