ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)
কলকাতায় মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে হেডগেওয়ার শরীর চর্চার পাশাপাশি কতখানি ভোজন পটু ছিলেন- সেটিকে নিজেদের আদর্শগত অবস্থান বোঝানোর প্রেক্ষিতে আরএসএস খুব উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবহার করে থাকে। ছাত্র অবস্থায় কলকাতা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত হেডগেওয়ার একসাথে কতগুলি রুটি খেতে পারতেন, এবং কত লিটার দুধ পান করতে পারতেন- সে টিকে হেডগেওয়ারের আদর্শ বোধের ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মানদণ্ড হিসেবে আরএসএস ,তাদের বৌদ্ধিক কল্পকাহিনী নির্মাণের ভেতর দিয়ে ,নিজেদের কর্মী সমর্থকদের সামনে তুলে ধরে।
এই ধরনের খাদ্যাভ্যাসের ভেতর দিয়ে দৈহিক শক্তি অর্জন এবং নিয়মিত শরীরচর্চার ভেতর দিয়ে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, সেই সমস্ত সক্ষমতাকে, মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ই কিন্তু হেডগেওয়ারের খাদ্যাভ্যাস বা শরীরচর্চা ঘিরে আরএসএসের এই প্রচার ।
১৯০২ সালে নাগপুর শহরে খুব ভয়ঙ্কর রকম ভাবে প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয় ।সেই প্লেগ দূর করবার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পন্থার পরিবর্তে, হেডগেওয়ারের বাবা পুজোপাঠের উপরে কতখানি জোর দিয়েছিলেন, সেটিকে প্লেগ মোকাবিলার একটি মানদণ্ড হিসেবে আরএসএস, তাদের কর্মী সমর্থকদের সামনে তুলে ধরে ,আধ্যাত্মিকতাকে ধর্মীয় কুসংস্কারে পর্যবসিত করে, যাবতীয় বিজ্ঞানচিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে ,সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কিভাবে প্রতিক্রিয়াশীলতার চর্চাকে চিরস্থায়ী করে দেওয়া যায়– সেই বিষয়টিকে ই তাদের দৈনন্দিন চর্চার ভেতর দিয়ে, কর্মপদ্ধতির ভেতর দিয়ে, তথাকথিত আদর্শবোধের ভেতর দিয়ে, প্রচার কৌশলের ভেতর দিয়ে ,প্রয়োগ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে পরিবেশন করতে গিয়ে, হেডগেওয়ারের পারিবারিক প্রেক্ষাপট কে কিভাবে ব্যবহার করে সেটি আমাদের মনে রাখা দরকার।
১৯০২ সালের মহামারী আকারে প্লেগের প্রাদুর্ভাব নাগপুর শহরে হেডগেওয়ারের পারিবারিক জীবনে অত্যন্ত বিয়োগান্তক ঘটনাবলী সৃষ্টি করেছিল। প্লেগের প্রাদুর্ভাবে তার পিতা পূজার্চনার ভেতর দিয়ে প্লেগ কে প্রতিরোধ করার সংকল্প নিলেও, সেই প্রেগের প্রাদুর্ভাবে হেডগেওয়ারের দাদা বলিরাম এবং তার স্ত্রী মারা যান। হেডগেওয়ারের বড়ভাই মহাদেব, এই সময়ে পারিবারিক দায়বদ্ধতা বহনের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি ।অথচ এই বিষয়ে গুলিকে কিন্তু আরএসএস, তাদের কর্মী- সমর্থকদের সামনে উপস্থাপিত করতে মহাদেব কে যথেষ্ট ইতিবাচক ,গৌরবজনক ভূমিকায় প্রতিস্থাপিত করে।
হেডগেওয়ারের আরেক ভাই সীতারাম ,এই প্রেগের প্রাদুর্ভাবে আতঙ্কিত হয়ে নাগপুর শহর ছেড়ে ইন্দোরে চলে যান। সেখানে গিয়ে পৌরোহিত্য কে পেশা হিসেবে বেছে নেন ।হেডগেওয়ার থেকে যান নাগপুরে ই। কিন্তু হেডগেওয়ারের পিতা র যাগ-যজ্ঞ ,পূজা পাঠ সত্বেও কেন প্লেগকে প্রতিরোধ করা গেল না, প্লেগ প্রতিরোধে ,আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত কোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে কেন হেডগেওয়ারের পরিবার কোনরকম সংযোগ স্থাপন করতে পারল না– এই প্রশ্নে কিন্তু নীরব ভূমিকা পালন করে যায় আরএসএস নেতৃত্ব ।
