এক অমোঘ দূরদৃষ্টি
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/images.jpg)
ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
১৯৩১ সালের ১ মে। সাংহাই থেকে দুজনকে গ্রেফতার করা হল। একজন ফিয়েম চ্যু, তারই সাথে ন্যগুয়েন লুওং বাং।
দুজনকেই অনেকদিন ধরে খুঁজেছে পুলিশ, শেষে বিপ্লবীদের বিশ্বস্ত এক মিলিটারি কর্পোরালের বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ে তারা।
শুরু হল শারীরিক অত্যাচার। সন্ধ্যেবেলায় এক আধিকারিক লুওং’কে জনৈকের ছবি দেখিয়ে জানতে চাইলেন “একে চেন? ইনিই ন্যগুয়েন আই কুয়ক – তোমাদের নেতা হংকং’এ ধরা পড়েছে! এখনও সময় আছে, স্বীকার করে নাও তুমি একে চেনো – বেঁচে যাবে!”
সকাল থেকে হাত পা বাঁধা, তার উপরে অমানুষিক নির্যাতন। তাতেও লুওং সংজ্ঞা হারায় নি।
এখন এই ভর সন্ধ্যেবেলা আধিকারিকটির হাতে ধরা ছবিটি দেখে তার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
১৯২৫ সাল থেকে যে মানুষটিকে সে মিঃ ভুয়ং বলে চেনে, যার সাথে বিদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে এবং গোপনে বহু মিটিং করেছে, বহু পরিকল্পনা একসাথে এগিয়েছে সেই মানুষটাই নাকি ন্যগুয়েন আই কুয়ক!
এই লোকটাই সেই মানুষ যার কথা শুনে গোটা ভিয়েতনামের নিপীড়িত মানুষ লড়াই করার শপথ নিয়েছে! এই সেই মানুষ যাকে পরের দিকে হো চি মিন অথবা চাচা হো বলে ডাকে সবাই!
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/01_2.jpg)
উত্তেজনায় অজ্ঞান হলো না… তার মাথায় তখন চিন্তা যদি এই শয়তান আধিকারিক সত্যি কথা বলে থাকে তার মানে তো ভিয়েতনামের জনগণের এতদিনের লড়াই, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ বিরাট ধাক্কা খেতে চলেছে! সত্যিই যদি ন্যগুয়েন আই কুয়ক গ্রেফতার হন তাহলে তো ওরা তাকে কিছুতেই ছাড়বে না।
মনের চিন্তায় সে ছয় বছর আগে ফিরে যায় – তখন সে ক্যান্টনে একটি ফরাসী যুদ্ধজাহাজে কর্মরত। গরীব পরিবারের সন্তান, পড়াশোনার খরচ বেশি তাই কম বয়স থেকেই কাজ করতে হয়েছে। নিজের চোখে সে দেখেছে, জেনেছে, বুঝেছে কিভাবে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ তাদের দেশটাকে শোষণ করে চলেছে। এসব দেখে তার মন বিদ্রোহী হয়েছে – রাস্তা খুঁজেছে, তখনও কোনও নির্দিষ্ট পথ খুঁজে পায় নি। সেই লুওং খোঁজ পেয়েছে একটি গোপন দলের, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, সকলেই বিদেশের মাটিতে নানা কাজের খোঁজে এসেছে, সকলেই নিজের দেশকে মুক্ত করতে কিছু একটা করতে চায়।
এই দলের সাথে থেকেই তার পরিচয় হয় সিমেনের ট্রেড ইউনিয়নের সাথে, যারা তাকে একটি মানুষের কথা বলে যিনি দেশের মুক্তির লক্ষ্যে সাহায্য করতে পারেন। তখন থেকেই সেই মানুষের নাম জেনেছে মিঃ ভুয়ং! ভুয়ং তাকে সময় দিয়েছেন, অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে কথা বলে সবাইকে একজোট হতে শিখিয়েছেন। শ্রমিকদের জীবনসংগ্রামের কথা উপলব্ধি করিয়েছেন এবং সবচাইতে বড় কথা এই অত্যাচার, শোষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সঠিক দিশা বুঝতে শিখিয়েছেন। ভিয়েতনামের বাইরে থাকা অনেক শ্রমিক ধীরে ধীরে মুক্তির লক্ষ্য হিসাবে শ্রমজীবীদের স্বার্থ এবং জাতীয়মুক্তির আন্দোলনকে একরেখায় উপলব্ধি করতে শিখেছেন এরই দেখানো পথে হেঁটে!
