নীলোৎপল বসু
সবকিছু থেকে দায় ঝেড়ে ফেলার শিকড় সন্ধানে
মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ২০১৪ সালে। ফোর্বস পত্রিকায় দুনিয়াজুড়ে ধনীদের তালিকায় তখন আদানির অবস্থান ছিল ৬০৯তম। ২০২২ সালে তারাই সেই তালিকার ২ নম্বরে উঠে আসে। এমন উল্কাসম উত্থানে সবারই আগ্রহ তৈরি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। হিন্ডেনবুর্গ সংস্থাও সেরকমই আগ্রহ নিয়ে এদের গতিবিধির পর্যালোচনা করেছে, যদিও তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল বেরিয়েছে উল্টো! দেখা যাচ্ছে এমন উত্থানের পিছনে দায় ঝেড়ে ফেলার মতো নির্লজ্জ মনোভাবই আসল কৌশল। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোদী আদানির পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন, ২০১৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসলে সেই লক্ষ্যের ষোল কলা পূর্ণ হয়।
মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম একটি অভিযোগ হল তারা ইডি, সিবিআই ও আইটি’র মতো সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে তারা সরকার বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিজেদের পক্ষে টেনে আনে- সহজ কথায় কিনে নেয়। এমন আকজের উদ্দেশ্য কি? আসলে বিভিন্ন রাজ্যে এভাবেই তারা নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সাংবিধানিক সংস্থাগুলির উপরে নিজেদের এমন দাপটের কারনেই আদানি’র এতদিন কিছু হয়নি, তারা নিশ্চিন্তে একের পরে এক সরকারী সম্পত্তি কিনে নিয়েছে। কেমন সেই কায়দা? ২০১৮ সালে আয়কর বিভাগ কৃষ্ণপত্তনম বন্দরে তল্লাশি চালায়, একইসাথে নবযুগের দপ্তরেও অভিযান চলে। এর ফল কি? দু বছর বাদে, ২০২০ সালের ৬ই অক্টোবর আদানিরা ঐ বন্দরের ৭৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। পরের বছর এপ্রিল মাসে তারা ঐ বন্দরের মালিকানা শেয়ারের একশো শতাংশই তুলে নেয়। এবার সিবিআই। ২০২০ সালের ২রা জুলাই এসিসি অম্বুজা সিমেন্টের কোম্পানিতে অভিযান চালায় সিবিআই। গত বছর ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে আদানিদের হাতে ঐ কোম্পানির বেশ কিছু শেয়ার চলে আসে। ২০২০’র ২রা জুলাই সিবিআই জিভিকে (গুণপতি বেঙ্কট কৃষ্ণা) গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে, ১৮ই জুলাই তাদের দপ্তরে অভিযান চালায় ইডি। এতে কি হল? ৩১শে আগস্ট জিভিকে আদানিদের হাতে মুম্বই বিমানবন্দরের মালিকানা বিক্রি করে দেয়। আর্থিক বিকাশের এমন বিবরণ অন্য কোনও অনুমানের অপেক্ষায় বসে থাকে কি?
