প্রাককথন
গত দুটি পর্বে আমরা যে আলোচনা করেছি তার দুটি মূল কথা- ১) পরিবেশের সংকট আচমকা সামনে চলে আসা কোনও দুর্ঘটনা নয়, ২) বিজ্ঞান সচেতনতার আসল শিকড় শুধুমাত্র স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে নয়, তা প্রোথিত রয়েছে ঐতিহাসিকরূপে বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোয়। এহেন কথাবার্তার উদ্দেশ্যে কোনওরকম ভনিতার সুযোগ নেই। যে সমাজব্যবস্থার সুবাদে উক্ত সংকট ক্রমাগত বিপদ বাড়িয়ে চলছে সমস্যা হিসাবে শুধুমাত্র সেই বিপদকেই বিবেচনায় রাখা কতটা কাজের কাজ? পরিবেশের সুংকট, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রসঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির আসল লক্ষ্য কি তবে সমাজ বদল নয়?
তাই মনে রাখতে হয়- ইট ইস নট লাইক দ্যেয়ার ইস আ ফল্ট ইন দ্য সিস্টেম, র্যাদার দ্য সিস্টেম ইটসেলফ ইস ফল্টি। সুতরাং সেই জরুরী বদলের সম্ভাব্য পরিকল্পনায় বিজ্ঞানসম্মত যাবতীয় বিকল্পের ধারনা সঞ্জাত হয়েই এমন আলোচনা শেষ করতে হয়। প্রকৃতিকে নিজেদের থেকে আলাদা কোনও বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে সেই দায় মিটবে না, ক্যাপিটালিজম নিজের ক্ল্যাসিক যুগ থেকে আজকের ক্রোনিনেস অবধি পৌঁছেও যে ব্যাপারটা কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পারছে না তার কারণ আসলে ওটাই।
এখানেই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ভূমিকা। কেউ কেউ এই অবধি এসেই ‘সামাজিক মডেল’ ইত্যাদির কথা ভেবে আশংকিত হতে পারেন, তাতে তারা ব্যতীত অন্যদের খুব একটা অসুবিধা হবে না। আমরা তো সেই কবে থেকেই জানি, সমাজ পরিবর্তনের ধারায় আগামী পর্বটি আদৌ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হিসাবে সমাধা হবে না। এযাবৎ কাল অবধি সমাজ এগিয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে ঠিকই- কিন্তু তার গোড়ায় ছিল বিকশিত উৎপাদিকা শক্তির সাথে পিছিয়ে পড়া উৎপাদন সম্পর্কের সংঘাত। আগামী যুগে ঐ ব্যপারটি প্রথমবার সামাজিক মানুষের সচেতন সক্রিয়তার জোরে ঘটবে।
যাবতীয় ইউটপিয়ার জাল ছিঁড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই এহেন সমাজতন্ত্রকে আমরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলি।
আজ লেখার তৃতীয় এবং শেষ পর্ব।
পর্ব ৩
শ্যামাশীষ ঘোষ
আজকের সমস্যা ও রাজনীতির প্রশ্নগুলি
এ পর্যন্ত বিদ্যমান সকল উৎপাদন পদ্ধতির লক্ষ্য ছিল শ্রমের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ও প্রত্যক্ষভাবে কার্যকরী প্রভাব অর্জন করা। পরবর্তী পরিণতিগুলি, যা কেবল অনেক পরে দেখা দিয়েছিল তা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত ছিল। শাসক শ্রেণীর স্বার্থই উৎপাদনের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে, উৎপাদন আর জনগণের জীবিকার ন্যুনতম উপকরণ সরবরাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা আজকের বিরাজমান পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে সর্বাত্মকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। পুঁজিপতিরা, যারা উৎপাদন ও বিনিময়ের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, তারা কেবল তাদের ক্রিয়াকলাপের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক কার্যকর প্রভাব নিয়ে ভাবনার মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখে। প্রকৃতপক্ষে, এমনকি এই দরকারী প্রশ্নটিও – উৎপাদিত বা বিনিময় করা পণ্যের উপযোগিতার প্রশ্ন – পিছনে চলে যায় এবং বিক্রয়ের উপর মুনাফা অর্জনই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।