এই ঘটনা ক্রমের পাশাপাশি আমাদের মনে রাখা দরকার ;এই সময়কালে র কিছু আগে কলকাতা শহরের প্লেগ রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছিল। প্লেগ প্রতিরোধে বিবেকানন্দ এবং নিবেদিতা সেবাব্রত কে যে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের যাপন চিত্রে একাত্ম করে, সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন –এইসব প্রসঙ্গ গুলি কিন্তু আরএসএস তাদের কর্ম পদ্ধতিতে, তাদের নিজেদের ইতিহাস বলবার ক্ষেত্রে, একটিবারের জন্যও উল্লেখ করে না।
আধ্যাত্মিক পুরুষ বিবেকানন্দ কিন্তু মঠ স্থাপনের উদ্দেশ্যে, বহুকষ্টে অর্থ সঞ্চয় করে ,বেলুড়ে যে জমি ক্রয় করেছিলেন, সেই জমি পর্যন্ত প্রেগ আক্রান্ত রোগীদের সেবা কাজে ব্যয় করার উদ্দেশ্যে, বিক্রি করে দেওয়ার সংকল্পে সেই সময় ব্রতী হয়েছিলেন। বিবেকানন্দ- নিবেদিতা -রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পূজো -পাট, যাগ যজ্ঞ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে প্লেগ প্রতিরোধের বিন্দুমাত্র চিন্তা-ভাবনা করেননি।
বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ,আধুনিক চিন্তা চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ,অন্তহীন সেবা যজ্ঞের মধ্যে দিয়ে, প্লেগের মোকাবিলা তে এঁরা প্রত্যেকে ব্রতী হয়েছিলেন। নিবেদিতা এবং রবীন্দ্রনাথের একযোগে কোনো কর্মযজ্ঞে ঝাঁপ দেওয়ার সেই প্রথম ও শেষ উদাহরণ। ভারতবর্ষের সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই ঘটনাপ্রবাহ একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় রচনা করে রেখেছে। এইসব পর্যায়ের ধার কাছ দিয়ে কিন্তু হেডগেওয়ার বা তার পরিবার ,কলকাতার প্লেগের প্রায় সমসাময়িক সময়ে, নাগপুরে যে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে ,তার মোকাবিলা তে এই ধরনের কোন মানসিকতার প্রয়োগ ঘটাননি।
আধুনিক বিজ্ঞানচেতনা অপেক্ষা, আধ্যাত্মিকতাকে বাদ দিয়ে অন্ধ কুসংস্কারের উপর এই যে আরএসএসের তাত্ত্বিক ভিত্তি র সমস্ত কিছু নির্ভরশীল, হেডগেওয়ারের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ক্রম কে উল্লেখ করে ,নিজেদের তথাকথিত আদর্শের ভিত্তিতে, মানের লক্ষ্যে ,আরএসএসের এইসব চিত্রকল্প সাজানো, তার ভেতর দিয়ে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায় তাদের চেতনার দৈন্য।
নাগপুর শহরে এই যে প্লেগের প্রাদুর্ভাব রোধে সামাজিক সচেতনতার প্রশ্নে ,অন্ধ কুসংস্কারের প্রাদুর্ভাবেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেয় ,আরএসএস তাদের সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হেডগেওয়ারের অন্যতম প্রধান সহযোগী বিএস মুঞ্জের ভূমিকার কথা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে উল্লেখ করে থাকে। বস্তুত এই মুঞ্জের সামান্য কিছু কর্মকাণ্ডের দৌলতে ,তাকে একজন ব্রিটিশবিরোধী নায়ক হিসেবে উপস্থাপিত করে, হেডগেওয়ারের পাশাপাশি, তাকেও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ,সন্ত্রাসী শক্তির ভূমিকাকে খুব জোরের সঙ্গে উপস্থাপিত করবার চেষ্টা করে।
নাগপুরে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের সময়কালে বিএস মুঞ্জে কে একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপিত করে দেখাতে চেষ্টা করলেও আরএসএস কিন্তু মুঞ্জের ,সেই সময় কালে যুক্তিবাদের স্বপক্ষে একটি ভূমিকা র ও উল্লেখ করতে পারে না ।বিএস মুঞ্জে, হেডগেওয়ারের মতই এই সময়কালে ,গোটা বোম্বাই প্রেসিডেন্সি যখন লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে এবং তার সহযোগীদের কর্মতৎপরতায় ,ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ -প্রতিবাদের নানা কর্মতৎপরতা সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, চাপেকার ভাইদের যে ভূমিকা, তিলক কে বিচারের নামে প্রহসনের ভেতর দিয়ে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কারা নির্যাতন– এই সময়কালটাতে কিন্তু আমরা মুঞ্জের কোনো ভূমিকা ই দেখতে পাই না ।
