সীতারাম ইয়েচুরি
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির এই বর্ধিত অধিবেশনে উপস্থিত প্রত্যেক প্রতিনিধি ও অংশগ্রহণকারীকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানাই। কেন এই অধিবেশন আয়োজন করা হয়েছে সেকথা ইতিমধ্যে পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম স্পষ্ট করেছেন। পার্টির রাজ্য সম্মেলন ও পার্টি কংগ্রেসের পরে এখনও অবধি অর্থাৎ শেষ দেড় বছরে আমরা নিজেদের কাজে কতদূর এগোতে পেরেছি সেই সংক্রান্ত আলোচনাই এই আয়োজনের মুখ্য বিষয়। এই দেড় বছরে আমরা জনগণের স্বার্থে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় সক্রিয় থেকেছি, এর সাথেই বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক সমস্যাকে তুলে ধরেও লড়াই-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে। এই সকল আন্দোলন-সংগ্রামে নতুন প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ তথা এ রাজ্যে সংগঠিত বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পক্ষে এসবই ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নির্বাচনী সংগ্রামেও তার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এই সমস্ত ইতিবাচক সম্ভাবনাসমুহকে সংহত করে কিভাবে সামনের দিকে এগোনো যাবে, এই অধিবেশনে সেটাই নির্ধারিত হবে। এই রাজ্যের জনসাধারণের সাথে আমাদের নিবিড় যোগাযোগ ও তাদের দৈনন্দিন লড়াই সংগ্রামের মধ্যেই আমাদের ভিত্তি নিহিত রয়েছে। এই মুহূর্তে জনসমর্থনের চিত্র কিছুটা অস্পষ্ট কিংবা দ্বিধাগ্রস্থ বলে মনে হতে পারে- কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আমাদের গণভিত্তির অতীত ঐতিহ্য আজও প্রবল। বামপন্থা ও বামপন্থীদের প্রতি সেই জনসমর্থন কিভাবে সক্রিয় ও উদ্দীপ্ত অবস্থায় সামনের সারিতে উঠে আসবে সেই পরিকল্পনাই আমাদের আলোচনার লক্ষ্য। জনসমর্থনের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন যেমন সারা পৃথিবীর বামপন্থী আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনই এই প্রেক্ষিত আমাদের দেশ তথা পশ্চিমবঙ্গের আন্দোলন সংগ্রামেও অন্যতম প্রধান আলোচ্চ।
জনসাধারণের ভরসা ও সক্রিয় সমর্থন লাভ করার বিষয়টি কঠিন কাজ সন্দেহ নেই। প্রতিদিন সংগ্রামের চেহারা বিভিন্ন জটিল বাঁক-মোড়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। অনেক সময়ই আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও নিজেদের রাজ্যে প্রধান দন্দ্বের প্রেক্ষিত একে অন্যের সাথে বিসদৃশ বলে প্রতিভাত হয়। এমন পরিস্থিতিতে বাস্তব পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে প্রধান প্রধান দ্বন্দ্বের গতিময়তাকে চিহ্নিত করা এবং তার ভিত্তিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলার রাস্তাটি আমরা ইতিমধ্যে নির্ধারণ করেছি। প্রতিদিনকার আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে বিবিধ সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রধান দ্বন্দ্বটি চিহ্নিত করার কাজে ভুল হওয়ার, মূল সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর বদলে অন্যান্য বাধার সাথে যুঝতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে- এসবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ার বিপদ থাকে। এই অধিবেশনের শেষে সঠিক পথ চিহ্নিত করার কাজে আমরা আরও কিছুটা এগিয়ে যাব। নির্বাচনী ফলাফলের বাস্তবতা যাই থাকুক না কেন, গোটা দেশে বামপন্থী আন্দোলন বিকাশের অন্যতম পূর্বশর্তই হল পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। এ শুধু ইতিহাসের বিষয় না, আজকের পরিস্থিতিতেও বাস্তব প্রেক্ষিত।
