EB New

Electoral Bond: The Story Beneath

সুকুমার আচার্য

‘না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা বলে’- ছোটবেলায় পড়া বিদ্যাসাগরের কথা। চুরি যারা করে তাদের চোর বলে। খেতে পরতে না পেয়ে প্রথাগত শিক্ষায় অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিতের কেউ যখন না বলে পরের দ্রব্য নেয়, তখন তাকে না হয় চোর বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষায় পূর্ণ শিক্ষিত দল, বাহুবলে বলীয়ানদের দল যখন চূড়ান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে পরের (জনগণের) জিনিস লেনদেন করে, তখন কি আর তাদের উদ্দেশ্যে এই শব্দ প্রয়োগ করা যায়? বিশেষ করে আইনি রক্ষাকবচ দিয়ে যখন তাদের মুড়ে দেওয়া হয়, তখন তো তাদের উদ্দেশ্যে এই কথা একেবারেই বলা যায় না। আমি তাই ‘নিশিকুটুম্ব’ শব্দটাই প্রয়োগ করছি। ‘নিশিকুটুম্ব’ রজনীর (গোপন) অতিথি। অতি সংগোপনে লেনদেন হয়। দিবালোক যেখানে হয় আঁধার সমান। এত কথা বলছি সদ্য বাতিল হওয়া এক আইনি রক্ষাকবচকে ঘিরে, যার নাম ইলেক্টোরাল বন্ড বা নির্বাচনী বন্ড।

বন্ড কি? চুক্তিপত্র। একটা কাগজ, যাতে লেখা আছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাত বদলের পরিমাণ। নির্বাচনী বন্ড বা ইলেক্টোরাল বন্ড শব্দটাতেই বলা হচ্ছে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে অর্থ প্রদানের বিষয়। আসলে শুধুমাত্র নির্বাচনের সময়ই এটা হতো না। সারা বছরে চার মাসে মোট চারবার হত। জানুয়ারি, এপ্রিল, জুলাই আর অক্টোবর -এই নিয়ে চারবার। কিন্তু কর্ণাটক নির্বাচনের সময় শাসক বিজেপির খুব দরকার হল বোধহয়। সেজন্য প্রয়োজনমতো সেই বছর আরেকবার অন্য মাসে কাউন্টার খোলা হল। সারাদেশে ৩০ টি স্টেট্ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (SBI)-র কাউন্টারে লেনদেন হত। ১০০০ টাকা, ১০ হাজার টাকা, ১ লক্ষ টাকা ইত্যাদির গুনিতকে এক একটি চালান তৈরি হত। এগুলিই বন্ড। ঐ ৩০টির কোনো এক কাউন্টারে উল্লেখিত চার মাসের কোনো এক মাসে কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে যতগুলি নিতে চায় সেইমত এক একটা বন্ড নিয়ে আসত। তাতে কেবল টাকার অংক লেখা থাকত। কে দিচ্ছে, তার নাম থাকত না, কে পাবে তারও নাম থাকত না। ব্যক্তি বা কোম্পানি বন্ড নিয়ে এসে তার পছন্দের পার্টিকে দিয়ে দিত। পার্টির পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ সেই বন্ড SBI তে জমা দিয়ে পার্টির একাউন্টে ট্রান্সফার করে আসত। তারপর সেখান থেকে পার্টি খরচ করত। জমা দেওয়ার আর টাকা একাউন্টে ট্রান্সফার করার মধ্যে ১৫ দিন সময় (ছুটির দিন সহ) থাকত। ঐ সময়ের মধ্যে টাকা না তুলতে পারলে পুরো টাকা জমা পড়ে যেত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। ব্যতিক্রম যে একেবারেই হয়নি তা নয়। একবার বিজেপির ফান্ডে জমা করা ৩ মে’ ২০১৮ এবং ৫ মে’ ২০১৮-র বন্ড দু’টির সময় পেরিয়ে যায়। মোট ২০ কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে পড়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। অর্ধেক গেছে বিজেপি তহবিলে, বাকি অর্ধেক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। এক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় বলা যায়, এই যে কেউ অর্থ দান করল, সে বন্ডটা দিয়ে রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে একটা রশিদ নিয়ে নিল, তারপর সেটা কোম্পানির ইনকাম ট্যাক্স দপ্তরকে দেখিয়ে ১০০% কর ছাড় করিয়ে নিল। কর ছাড়ের এই ব্যাপারে আইনটা তো ২০০৩ সালে বাজপেয়ীই করে গিয়েছিলেন।

ইলেক্টোরাল বন্ডের মূল কথা গোপনীয়তা। বলা ভালো চৌর্যবৃত্তির গোপনীয়তা। কিন্তু তা গোপনীয় কেবল জনগণের কাছে। জানার ব্যাপারটা কেবল SBI -এর কাছে। SBI  -এর থেকে জেনে নিতে শাসক বিজেপির খুব একটা অসুবিধা থাকতে পারে কি ? যে বন্ডের কথা বলা হচ্ছে, তার উপরের দিকে কোণে একটি নম্বর থাকত, একে বলা হত ‘ইউনিক আলফা নিউমেটিক কোড’। একে একমাত্র অতিবেগুনি রশ্মি ছাড়া অন্য কোনোভাবেই জানা সম্ভব নয়। সেটা দেখেই SBI বুঝতে পারত বন্ডটা সে কাকে দিল, আর বন্ডটা কে জমা দিয়ে টাকা নিয়ে গেল। বন্ডটা চালুর সময়েই অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি প্রধানমন্ত্রীর কথার অনুরণ ঘটিয়ে বলেছিলেন, এই কাজ অত্যন্ত গোপনে হবে। কিন্তু কেন এই গোপনীয়তা? কেন ভারতের সংবিধান প্রদত্ত ১৯/১/A ধারায় বর্ণিত নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণের এই ব্যবস্থাপনা? এর উত্তর খুঁজতে গেলে তখনকার নির্বাচন কমিশন এবং ভারতের আর্থিক ব্যবস্থা পরিচালনার সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপক সংস্থা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI)-এর বক্তব্যের প্রতি আমাদের নজর দিতে হয়।