এখানেই শেষ নয়! এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার অধীনে থাকা প্রতিটি বিমানবন্দরই কিভাবে কেবলমাত্র আদানিদের হাতেই বিক্রি হল সে কাহিনী এত বড় যে একটি প্রবন্ধে সেকথা লিখতে গেলে স্থানসংকুলানের সমস্যা দেখা দেবে। গোটা দেশজুড়ে এমন একচেটিয়া মালিকানা প্রাপ্তির বিরুদ্ধে কার্যকরী উদাহরণ একটাই– নিজেদের তহবিল থেকে ভরতুকি দিয়েও তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরটিকে নিজেদের আওতাধীন রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কেরালার এলডিএফ সরকার।
এলআইসি কিংবা এসবিআই’র মতো রাষ্ট্রায়ত্ব আর্থিক সংস্থাগুলি থেকে আদানিরা যে কায়দায় নিজেদের ব্যবসায় পুঁজি টেনে এনেছে তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অবশ্য শেষ কয়েকদিন ধরে দেশের অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আদানিদের বিষয়ে মৌনব্রত ধারণ করে রয়েছেন তাতে স্পষ্ট আরও একবার চৌকিদার’দের সরকার বিপাকে পড়েছে। বেকায়দায় পড়লেই মোদী সরকারের তরফে এমন নৈশব্দ নেমে আসে।
আপাতত আদানিদের কল্যানে শেয়ার বাজার ও বন্ড মার্কেটে যে অব্যবস্থা তৈরি হয়েছে তার চাপে তারা সমস্ত এফপিও (ফলো অন পাবলিক অফারিং) ও ডলার ডিনোমিনেটেড বন্ড অফারিং বাতিল করেছে। এমনটা না করলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব ক্যাপিটাল মার্কেট সহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিমন্ডল সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতা বড়সড় ধাক্কা খেত। ইতিমধ্যেই ক্রেডিট স্যুইস, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলি নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। ভারত সরকার ও তাদের অধীনস্থ নিয়ামক সংস্থাগুলি আদানিদের প্রসঙ্গে যত বেশিদিন চুপ থাকবে আন্তর্জাতিক পরিসরে এই নিয়ে ততই বেশি আওয়াজ উঠবে। আদানিরা যা করেছেন তা শুধু একটি দেশ, তার আর্থিক ব্যবস্থা কিংবা হিন্ডেনবুর্গের বিষয়মাত্র নয়। সাম্প্রতিক ঘটনায় বিশ্বপুঁজিবাদের আসল চেহারাটা সামনে এসে গেছে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস লিখছে- ‘এটা শুধু আদানি কিংবা কোনও একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কিংবা তার জালিয়াতির অনুসন্ধানকারী সংস্থার কথা না। এর প্রভাব পড়বে অনেকদূর অবধি। ভারতে কর্পোরেট ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ প্রশ্নের সামনে পড়েছে। দেশের উন্নয়ন সম্পর্কে যে মডেলটি এত বছর ধরে তুলে ধরা হয়েছে সেই গোটা বন্দোবস্তটাই এখন ঝুঁকির মুখোমুখি’। আসলে কতিপয় অতিধনীদের হাতে একটি দেশের যাবতীয় সম্পদ এমনকি ভবিষ্যৎ অবধি তুলে দেওয়া হলে কি হতে পারে সেটাই এখন দেখার- এমনই বলতে চাইছে তারা। আজকের দুনিয়ায় নয়া-উদারবাদের শৃঙ্খল কেটে বেরিয়ে আসা সহজ না- হিন্ডেনবুর্গ যা করেছে তা হিমশৈলের চুড়ামাত্র।
কে কত সম্পত্তির মালিক সেইসব খতিয়ান রেখে চলা সংস্থার নাম গ্লোবাল ইন্ডেক্সিং এজেন্সি। আদানিদের কাজকর্মের প্রতি তাদের কড়া নজর রয়েছে বলে জানাচ্ছে তারা। মুখের কথায় কোনোকিছু মেনে নিতে তারা নারাজ।
এই ঘটনায় আমাদের দুশ্চিন্তা করার মতো কি রয়েছে?
আদানি কিংবা তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা এই পরিস্থিতির দায় সম্পর্কে হাত ধুয়ে ফেলার যতই চেষ্টা করুক না কেন, এখনও অবধি স্পষ্ট ব্যাপারটা অত সহজে হবে না। এফপিও (ফলো অন পাবলিক অফারিং) খারিজ করলেই সবাই সব ভুলে যাবে এমনও না। মোদীর একান্ত বন্ধু বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যতই আদানিদের জন্য পুঁজির যোগান দিন না কেন- দুনিয়ার সব বিনিয়োগকারীই তো আর ভক্ত নন!