সেইসব দিনেই তারা শুনেছে ন্যগুয়েন আই কুয়কের কথা – যিনি দেশকে মুক্ত করতে সারা পৃথিবী ছুটে চলেছেন, সংগ্রামের নানা রসদ সংগ্রহ করছেন। যাকে ধরতে চায় পুলিশ, মিলিটারি সকলে!
আজ ছয় বছর পরে পুলিশের হাতে জেলখানায় বন্দী হয়ে সে জানতে পারল এতদিন যাকে তারা মিঃ ভুয়ং বলে জানতো সেই মানুষটাই আসলে ন্যগুয়েন আই কুয়ক!
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/354e0d8c2a81e5361790f3b955622bc8.jpg)
হ্যাঁ! হো চি মিন বলে যাকে আমরা আজ একডাকে চিনে নিতে পারি সেই বিপ্লবী মানুষটিকে সারাজীবনে বহু পরিচয়ের আশ্রয় নিতে হয়েছে। বলা চলে তার সেই বহু পরিচয়ের কথা এক কিংবদন্তি হিসাবে পরিণত হয়েছিল তার জীবদ্দশাতেই। তখন সেই দেশের নাম ইন্দোচীন – পরে যাকে আমরা ভিয়েতনাম বলে চিনতে পারি।
হো চি মিন – একটি বিপ্লবী উত্তরাধিকার
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/5yyjhe3e4wyy-623x1024.jpg)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই ফরাসী উপনিবেশের মধ্যে নিপীড়িত দেশগুলির অন্যতম ছিল ভিয়েতনাম।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেনাবাহিনীতে ভিয়েতনামের মানুষদের যুক্ত হবার কথা বলে ফ্রান্স, পরে অবশ্য সেই অঙ্গীকার পালন করতে তারা সরাসরি অস্বীকার ও করেছিল।
হো চি মিন তখন ফ্রান্সেই ছিলেন – ভিয়েতনামের মুক্তির লড়াইয়ের নেতৃত্ব হিসাবে তার নাম ইতিমধ্যেই প্রচার হয়ে গেছিল।
১৮৯০ সালে ভিয়েতনামের এক নিম্নবিত্ত পরিবারে তার জন্ম হয়, জন্মসুত্রে নাম ছিল নগুয়েন সিনহ কাং। একসময় শিক্ষকতার কাজেও যুক্ত হয়েছিলেন, পরে জাহাজে রাঁধুনির কাজ নিয়ে ফ্রান্সে চলে যান। ততদিনে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে জয়ের স্বপ্ন তার চোখে ভরে উঠেছে।
অনেক লড়াইয়ের পরেও সাফল্য আসেনা, অক্লান্ত পরিশ্রমে খোঁজ নিতে থাকেন কোন মতে, কোন পথে দেশের মুক্তি, দেশের মানুষের মুক্তি সম্ভব।
এই সময়েই তার হাতে আসে লেনিনের লেখা বিভিন্ন দেশে জাতিসমূহের আত্মনির্ধারণের প্রশ্ন ( The Right of Nations To Self Determination) বইটি। হো চি মিন উপলব্ধি করেন তার বহু প্রতীক্ষিত সেই মুক্তির পথ লেনিন লিখে রেখে গেছেন। সংগ্রামের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/ho-chi-minh-president1.jpg)
ভিয়েতনাম ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ গঠন করেন – এই সংগঠনের সদস্যদেরই ভিয়েতমিন বলা হত। নগুয়েন সিনহ কাং নতুন নাম গ্রহণ করলেন – হো চি মিন, এই নামের অর্থ ‘আলোর দিশারী’। এর আগে ফ্রান্সে থাকাকালীন তার নাম ছিল নগুয়েন আই কুয়ক -অর্থ দেশপ্রেমিক নগুয়েন।