২৬ মে’ ২০১৭, নির্বাচন কমিশন বলেছিল- “…the Electoral Bond will reduce the transparency in politics.” (ইলেক্টোরাল বন্ড রাজনীতিতে স্বচ্ছতাকে কমিয়ে দেবে)। যখন ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে ভাবছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার, তখন RBI জানুয়ারি’ ২০১৭ তে লিখিতভাবে যে কথাগুলি জানায়, তার মধ্যে মূল বিষয়গুলি ছিল- ‘The scheme impact the principles of the prevention of Money Laundering Act, ২০০২.’ (এই ব্যবস্থা অর্থ পাচার নিরোধক আইন ২০০২ এর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে)। এছাড়াও বলেছিল- এই ব্যবস্থায় কোম্পানিটি বৈধ না অবৈধ জানা যাবে না। ভুয়ো কোম্পানি খোলা হতে পারে এবং তার মাধ্যমে টাকার লেনদেন বা পাচার হতে পারে। RBI সেই জন্য বলেছিল- তবুও যদি এই ব্যবস্থা চালু করতে হয়, তাহলে বন্ডের লেনদেনের বিষয়টা SBI নয় RBI-এর মাধ্যমেই করা হোক, তাতে RBI নজরদারি করতে পারবে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার RBI কে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেনি। তাহলে কি ধরে নিতে হবে SBI তে শাসক দলের কর্তৃত্ব বেশি রয়েছে ? এমনটা আশঙ্কা করা যেতেই পারে। তার কারণ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি যখন SBI কে ১৩ মার্চ’ ২০২৪ এর মধ্যে ইলেক্টোরাল বন্ড সংশ্লিষ্ট সমস্ত তথ্য জমা দিতে বলেন, তখন SBI জানায় তাকে ৩০ জুন’ ২০২৪ অবধি সময় দেওয়া হোক। যে কোন মানুষই ভাবতে পারেন শাসক দল বিজেপি যাতে নির্বাচনের সময় বিপাকে না পড়ে তার জন্য SBI এই কথাটি বলেছিল। যে বলেছিল দিতে পারবে না, সে দ্বিতীয়বার সুপ্রিম কোর্টের চাপে পড়ে ১৩ মার্চের মধ্যে দিতে পারল কি করে ? আসলে সে দিতে পারে, কিন্তু না বলেছিল নির্বোধের মত। হতে পারে তা শাসকদলের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। আমাদের দেশের শিল্পপতিদের যত সংগঠন আছে CII, ASOCHEM -সবাই SBI -এর পিছনে দাঁড়িয়ে গেল। কেন ? ঝাঁপির ভিতর এদের সকলের সাপ আছে যে !

২০১৭ সালে বিষয়টা নিয়ে যখন রাজ্যসভায় আলোচনা হয়, সেই সময় রাজ্যসভার সাংসদ CPI(M)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ঠিক এই কথাগুলির পাশাপাশি আরও কতগুলি কথা বলেছিলেন। সেগুলি হল- তখনও আইন ছিল এবং এখনও আইন আছে কোনো কোম্পানি দান করতে চাইলে তার সমগ্র দান কোম্পানির মোট লাভের ৭.৫% -এর বেশি কখনোই হবে না। অথচ ইলেক্টোরাল বন্ডের বেলায় বলা হচ্ছে- লাভ হল কিনা দেখে লাভ নেই, আর দান যত খুশি করা যাবে। ভাবখানা এমন যেন কিছু না থাকলেও করা যাবে (অন্য কেউ ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য অন্য কারোর নামে চালিয়ে দিতে পারে)। আরও একটা আইন দেশে এখনও আছে, সেটা হল FCRA -ফরেন কোম্পানি রেগুলেশন এক্ট। এই আইন বলে বিদেশি কোনো সংস্থা বা তার অধীনস্থ কোনো সংস্থা কোনো রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিতে পারবে না। এই আইনটা তৈরি হয় ১৯৯০ সালে। প্রধানত আমাদের দেশের পুঁজিপতিদের সংগঠন CII সরকারকে জানিয়েছিল যে- এমন একটা আইন করা হোক, যাতে বিদেশি কোম্পানিগুলো রাজনৈতিক দলকে যেন চাঁদা না দেয়। তখন বিদেশি কোম্পানিগুলোর আর্থিক সামর্থ আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তারা রাজনৈতিক দলকে বেশি বেশি করে চাঁদা দিলে রাজনীতিতে তারা বেশি করে প্রভাব বিস্তার করবে। আমাদের দেশের পুঁজিপতিরা টেক্কা দিতে পারবে না। সেজন্য প্রধানত তাদের ভয় জনিত উদ্বেগের ফলে সরকার এই ধরনের একটা ইতিবাচক ভূমিকা বা ভালো উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ডে তার সলিল সমাধি হল। কোথাকার কোম্পানি, আদৌ তা আছে কিনা দেখার দরকার নেই, শুধু কোম্পানির নাম থাকলেই হবে। কোনো সন্ত্রাসবাদী দলও যদি এইরকম একটা কোম্পানির নাম নিয়ে চাঁদা দেয় তো কার কি করার আছে ? আর পরবর্তী সময়ে হলও তাই। হাব পাওয়ার কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি ইলেকট্রোরাল বন্ড কিনেছে। খোঁজ নিয়ে প্রথমে পাওয়া গেল এটা পাকিস্তানের একটা কোম্পানি। সে পুলওয়ামা কান্ডের ঠিক পরেই নাকি টাকা দিয়েছে। পরে বলা হল সে দিল্লির একটা সংস্থা। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সরকার এখনও তার হদিস পায়নি। কোন ভূতে যে টাকা দিল ! ভূতের কথা না হয় বাদ দিন, অর্থ পাচার হয়েছে এটা দিনের আলোর মতো সত্য।

