Neo-Liberalism In India: A Retrospective (Part I)

ভারতে ১৯৯১ সাল থেকে নয়া-উদারনীতি ভিত্তিক অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়। তিন দশক পেরিয়ে এসে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্যের নিরিখে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আজকের ভারত? এই প্রসঙ্গেই ফ্রন্টলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি একটি সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়েছে। সেই কথোপকথনের সুত্র ধরে বর্তমান নিবন্ধটি (দুই পর্বে) রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষ থেকে বাংলায় প্রকাশ করা হল।

সীতারাম ইয়েচুরি

প্রথম পর্ব

বামেরা বরাবরই নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক সংস্কারনীতির সমালোচনা করে এসেছে। তিন দশকের উদারনীতির দিকে ফিরে তাকালে কি এমন বলা যায় যে বামেদের সমালোচনা সঠিক ছিল?

অবশ্যই! নয়া-উদারবাদ চিরকালই একটি মুনাফা-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা হিসাবে সক্রিয় থেকেছে, জনগণের কল্যান কোনদিনই তার লক্ষ্য ছিল না। সারা দুনিয়ার সাথে ভারতের অভিজ্ঞতা প্রমান করেছে নয়া-উদারবাদী সংস্কারের তিন দশকে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য আরও ভয়ানক চেহারা নিয়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্যকে উৎকট মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং দেশে যখন অভ্যন্তরীণ চাহিদার তীব্র সংকট চলছে তখন এই বন্দোবস্ত সংকট মোকাবিলার বদলে সর্বাধিক মুনাফা লুটে নিতে মনোনিবেশ করেছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের জীবন ইতিমধ্যেই দুর্বিষহ হয়ে ছিল – মহামারী সেই অবস্থাকে একেবারে সর্বনাশের দিকে ঠেলে নিয়ে গেছে। মার্কস লিখেছেন: “উৎপাদন এবং বিনিময়ের উপায়সমুহকে পুঁজিবাদ বিশ্রীভাবে জট পাকিয়ে ফেলেছে, ঠিক সেই জাদুকরের মতোই, যিনি মন্ত্রোচ্চারনে অলীক সমস্ত ক্ষমতাগুলিকে আহবান করেছিলেন কিন্তু এখন নিজেই আর সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না” – এই কথা আজকের অবস্থা ব্যাখ্যায় একশ শতাংশ সঠিক।

আজকের ভারতে নয়া তিন কৃষি আইনের বিরদ্ধে এবং উৎপাদিত ফসলে এম এস পি (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য)-র আইনি দাবীর লড়াইতে কৃষকদের অভূতপূর্ব সংগ্রামের প্রেক্ষাপটেই তিন দশক ধরে চলা অর্থনৈতিক সংস্কারকে বিচার করতে হবে। একশো বছর আগে যেভাবে নীল চাষের বিরুদ্ধে চম্পারন সত্যাগ্রহ হয়েছিল আজকের দিনে কৃষকদের লড়াই সেই স্মৃতিকেই জাগিয়ে তুলেছে। নোটবাতিল থেকে শুরু করে একের পর এক সরকারি সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী মোদীর হাত ধরে কর্পোরেটরা আমাদের দেশে কৃষিব্যবস্থাসহ ক্ষুদ্র উৎপাদনের গোটা বাজারটাকেই দখল করতে চাইছে। আজকের ভারতে উদ্ভুত খাদ্য সংকট অচিরেই এক দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করছে।

