জিএসটি হারের আপৎকালীন নিম্নমুখী সংশোধন
দুর্ভাগ্যবশত, সামনে লোকসভা নির্বাচন দেখে কেন্দ্রীয় সরকার পণ্যের উপর করের হার কমানোর উদ্যোগ নেয়, বিশেষ করে ২৮ শতাংশ হারের পণ্যের ওপর।এই হ্রাসের প্রভাব রাজস্ব সংগ্রহে কী হবে সে সম্পর্কে কোনও মূল্যায়ন উপস্থাপন করা হয়নি। নির্বাচনের প্রাক্কালে কোনো অর্থমন্ত্রীই এ ধরনের কমানো নিয়ে আপত্তি করতে পারেননি। খুব শীঘ্রই তারা হার কমানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছিল ২৮ শতাংশ হারের ওপর যা কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। হার কমানোর এই তাড়াহুড়োর সিদ্ধান্ত নতুন হারগুলিকে আর রাজস্ব নিরপেক্ষ রাখে না।
এটি ছিল জিএসটি জমানায় রাজস্ব বৃদ্ধি না পাওয়ার প্রাথমিক কারণ।এখন সবাই ভুল বুঝতে পেরেছে এবং নিশ্চিত যে সংশোধীত ঊর্ধ্বমুখী হার অনিবার্য। সুস্পষ্ট পদক্ষেপ হোত ২৮ শতাংশ করের হার পুনরায় লাগু করা। আমরা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি যে জিএসটি প্রণয়নের সময় দীর্ঘস্থায়ী ভোগ্য পণ্যের উপর করের বোঝা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছিল এবং প্রাক-নির্বাচনী সময়ে কর হ্রাসের উন্মাদনায় এটা আরো প্রকট হয়েছিল।
জিএসটি কর কাঠামোতে প্রগতিশীলতার গুরুত্ব
কিন্তু কর্পোরেট এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই পরামর্শগুলির কোনওটিই প্রযোজ্য না। ধনীদের ওপর কর চাপানোর পরিবর্তে তারা সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পণ্যের ওপর এই বোঝা চাপাতে চায়। ব্যবসা করার সুবিধার উন্নতির জন্য(ease of doing business) বর্তমান বহুস্তরীয় জিএসটি-কে একটি মাত্র বা বর্তমানের চেয়ে কম সংখ্যক হারে একীভূত করার জন্য কর্পোরেট দাবির সাথে এটি সম্পূর্ণভাবে খাপ খায়।
যদি একটি মাত্র হারে জিএসটি নেওয়ার পথে সরকার অগ্রসর হয় তাহলে এমনিতেই পশ্চাদগামী পরোক্ষ কর হিসাবে জিএসটি-এর মধ্যে যেটুকু প্রগতিশীলতা ছিল তাও লুপ্ত হবে। দীর্ঘস্থায়ী ভোগ্য পণ্য এবং শহুরে ভোগ্যপণ্যের উপর করের হার সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে। এই একই পণ্যগুলি আরও মুনাফা করবে যদি সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ হারের জিএসটি-এর দাবি মেনে নেওয়া হয়।
জিএসটি-এর হার সংশোধন কার লাভ কার ক্ষতি
শস্য, শস্যজাত পণ্য এবং দইয়ের উপর ৫% শুল্ক চাপানো হয়েছে এবং অন্য বেশ কিছু পণ্যের উপর বিদ্যমান করের হার আরও বাড়ানো হয়েছে। সোলার ওয়াটার হিটার, চামড়ার মতো পণ্য এবং পরিষেবা যেমন ₹ ১০০০-এর নীচে হোটেলের ঘর এবং ₹ ৫০০-এর উপরে হাসপাতালের ঘর এবং বিভিন্ন চুক্তিগুলির জিএসটি ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এলইডি বাল্ব, কালি, ব্লেড, পাম্প, সাইকেল, বিভিন্ন ধরনের মেশিনের মতো অনেক পণ্যে জিএসটি ১২শতাংশ থেকে ১৮শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। যে চুক্তিতে ১২ শতাংশ কর ছিল তা বাড়িয়ে ১৮ শতাংশ করা হয়েছে।
বিলাস দ্রব্যের একটি ক্ষেত্রেও করের হার ১৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৮শতাংশ করা হয়নি। সুতরাং, অভিপ্রায় খুব পরিষ্কার- ভারত সরকার ২৮ শতাংশ হারটাই বাদ দিতে চায়। বিলাস দ্রব্যের উপর কর আরো কমানো এবং সাধারন মানুষের ভোগ করা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর বোঝা বৃদ্ধি করা। এই অবস্থানের চেয়ে বেশি পশ্চাদগামীতা আর কিছু হতে পারে না।