আজ আমরা এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি লড়াই করছি। বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন? প্যালেস্তাইনের উপরে যেরকম অমানবিক কায়দায় আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে তাতে জালিয়ানওয়ালাবাগের কথা স্মরণ করতে হচ্ছে। ঐ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ শাসনকে ‘নাইট’ উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন- সেই শক্তি বা কর্তৃত্ব যারা এহেন অমাবনিক নিপীড়ন চালায়, তাদের দেওয়া কোনও উপহার আমি গ্রহণ করতে পারি না। সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের ইতিহাসে যতরকম জঘন্য দৃষ্টান্ত রয়েছে আজ প্যালেস্তাইনের পরিস্থিতি তাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় আজ গাজায় যা ঘটছে একমাত্র ফ্যাসিস্ত শাসনের সময়কার গণহত্যার সাথেই সম্ভবত এর তুলনা চলে। ইতিহাসে সেই হত্যাকাণ্ড হলোকাস্ট নামেই কুখ্যাত। প্রতিদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেসব যে শুধু আমাদের বিষণ্ণ করে তাই না- নারকীয় দৃশ্যের ছবি, ভিডিও যেকোনো সুস্থ মানুষকেই ভিতর থেকে দুর্বল করে দেবে। ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়া মৃত শিশুর শবদেহটুকু উদ্ধার করতে মায়েরা দুহাতে মাটি খুঁড়ছেন। শবদেহ খুঁড়ে বের করার কাজে প্রয়োজনীয় এমনকি ন্যুনতম সামগ্রীটুকুও তাদের হাতে নেই। এই যুদ্ধে মৃতদের মধ্যে শিশুরাই অন্যতম। প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলের ইতিহাস আমরা সকলেই কমবেশি জানি। এক বিরাট আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলেই ইজরায়েল নিজের পিতৃভূমি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে সাবেক ভূখণ্ডটি ইংলন্ড ও ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। ১৯১৬ সালে ইংলন্ড ইহুদীদের উদ্দেশ্যে তাদের দেশ পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। সারা দুনিয়াতেই তারা এমন বিভাজনের নীতি প্রয়োগ করেছিল। এদেশেও তারা ম্যাকমোহন লাইন নির্মাণ করে সীমানা নির্ধারণ করে। প্যালেস্তাইন দেশকে দখলে রেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইহুদীদের জন্য যে পরিকল্পনা নেয় তারই ফলশ্রুতিতে আধুনিক ইজরায়েল নির্মিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৮ সালে সেই পরিকল্পনা রুপায়িত হয়। ইজরায়েল বলে চিহ্নিত ঐ ভূখণ্ড থেকে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ প্যালেস্তাইনীয়দের সরাসরি উচ্ছেদ করে, বিতাড়িত করা হয়। এই ঘটনাকে প্যালেস্তাইনের মানুষ ‘নাকবা’ বলে চিহ্নিত করেন। নাকবা’র অর্থ বিতাড়ন- এক্সপালসন। ১৯৪৮ সাল থেকে প্যালেস্তাইনের নাগরিকদের উপরে অবিরাম আক্রমণ চলে আসছে। যে জায়নবাদী চিন্তাভাবনা থেকে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের এমন পরিকল্পনা গৃহীত হয় তার ইতিহাস আরও পুরানো। জায়নবাদী ভাবনা থেকে রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা বস্তুত ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিস্থারই নামান্তর। আমাদের দেশেও এদের সুযোগ্য দোসর রয়েছে। রাজনৈতিক দর্শনের অভিন্ন উদ্দেশ্যের কারণেই হিন্দুত্ব ও হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকারী আরএসএস’র সাথে জায়নবাদীদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। এরা একে অন্যের (মোদী ও নেতানিয়াহু) স্বাভাবিক মিত্র। ইজরায়েল গোটা প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডটাই নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে চাইছে। তারা চায় প্যালেস্তিনিয়রা অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করুক কিন্তু প্যালেস্তাইন নামের কোনও দেশ যেন না থাকে।