এই সমস্ত বিপদের সম্ভাবনার কথা সীতারাম ইয়েচুরি সেদিন বলেছিলেন। পুঁজিবাদের অনুসারী দলগুলি সেদিন তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। সুযোগটা নিয়েছিল বিজেপি। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ২৬ জানুয়ারি’ ২০১৮ থেকে বিজেপি সরকার সারাদেশে এই ব্যবস্থা চালু করে। ফলে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া ছাড়া আইনি আর কোন রাস্তা থাকে না CPI(M)-এর সামনে। ADR, ‘কমন কজ’ নামে দু’টি সংস্থা সহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র CPI(M)-ই সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ দায়ের করে। তখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন রঞ্জন গগৈ। ১২ এপ্রিল’ ২০১৯ তারিখে তিনি জানান- এটা একটা অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা (অধ্যাদেশ), একটা বিল -আইন নয়, অতএবএ নিয়ে আলোচনার তেমন দরকার নেই। পরপর আরও তিনবার আবেদন করা হয় যথাক্রমে নভেম্বর’ ২০১৯, অক্টোবর’ ২০২০, মার্চ’ ২০২১ তারিখে। প্রতিবারই একই উত্তর ও আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। এখন তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন- তখন কি বলেছেন তা তাঁর মনে নেই। ইনি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি অবসর নেবার ঠিক আগেই রাম মন্দির নিয়ে বিতর্কিত রায় দেন। এখন তিনি রাজ্যসভায় বিজেপির সংসদ। এত কাজ করেছেন আর এখন এত কাজে ব্যস্ত যে, সবটা মনে হয়তো না-ও থাকতে পারে ! অথচ এই সুযোগে প্রচুর টাকা পেয়ে বিজেপি নির্বাচনে লাভবান হচ্ছে। সঙ্গে রাজ্যের কিছু দল, যেমন- তৃণমূল কংগ্রেস, BSR (তেলেঙ্গানা), এমনকি DMK ইত্যাদি, কোথাও কোথাও কংগ্রেস। CPI, CPI(M), CPI(ML) -এই তিনটি দল প্রকাশ্যেই জানায় তারা এই ব্যবস্থাপনার বিরোধী এবং এর মাধ্যমে কোনো টাকা তারা নেবে না। অবশেষে ১৬ অক্টোবর’ ২০২৩ আবার সুপ্রিম কোর্টে আবার CPI(M) সহ উক্ত NGO দুটির দ্বারা আবেদন করা হয়। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের সামনে ৩১ অক্টোবর’ ২০২৩ তারিখে শুনানি হয়। প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সওয়াল করেন। অবশেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি’ ২০২৪ সমস্ত বিচারপতি ঐক্যবদ্ধভাবে ইলেক্টোরাল বন্ডকে অসংবিধানিক বলে রায় দেন এবং SBI কে সমস্ত তথ্য জমা দিতে বলেন। SBI গড়িমসি করেও ১৩ মার্চ’ ২০২৪ তারিখে দিতে বাধ্য হয়। এটা প্রগতিশীল আন্দোলনের জয়। এই জয় ঐতিহাসিক। বিচারপতি কৃষ্ণ আইয়ার ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন নিয়ে যে দৃঢ়তা রেখে গেছেন সুপ্রিমকোর্টে, এই রায় তার সঙ্গে তুলনীয়। সমগ্র ঘটনায় সংবিধানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে একটা প্রশ্ন তো থেকেই যায়। বিচারপতি রঞ্জন গগৈ যে রায় দেন, এই রায় তার উল্টো। কি করে সম্ভব হয়? দুটিই তো হয়েছে সংবিধানকে সামনে রেখে। তাহলে কি সংবিধানের ধারা প্রয়োগের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে, যা বিচারপতি গগৈ অপব্যবহার করেছেন? এই বিষয়টা ভাবার আছে। এখন প্রশ্ন, যদি গোটা ব্যাপারটা অসাংবিধানিক হয়, তাহলে এই প্রক্রিয়ায় যে পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে তা ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া কোনো নিরপেক্ষ সরকারি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা হবে কি না? অর্থ পাচার হবার যে সম্ভাবনাগুলি আপাত দৃষ্টিতে আসছে, সেগুলির তদন্ত করা হবে কি না? কেন নির্বাচন কমিশন এবং RBI –এর বক্তব্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য সুপ্রিম কোর্ট জানতে চাইতে পারে কি না? IT বা ED ইত্যাদির তদন্ত যদি আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সন্দেহজনক ভূমিকায় থাকে, তবে তাদের ভূমিকার তদন্ত কিভাবে হতে পারে? কোনো বিচারপতির রায় যদি সংবিধানের নির্দেশিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে তার প্রতিষেধাত্মক কোনো ব্যবস্থা সেই বিচারপতির সাপেক্ষে নেওয়া যায় কি না ?

সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে কারা লাভবান হয়েছে তার একটা তালিকা সানডে টাইমস অফ ইন্ডিয়া, কলকাতা, ২৪ মার্চ’ ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। সুবিধাপ্রাপ্ত প্রথম ১০টি রাজনৈতিক দলের পরিসংখ্যান-

ক্রমিক নংরাজনৈতিক দলের নামপরিমান (কোটি টাকা)% ক্রমিক নংরাজনৈতিক দলের নামপরিমান (কোটি টাকা)%
BJP৮২৫০.৭৫০.১ DMK৬৫৬.৫
কংগ্রেস১৯৫১.৭১১.৮ YSRSP৪৯৯.৮
TMC১৭১৬.৮১০.৪ TDP৩২০.৭১.৯
BRS১৪০৮.২৮.৫ শিবসেনা২২৭.৪১.৪
BJD১০১৯.৫৬.২ ১০JD(S)৮৯.৮০.৫

হিসাবে ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ধরা হয়েছে। মোট অর্থের পরিমাণ- ১৬,৪৭৮.৫০ কোটি টাকা (অনেকে ২০১৯ থেকে ২০২৪ ধরেছেন, তাই কিছু তারতম্য থেকে যাচ্ছে)। সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে বিজেপি নিজেকে লাভবান করিয়েছে সর্বাধিক। ২০১৩-১৪ সালে বিজেপির সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৭০ কোটি টাকা। ৬ বছর পর তারা নির্বাচন কমিশনে যা তথ্য দেয়, সেই অনুযায়ী তার সম্পদ বেড়েছে প্রায় ২১ গুণ- মোট ৩৬২৩ কোটি টাকা। এই বিধি ব্যবস্থার প্রয়োগ কতখানি ভারতের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নগ্ন করেছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নেওয়া যাক-

(১) ED বা IT-র মত সংস্থাকে ব্যবহার : দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো কোম্পানি আগে ইলেক্টোরাল বন্ডে কোনো টাকা দেয়নি। ED বা IT-র মতো সংস্থা তদন্ত করার জন্য কোম্পানিটির কাছে গেছে। তার কয়েকদিন পর কোম্পানিটি ইলেক্টোরাল বন্ডে টাকা জমা দিয়েছে। তারপর কোম্পানিটির ক্ষেত্রে ED বা IT -র প্রায় কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এইরকম একটা তালিকা দিয়ে ‘দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ২৫ মার্চ’ ২০২৪ তারিখে প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটির বক্তব্য হচ্ছে ২৬টি কোম্পানিতে ED গিয়েছিল। তার মধ্যে ১৬টি কোম্পানি ED যাবার আগে কোনো ইলেক্টোরাল বন্ড কেনেনি। তারপর কিনেছে এবং পরে পরে প্রায় সবই চুপ। আলোচনায় ১০টি কোম্পানির পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে-

কোম্পানির নামED/IT তদন্তে যাবার সাল/তারিখED/IT যাবার আগে বন্ডের পরিমান (কোটি টাকা)ED/IT যাবার পর বন্ডের পরিমান (কোটি টাকা)ED/IT যাবার আগে বন্ড প্রাপক (কোটি টাকা)ED/IT যাবার পর বন্ড প্রাপক (কোটি টাকা)
ফিউচার গেমিং এন্ড হোটেল সার্ভিসেস প্রাঃ লিঃED, জুলাই’ ২০১৯ অভিযোগ- অর্থ পাচার১৩৫৬TMC- ৫৪২ DMK- ৫০৩ BJP- ১০০ অন্যান্য- ২১১
মেঘা ইঞ্জি: এন্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিঃIT, অক্টোবর’ ২০১৯১২৫১১০৭BJP- ১২০BJP- ৫৪৯ BRS- ২০১ অন্যান্য- ৩৬২
DLFCBI, ২৫ জানুয়ারি’ ২০১৯ অভিযোগ- জমি সংক্রান্ত১৭০BJP- ১৭০
NCC১৫ নভেম্বর’ ২০২২৬০BJP- ৬০
ইউনাইটেড ফসফরাসমুম্বাই পুলিশ, এপ্রিল’ ২০১৯৫০BJP- ৫০
WELSPUNজুলাই’ ২০১৭ অভিযোগ- বিদেশি মুদ্রা সংক্রান্ত৫৫BJP- ৪২ অন্যান্য- ১৩
রামকো সিমেন্টঅক্টোবর’ ২০২০ অভিযোগ- শেয়ার দুর্নীতি৫৪BJP- ২৫ YSRCP- ২৪ অন্যান্য- ৫
DIVIS LABফেব্রুয়ারি’ ২০১৯৫৫BJP- ৩০ BRS- ২০ অন্যান্য- ৫
হলদিয়া ইঞ্জিনিয়ারিংCBI, ২০২০২২৩৫৫BJP- ১৬TMC- ২৭৫ BJP- ৬৫ অন্যান্য- ২১
বেদান্তED, ২০১৮ অপরাধ- ঘুষ৫২.৬৫৩৪৭.৭BJP- ৫২.৬৫BJP- ১৭৭.৫ কংগ্রেস- ১২৫ অন্যান্য- ৪৫.২

