ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
গত জুন মাসেই ভারতে মোট ১৩০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। স্থায়ী বেতনের কাজ হারিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা ২৫ লক্ষ। ৮০ লক্ষেরও বেশি কাজ বন্ধ হয়েছে আমাদের দেশে সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান দেওয়া কৃষিক্ষেত্রে।
এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)’র প্রতিবেদনে।
এই বছরেরই মে মাসে গ্রামাঞ্চলে বেকারত্মের হার ছিল ৬.৬২ শতাংশ, এক মাসেই তা বেড়ে হয়েছে ৮.০৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলেও বেকারত্মের হার এই পর্বে বৃদ্ধি পেয়েছে, জুন মাসে সংশ্লিষ্ট হার হয়েছে ৭.৩০ শতাংশ- মে মাসে ছিল ৭.১২%।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর মহেশ ব্যাস জানিয়েছেন লকডাউন নেই এমন অবস্থায় বেকারত্মের হার আগে কখনো এই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। কাজ হারানোর নিরিখে এমন অবস্থা অভূতপূর্ব। স্থায়ী বেতনের কাজে কর্মচ্যুতির ব্যখ্যায় তিনি দুটি সম্ভাব্য কারনের কথা জানিয়েছেন। একদিকে সশস্ত্র রক্ষীর প্রয়োজন হয় এমন সরকারী কাজের চাহিদা কমে যাওয়া, আরেকদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ নির্ভর বাজারে কাজের সুযোগে ক্রমশ সংকোচন। তার বক্তব্য দেশের অর্থনীতির এমন বেহাল অবস্থা মোকাবিলায় খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, চালু কাজের স্থায়িত্ব বজায় রেখেই নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে কাজের সুযোগ প্রসঙ্গে তিনি জানান শুধু বর্ষার আগমনের অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না, ভালো বৃষ্টির জোরে বেকারির সবটুকু মোকাবিলা করা যাবে না।
নিচের ছবিতে গত পাঁচ বছরে সারা দেশে বেকারত্মের গতিপ্রকৃতি বোঝা যাবে-
চলতি হিসাবে (জুন-২০২২) ভিত্তিতে ভারতে বেকারত্মের হার ৭.৮ শতাংশ। ১০ শতাংশের বেশি হারে বেকারি যুক্ত রাজ্যওয়াড়ি তথ্য নিচের তালিকায় দেওয়া হলঃ
State | বেকারির হার (%) |
তেলেঙ্গানা | ১০ |
ঝাড়খণ্ড | ১২.২ |
সিকিম | ১২.৭ |
বিহার | ১৪.০ |
আসাম / জম্মু-কাশ্মীর | ১৭.২ |
রাজস্থান | ২৯.৮ |
হরিয়ানা | ৩০.৬ |
পশ্চিমবঙ্গে জুন-২০২২’র হিসাবে বেকারির হার ৫.২ শতাংশ।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) বলছে কাজের বাজারে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা কমেছে ৩০ লক্ষ, বাকিরা কোথায় গেলেন? সহজ কথায় তারা বাজারের আওতার বাইরে চলে গেছেন অর্থাৎ কাজের বাজারে শ্রমশক্তির অংশ দাঁড়িয়েছে ৩৮.৮ শতাংশে। এই তথ্যই সবচাইতে ভয়াবহ। এমন হয়েছে বলেই সিএমআইই’র ডিরেক্টর দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন। এপ্রিল-মে’২০২২ এই দুমাসে শ্রমশক্তির অংশীদারিত্মের হার ৪০ শতাংশে আটকে ছিল, জুন মাসে তা আরও কমেছে।