প্যালেস্তাইনের সংগ্রামে ভারতের সমর্থনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন যদি ইংরেজদের জন্য ইংলন্ড থাকে, ফরাসীদের জন্য ফ্রান্স যেমন নিজেদের দেশ হয় তবে প্যালেস্তিনীয়দের জন্যও প্যালেস্তাইন বৈধ। আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছেন। তার অবস্থান স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথেই সংবাদমাধ্যমের সেই অংশ যাকে গোদী মিডিয়া বলা হয়, তারা সুদূর গাজায় নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিয়েছে। এইসব মিডিয়া সংস্থাগুলি তিন মাস আগেও মণিপুরে ঢুকতে পারেনি, সেখানকার পরিস্থিতি সরেজমিনে তুলে ধরেনি। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত ইউরোপের দেশগুলি ইজরায়েলকে সমর্থন জানিয়েছে, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের দেশের সরকারও তাদের অনুসরণ করেছে। ইউক্রেনে কি ঘটছে? চীন ও রাশিয়াকে একঘরে করতে ন্যাটোর নেতৃত্বে কার্যত শীতল যুদ্ধেরই এক নয়া পর্যায় শুরু হয়েছে। ইউক্রেনে তারা অস্ত্র সাহায্য পাঠিয়েছে, সেদেশের তবু নিজেদের সেনাবাহিনী বলে কিছু একটা রয়েছে- ইজরায়েলের নিজস্ব বাহিনী বলতে প্রায় কিছুই নেই, সবটাই সাম্রাজ্যবাদী দেশের তরফে সরাসরি সহায়তা। শীতল যুদ্ধের এই নব পর্যায়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধস্তন সঙ্গী (জুনিয়র পার্টনার) হিসাবে ভারত নিজেকে তুলে ধরছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসাবে সক্রিয় হতে মোদী সরকার চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। সম্মেলন শেষের বিবৃতিটুকুই জি-২০ সামিটের একমাত্র সাফল্য। এছাড়া ঐ বৈঠকের অন্য কোনও সারবত্তা নেই। আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
স্বাধীনতা লাভের পর বিগত ৭০ বছর ধরে ভারত কখনো নিজেদের স্বাধীন বৈদেশিক নীতি থেকে সরে আসেনি। সেই ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে আজ আমরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জুনিয়র পার্টনারের ভূমিকা পালন করছি। এমনটা ঘটছে কেন? মোদীর শাসনে আমাদের দেশ দুনিয়াজোড়া আধিপত্যকামী শক্তির সাথে কিভাবে জড়িয়ে পড়ছে সেই সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ উপলব্ধি থাকা জরুরী। হিন্দুত্ব ও জায়নবাদের মধ্যে মতাদর্শগত সখ্যতা অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু সেটুকুই সব না। ভারত সম্পর্কে আরএসএস’র এক বিরাট রাজনৈতিক ও আদর্শগত পরিকল্পনা রয়েছে- মোদীর শাসনে সেই পরিকল্পনাই ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। প্রায় একশো বছর আগে আরএসএস এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। গত শতকের ২০’র দশকে স্বাধীন ভারত তার ভবিষ্যৎ চেহারা সম্পর্কে তিনটি ধারণা সামনে আসে। আমাদের দেশের সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের কথা মাথায় রেখে ভবিষ্যৎ ভারতের সামনে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সাধারণতন্ত্র হয়ে ওঠা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। এআইসিসি’র করাচী এবং লাহোর অধিবেশনে সেই পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয়। ঐ ভাবনাই পরবর্তীকালে আমাদের দেশের সংবিধান রচনার ভ্রূণ। আমরা, কমিউনিস্টরা কি বলেছিলাম? ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সাধারণতন্ত্রের সাথে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হবে তাকে অসম্পূর্ণ চিহ্নিত করে আমরা প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবী জানাই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত পরিকল্পিত ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সাধারণতন্ত্র টিকে থাকতে পারবে না- এই ছিল আমাদের বক্তব্য। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সাধারণতন্ত্র সবটা মিলে আমাদের লক্ষ্য হবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আমাদের বক্তব্যে বিরোধিতা জানিয়ে দেশ নির্মাণ প্রসঙ্গে তৃতীয় মতটি কি ছিল? তারা বলেন ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে তুলতে নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচিতিকে ভিত্তি হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। এই ভাবনা থেকেই হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনা জন্ম নেয়। ১৯২৫ সালে সেই পরিকল্পনাকে রুপায়ন করতে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংস্ববক সংঘ। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতার এই যে ভাবনা তারই অনুবন্ধী মনোভাব হিসাবে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক শক্তিও মাথাচাড়া দেয়, তারা ইসলামিক রিপাবলিকের ধুয়ো তোলেন। এই দুই শক্তির সংঘাতের অভিঘাতেই দেশভাগের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। দেশভাগের সেই অভিশাপ আজও আমাদের বইতে হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমাদের বাড়তি সতর্ক হতেই হয়। স্বাধীনতার ঠিক আগে দেশের দু-প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়েছিল, কিন্তু পশ্চিম সীমান্তের চাইতে এই অংশে সাম্প্রদায়িকতার চেহারাটি অনেক বেশি ভয়ানক ছিল। এই কারণেই ১৫ই অগাস্টের সন্ধ্যায় মহাত্মা গান্ধী কলকাতায় ছিলেন। সেই বিষাক্ত মনোবৃত্তি এখনও অনেক মানুষের চেতনায় চাপা পড়ে রয়েছে। আরএসএস-বিজেপি তাকেই কাজে লাগাতে চায়। মহম্মদ আলী জিন্নাহ’র অনেক আগে বিনায়ক দামোদর সাভারকরই প্রথম দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রসঙ্গ তোলেন। সাভারকরের সেই ভাবনাই হিন্দুত্বের আদর্শগত এবং রাজনৈতিক পরিকল্পনার আকর। আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সাধারণতন্ত্র ভিত্তিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করে যে হিন্দু রাষ্ট্রের পথে মোদী ভারতকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন তা আসলে সেই ফ্যাসিবাদী ভাবনায় সঞ্জাত হিন্দুত্বেরই চেহারা। ঐ লক্ষ্যেই এশের ইতিহাস বিকৃত করার কাজ চলছে, এনসিইআরটি’র প্রকাশিত পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস, ভাষ্য ও ভাবনা সবই বদলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই কাজ চুড়ান্ত করতে আরএসএস-বিজেপি’র শক্তিশালী সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শিবির সেই সহায়তা যোগাচ্ছে, তার সাথে রয়েছে ভারতের শাসক শ্রেণীর সমর্থন। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সমর্থন পেতেই মোদী সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক জোটের চুক্তিতে সাক্ষর করেছে, তাদের অধস্তন সহযোগী (জুনিয়র পার্টনার) হয়েছে। দেশীয় শাসক শ্রেণীর সমর্থন এসেছে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে কর্পোরেট পুঁজির আঁতাতের (কর্পোরেট-কমিউনাল নেক্সাস) মাধ্যমে। মোদীর জমানায় জাতীয় সম্পদের লুঠ, আদানি গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের ব্যাপক সমর্থন এসব সেই পরিকল্পনারই অন্তর্গত কর্মসূচি। দেশের সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে দেশী, বিদেশী কর্পোরেট এমনকি সরাসরি বিদেশী পুঁজির হাতে। উদাহরণ হিসাবে সম্প্রতি এয়ার ইন্ডিয়া’কে টাটা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাকে মনে করা যায়। এয়ার ইন্ডিয়ার মালিক বনেই টাটারা নতুন একশোটি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, সাথে সাথেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানান। ফরাসী যুদ্ধ বিমান কেনার ক্ষেত্রে ম্যাকরঁ’ও একইরকম সৌজন্য দেখিয়েছিলেন। মোদীর শাসন ভারতের বাজারকে কার্যত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুনাফা লুটের জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। দেশের কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেট স্বার্থের সাথে যুক্ত করাই নয়া কৃষি আইনের উদ্দেশ্য ছিল। মোদী সরকারের তরফে যুগিয়ে দেওয়া এমনসব সুযোগ-সুবিধার প্রতিদানে দেশীয় কর্পোরেট পুঁজি কি করছে? দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে তারা চুপ করে রয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাতে বিদেশী পুঁজিও পেছিয়ে নেই। সারা দুনিয়ায় যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার তারাই আজকের ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব। দেশজুড়ে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে অভূতপূর্ব কায়দায় ঘৃণার প্রচার চলছে। প্রকাশ্য গণপিটুনিতে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসছে। এমনকি সংসদের মধ্যেও ঘৃণাভাষণ (হেট স্পিচ) দেওয়া শুরু হয়েছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গোরক্ষা বাহিনীর মতো খুনে গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে, বাড়তি সাহস এমনকি ক্ষমতা অবধি দেওয়া হচ্ছে। হরিয়ানায় এরা পুলিশকে নিজেদের সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র হচ্ছে। এভাবেই কর্পোরেট-হিন্দুত্ব আঁতাত নিজেদের ভোটব্যাংক সুরক্ষিত করতে চাইছে, তাকে আরও প্রসারিত করতে চাইছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে তার প্রমাণ মিলেছে। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে ব্যাপক অর্থের যোগান (মানি পাওয়ার), ইডি, সেবি, সিবিআই-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে বিরোধীদের কণ্ঠরোধের বন্দোবস্ত। এর বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই, আমাদের সংগ্রাম। এই লড়াই যেমন মতাদর্শের ততটাই রাজনৈতিক।
এমন বাস্তবতার জন্যই আজকের ভারত নিজেদের অতীত ঐতিহ্যকে ছুঁড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর। সেই কাজ সম্পন্ন করতে গেলে দেশের সংবিধান, নাগরিকদের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার এসবকিছুকেই বাতিল করতে হবে- তাই সংবিধান আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা, সিপিআই(এম) শুধু যে এই বাস্তবতাকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করছি তাই নয়, এধরণের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা আরএসএস-বিজেপি’র বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ সংগঠিত করে চলেছি। বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চে সমস্ত পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আমাদের জোরালো উপস্থিতি অনেকের কপালেই চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। সংসদে আসনের নিরিখে আমাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হলেও আমরা কেমন করে ঐ মঞ্চে স্বকীয় উপস্থিতি উজ্জ্বল রেখেছি তা অনেকের জন্যই দুশ্চিন্তার বিষয়।