হারের বহুগুণত্বের সমস্যা অতিরঞ্জিত। কর কাঠামোটি কতটা সরলীকরণ করা হয়েছে তা উপলব্ধি করার জন্য শুধুমাত্র জিএসটি-এর আগে বিদ্যমান হার কাঠামোর কথা ভাবতে হবে। দেশে ব্যাপক দারিদ্র্য এবং বিশাল আয় বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে, শস্য, আটা এবং বিলাসবহুল যানবাহনের জন্য একটি অভিন্ন করের প্রস্তাব করা অযৌক্তিক। সাম্যের আদর্শকে অন্তত সহজে ব্যবসা করার সুবিধার মতো গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। বাড়তি সরলীকরণ ন্যায্যতার ধারণার পরিপন্থী।
রাজ্যগুলি এবং কর সংশোধন
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ট্যুইট করে কর বৃদ্ধির আরেকটি যুক্তি দিয়েছেন “রাজ্যগুলি প্রাক-জিএসটি সময়কালে খাদ্যশস্য থেকে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব সংগ্রহ করছিল। শুধুমাত্র পাঞ্জাবই ক্রয় করের মাধ্যমে খাদ্যশস্যের উপর ২,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। উত্তরপ্রদেশ ৭০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।” এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য শস্যের উপর পাঞ্জাবে অনেকটাই কর ছিল যা একটি রপ্তানিকারক রাজ্য ছিল,এবং কিছু রাজ্যে খাদ্যশস্য এবং পণ্যের উপর কর কম ছিল, বিশেষ করে, যদি সেগুলি ব্র্যান্ডেড হয়। তবে এটি একটি কোন সাধারণ ভবিষ্যত হতে পারে না। ঐতিহাসিকভাবে এদেশে শস্যকে করছাড় দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আরো দাবি করেছেন যে সমস্ত রাজ্য এই হার সংশোধনে সম্মত হয়েছে।
“এটি জিএসটি কাউন্সিলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল। ২৮শে জুন, ২০২২-এ চণ্ডীগড়ে অনুষ্ঠিত ৪৭ তম বৈঠকে হারের যৌক্তিকতা সংক্রান্ত মন্ত্রীদের গোষ্ঠী যখন এই সমস্যাটি উপস্থাপন করেছিল তখন সমস্ত রাজ্য জিএসটি কাউন্সিলে উপস্থিত ছিল।
অ-বিজেপি রাজ্য (পাঞ্জাব, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কেরালা) সহ সমস্ত রাজ্য এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত। জিএসটি কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্ত আবারও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।”
এটা অসত্য। কেরালার অর্থমন্ত্রী জিওএম-কে একটি চিঠির মাধ্যমে কর আরোপের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তার মতবিরোধ জানিয়েছিলেন। কিছু রাজ্য কাউন্সিলেই তাদের মতবিরোধ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু কোনো ভোটগ্রহণ হয়নি। কেরালা যখন লটারি করের হার সংশোধন ওপরে প্রবল মতানৈক্য জানিয়েছিল তখন ছাড়া কাউন্সিলের এইটাই অভ্যাস ছিল। অতএব, সমস্ত রাজ্য সিদ্ধান্তে সম্মত ছিল এমন দাবি করা অন্যায়।
এই কর বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতিতে ইন্ধন জোগাবে
অবশেষে, জিএসটি হার বৃদ্ধির বিষয়ে সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যাপার হল এই সিদ্ধান্তের সময়। দেশ এখন মূদ্রাস্ফীতির তীব্র সংকটের মুখে। খুচরো মূদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশের উপরে। পাইকারি মূল্য সূচক ১৫শতাংশ বেড়েছে। জুন মাসের সূচকে খাদ্য সামগ্রী যার ওয়েটেজ ২৪%, ১৬.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সংক্ষেপে, দেশের মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতির জন্য খাদ্য মূল্যস্ফীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এখন এই ৫ শতাংশ কর অবশ্যই পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে চলেছে। এইভাবে হার বৃদ্ধি পশ্চাদপসরণমূলক, মুদ্রাস্ফীতিমূলক এবং কর ফাঁকির দিকেই পরিচালিত করবে।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সরিৎ মজুমদার