ভারতে এই সময় খরিফ শস্য চাষ হয়। তথ্যে দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ কর্মসংস্থান যখন ভয়াবহভাবে কমে যাচ্ছে ঠিক তখনই দেশে কৃষক হিসাবে নতুন করে কাজে যুক্ত হয়েছেন প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষ। এমনটা হয়েছে কারণ এরা সকলেই জমির মালিক, গ্রামাঞ্চলে কৃষিজমিতে মজুরির কাজেই সবচাইতে বেশি কর্মসংস্থান হয়। বর্ষা আসতে দেরি করায় ব্যাপক মানুষ সেই কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। বেকারত্মের এমন অবস্থার সুযোগ নিয়ে সরকারী নজরদারি নেই এমন জায়গায় খেতমজুরদের ন্যায্য মজুরি কমিয়ে দেওয়াই রেওয়াজ- আগামিদিনে সেই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন পুনরায় শহরাঞ্চলে বেকারির হার বাড়তে দেখা যাবে কারণ চাষের কাজে ন্যায্য মজুরি না পাওয়ায় অনেকেই কাজ খুঁজতে শহরে এসে হাজির হবেন। শস্য চাষের সময় বলেই তারা এখন গ্রামে ফিরে গেছেন, শহর এবং গ্রামাঞ্চলে বেকারির হারে বিরাট ফারাক সেই কারনেই হয়েছে।
এই অবস্থার মোকাবিলা করতে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। কিন্তু সবচেয়ে বেশ জরুরী হল এখনই গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের (এমএনরেগা) কার্যকরী বিস্তৃতি ঘটানো। ১০০ দিনের বদলে ২০০ দিনের রোজগার নিশ্চিত করতে হবে, দৈনিক মজুরি বাজার দর অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। এমনটা হলে তবেই গ্রামীণ এলাকার কর্মক্ষম জনগণ নিজের এলাকায় কাজ পাবেন, তারা কাজে ন্যায্য মজুরি পেলে তবেই বাজারে চাহিদার ভারসাম্য বজায় থাকবে। এর প্রভাবে শহরাঞ্চলের কাজের বাজারে বাড়তি চাপ তৈরি হবে না। একইসাথে শহরাঞ্চলেও কার্যকরী রোজগার প্রকল্পের বন্দোবস্ত করতে হবে – তবেই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতাবস্থায় ফিরবে।
আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য এবং জরুরী পরিষেবাক্ষেত্রে সরকারী বন্দোবস্তের অভাব, কাজের সুযোগ হ্রাস এসবকিছুর সম্মিলিত প্রভাবে ভারতের অর্থনীতি ধ্বসে পড়ছে। সরকারকে বুঝতে হবে বাজারে পণ্য বিক্রি হয় ক্রেতার সামর্থ্যের জোরে। ব্যাংকের আমানতে সুদ কমিয়ে, সার্বিক পরিষেবাক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে উপহার দিয়ে এবং দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির দায়কে বাজারের ভরসায় ছেড়ে দিলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এখনই যদি পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ না বাড়ানো হয়, রোজগার নেই এমন পরিবারগুলিকে মাসিক ন্যুনতম ৭৫০০ টাকার ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার প্রকল্পের আওতায় না আনা যায় এবং গণবণ্টন ব্যাবস্থাকে আরও বিস্তৃত করে জনগণকে রিলিফ না দেওয়া যায় তাহলে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি দেখেও কিছুমাত্র শিক্ষালাভ হয় নি বলেই বুঝতে হবে। এই কাজে প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান খুব সহজেই হতে পারে যদি সরকার অতি-ধনীদের সম্পত্তি কর বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য কর্পোরেটদের লাগাতার কর ছাড় দিয়ে চলা মোদী সরকারের সেই হিম্মৎ আদৌ আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন এই মুহূর্তে সারা দেশ চরম দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় রয়েছে। সরকারের উচিত অবিলম্বে উপযুক্ত আর্থিক সংস্থানের (সম্পতি কর বাড়িয়ে) সাহায্যে নতুন কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ
তথ্য সিএমআইই’র ওয়েবসাইট এবং ছবি সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে প্রাপ্ত