আমি আগেই বলেছি বহুবিধ দ্বন্দ্বের মাঝে আমাদের সক্রিয় হতে হচ্ছে। আমাদের কর্মকাণ্ডে উগ্র দক্ষিণপন্থা বিপদের আঁচ পেয়েছে। তাই বিজয়া দশমী উপলক্ষ্যে বক্তব্য রাখার সময় সংঘের প্রধান অবধি বামপন্থীদের দেশজোড়া কার্যকরী উপস্থিতি (লেফট ইকোসিস্টেম)-র উল্লেখ করে বলেছেন, বামেরা এমন এক বন্দোবস্ত করে রেখেছে যাতে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে গণমাধ্যম অবধি তাদের প্রভাব বিস্তৃত রয়েছে। তিনি বামপন্থীদের এহেন উপস্থিতিকে নিশানা করেছেন। এর রাজনৈতিক গুরুত্ব কোথায়? অনেকেই নির্বাচনী ফলাফল দেখে লড়াই-সংগ্রামের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন- তারাও জেনে রাখুন, সংঘ প্রধানের এই বিবৃতি আসলে দেখিয়ে দেয় নির্বাচনী জয়-পরাজয়ের হিসাবকে পেরিয়ে গিয়ে আসলে আমাদের সাথে, বামপন্থীদের সাথে তাদের লড়াই এক মতাদর্শগত নির্মাণের বিরুদ্ধে আরেক মতাদর্শগত পরিকল্পনার সংঘাত। বিকল্প দেশগঠন, বিকল্প সমাজ গঠন সম্পর্কে আমাদের পরিকল্পনা, প্রস্তাবনা কার্যকর হতে পারে বলেই ওরা আমাদের নিশানা করছেন।
আরএসএস-বিজেপি ভারতের সংবিধানের ভিত্তিস্বরূপ স্তম্ভগুলিকে ধ্বংস করতে চাইছে। এই লক্ষ্যেই স্বাধীন ও সরকারের সমালোচনা করে এমন সংবাদমাধ্যমকে এরা নিশানা করছে। সকলেই জানেন নিউজক্লিকের সাথে কি ঘটছে। এর কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যে প্রথমে ইডি’র মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা হল। পরে যখন বোঝা গেল ইডি’র তদন্তে এমনকিছু বেরোবে না যাতে নিউজক্লিক’কে দমিয়ে রাখা যায় তখন মনগড়া অভিযোগের মাধ্যমে ইউএপিএ ধারায় গ্রেফতার করা হল। এসবই আমাদের হিটলারি শাসনের কথা স্মরণ করতে বাধ্য করায়। নিজের শাসন কায়েম করত হিটলার ইহুদিদের নিশানা করেছিলেন, মোদীর শাসনে মুসলমান এবং সংখ্যালঘুরা প্রায় একই কায়দায় নিপীড়িত হচ্ছেন।
নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রের তরফে নজরদারি চালানো হচ্ছে। আমার মোবাইল ফোনেও আড়ি পাতার চেষ্টা চলেছে। এই সম্পর্কে অ্যাপল কোম্পানি থেকে আমার কাছে নোটিফিকেশন পাঠানো হয়েছে। এর আগেও প্যেগাসাস সফটওয়ার প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও উত্তর দেয়নি। সুপ্রিম কোর্ট অবধি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট তদন্তের কাজে কেন্দ্রীয় সরকার সহযোগিতা করছে না। এবারেও তারা মূল প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যেতে যাবতীয় যুক্তি হাজির করছে। অ্যাপল সংস্থার পক্ষে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এহেন তাদের প্রযুক্তিগত সুরক্ষাকবচ ভেদ করে নজরদারি চালানো কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থার পক্ষেই সম্ভব।
আজকের ভারতে মোদী সরকার সেইসব করতে চাইছে যা পকিস্তানে চলে। ওদেশে স্কুল পাঠ্যের অন্তর্গত ইতিহাস বইতে লেখা রয়েছে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান নাকি ভারতকে পরাজিত করেছিল। আমাদের দেশেও মুঘলদের ইতিহাসের গোটা পর্বটি বাদ দেওয়া হচ্ছে, ব্রিটিশ শাসনের পর্বকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে চাওয়া হচ্ছে। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটালে কি হয়? এতে সমাজের মধ্যে যুক্তিবাদী মনোভাবের প্রভাব কমতে থাকে। মনে রাখতে হবে যাবতীয় অযুক্তির গোড়ায় রয়েছে অন্ধ বিশ্বাস। ফ্যাসিস্ত ভাবনায় রাষ্ট্র গঠনের জন্যই অন্ধ বিশ্বাসের প্রচার ও ইতিহাসের বিকৃত পুনর্নির্মান করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। হিন্দু পুরাণকেই দেশের ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের দেশের দার্শনিক চিন্তাভাবনার গভীরতা সারা বিশ্বের জ্ঞানচর্চায় সমাদৃত হয়ে এসেছে। সেই সুমহান দার্শনিক ঐতিহ্যকে হিন্দুত্বের ধর্মতত্ত্বে পর্যবসিত করা চলছে, দেশের ইতিহাসের নামে হিন্দু পুরাণসমূহের কাহিনীকে তুলে ধরা হচ্ছে।