পরবর্তীকালে বিএস মুঞ্জে জাতীয় কংগ্রেসের যখন চরমপন্থী- নরমপন্থী দের সংঘাত খুব তীব্র হয়ে উঠেছে ,এই পর্যায়কালে তিলকের সহযোগী হিসেবে ,কংগ্রেসের সঙ্গে একটা ক্ষীন সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। এই পর্যায়ে টি কে ই উল্লেখ করে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী, সন্ত্রাসী শক্তি বারবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ,ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে, নিজেদের ভূমিকার কথা বলে থাকে।
এই প্রেক্ষিতে হেডগেওয়ার ও মুঞ্জের ভিতরে সংযোগ তৈরীর সময় কালে ,গোটা দেশের সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলন ,যাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল; সশস্ত্র উপায়ে ইংরেজকে এই দেশ থেকে তাড়ানো ,সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিত ,আর তার গোটা পর্যায়ক্রম রচনার পটভূমিকার দিকে যদি একটু নজর না দিই, তাহলে আমাদের জাতীয় আন্দোলন ঘিরে, রাজনৈতিক হিন্দুদের নেতিবাচক ভূমিকার গোটা আঙ্গিকটা স্পষ্ট ভাবে বুঝে উঠতে পারব না।
এই প্রেক্ষিত টিকে সঠিক ইতিহাসবোধের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের বুঝতে গেলে, ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতা দানা বাঁধার কালে, জাতীয় চেতনা, জাতীয়তাবাদের জন্মের ঊষালগ্নকালে, সংস্কার আন্দোলনের ভিতর দিয়ে যে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চেতনার বিকাশ ঘটেছিল, সেদিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
অনেকেই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চেতনাকে, প্রত্যক্ষ ভাবে সাম্প্রদায়িক ভাবনার দোসর হিশেবে দেগে দেন, বিশেষ করে বঙ্কিমের ‘ আনন্দমঠ’ ঘিরে যে পুনরুত্থানবাদী ভাবনা, সেটিকে উপন্যাসের আঙ্গিকের বাইরে এনে, সমাজজীবনের একটি টিপছাপ হিশেবে ধরতে চান।ফলে সেকালেও যেমন এই ভাবনা থেকে বিভাজনের দেওয়াল টা ক্রমশ উঁচু ই হয়েছে, তার বিশেষ ব্যতিক্রম এযুগেও হয় নি।
‘আনন্দমঠে’ র হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চেতনা ,আমাদের জাতীয় আন্দোলনের একটি প্রেক্ষিতে ছোট একটি অংশের ভিতরে, নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও , কেবলমাত্র এই একটি আঙ্গিককে ই বিশ্লেষণ করে, গোটা সশস্ত্র পথে ব্রিটিশকে প্রতিরোধের সংকল্পে প্রত্যয়ী বিপ্লবী সমাজকেই পুনরুত্থানবাদী হিশেবে দেগে দেওয়া- এটি ইতিহাসের প্রতি অবিচার।
পুনরুত্থানবাদ , হিন্দু- মুসলমান – দুটি জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে কিছুটা প্রভাবিত করলেও , তাঁদের চেতনায় , এই পুনরুত্থানবাদী ভাবনা কিন্তু একটি বারের জন্যেও আর এস এস বা তাদের হাজারো শাখা সংগঠন , অথবা রাজনৈতিক সংগঠনের মতো জাতি বিদ্বেষ, ধর্ম বিদ্বেষ, ঘৃণার রাজনীতির সমার্থক ছিল না।একটি দুটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদ দিলে হিন্দু- মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের ভিতরেই পুনরুত্থানবাদী যে চেতনা উনিশ শতকে বিকাশ লাভ করেছিল, উভয় সম্প্রদায় ই যে চেতনাকে সর্বোপরি ব্রিটিশ বিরোধী চেতনাতে পর্যবসিত করেছিলেন , সেখানে কিন্তু আর এস এস যে পরমত অসহিষ্ণুতা, পরধর্ম অসহিষ্ণুতা, পরধর্মের প্রতি ঘৃণার রাজনীতিকেই প্রধান উপজীব্য করে তুলেছে– তেমনটা কোনো অবস্থাতেই ছিল না।