এই ২৬ টি কোম্পানি ৫১৭৯ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে। এর মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৩৭%, কংগ্রেস পেয়েছে ১২%, আর একটি মাত্র রাজ্য সরকারে থেকে তৃণমূল-কংগ্রেস পেয়েছে ১৮% অর্থ। এটা উচ্চস্তরের তোলাবাজি কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে।

(২) লাভ হয়নি, হয়তো সম্পত্তিও তেমন নেই, কিংবা প্রচন্ড লোকসানে চলা কোম্পানি মাত্রাতিরিক্তভাবে এই ব্যবস্থার মধ্যে টাকা দান করছে। এটা কিভাবে সম্ভব? এটা হতে পারে কোনো বড় ধরনের কোম্পানি ঐ কোম্পানিকে টাকা পাচার করেছে। সে নিজে হয়তো দিনের আলোয় আসতে চাইছে না। গভীরে তদন্ত করলে আসল ব্যক্তি বা কোম্পানিটা ধরা পড়ে যেতে পারে। আপাতত লোকসানে চলা এই ধরনের কোম্পানিগুলির ইলেক্টোরাল বন্ডে দান করার কয়েকটি পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে-

কোম্পানির নামক্ষতি/লাভইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছেBJP ইলেক্টোরাল বন্ড বাবদ পেয়েছে
ভারতী এয়ারটেল২০২১-২৩ এর মধ্যে ক্ষতি ৯৭১৬ কোটি টাকা১৯৭.৬ কোটি টাকা১৮৩ কোটি টাকা
ক্যাসল লিকার প্রাঃ লিঃ (কলকাতা)লাভ ৬ লক্ষ টাকা৭.৫ কোটি টাকা৬.৮ কোটি টাকা
মদনলাল লিমিটেড (কলকাতা)লাভ ১.৮৪ কোটি টাকা১৮৫.৫ কোটি টাকা১৭৫.৫ কোটি টাকা

এইভাবে যে তালিকা পাওয়া গেছে তা হিসাব করলে দেখা যাবে ১৬টি এমন কোম্পানি আছে, যাদের গত তিন বছরে ক্ষতি হয়েছে, অথচ ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে ৭১০ কোটি টাকার, আর বিজেপি সেখান থেকে পেয়েছে ৪৬০ কোটি টাকা। ক্ষতি হলে বন্ড কেনার টাকা পেল কোথায় ? আর লাভ হলে, লাভের বেশি টাকা দিয়ে বন্ড কিনল কীভাবে ? সম্পত্তি বিক্রি করেছে ? নাকি অর্থ পাচার হয়েছে এখানে ?

(৩) সরকারি বরাত এবং ইলেক্টোরাল বন্ডের সংযোগ প্রমাণ করছে সরকারি বদান্যতার বিনিময়ে চাঁদা আদায় করা হয়েছে। এখানে আর্থিক অভিযোগে অভিযুক্ত কোম্পানিও পুরস্কৃত হয়েছে। এমন কয়েকটি কোম্পানি হল- (i) উত্তরাখন্ডে বিখ্যাত টানেল তৈরি করতে গিয়ে ৪১ জন শ্রমিক অসহায়ের মতো দীর্ঘক্ষন আজকে পড়েছিল। কাজের বরাত পেয়েছিল নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্টোরাল বন্ডে দিয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। (ii) রঞ্জিত বিল্ডিং- হায়দ্রাবাদে সেতু ভেঙে পড়ার কাহিনী সবাই জানে। তবুও তার গুজরাটে ভাদোদরা, সুরাট, রাজকোট সহ অনেকগুলো জায়গায় কাজের বরাত পেতে অসুবিধা হয়নি। ইলেক্টোরাল বন্ডে দিয়েছে ৯ কোটি টাকা। (iii) হায়দ্রাবাদের মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং- নীতিন গডকরি যার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন লোকসভায়, ২০১৯ সালে IT তার দপ্তর রেড করেছিল। ক্যাগ রিপোর্ট যার সম্পর্কে আগের কাজের সমালোচনা করে বলেছিল- তার কাজের ফলে ৮১ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। তবুও L&T কোম্পানিকে কাজ না দিয়ে তাকে ১৪ হাজার কোটি টাকার থানে-বলিভারি টুইন টানেল তৈরি করার কাজ দেওয়া হয়েছে। বরাত পাবার কয়েক মাস আগে সে ১১৮৬ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছিল। এখান থেকে বিজেপি পেয়েছে ৬৬৪ কোটি টাকা। (iv) বিজি শ্রাইক সংস্থাটির বিরুদ্ধে শ্রমিক মৃত্যুর জন্য এফআইআর করা হয়েছে। ইলেক্টোরাল বন্ডে দিয়েছে ১১৮ কোটি টাকা। এইভাবে কেন্দ্র ও বিজেপি শাসিত রাজ্যে এইরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে।