১৯২৩ সালে কমিন্টার্নে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, সেখানে বিপ্লবী শিক্ষায় প্রশিক্ষন লাভ করেন। পরে সেখান থেকে চলে যান চীনে, সেই দেশে আশ্রিত বিপ্লবীদের একত্রিত করে ইন্দোচীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে – এমন সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্র্যুম্যান’কে সাবধান করে বলেন যদি ফ্রান্স যুদ্ধশেষে নিজের উপনিবেশগুলি পুনরায় কব্জা না করে তবে সেগুলি কমিউনিস্টদের দখলে চলে যাবে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/1024px-Jawaharlal_Nehru_with_Ho_Chi_Minh.jpg)
সেই সাবধানবানী মাথায় রেখেই ১৯৪৬ সালে ফ্রান্সের সেনাবাহিনী আবার একবার ভিয়েতনামে ঢোকে, একইসময় হো চি মিন’ও দেশে ফিরে আসেন – স্বাধীনতার লড়াইকে সফল করতে, মুক্তির যুদ্ধ শেষ করতে। লড়াই শেষ হবে, ভিয়েতনামের জনগন তাদের স্বাধীনতা পাএবন এবং সেই স্বাধীনতা একইসাথে শ্রমজীবী জনতার উপরে চলা শোষণেরও অবসান ঘটাবে এই উপলব্ধি তার ছিল। লেনিনের শিক্ষাই তাকে সেই প্রত্যয় দেয়। সেই দূরদৃষ্টির কারনেই তিনি বারংবার নিজের প্রাণ সংশয়ে জেনেও লড়াই চালিয়ে গেছিলেন। জয়ের লক্ষ্যে অবিচল আবার একইসাথে আসন্ন সংকটের মোকাবিলায় সতর্ক – প্রকৃত বিপ্লবীদের এমন অমোঘ দূরদৃষ্টি থাকেই।
মুক্তির লড়াই সফল হয়েছিল। যদিও জেনিভা শান্তি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তখনকার মতো ভিয়েতনামের দক্ষিণ অংশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দখলে রয়ে যায়, স্বাধীনতা পায় উত্তর ভিয়েতনাম ।সেই উত্তর ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন হো চি মিন। ১৯৫০ সালে মাও সে তুং’ই সবার প্রথমে ভিয়েতনামকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেন।
আজও সারা পৃথিবীতে এবং আরও বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সাথী কমরেড জেনারেল গিয়াপকে পাশে নিয়ে হো চি মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের লড়াই, দিয়েন বিয়েন ফুয়ের যুদ্ধ – ইতিহাসের এক মহানতম অধ্যায়। জনসাধারনের জন্য ভিয়েতমিনদের সেই লড়াই সারা দুনিয়াতেই আজও এক আলোকবর্তিকা, এক প্রকৃত অনুপ্রেরণা যার বিজ্ঞাপন লাগেনা।
সেই লড়াইয়ের নেতা ছিলেন হো চি মিন – সেই নামের অর্থ আজও সকলের মনে রাখার উপযুক্ত, “আলোর দিশারী”।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/facebook_1590574866008_6671354522799231690-576x365-1.jpg)
ওয়েবডেস্কের পক্ষে – সৌভিক ঘোষ
তথ্যসুত্রঃ
১) The times i met him – Nguyen Luong Bang
২) Ho Chi Minh: A Biography – Pierre Brocheux
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া