ভারতে অর্থনৈতিক সংস্কারকে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির নিয়ন্ত্রনাধীন নয়া উদারবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই দেখতে হবে। উদারবাদের একমাত্র উদ্দেশ্যই হল আরও আরও মুনাফা – এটাই পুঁজিবাদের প্রকৃত চরিত্র যা আসলে সমাজকে “পাশবিক প্রবৃত্তি”র দিকে টেনে নিয়ে যায়। একদিকে উপযোগিতামূলক এবং সরকারী পরিষেবাসহ যাবতীয় খনিজ যা আসলে জনসাধারণের সম্পদ তাকে ব্যাপকহারে বেসরকারি মালিকানার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে আবার দেশের নাগরিকদের উপরেই নানা কায়দায় ‘ব্যবহার শুল্ক’ আরোপ করা চলছে। গোটা পৃথিবীসহ ভারতেও নয়া উদারনীতি কর্পোরেটদের হাতে দেশের সম্পদকে উপহার হিসাবে তুলে দেবার বন্দোবস্ত করেছে। এই বন্দোবস্তে এখনও অবধি সারা পৃথিবীতে ধনীদের জন্য প্রায় ৭৯ শতাংশ কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ধনকুবেররা ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার ধাক্কা সামলে তাদের সম্পদ মাত্র তিন বছরেই পুনরুদ্ধার করে নেয় এবং ২০১৮ সাল নাগাদ তারা সেই সম্পদ দ্বিগুন বাড়িয়ে নিতে পেরেছে। এহেন সম্পদ বৃদ্ধি আদৌ উৎপাদনের মাধ্যমে হয় নি। এই বৃদ্ধি পুরোটাই ফাটকা ব্যবসার মাধ্যমে আর তাই বিশ্বব্যাপী মন্দা শেয়ারবাজারে কোনরকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।

অন্যদিকে, বিশ্বজুড়ে ৮০ শতাংশ মানুষের আয় এখনও ২০০৮-এর মন্দা-পূর্ব স্তরে অবধি পৌঁছাতে পারেনি। ১৯৭৯ সালে আমেরিকায় ট্রেড ইউনিয়ন প্রতি চারজন শ্রমিকের মধ্যে একজনের প্রতিনিধিত্ব করতো, আজ সেই অনুপাত আরও বেড়ে প্রতি দশজন শ্রমিকে একজনের প্রতিনিধিত্বে পৌঁছেছে। এমন অবস্থার কারন সংগঠিত ক্ষেত্রসহ শ্রমিকশ্রেণীর যাবতীয় অধিকারকেই নাকচ করা হচ্ছে।

জেফ বেজোসের ব্যাক্তিগত মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দিতে অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক বৈষম্য নির্ধারণ বিভাগের প্রধান দীপক জেভিয়ার বলেছেন: “আমরা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার আকৃতির বৈষম্যের যুগে এসে পৌঁছেছি। কারোর এগারো মিনিটের জন্য মহাকাশ ভ্রমনের প্রস্তুতি নেওয়ার প্রতি মিনিটেই সারা পৃথিবীতে অন্তত এগারো জন মানুষ খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে। এমন মহাকাশ ভ্রমণ কোন গর্বের বিষয়ই নয়, এসব আমাদের মুর্খামি।”

শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করে এবং অন্যায্য কর ব্যবস্থার জোরে অতি-ধনীদের সুখের সন্ধান করা চলছে। মহামারী শুরুর পর থেকে এখনও অবধি মার্কিন ধনকুবেররা প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছেন এবং কোভিড সংক্রমনের প্রথম পর্বে ভ্যাকসিন বিপননের বাজারে একচেটিয়া নতুন নয়জন ধনকুবের তৈরি হয়েছেন।

মহামারীর শুরু হবার পর থেকে এখনো অবধি সারা পৃথিবীতে অর্থনীতি সচল রাখতে ১৮ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি প্রায় ১১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, প্রতি ঘন্টার হিসাবে ৮৩৪ মিলিয়ন ডলার। যখন ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং বঞ্চনার শিকার হচ্ছে লক্ষ্য কোটি মানুষ সেই সময়েই এতো বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগের যজ্ঞ চলছে অথচ তাতে মানুষের কল্যানের কোন সুযোগ নেই। বিলিয়নিয়াররা এই ফুলে-ফেঁপে ওঠা শেয়ারবাজারের ভরসাতেই সমৃদ্ধ হয়েছেন। গভীর অর্থনৈতিক মন্দার সংকট যখন দগদগে ঘায়ের চেহারা নিয়েছে তখন শেয়ার বাজারে এহেন চড়চড়ে উত্থান আসলে একটি বুদবুদদের মতো – কিন্তু বুদবুদের ফুলে ওঠারও একটা সীমা থাকে। সেই বুদবুদ একটা সময় বিস্ফোরণের মতোই ফেটে পড়বে যাতে অর্থনীতির আরও ধ্বংসসাধন হবে, অনেক দেশ একসাথে খাদের কিনারায় পৌঁছাবে।

৮০’র দশক অবধি বামেরা নেহেরু জমানার অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলিরও সমালোচনা করত। আজকের শাসক যে নীতি নিয়ে চলছে তাকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রেও কি একই দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে নাকি আলাদা?