পুঁজি প্রথমে এসেছিল আগের শতকের বনিকদের লাভের থেকে, নতুন-আবিষ্কৃত দেশগুলির দাসেদের পরিশ্রম বা উপনিবেশের প্রায় খোলাখুলি লুণ্ঠনের থেকে। একদিকে তাদের সস্তা পণ্য যেখানে যেখানে পৌঁছেছিল সেখানকার স্থানীয় শিল্পকে ধ্বংস করেছিল। অন্যদিকে আরো শ্রমিকের এবং খাদ্যের চাহিদা তৈরি করেছিল। এই চাহিদাই অর্থকরী শস্যের কৃষিতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। কৃষিতে প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সাথে খামারে ফসলের উৎপাদনের জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন কমতে থাকে, একটি বড় অংশের মানুষকে শহরে টেনে আনে। আধুনিক শিল্পকেন্দ্র ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রিটেন থেকে সারা বিশ্বে। প্রকৌশলের সমস্ত নতুন বিজয়ের সাথে একটি ধোঁয়াময় ময়লা, অপরিচ্ছন্নতা এবং কদর্যতা এসেছিল যা পূর্ববর্তী কোনও সভ্যতা তৈরি করতে পারেনি। এই পরিবেশেই বিজ্ঞান তার ক্রিয়াকলাপ এবং গুরুত্বের বর্তমান মাত্রার কাছাকাছি পৌঁছেছিল।
বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সামাজিক বিজ্ঞান, উৎপাদন ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে মানুষের ক্রিয়াকলাপের সামাজিক প্রভাবগুলি পরীক্ষা করে। এই শাস্ত্র সম্পূর্ণরূপে যে পুঁজিবাদী সামাজিক সংগঠনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তারই তাত্ত্বিক প্রকাশ। যেহেতু ব্যক্তি পুঁজিপতিরা তাৎক্ষণিক মুনাফার জন্য উৎপাদন ও বিনিময়ে নিয়োজিত থাকে, সেহেতু তারা সর্বপ্রথম তার নিকটতম ও সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ফলাফলগুলোই বিবেচনায় নেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বতন্ত্র উৎপাদক বা বণিক স্বাভাবিক ঈপ্সিত মুনাফা সহ একটি উৎপাদিত বা ক্রয় করা পণ্য বিক্রি করতে পারে, ততক্ষণ সে সন্তুষ্ট থাকে এবং পণ্য এবং এর ক্রেতাদের পরে কী হয় তা নিয়ে নিজেকে উদ্বিগ্ন করে না। এইধরনের কর্মের প্রাকৃতিক প্রভাবের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। প্রকৃতির সম্পর্কে, সমাজের ক্ষেত্রেও বর্তমান উৎপাদন পদ্ধতি প্রধানত কেবল তাৎক্ষণিক, সবচেয়ে বাস্তব ফলাফল নিয়েই চিন্তিত; এবং তারপরে বিস্ময় প্রকাশ করা হয় যে এই লক্ষ্যে চালিত কাজগুলির আরও দূরবর্তী প্রভাবগুলি বেশ আলাদা হয়ে যাচ্ছে, এবং বেশিরভাগই বিপরীত চরিত্রের। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তথাকথিত উন্নত দেশগুলির ভাবনাচিন্তা অনেকটা এই রকমই। বছরের পর বছর নতুন নতুন লক্ষ্যমাত্রা স্থাপিত হচ্ছে, আর কাজকর্ম পরিচালিত হচ্ছে এমনভাবে যাতে পুঁজিপতিদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আবার পরের সম্মেলনে উদ্বেগ প্রকাশ, আবার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ!
এইভাবে মানবজাতি তার শারীরিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে আজ ভয়ানক হুমকির সম্মুখীন: পারমাণবিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক যুদ্ধ, গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব এবং ওজোন স্তরে গর্ত দ্বারা চিহ্নিত পরিবেশ ধ্বংসের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি, গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস, উষ্ণায়ন, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিশাল অংশের মরুকরণ এবং সব মিলিয়ে অতিমারী পর্যায়ের বিপর্যয়ের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনার মুখোমুখি আমরা।
সদিচ্ছা থাকলে কি এর কিছুটা সমাধান করা যায় না? শুধু একটি উদাহরণ: আফ্রিকার মরুকরণকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেওয়ার জন্য একটি বাস্তব, গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি অনায়াসেই কাজে লাগানো সম্ভব। সেচের মাধ্যমে মরুভূমিকে আবার একটি সমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলে পরিণত করা যায়, যেমন এটি ১৫০০ বছর আগে ছিল। এর অধিবাসীদের প্রকৃতি সংরক্ষণকারী কৃষি কৌশল প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করা যায়, যাতে তারা বাণিজ্যিক ফসল থেকে এমন ফসলের দিকে ফিরে যেতে পারে যা তাদের স্বাস্থ্যকর উপায়ে খাওয়ার যোগান দিতে সক্ষম। বিশ্ব জলবায়ুর উপর একটি সবুজ, বনসমৃদ্ধ সাহারার প্রভাব সত্যিই অত্যাশ্চর্যকর হবে। এক্ষেত্রে সমস্যার যে সমাধান দরকার তা কারিগরি, প্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক নয়– এটি একটা সামাজিক সমাধানের বিষয়। এই সমাধানটি প্রয়োগ করার জন্য, এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে লোভ, সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যয় নির্বিশেষে ব্যক্তিগত সম্পদ জমা করার ইচ্ছা এবং দীর্ঘমেয়াদী যৌক্তিকতার পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদী ছদ্ম-যৌক্তিকতা সামাজিক ও অর্থনৈতিক আচরণ নির্ধারণ করে না। আমাদের প্রয়োজন এমন এক সামাজিক শক্তির হাতে ক্ষমতা, যা ব্যক্তি, শ্রেণী এবং শ্রেণীর প্রধান অংশকে সমাজের বড় অংশের উপর তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। অদূরদর্শী অহংবোধ ও দায়িত্বহীনতার ঊর্ধ্বে গণতান্ত্রিক উপায়ে সংহতি, সহযোগিতা ও উদারতাকে প্রাধান্য দিতে ইচ্ছুক খেটে খাওয়া প্রকৃতির সাথে সর্বাধিক সম্পৃক্ত মানুষের হাতে ক্ষমতা থাকা দরকার।
প্রথাগত বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলন কেবলমাত্র পরিবেশ প্রসঙ্গে সচেতনতা বাড়ানোর কাজেই নিজেদের ব্যস্ত রাখে– ‘সচেতন হোন, গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। কিন্তু এটা শুধু সচেতনতার প্রশ্ন নয়। ধনী, ক্ষমতাবানরা তো আর নিছক বোকা নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই পরিবেশগত বিপদ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। তারা তাদের বিবেচনায় এইগুলি অন্তর্ভুক্ত চেষ্টাও করে কখনও, তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং প্রক্ষেপণে অন্তর্ভুক্তও করে, কিন্তু প্রতিযোগিতার চাপে তারা এমনভাবে কাজ করতে বাধ্য হয় যে সামগ্রিক হুমকি থেকেই যায়। বিজ্ঞান আন্দোলন যদি এই রাজনীতি না বোঝে বা পাশ কাটাতে চেষ্টা করে, তাহলে এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নেই। গাছ পোঁতা যেতেই পারে, যদিও যত্রতত্র এলোমেলোভাবে গাছ পোঁতার থেকে পরিকল্পনা করে কিছু কিছু অঞ্চলে বনসৃজনের প্রচেষ্টা হবে অনেক কার্যকরী। আর গাছ পোঁতার চেয়ে গাছ কাটার প্রতিরোধ অনেক বেশি ফল দিতে পারে।
বিজ্ঞানের ধারণাগুলিকে তার সামাজিক প্রভাব থেকে আড়াল করার জন্য “বিশুদ্ধ বিজ্ঞান” এর একটি ধারণা তৈরি করা হয়েছে, যাতে একে শিল্পের জন্য লাভজনক করে তোলা যায়। আইনের এবং অর্থনীতির কড়া নিয়মের অধীনেই পুঁজিবাদীর অবাধ ক্ষমতার স্বীকৃতি এসেছিল। পুঁজিপতিরা বিজ্ঞানকে সাগ্রহে ব্যবহার করেছিল যখন এটি মুনাফা বাড়ানোর জন্য তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করেছিল। বিজ্ঞানকে লাভজনক করার প্রক্রিয়ায় পুঁজিপতিরা বৃহৎ আকারের সামাজিক উৎপাদন পদ্ধতির পথ দেখিয়েছিল। একই সাথে তারা এমন একটি শ্রমিক শ্রেণিকে অস্তিত্বে এনেছে, যাদের কাছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে অমানুষিক পরিশ্রম, নিরাপত্তাহীনতা এবং অভাবের। পুঁজিবাদের উত্থানই ঘটেছিল অত্যধিক সম্পদ এবং চরম দারিদ্র্যের সাথে। কেউ কেউ বলেন যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তাদের নিজস্ব একটি অপ্রতিরোধ্য যুক্তি তৈরি করেছে, এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত বিকাশ মানবজাতিকে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে, তবে এটি জিনিসগুলিকে দেখার সঠিক উপায় নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও শক্তি নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির, যে সামাজিক গোষ্ঠী তাদের আবিষ্কার করে, তাদের প্রয়োগ করে এবং তাদের স্বার্থের অনুসারী করে তোলে তার থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র কোনও নিজস্ব শক্তি নেই। বিজ্ঞানকে একটি রহস্য হিসাবে মুষ্ঠিমেয় কয়েকজনের হাতে সীমাবদ্ধ করে রাখলে, তা শাসকশ্রেনির স্বার্থের সাথেই যুক্ত হয়ে পড়ে এবং জনসাধারণের প্রয়োজনীয়তা এবং ক্ষমতার থেকে উঠে আসা উপলব্ধি এবং উৎসাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যেমনটি হয়েছে পুঁজিবাদের বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে। মূল সমস্যা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থে সচেতন সামাজিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা; বিশেষ স্বার্থের বশ্যতা থেকে মুক্ত করা, যা মানব জাতির দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের তোয়াক্কা না-করে তাদের অপব্যবহার করে। সেই উদ্দেশ্যে সমাজের সংগঠন ও কাঠামোকে অবশ্যই গণতান্ত্রিকভাবে নির্ধারিত, সচেতন নিয়ন্ত্রণের অধীন হতে হবে।