(৪) ওষুধ কোম্পানিগুলো ইলেক্টোরাল বন্ডে টাকা জমা দিয়েছে। শুধু GST নয়, ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির এটাও একটা বড় কারণ হতে পারে। শুধু মূল্যবৃদ্ধি নয়, তারা বেপরোয়া ভাবে যদি ক্ষতিকর ওষুধও দেয়, তাতে ছাড়ও হয়তো পেয়ে যেতে পারে। Scroll.in -এর সমীক্ষায় দেখা গেছে ৩৫টি ওষুধ তৈরীর কোম্পানির প্রায় ১০০০ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে নির্বাচনী চাঁদা বাবদ দান করেছে। তার মধ্যে হেটরো গ্রুপের কোম্পানিগুলো দিয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। টরেন্ট ফার্মা দিয়েছে ৭৭.৫ কোটি টাকা। অথচ এই কোম্পানির বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র সরকার গুণমানের স্বল্পতার অভিযোগ এনেছিল। বিহার সরকার এইরকম অভিযোগ এনেছিল জাইদুস হেলথ কেয়ারের বিরুদ্ধে। কোম্পানিটি ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে ২৯ কোটি টাকার। গ্লেনমার্কের বিরুদ্ধে প্রায় একই অভিযোগ এনেছিল মহারাষ্ট্র সরকার। সে-ও ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে ৯.৭৫ কোটি টাকার। মূল্যবৃদ্ধি শুধু নয়, নিম্নমানের ওষুধ দিয়ে স্বাস্থ্যহানি বা মৃত্যুর কারণ হয়ে যাচ্ছে না তো ইলেক্টোরাল বন্ড ?

(৫) দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া ২৩ মার্চ’ ২০২৪ সংখ্যায় যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে কোন কোন গোষ্ঠী এখন অবধি কাকে কত টাকা দিচ্ছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। বড় অংকের দানের কয়েকটি পরিসংখ্যান-

কোম্পানির নামমোট বন্ডের পরিমান (কোটি টাকা)BJP পেয়েছে (কোটি টাকা)TMC পেয়েছে (কোটি টাকা)কংগ্রেস পেয়েছে (কোটি টাকা)অন্যান্য (কোটি টাকা)
ফিউচার গেমিং (ডিয়ার লটারি)১৩৬৫১০০৫৪২DMK- ৫০৩ BJP- ১০০ অন্যান্য- ২১১
মেঘা গ্রূপ অফ কনস্ট্রাকশন১২৩২৬৬৯১২৮৪৩৫
সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গ্রূপ৬০৬১২৭৪৫৯১৫
কেভেন্টার গ্রূপ৫৭৩৩৪৫৬৬১২২৩৮.৫
আদিত্য বিড়লা গ্রূপ৫৪৩২৭৫১০ লক্ষBJD- ২৬৪.৫ অন্যান্য- ৩
ক্যুইক সাপ্লাই (আম্বানি সংশ্লিষ্ট)৪১০৩৭৫৩৫
ওয়েল স্পুন (আদানি সংশ্লিষ্ট)৫৫৪২১৩

মাত্র একটা রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে কত অর্থ পাওয়া যেতে পারে তা একমাত্র তৃণমূল-কংগ্রেস আর কিছুটা তেলেঙ্গানার ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি (BRS)-ই বলতে পারবে।

(৬) রাতারাতি ভুয়ো কোম্পানির জন্ম দিয়েছে কিনা সেই বিষয়েও তদন্ত হওয়া দরকার। ইলেক্টোরাল বন্ডের ব্যবস্থাপনা চালু হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ৬০টি কোম্পানি জন্ম নিয়েছে এবং তারা ২৫০ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে। সেখান থেকে বিজেপি পেয়েছে ১০০ কোটি টাকা। তেলেঙ্গানার BSR পেয়েছে ৬১ কোটি টাকা। LCC প্রজেক্ট প্রাঃ লিঃ ৩১৫ কোটি টাকার বন্ড কিনে পুরোটাই বিজেপিকে দিয়েছে, কোম্পানির জন্মতারিখ- ২৮/১২/২০১৭; TVS মোবিলিটি প্রাঃ লিঃ কোম্পানি ১৬ কোটি টাকা বন্ডের পুরোটাই দিয়েছে বিজেপিকে, কোম্পানির জন্মতারিখ- ২৬/০২/২০১৮ (সূত্র- সানডে টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৪/০৩/২০২৪)।

(৭) এছাড়া প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সাংবাদিক বৈঠকে ৩০টি শিখন্ডি কোম্পানির কথা জানিয়েছেন। এইগুলি আসলে বিদেশে থাকা কোম্পানির কথা জানিয়েছেন। এইগুলি আসলে বিদেশে থাকা কোম্পানি, যাদের সঙ্গে কোনো ভারতীয় কোম্পানির যোগাযোগ থাকে। উক্ত কোম্পানিগুলির ১৪৩ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে এবং বেশিরভাগ টাকাটাই বিজেপিকে দিয়েছে।