১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তি সময়কাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ,এই কুড়ি বছর কার্যক্রম টিকে জাতীয় কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদন নীতির যুগ বলা হয় ।এই সময়কাল টিকে জাতীয় কংগ্রেস একটা পরিপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদেরকে বিকশিত করেনি ।বার্ষিক অধিবেশনের ভেতরেই সংগঠনটির নিজেদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। সেই বার্ষিক কার্যক্রম কে ,’ তিন দিনের তামাশা’ বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সেই সময়ে ব্যাঙ্গ করা হতো ।
এই অধিবেশনে কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা র ভেতরে ই জাতীয় কংগ্রেসের কর্মপদ্ধতি সীমাবদ্ধ ছিল। তিন দিনের সেই অধিবেশনের পর জাতীয় কংগ্রেসের কার্যক্রমের সেরকম কোন ব্যপ্তি দেখতে পাওয়া যেত না ।এমনকি সংগঠন টির ভিতরে যাঁরা সংযুক্ত ছিলেন, বা নেতৃত্বে ছিলেন ,তাঁরাও কেউ পূর্ণ সময়ের রাজনীতিক ছিলেন না ।নিজের নিজের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁরা অত্যন্ত সফল মানুষ হলেও ,পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি তাঁদের মোহ , এতই বেশি ছিল যে ,উচ্চবর্গীয় সেই সব নেতৃত্ব ,এক ধরনের ব্রিটিশ চাটুকতার ভেতরেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করতেন ।
গোটা সময়টা রাজনীতির জন্য খরচ করার মত মানসিকতা বা শারীরিক ক্ষমতা –কোনো কিছুই তাঁদের ছিল না। পেশাদার জীবনের প্রতি তাঁরা সব থেকে বেশি দায়বদ্ধ থেকেছেন ।পেশাদার জীবন যাপন করার পর , যতো টুকুনি সময় তাঁরা পেয়েছেন ,সেইটুকুই সময় তাঁরা রাজনীতির জন্য ব্যয় করেছেন ।এই পর্যায়ক্রমে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম কুড়ি বছর পরিচালিত হওয়ার ক্ষেত্রে ,তাদের নেতাদের আন্দোলনের পদ্ধতি এবং লক্ষ্যের মধ্যে একটা সাযুজ্য সব সময় আমরা দেখতে পেয়েছি। উপযোগবাদী তত্ত্ব এই নরমপন্থী নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড রকম ভাবে শক্তিশালী ছিল ।জন স্টুয়ার্ট মিল, এডমন্ড বার্ক– এইসব পাশ্চাত্য ভাবধারার মনীষীরা জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম কুড়ি বছরের নেতৃত্বের চিন্তা-চেতনা এবং মনোজগতকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অধিকার করে রেখেছিল।
ব্রিটিশ সংসদে অভিযোগ করা এবং সেই অভিযোগে বারবার ব্রিটিশ, ভারতবর্ষে কিভাবে সাংবিধানিক নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করছে– সেই বিষয়টিকে সবথেকে বেশি কার্যকরী ভাবে তুলে ধরা ছিল এইসব নরমপন্থী নেতাদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।একটিবারের জন্যে ও ব্রিটিশ সংসদের কাছে তাঁরা ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে, ব্রিটিশের সঙ্গে সমান অধিকারের দাবি জানান নি। সমতার ধারণাটি তাঁদের কাছে একটা বিমুর্ত ধারণা হিসেবে সেই সময়ে প্রতিভাত হয়েছিল। স্বাধীনতাকে তাঁরা দেখতেন, একটা শ্রেণি স্বার্থের তাগিদ থেকে। যে যে পেশাগত শ্রেণীতে তাঁরা অবস্থান করতেন, সেই সেই শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার ভেতর দিয়ে ই, তাঁরা মনে করতেন, স্বাধীনতার ধ্যান-ধারণা বিশেষভাবে মর্যাদা পাবে ।