সম্প্রতি দেশের নাম হিসাবে ইন্ডিয়া’র বদলে ভারত ব্যবহার করার ঘটনা ঘটেছে। জি-২০ বৈঠকের শেষে বাকি ১৯টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা প্রতিনিধিরা বুঝতেই পারেননি কোন দেশের তরফে তাদের ডিনারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সরকারী নিমন্ত্রনপত্রের নিচে প্রেসিডেন্ট অফ ভারত লেখা হয়েছিল। সারা পৃথিবী আমাদের ইন্ডিয়া বলে চেনে। আজ হঠাৎ করে নিজেদের নাম বদলে ফেললে অসুবিধা কোথায়? ঐ নাম বদলের ফলে আমরা আমাদের গোটা ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারগুলি হারিয়ে ফেলব। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় আমাদের দেশ যে সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বোঝাপড়ার অন্তর্গত হয়েছিল তার সবটাই ঘটে ইন্ডিয়া নামের মাধ্যমে। জিন্নাহ একসময় চেষ্টা করেছিলেন আমরা যেন ইন্ডিয়া নাম ব্যবহার করতে না পারি। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বলেছিলেন হিন্দুস্তান’কে ইন্ডিয়া নাম ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া উচিত না। তিনি চেয়েছিলেন ঐ দেশ যেহেতু পাকিস্তান তাই আমাদের নাম হওয়া উচিত হিন্দুস্তান। ইন্ডিয়া নামের কারণেই আমরা স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই রাষ্ট্রসংঘের সদস্য নির্বাচিত হই, এছাড়াও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সাথেও যুক্ত হতে পারি। এরা হয়ত সেসবই নষ্ট করে ফেলতে চাইছেন। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে বামপন্থীদের কার্যকরী উপস্থিতি (লেফট ইকোসিস্টেম)-র কথা বলে তারা আসলে হিন্দুত্বের সার্বিক কর্তৃত্ব (হিন্দুত্ব ইকোসিস্টেম) প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। সর্বত্র তারা আমাদের উপস্থিতি খুঁজে বের করতে চাইছেন, আসলে সেই অজুহাতে নিজেদের দখল কায়েম করছেন।
এহেন আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। আমরা আহ্বান জানিয়েছি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সাধারণতন্ত্র ভিত্তিক ব্যবস্থাকে যারা বাঁচাতে চান তারা সকলে একজায়গায় আসুন। কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাতের এই যুগে দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারেও এহেন ঐক্য রীতিমত জরুরী। প্রধানমন্ত্রী দাবী করেছেন আগামিদিনে সকলের হাতে কাজ থাকবে। এহেন আকাশকুসুম বিবৃতির ভিত্তি নাকি সরকারী তথ্য। আমরা সেইসব তথ্য পর্যালোচনা করে দেখলাম কর্মহীন জনসাধারণকে স্বনিযুক্তির (সেলফ এমপ্লয়মেন্ট) মাধ্যমে রোজগেরে দেখানো হয়েছে। এমন তথ্যের সুবাদে তারা দেশের বেশিরভাগ মানুষই কাজে যুক্ত বলে প্রচার করছেন। আমরা জানতে চেয়েছিলাম স্বনিযুক্তি বলতে তারা কি বোঝাতে চাইছেন। তারা যা ব্যখ্যা দিলেন তাতে দেখা গেল ঘরের কাজ করাও স্বনিযুক্তির অন্তর্গত। আমাদের দেশের বাস্তবতায় ঘর সামলানোর দায়িত্ব মূলত মহিলাদেরই- একে উপযুক্ত রোজগার যুক্ত কর্মসংস্থান বলে দেখানোর কোনও মানেই হয় না। বাস্তব পরিস্থিতি কেমন? আমাদের দেশে অন্তত ৪০শতাংশ স্নাতকই বেকার। অর্থনীতি কিংবা সামাজিক উন্নয়ন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যেকোনো পরিসংখ্যান যাতে এই সরকারের মিথ্যাপ্রচার, দাবী ইত্যাদির ফানুস ফেটে যায়- এরা সেগুলিকে মান্যতা দিতে চান না। অথচ কোনও আন্তর্জাতিক মাধ্যমে এদের প্রশংসা হলে এরাই ঢাক পেটানো শুরু করেন। এই পরিস্থিতিকে আর কিছুতেই নির্বাচনী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা চলে না, এ হল কার্যত নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র। ক্ষুধা, কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধি কোনও ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থার উন্নতি নেই। কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা আদৌ কমেনি।