(৮) ইলেক্টোরাল বন্ডকে যদি চলতে দেওয়া হত, তাহলে ভারতীয় গণতন্ত্রের শ্রাদ্ধ করেই ছাড়ত। এটাই তো এখন চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী পথে চলা শাসকরা চায়। এক একটা নির্বাচন আসবে, এই সমস্ত নিশিকুটুম্বরা পুঁজিবাদী দলগুলিকে অঢেল টাকা দেবে। কেন্দ্রে যে থাকবে তাকে দেবে, কাজের সুবিধায় রাজ্যের শাসকদলকেও দেবে। সেই জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের এত টাকা পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন। তৃণমূল-কংগ্রেস ইলেক্টোরাল বন্ডে টাকা পেল ২৪৯ কোটি, বিজেপি পেল ৮০ কোটি, কংগ্রেস পেল ৫০ কোটি। কংগ্রেস কোনো আসন পেল না। বাকি ফল এল টাকার অংক মিলিয়েই। কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপি পেল ৩৩৫ কোটি টাকা, কংগ্রেস পেল ১৮০ কোটি টাকা। বিজেপি বিরোধী ক্ষোভের মাত্রাটা বেশি ছিল বলে টাকার অংক চূড়ান্ত কথা বলতে পারল না। তবুও দুর্নীতিতে জড়িত এই টাকা সাধারণ নির্বাচনের সামনে একটা বাধা। এই টাকা জনগণের মধ্যে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। প্রভাব বিস্তার করানোর জন্য মিডিয়া, বাহুবল সবই একসাথে কাজ করে। নির্বাচনী খরচের যে আর্থিক গণ্ডি বেঁধে দেওয়া আছে তা পুঁজিবাদী দলগুলি প্রতিনিয়ত উপেক্ষা করে চলার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। যদিও চূড়ান্তভাবে শেষ কথা বলে মানুষ।

সমস্ত লেনদেনের মধ্যে এক কোটি টাকা বা তার বেশি লেনদেন করেছে ৯৩.৬৭ শতাংশ কোম্পানি বা ব্যক্তি। অর্থাৎ প্রচুর টাকার মালিকরা বা কোম্পানিগুলো লেনদেন করেছে। আর তার ভিতর দিয়ে জনগণের টাকা লুট হয়েছে। সেতু ভেঙে পড়া, শ্রমিক মারা যাওয়া, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া, কালো টাকা পাচার করা -এসব ক্ষতি আসলে জনগণের ক্ষতি। এটা কোনো একটা একক দুর্নীতি নয়, একগুচ্ছ দুর্নীতির সমাহার। FCRA আইন লঙ্ঘন, অর্থ পাচার, কর ফাঁকি, নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ব্যবহারে মদত ইত্যাদি আলাদা করে ধরলে এক একটা আলাদা দুর্নীতি। আর একসঙ্গে ধরলে তারই নাম ইলেক্টোরাল বন্ড। অন্য সমস্ত দুর্নীতির সঙ্গে এর আর একটা পার্থক্য হল, অন্য সমস্ত দুর্নীতিতে আইনকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর এখানে আইন করা হয়েছে দুর্নীতি করার জন্য। এই আইনে লুটেরা পুঁজিকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছিল।

মোদির নেতৃত্ব বিশ্বের পুঁজিবাদের সামনে, দুর্নীতির সামনে লুটেরা পুঁজির নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ভারতেই তার রথযাত্রার চাকা কাদায় বসিয়ে দিয়েছে। আরও একটা আছে- পিএম কেয়ার ফান্ড। এখানেও বলা হয়েছে চূড়ান্ত গোপনীয়তা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী তার ইচ্ছেমতো লেনদেন করবেন। কত টাকা এল, কত টাকা গেল, কার কাছে গেল -এইসব তিনি কাউকে জানাবেন না। লোকসভায় সংখ্যাধিক্যের জোরে সংবিধান প্রদত্ত জনগণের জানার অধিকারকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। করোনার সময় কেন্দ্রীয় সরকার স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মচারীদের কাছ থেকে তাদের সম্মতি ছাড়াই টাকা আদায় করেছে। অথচ ব্যবস্থাপনা এমন যে, তাদেরও জানার কোন অধিকার নেই। তারা জানতে কখনো পারবে না যে তাদের টাকাটা কোথায় এবং কীভাবে খরচ করা হল। ইলেক্টোরাল বন্ড যে কারণে বাতিল হয়, একই কারণে পিএম কেয়ারও বাতিল হবার যোগ্য। বিচার চাইলে এমন বিচারই হয়তো পাওয়া যেতে পারে ভবিষ্যতে। পিএম কেয়ার চালু হয়েছিল কোভিডের দুর্যোগের দিনে। দেশ যখন অতিমারিতে আতঙ্কিত, শাসক সেদিন নির্ভয়ে ২০২০ সালের ২৭ মার্চ তারিখে এটা চালু করেছিল। তারপর ৯ নভেম্বর’ ২০২০ তারিখ আমেরিকার তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশেও হুবহু প্রায় একই রকম ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তার নাম সেভ আমেরিকা পিএসি। তবে সেখানে সর্বোচ্চ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফেড রিজার্ভকে জানাতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু ফেড রিজার্ভ রাষ্ট্রপতিকে না জানিয়ে সেটা কাউকে জানাতে পারত না। এখন ঝাঁপি খুলেছে। বাইডেন জেনে গেছেন। দেখা গেছে সেখানে ভারত থেকে ২.৮৩ লক্ষ ডলার জমা পড়েছে। কোন ফান্ড থেকে গেছে এখনও কেউ জানে না এবং চীন, সৌদি আরবসহ প্রায় ২০টির মতো দেশের সরকার বা ব্যাংক সেখানে টাকা দিয়েছে। সেখান থেকে ট্রাম্প বেশ কিছু ডলার নিজের ব্যবসায় সরিয়ে নিয়েছেন -এটাও ধরা পড়ে গেছে।

কি বোঝা গেল ? আর কি বা পরে বোঝা যেতে পারে আমাদের দেশে ?

