সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদকের বার্তা
সূর্যকান্ত মিশ্র
রাজ্যের সরকার ও শাসকদল গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক পন্থা অবলম্বন করেছে। আমতা থেকে দেউচা পাঁচামি সর্বত্র তারা চাকরি, টাকাপয়সা, প্যাকেজের প্রলোভন এবং ভয় ভীতি সন্ত্রাসের পথে মানুষের মুখ বন্ধ করতে চাইছে। এরাজ্যের সরকারের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এই গণতন্ত্র বিরোধী ঘৃণ্য কৌশল।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্র আনিস খানকে আমতায় গভীর রাতে তাঁর বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হয়েছে। পুত্রের হত্যাকারীদের শাস্তির জন্য তাঁর পিতা এই ঘটনায় সিবিআই তদন্ত চেয়েছেন। যেহেতু সিবিআই তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, তাই যে তদন্তই হোক, আমরা আদালতের নজরদারি ও তত্ত্বাবধানে সত্য উদঘাটনে এবং খুনীদের শাস্তির দাবিতে তদন্ত চেয়েছি। নবান্নের এই সরকারের ওপর ভরসার কোনো কারণ নেই। রিজওয়ানুর রহমানের দুঃখজনক আত্মহত্যার ঘটনার পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে নিজে রিজওয়ানুর রহমানের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আর আমতায় নিহত আনিস খানের বাড়িতে কালকেও মধ্যরাতে কিছু টাকাপয়সা এবং চাকরির প্রলোভন নিয়ে গিয়েছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর বাহকরা। আজ আবার পুলিশ নিয়ে আনিসের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বৃদ্ধ অসুস্থ পিতাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নবান্নে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এভাবে ঘটনা ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা সফল হবে না, সবাই মিলে বৃহত্তর আন্দোলন তীব্র হবে। সমাজের নানা অংশের মানুষ ইতিমধ্যেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ করছেন, সবাইকে আন্দোলনে সামিল করার চেষ্টা করা হবে।
রাজ্যের সরকার ও শাসকদলের এই একই মনোভাব দেখা যাচ্ছে দেউচা পাঁচামীতে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করতে। গোড়া থেকেই এই প্রকল্প নিয়ে যেসব গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে তার জবাব আজ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। তারা প্যাকেজের নামে প্রলোভন দিয়ে প্রকৃত প্রশ্নগুলোকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করছে। সরকার কতটা জায়গার ওপরে কতজনকে ফ্ল্যাট ইত্যাদিতে পুনর্বাসন দেওয়া হবে, কত টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, কতজনকে চাকরিতে নিযুক্ত করা হবে ইত্যাদি বিষয় দিয়ে আসল প্রশ্নকে এড়িয়ে যাচ্ছে। খোলা মুখ খনির প্রকল্পে ঐ এলাকা এবং তার বাইরে পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে জবাব নেই, এখনও পর্যন্ত পরিবেশ ছাড়পত্রও নেই। যে সব শর্তে চাকরিতে নিযুক্তির কথা বলা হয়েছে তা মান্য করে এর আগে বহুজনকে এখনও চাকরি দেওয়া হয়নি। লাফিয়ে লাফিয়ে মূল্যবৃদ্ধির বাজারে শুধু ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে নিয়ে দেউচা পাঁচামীর মানুষ কতদিন কীভাবে দিনযাপন করবেন? পুনর্বাসনের নামে তাদের বাসার ব্যবস্থা করলেও আদিবাসীদের স্থায়ী উপার্জন, জীবনজীবিকা নির্বাহের কী ব্যবস্থা হবে? তাঁদের সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রাখার কতটুকু সম্ভাবনা থাকবে এই জোর করে তুলে আনা পুনর্বাসনে? অতীতে যখন খনি প্রকল্পের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হয়েছিল তখন উদ্যোগটা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা কোল ইন্ডিয়া এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মিনারেল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের মাধ্যমে। এখন আদানিদের ঘন ঘন যাতায়াত দেখে এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে পরিবেশ ও মানুষের জীবনজীবিকার ক্ষতি করে তারা কেবল মুনাফা লুটে নিয়ে যাবে। অষ্ট্রেলিয়ায় এর জন্য তাদের জরিমানা দেওয়ার রেকর্ডও রয়েছে।
এই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে রাজ্য সরকার প্যাকেজের নামে প্রলোভন এবং প্রতিবাদের কন্ঠ দমন করতে ভয়ভীতি সন্ত্রাসের রাস্তা বেছে নিয়েছে। দেউচা পাঁচামীর মানুষের কন্ঠরোধ করা হচ্ছে, বাইরে থেকে বিদ্বেষের রাজনীতি বিরোধী জনমঞ্চের পদযাত্রীরা সেখানে ঢুকতে গেলে আটকানো হয়েছে, আমাদের পার্টির জেলা সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পদযাত্রীদের আশ্রয়স্থলে শাসকদল হামলা চালিয়েছে। এরপরেও যারা সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাদেরও বাধা দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রকল্পের বিষয়ে মূল প্রশ্নগুলো এবং মানুষের প্রতিবাদকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। সর্বাত্মক ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে এর বিরুদ্ধে।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া