মোদী-আদানির সম্পর্ক ধান্দাবাজির (ক্রোনি) সমস্ত পর্যায়ের উর্ধে উঠে সক্রিয় ছিল। দেশের যাবতীয় পরিকাঠামো ক্ষেত্রগুলি আদানিদের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি হাজির করে ব্লুমসবার্গের জনৈক কলাম লেখক জানাচ্ছেন- ‘আমরা কি চাইব না আমাদের দেশে সোলার প্যানেল তৈরি হোক? আদানিরা সেই কর্তব্য মাথা পেতে নেবে। প্রধানমন্ত্রী কি ইতিমধ্যেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে শক্তপোক্ত সরকারী নীতি গ্রহণ করেননি? আদানি ছাড়া আর কে সেই দায়িত্ব নেবে? আমাদের দেশের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় অস্ত্রসস্ত্র বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে বলে কি আমরা উদ্বিগ্ন? কে না জানে আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে এবং আদানিই পারেন সেই স্বনির্ভরতা যোগাতে। মেক ইন ইন্ডিয়া-তো আমাদেরই স্লোগান, সেইমতই সব করা হবে। রাজনীতির কারণে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার প্রেক্ষিতে ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই নির্মাণ করে দেবে আদানিরা’।
বোঝাই যাচ্ছে আদানির সাম্প্রতিক অধোগতি দেশের সম্মানকে সামনে রেখেই আড়াল করার চেষ্টা হবে। ইতিমধ্যেই আদানিরা সেই কথা বলে ফেলেছেন- তার উপরে আক্রমণ যে আসলে ভারতেরই অসম্মান! একে কি বলা যায়? আজকের পৃথিবীতে এই হল উগ্র-জাতীয়তাবাদ।
আদানিদের পক্ষে কেউ নেই এমন না। আরএসএস মাঠে নেমে পড়েছে। হিন্ডেনবুর্গের প্রতিবেদন কতদুর ভারতবিরোধী সেই ব্যখ্যা দেওয়ার সঙ্গেই এই পরিস্থিতির জন্য বামপন্থীদের দোষারোপ করতে তারা ভোলেনি। আমরা এর থেকে কি সিদ্ধান্তে উপনীত হব? ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার পরে যে সম্পর্কের সুত্রপাত ঘটেছিল, আজকের দিনে মোদী-আদানির সেই বন্ধুত্বই হল ভারতের ক্ষেত্রে কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাত। এই রাজনীতির স্বরূপ বুঝতে এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।
আগামিদিনে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কিংবা লগ্নী পুঁজির আন্তর্জাতিকতা যাই হোক না কেন আসলে তো ব্যাপারটা পুঁজিবাদই। আদানিদের জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রতিটি অনুসন্ধান, প্রতিটি তথ্যতালাশ শেষ অবধি মোদী সরকারকেই প্রশ্নের সামনে এনে ফেলবে। এই কারনেই সরকারের আওতার বাইরে উচ্চ পর্যায়ের স্বতন্ত্র সংস্থার হাতে সংশ্লিষ্ট তদন্তের দায়িত্ব দিতে হবে।
এমন ভয়ানক পরিস্থিতির ব্যখায় মার্কসের কথা মনে পড়তে বাধ্য। পুঁজি গ্রন্থে ‘শিল্প পুঁজির গোড়াপত্তন’ প্রসঙ্গে মার্কস লিখেছিলেন- ‘ পুঁজির মাথা থেকে পা অবধি সর্বত্রই লুঠের নোংরা ও রক্তের চিহ্নগুলি লেগে রয়েছে’। পরে আরও যুক্ত করলেন এই বলে- ‘যথেষ্ট মুনাফা পেলে পুঁজি খুবই সাহসী। মুনাফা যখন ১০ শতাংশ, গোটা দুনিয়া ছুটে বেড়াতে পুঁজির এতটুকুও ক্লান্তি নেই। মুনাফা ২০ শতাংশ হলে পুঁজি বেপরোয়া হয়ে ওঠে, ৫০ শতাংশ হলে তার স্পর্ধা মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। ১০০ শতাংশ মুনাফার ক্ষেত্রে পুঁজি মানুষের তৈরি যেকোনও আইনকেই পায়ে মাড়িয়ে যেতে প্রস্তুত। মুনাফা ৩০০ শতাংশে পৌঁছালে এমন কোনও অপরাধ নেই যা করতে তার হাত কাঁপবে, এমনকি সেই অপরাধের জন্য যদি স্বয়ং পুঁজির মালিককেই ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয় তবুও সে ঝুঁকি নিতে রাজী’। আদানি’র ঘটনা আর কিছু না হোক অন্তত মার্কসের কল্পনাকে সত্য প্রমাণ করে তবে ছেড়েছে।