এটা ঠিক যে আমরা নেহেরুভিয়ান অর্থনৈতিক মডেলের সমালোচক ছিলাম। সেই সমালোচনার ভিত্তি ছিল স্বাধীনতার লড়াই চলার সময় ভারতের জনসাধারনের প্রতি সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে স্বাধীন ভারত ও তার স্বরূপ সম্পর্কে যেসকল প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, স্বাধীনতা লাভের পর দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন হয়ে বুর্জোয়া – জমিদার জোট তাদের সাথে কার্যত বিশ্বাসঘাতকতা করে। বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে জমিদারশ্রেণীর সাথে তাদের এই রাজনৈতিক জোট আসলে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে দেশের বাস্তব উন্নয়নের সম্ভাব্য সকল পথ রুদ্ধ করেছে, জনসাধারন প্রতারিত হলেন এই কারনেই। স্বাধিন ভারতে দারিদ্র, বুভুক্ষা, বেকারি এবং শিক্ষা কোনদিকেই পূর্বাবস্থার কোন পরিবর্তন হল না, বরং দুরবস্থা আরও বাড়ল – এখানেই প্রতারনা। নেহেরুভিয়ান মডেলের ব্যাখ্যায় যতই সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের একটা বন্দোবস্তের কথা প্রচার করা হোক না কেন আসলে তা ছিল পুঁজিবাদী বন্দোবস্ত।

বর্তমানে অর্থনৈতিক নীতির নামে যা চলছে তাকে কিছুটা অন্য বাস্তবতার উপরে দাঁড়িয়ে সমালোচনা করতে হবে। নেহরু জমানা নিজের সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্বেও ইতিবাচক যা কিছু, যতটুকু অর্জন করতে পেরেছিল তাও বর্তমান ব্যবস্থায় দ্রুততার সাথে ধ্বংস করা হচ্ছে। যোজনা কমিশন এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত পাবলিক সেক্টরগুলি (পিএসইউ) কার্যত দেশের অর্থনীতিকে দিশা দেখানোর এক প্রচেষ্টা ছিল যা ভারতের জন্য এক স্বাধীন অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয়।

মোদি সরকার অনুসৃত নয়া-উদারবাদের আগ্রাসী নীতিসমূহ নির্মমভাবে জাতীয় এবং স্বাধীন অর্থনীতির সেই ভিতকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। এহেন ধ্বংসলীলা শুধু শিল্পক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় বরং কৃষির প্রশ্নেও তারা আগ্রাসী আর তাই নতুন করে নয়া কৃষি আইনের নামে আসলে দেশের গোটা কৃষি ব্যবস্থাটাই মুনাফাখোরদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

অত্যন্ত হাস্যকর হলেও একথা সত্যি যে বেসরকারি মালিকানা, বেসরকারি পুঁজি যাতে আরও বেশি সমৃদ্ধ হতে পারে সফল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রগুলি অন্যান্য দায়িত্বপালনের পাশাপাশি সেই ভুমিকাও পালন করেছে।  আর কিছু না হোক যাতে ভারত কোনোভাবেই পশ্চিম গোলার্ধের অর্থনৈতিক শক্তিসমূহের বশংবদে না পরিণত হয় সেই কাজে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলি নিশ্চিতভাবেই সফল হয়েছে, যদিও একথাও মনে রাখতে হবে যে সেইসব বৈদেশিক শক্তির সমীপে আমাদের অর্থনীতির একটা নির্ভরতা রয়েই গেছে। এই বাস্তবতার ভিত্তিতেই দেশের স্বাধীন অর্থনৈতিক সত্বা এবং জাতীয় সম্পদ লুঠ রুখে দেবার প্রশ্নে আমরা, বামেরা আজও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রগুলিকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে লড়াই – আন্দোলন করছি।

এমনও তো কিছুজন রয়েছেন যারা বিশ্বাস করেন যে অর্থনৈতিক উদারীকরণের কারনেই মানুষের আয়ের সুযোগ বেড়েছে এবং দেশে প্রভুত সম্পদ তৈরি হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জন্য নয়া-উদারবাদ কি কেবলই এক আক্রমনের নাম? এর কি আর কোন ব্যাখ্যা নেই?

নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক সংস্কারের একমাত্র পরিণতি হল উৎকট অর্থনৈতিক বৈষম্যের বহুগুনে পরিসর বৃদ্ধি পাওয়া। ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ সর্বদা ‘সাফারিং ইন্ডিয়ার’ কাঁধে চেপে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ যত বেশি উজ্জ্বল হয়েছে সেই একই অনুপাতে ‘সাফারিং ইন্ডিয়ার’ অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।

২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে এখনো অবধি ভারতের একশজন বিলিয়নেয়ার মোট ১২,৯৭,৮২২ কোটি টাকা মূল্যের ব্যাক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন। এই টাকায় দেশের ১৩৮ কোটি গরীব জনতার প্রত্যেককে মাথাপিছু ৯৪,০৪৫টাকার চেক দেওয়া যায়।   

মহামারী চলাকালীন মুকেশ আম্বানির এক ঘন্টার সম্পদ বৃদ্ধিকে ছুঁতে একজন অদক্ষ শ্রমিকের ১০ হাজার বছর সময় লাগবে (বর্তমান গড় মজুরির হিসাবে) এমনকি প্রতি সেকেন্ডে তার যেটুকু সম্পদ বাড়ছে সেটুকু রোজগার করতেও লেগে যাবে তিন বছর। ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সাম্প্রতিক চেহারা ব্যাখ্যা করতে অক্সফ্যামের পক্ষ থেকে এমনই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। তারা এহেন অমানবিক বৈষম্যের নাম দিয়েছে “দ্য ইনইক্যুয়ালিটি ভাইরাস”।

সংশ্লিষ্ট তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রতি ঘণ্টায় ১,৭০,০০০ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন। লকডাউন চলাকালীন ভারতীয় ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৩৫ শতাংশ এবং ২০০৯ সাল থেকে হিসাব করলে দেখা যাবে সেই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশে পৌঁছে গেছে, যার মূল্য ৪২২.৯ বিলিয়ন ডলার। মহামারী চলাকালীন ভারতের শীর্ষস্থানীয় ১১জন ধনকুবেরের মোট সম্পদের বৃদ্ধি আগামী ১০ বছরের জন্য MGNREGS [মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প] খাতে বা একই সময় ধরে জাতীয় স্বাস্থ্যবাজেটের খরচের সমান।

জনগণের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্রতম, তাদের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশের স্বাস্থ্যসম্মত শৌচালয় ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। একই ক্ষেত্রে দেশের ২০ শতাংশ ধনীদের মধ্যে ৯৩.৪ শতাংশই তাদের প্রয়োজনের উপযুক্ত সুবিধা খরিদ করতে সক্ষম। দেশের ৫৯.৬ শতাংশ মানুষেরই মাথার উপরে সামান্য এক কামরার একটি নির্ভরযোগ্য, উপযুক্ত ছাদ অবধি নেই।  

জনস্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয়ের নিরিখে ভারত সারা বিশ্বে চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। মহামারী চলাকালীন ভারতের শীর্ষস্থানীয় ১১জন ধনকুবেরদের মোট সম্পদ বৃদ্ধির উপরে মাত্র ১শতাংশ হারে কর ধার্য করা গেলে “জনৌষধী প্রকল্প” খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যাবে প্রায় ১৪৪ গুণ, যা দিয়ে দরিদ্র এবং প্রান্তিক প্রতিটি ভারতবাসীর জন্য অত্যন্ত কম খরচে যাবতীয় ঔষধ সরবরাহ করা যেতে পারে।