তাই আমরা বলছি দেশের শাসনক্ষমতায় আসীন এই শক্তিকে অবিলম্বে ভারতের যাবতীয় রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে সরিয়ে দিতে হবে। এই কাজে ইচ্ছুক প্রত্যেককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভারতের ভবিষ্যতের জন্য এই জরুরী কর্তব্য সম্পন্ন করতেই হবে।
ইন্ডিয়া মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেসের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই জানতে চাইছেন ওরা যদি থাকে তবে আমরা ঐ মঞ্চে কেন রয়েছি? কেন আমরা আলাদা হচ্ছি না। আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, তৃণমূল কংগ্রেস কোনোভাবেই বিজেপি’র বিরুদ্ধে বিকল্প না, কোনোদিন হতেও পারবে না। আমরা জানি ভবিষ্যতে তারা সমঝোতাও করতে পারে, এমন কাজ তারা আগেও করেছে। সংসদে বিজেপি’র বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সময় তার ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত থেকেছে, নয়ত সমর্থন জানিয়েছে- এসবই আমরা জানি। এই মুহূর্তে ভারত’কে বাঁচানোই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। দেশকে বাঁচাতে গেলে বিজেপি’কে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার জায়গা থেকে সরাতে হবে, যতদিন না সেই কাজ শেষ হবে ভবিষ্যৎ ভারত নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে না। এই লক্ষ্যেই আমরা সবার কাছে আবেদন জানিয়েছি। আপাতত তৃণমূল কংগ্রেস সেই ঐক্যের আহ্বানে সামিল রয়েছে। আমাদের এমন আশা করা উচিত না যে তারা শেষ অবধি থাকবে, কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনও পক্ষ যদি কিছুদুরও এগোতে পারে আমরা সেই সুযোগ দেওয়ার পক্ষে। এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে অতিতেও আমাদের পার্টিতে বিতর্ক হয়েছে। আমার মনে পড়ছে বি টি রণদিভের কথা। জরুরী অবস্থার সময় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন- ‘দিল্লী থেকে আগ্রা যেতে গিয়ে যদি গাড়ি চলা বন্ধ হয়ে যায় এবং রাস্তায় আটকে থাকা অবস্থায় কেউ এসে বলেন তিনি ঐ গাড়িকে সামনে এগোতে সাহায্য করবেন তখন কি এমন ভেবে নেওয়া উচিত যে তারা আগ্রা অবধিই গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাবেন? যতদূর তারা চলবেন সেটকু সহায়তাই আমরা গ্রহণ করব’।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তব উপলব্ধি ব্যতীত আজকের ভারতে আরএসএস-বিজেপি’র নেতৃত্বে উগ্র হিন্দুত্ববাদের মতো সাম্প্রদায়িক-কর্পোরেট শক্তির আঁতাতের মোকাবিলা করা যাবে না। জরুরী অবস্থার সময়ও আমরা প্রকাশ্য সমর্থন পাইনি, কিন্তু আমাদের কর্মী, সমর্থকরা কি হারিয়ে গেছিলেন? তারা নিজেদের উপযুক্তরূপেই সক্রিয় রেখেছিলেন, যখন উপযুক্ত সময় এলো তখন জনসাধারণ আমাদের পক্ষে বিপুল সমর্থন জানিয়েছিলেন। জরুরী অবস্থার মতো কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকে আমরা পরাস্ত করেছিলাম এই ঐতিহাসিক ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য মনে রাখতে হবে।
আমি প্রত্যয়ী, এই বর্ধিত অধিবেশনের আগামী দুদিনের আলোচনায় আজকের পরিস্থিতির মোকাবিলায় কার্যকরী সঠিক পথ নির্ধারিত হবে, এই অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী কমরেডরাই সেই কাজ সম্পন্ন করবেন।
শেষ কথা হিসাবে রবীন্দ্রনাথের লিখে যাওয়া সেই লাইনগুলিই আরেকবার মনে করাতে চাইব-
‘কণ্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী
কুৎসিত বীভৎসা-’পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন
নিত্যকাল রবে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের
হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধকণ্ঠ ভয়ার্ত এ শৃঙ্খলিত যুগ যবে
নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভস্মতলে।’
ভাষান্তর: সৌভিক ঘোষ