শাসক শ্রেণীর স্বার্থে সবসময়ই এটা বিশ্বাস করানোর প্রচেষ্টা ছিল, সমাজের বিদ্যমান ব্যবস্থা সর্বকালের জন্য ঐশ্বরিকভাবে নির্ধারিত হয়েছে। সামন্তবাদের সীমাবদ্ধতা থেকে বুর্জোয়া মুক্তির মহান আন্দোলনগুলি সবই ঘটেছিল এমন সময়ে যখন সমাজের এই ভিত্তিগুলি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। মানব ইতিহাসের কেন্দ্রীয় ভাবনাটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েন এবং মুক্তির একটি ক্রম; এই মুক্তি বা বিপ্লবের সময়কালেই সমাজপ্রকৃতির তত্ত্বগুলি পরীক্ষিত এবং পুনর্গঠিত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন সমাজতন্ত্রের নামে শ্রমিকশ্রেণি পুঁজিবাদের সামাজিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে, তখন সামাজিক সমালোচনা ও বোঝাপড়ার একটি নতুন ক্রম চালু হয়। সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্র – সমাজের কাঠামো এবং এর প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার এবং কর্তব্য – এর আগে কখনও এই ধরনের অনুসন্ধান এবং উৎসাহী বিতর্কের বিষয় ছিল না। শুধু বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক অংশেই নয়, যেখানেই শ্রেণিসমাজের নিপীড়ন বা ঔপনিবেশিক নিপীড়নের সমালোচনা ও বিরোধিতা করার জন্য মানুষ একত্রিত হয়েছে, সেখানেই নতুন ধরনের সামাজিক বিজ্ঞান গড়ে উঠেছিল।
শেষ বিশ্লেষণে সমাজতন্ত্র বলতে যা বোঝায় তা হলো জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য সম্ভাব্য সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের স্বাধীনতা জয় করা। এটা সকল মেহনতকারী মানুষের জন্য সত্য, যারা তাদের শ্রমশক্তি বিক্রি করার অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার অধীনে রয়েছে এবং যারা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে আজ বৃহত্তর জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে।
গোটা দুনিয়ার টেঁকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রশ্নে সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত একটি জরুরী বিষয়। সোভিয়েতের পতন এবং পরবর্তী নানা ঘটনাবলী এই বিশ্বাসযোগ্যতার উপরে একটি প্রশ্নচিহ্নের জন্ম দিয়েছে। সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট সমাধানের একটি প্রয়োজনীয় শর্ত হলো সমাজতন্ত্র ও মানবিক স্বাধীনতার একত্রীকরণ। পরিবেশ সহ যে কোনো সমস্যার প্রশ্নে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই, একে কিছুটা শুধরে নেওয়ার মাধ্যমে, বর্তমানের দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সমাধান খোঁজার চেষ্টাই আমাদের এক গোলকধাঁধার মধ্যে রেখে দিয়েছে। নানা উদারনৈতিক গনতন্ত্রীও, গণতন্ত্র বাঁচানোর সংগ্রামে যাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য, একেই ভবিতব্য হিসাবে হাজির করছেন – এই ব্যবস্থার পরিবর্তন তাঁরাও চান না। আমাদের সংগ্রাম করতে হবে শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে, সমাজতন্ত্রের পক্ষে, মানবজাতির দৈহিক অস্তিত্বের পক্ষে। কারণ এটাই আজ আসল সিদ্ধান্ত। সমাজতন্ত্র বা বর্বরতা নয়, প্রশ্নটা হল সমাজতন্ত্র নাকি মানব জাতির শারীরিক বিলুপ্তি।
সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে মৌলিক মানুষের বোধগম্য উপায়ে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ও প্রচার, লেনিন যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলিকে সহজবোধ্য আকারে মানুষের কাছে রেখেছিলেন। এই বর্তমান সমাজকে একটি মৌলিকভাবে ভিন্ন সমাজ দ্বারা প্রতিস্থাপন না করে মানবজাতিকে রক্ষা করা যাবে না। এটাকে যে নামই দেওয়া হোক না কেন, এর বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট করতে হবে, সমাজতন্ত্রের বিষয়বস্তু হিসাবে যেটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এই কঠিন কিন্তু একান্তভাবে প্রয়োজনীয় কাজ চালাতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে প্রাককথন- সৌভিক ঘোষ