বিগত তিনদশক ধরে চলা নয়া-উদারনীতি আসলে দেশের বুকে অর্থনৈতিক বৈষম্যকেই তীব্রভাবে বৃদ্ধি করেছে। আগেও উল্লেখ করেছি এই ব্যবস্থা আদৌ জনকল্যাণমূলক নয় বরং বলা চলে প্রথম থেকেই মুনাফা-কেন্দ্রিক উদারনীতি মুনাফাখোরিতেই মনোনিবেশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী আজকাল  সম্পদ সৃষ্টিকারীদের সম্মান জানানোর জন্য বলছেন। সম্পদ বলতে কী বোঝায়? সোজা কথায় সম্পদ হল মূল্যের আর্থিক সুচক। যে কোন সম্পদই (মূল্য অথবা দাম যেভাবেই তাকে বিচার করা হোক না কেন) শ্রমজীবী ​​মানুষের দ্বারা উত্পাদিত হয়। সম্পদের সৃষ্টিকারীদের যদি প্রকৃতই সম্মান দিতে হয় তবে মূল্যের (অথবা সম্পদের) প্রকৃত নির্মাতাদেরই (শ্রমজীবী মানুষ) সম্মান জানানো উচিত।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারত যাকিছু অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করছিল যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে, কার্যত মোদী সরকার সেই সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। যেমন, স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দেশে দারিদ্র্যের মাত্রা নিরুপন করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানবদেহে গড় পুষ্টির অবস্থাকে একটি স্বীকৃত মাপকাঠি বলে ধরা হত – এখন তা আর হচ্ছে না। গ্রামীণ ভারতে দিনপ্রতি মাথাপিছু ২,২০০ ক্যালোরি এবং শহরাঞ্চলে ঐ একই প্রকারে ২,১০০ ক্যালোরি ছিল পুষ্টির ন্যুনতম সুচক হিসাবে নির্ধারিত গড়। এনএসএস [জাতীয় নমুনা সংগ্রহ-নিরীক্ষণ প্রকল্প] দ্বারা দেশজোড়া নিরীক্ষণে দেখা যায় ঐ মাপকাঠি অনুযায়ী, ১৯৯৩-৯৪ সাল নাগাদ গ্রামের ৫৮শতাংশ এবং শহরের ৫৭শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। ২০১১-১২ সালে পরবর্তী অনুরূপ এনএসএস সমীক্ষা দেখায় যে এই শতাংশ ছিল যথাক্রমে ৬৮ (গ্রামাঞ্চলে) এবং ৬৫ (শহরাঞ্চলে)। পরবর্তী বড় আকারের এহেন সমীক্ষা হয়েছিল ২০১৭-১৮ সালে। সরকারী বিধিনিষেধের কারনে এখনো অবধি সেই সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় নি। তথ্যসংরক্ষণে বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করছে মোদী সরকার। বিভিন্ন সময়ে মিডিয়াতে ফাঁস হয়েছে এমন কিছু তথ্য যার ভিত্তিতে বলা যায় গ্রামীণ ভারতে মাথাপিছু সার্বিক ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে ৯শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে মহামারীর প্রকোপ শুর হবার অনেক আগে থেকেই ভারতের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে নিশ্চিত দারিদ্র্যের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি ঘটেছে। মহামারীর ফলে সেই পরিস্থিতি বর্তমানে আরও খারাপ হয়েছে।

বিশ্ব ক্ষুধার সুচকের ভিত্তিতে বর্তমান ভারত “আশংকাজনক দেশ”-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের পঞ্চম পর্যায়ে দেশে অপুষ্টির চিত্রে আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, শিশুমৃত্যুসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূচকের ভিত্তিতে শিশুস্বাস্থ্যের অবস্থা আরও বেশি খারাপ। সম্প্রতি, স্থায়ী উন্নয়ন সম্পর্কিত বিশ্বসূচকের তালিকায় ভারত আগের চাইতে আরও দুধাপ নিচে নেমে গেছে। পেউ নামক একটি অর্থনৈতিক নিরীক্ষণ সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল ৬০ মিলিয়ন যা এখন বেড়ে হয়েছে ১৩৪ মিলিয়ন। দেশে মধ্যবিত্তদের ৫৭.৩ শতাংশ এই পর্বে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছেন।

*দুই পর্বে সমাপ্ত

*দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

Spread the word

Leave a Reply