কতখানি দুর্নীতির পথে বেপরোয়া নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকার তা ভাবলে অবাক হতে হয়। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায় বেরোনোর তিনদিন আগে সরকার SPMCIL (সরকারি নোট, বন্ড ইত্যাদি ছাপার জায়গা)-এ ১০,০০০ কোটি টাকার বন্ড ছাপিয়ে রেখেছিল (সূত্র- ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ৩০/০৩/২০২৪)। গোটা বিষয়টা শুধু দুর্নীতি নয়, একই সাথে স্বৈরাচারী প্রবণতারও বহিঃপ্রকাশ।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাঁর একটি সমস্যা ও ভাবনাচিন্তার কথা ব্যক্ত করেছেন। ২৮ মার্চ’ ২০২৪ তারিখে দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় জানা গেল তিনি ED-র উদ্ধার করা ৩০০০ কোটি টাকা গরীবদের দিতে চান। কিন্তু কিভাবে তিনি দেবেন, সেই নিয়েই তাঁর গভীর চিন্তা। এই ভাবনার অবসানের জন্য তাঁর সদ্ভাবনাকে  আপাতত সম্মান জানিয়ে একটা অনুরোধ করতে পারি কি ? অসংবিধানিক ও নীতিহীনভাবে তাঁর দল বিজেপি ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে যে ৮০০০ কোটিরও বেশি টাকা আয় করেছে, সেটাই না হয় গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিক। এখানে তো কোন আইনি বাধা থাকার কথা নয়। আর তিনি তো তাঁর দলের সর্বেসর্বা। চাইলেই তিনি এই কাজ দলকে দিয়ে অনায়াসে করিয়ে নিতে পারবেন। দরকার শুধু একটুখানি সদিচ্ছার।

২৮ মার্চ’ ২০২৪ তারিখে রিপোর্টার টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ পরকলা প্রভাকর বলেছেন- “I think because of the electoral Bond issue, divide is going to the BJP and the people of India – not necessarily between the BJP and the political party for the BJP and the another alliance. So, therefore, I think the Electoral Bond issue will gain even much more momentum and it has already the Spark out of the control of the BJP and the Government. …it is not only the highest scam in India, but this is the biggest scam in the world.” (আমি মনে করি ইলেক্টোরাল বন্ডের বিষয় বিজেপি এবং জনগণের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে চলেছে। এটা বিজেপি ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলি বা বিজেপি ও অন্য কোনো জোটের মধ্যে বিভাজনের বিষয় নয়। তাই, আমি মনে করি ইলেক্টোরাল বন্ডের বিষয় আরও তীব্রতা লাভ করবে এবং তা বিজেপি ও সরকারের নাগালের বাইরে চলে যাবে। …এটা কেবলমাত্র ভারতের সর্বোচ্চ দুর্নীতির বিষয় নয়, সারা বিশ্বের সর্বোচ্চ দুর্নীতির বিষয়)। এরপর আরও এক জায়গায় তিনি বলেছেন- এর জন্য জনগণ বিজেপিকে কঠোরতম শাস্তি দেবেন।

একদম শুরুর বাক্যটাই সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যময়। এটা বিজেপির সাথে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের বিরোধের বিষয় নয়। এটা জনগণের সাথে বিজেপি ও তার সরকারের বিরোধ। কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ছাড়া বাকি সব পার্টিই তো ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেটের উচ্ছিষ্ট খেয়েছে। তাই তাদের সাথে বিজেপির বিরোধ হলে জনগণ বিশ্বাস করবে কেন ? জনগণের সাথে বিজেপির এই সংঘাতে জনগণ লড়বেন, কিন্তু নেতৃত্ব দেবে কে ? -কমিউনিস্ট পার্টিগুলি। তার মধ্যে CPI(M)-ই দিতে পারে, কারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে একমাত্র সে-ই সুপ্রিম কোর্টে লড়াই করে এই দুর্নীতি চক্রের মুখোশ খুলে দিতে সমর্থ হয়েছে। পুঁজিবাদী কাঠামোয় সৃষ্ট লুটেরা পুজির বিরুদ্ধে লড়াইতে CPI(M)-ই পারবে অন্য সমস্ত সম মতাবলম্বী দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে নিয়ে তীব্র লড়াই দিতে। কর্পোরেট চক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা CPI(M) তার সৃষ্টির সময় থেকেই কর্মসূচিতে লিখে রেখেছে। সেই জন্যই সে ২০০৪ সালে টাটা’র দেওয়া ১৯ লক্ষ টাকার চেকটা পত্রপাঠ ফেরত দিয়েছিল। CPI(M)-র সংগ্রামের প্রতি এই বিশ্বাস আদালতের সর্বোচ্চ স্থান থেকে জনগণের একেবারে মাটির কাছাকাছি থাকা স্তর পর্যন্ত ক্রমশ ব্যাপ্ত হচ্ছে। এখন প্রয়োজন এই দুর্নীতি প্রসঙ্গে নিরন্তর ও কার্যকরী প্রচার যাতে ভারতের জনগণ নতুন দিশার পথে এগোতে সাহস পাবেন।

দেশজুড়ে আমাদের মূল লড়াই বিজেপি’র বিরুদ্ধেই। তারাই এমন আগাগোড়া বেআইনি কাজের জন্মদাতা। বাকিরা ফলভোগকারী হলেও জন্মদাতা নয়। আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এ পথে চলে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দল। তারাই এ রাজ্যের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। আর তাই আমাদের সংগ্রামে তাদের বিরুদ্ধেও লড়াইটিও অবশ্যকর্তব্য।

Spread the word

Leave a Reply