সেই মর্যাদা পাওয়ার লক্ষ্যে তাদের ভেতরের কেউ কেউ হয়তো, কখনো ,কখনো কোধো সংস্কারের দাবি করতেন। কিন্তু সেটা অত্যন্ত নরম ভাবে। এই নরমপন্থী নেতারা আধুনিকতার আমদানি ঘটানোর ক্ষেত্রে ব্রিটিশের প্রতি ছিলেন একেবারে গদগদ ভক্তিতে ভরপুর। ব্রিটিশ কর্তৃক আধুনিকতার আমদানিকে তাঁরা ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের মানুষদের সুশাসনের বিষয়টিকে তাঁরা মনে করতেন; সেরূপ উপযুক্ত পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি ।আরো অনেক সময় দরকার ,যার ভেতর দিয়ে ,ভারতবর্ষের মানুষ, তাঁদের নিজেদের ,নিজেরা নিজেদেরকে শাসন করবার জন্য তৈরি হবে ।
ব্রিটিশের প্রতি অচলা ভক্তি এবং বিশ্বাস রাখার ক্ষেত্রেই এঁরা ছিলেন সবথেকে বেশি আত্মনিবেদিত। ব্রিটিশ কোথায় ব্রিটিশ সুলভ আচরণ না করে, অ – ব্রিটিশ সুলভ আচরণ করছে –তার উপরেই তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের ইতিবাচক দিকের সীমাবদ্ধতা গুলি তুলে ধরতেন। ব্রিটিশ শাসনের কোনো নেতিবাচক দিক কার্যত তাদের সামনে ফুটে উঠত না। এই ইতিবাচক দিকগুলো সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রে, তাঁরা বড়লাট ,তাঁর কার্যনির্বাহী পরিষদ, আর গোটা আমলা বাহিনীকে একমাত্র দায়ী করতেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন, অর্থ নৈতিক শোষণ এবং বিভাজন প্রক্রিয়া– এসব কোনো কিছুর সম্পর্কেই কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতৃত্ব কখনো কোনরকম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া দেখাননি। ব্রিটিশ শাসনে যেখানে যেটুকু নি অসংগতি আছে, অসঙ্গতি আছে, অত্যন্ত নিয়ম সিদ্ধ উপায়ে, একটা স্বাভাবিক সৌজন্যের ভেতর দিয়ে, ব্রিটিশের দৃষ্টিগোচর করে, ব্রিটিশের দৃষ্টি পরিবর্তন করাই ছিল ,এঁদের লক্ষ্য ।
একটা সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির ভেতরে ব্রিটিশ শাসন কে বুঝিয়ে-সুজিয়ে, ভারতবাসীর প্রতি দয়া দাক্ষিণ্যের পরিমাণ খানিকটা বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিল নরমপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতৃত্ব এবং তাদের আবেদন-নিবেদন নীতির সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য ।তবে তাঁরা কিন্তু কোনো অবস্থাতে সম্প্রদায়িক ছিলেন না। একটা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের একদম সূচনাপর্ব থেকে তাঁদের নরমপন্থী নেতাদের ভেতরে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল ।
সম্প্রদায়গত স্বার্থের ঊর্ধ্বে এইসব নেতৃত্ব খুব পরিষ্কারভাবে নিজেদেরকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন। এমনটা কিন্তু নয় যে; ব্রিটিশ শাসনের সমস্ত নেতিবাচক ভাবনা গুলি সম্পর্কে তাঁরা সচেতন থেকেছেন।সেই সচেতনতার বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সাবধানী ।সংস্কারের পক্ষে তাঁরা ছিলেন আত্মনিবেদিত। কোনো অবস্থাতেই তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান কে পরিপূর্ণভাবে কামনা করেননি।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় দাদাভাই নওরোজি র এক বিশেষ আপ্তবাক্য কে। ব্রিটিশ শাসন কে এই ভাবে তিনি দেখেছিলেন; আমার বিশ্বাস, ইংল্যান্ড যদি আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যায় ,আমাদের দেশের শাসনভার যদি আমাদের দেশের মানুষদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় ,তাহলে তার থেকে বৃহত্তর কোন দুর্ভোগ আমাদের দেশের মানুষের পক্ষে হতে পারে না।
ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)