করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মোকাবিলায় লকডাউন ও সরকারের ভুমিকাঃ ডাঃ সূর্য্যকান্ত মিশ্রের বিবৃতি

১২ মার্চ,২০২০ - রবিবার

সারা দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এই অবস্থায় কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার উভয়কেই খেয়াল রাখতে হবে। লকডাউনের ঘোষণা হবার অনেক আগে থেকেই সিপিআই(এম)'র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে কাজ করতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)'র অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, লকডাউন ঘোষণা করার আগে কিছু অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে পূর্ব-প্রস্তুতির দরকার ছিল। সেগুলি বাদ রেখে লকডাউন কার্যকরী হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা ঠিক যে আমাদের দেশে সেরকম কোন পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। যার ফলে সারা দেশেই মানুষ এবং মূলত গরীব শ্রমজীবী মানুষ এবং রোগীরা যাদের নিয়মিত চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে তারা অশেষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

এই দুর্যোগের পরিস্থিতি সত্বেও মানুষকে লকডাউনের আইন-বিধি নিষেধ মেনেই চলতে হবে। কিন্তু মানুষের হয়রানি বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। লকডাউনকে কার্যকরী করতে গেলে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হল ব্যাপক হারে পরীক্ষা চালানো (Test)। কয়েকটি রাজ্য এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে - কেরালা যেমন এব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক ব্যাবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এখনও সারা দেশে এবং আমাদের রাজ্যে এই পরীক্ষা যথেষ্ট পরিমানে করা হচ্ছে না। একথা বুঝতেই হবে যে রাজ্যজূড়ে অনেক মানুষের পরীক্ষা না করা হলে নির্দিষ্ট যে সব অঞ্চল যেখানে এই সংক্রমণ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই এলাকাগুলী চিহ্নিত করা যাবে না - ফলে অচিরেই অনেক জায়গায় গোষ্ঠীসংক্রমণের ( Community Transmission)'র সম্ভাবনা তৈরি হবে যাতে বিপদ আরও বাড়বে।

এই ক্ষেত্রে দুই ধরনের পরীক্ষার ব্যাবস্থাই এখনই শুরু করতে হবে। প্রথমটি হল রোগ চিহ্নিত করার নিশ্চায়ক পরীক্ষা যাতে বোঝা যায় নির্দিষ্ট রোগীর ক্ষেত্রে তিনি করোনায় আক্রান্ত কিনা এবং দ্বিতীয়টি হল র‍্যাপিড টেস্ট যাতে এই রোগ থেকে যারা ইতিমধ্যেই সুস্থ হয়েছেন ও তার ফলে তাদের শরীরে এই রোগ প্রতিরোধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তাকে প্লাজমা সংগ্রহ করার মাধ্যমে অন্যান্য আক্রান্তদের উপরে পরীক্ষা চালানো। প্রথমে ব্যাপকহারে রোগ চিহ্নিতকরণ পরীক্ষা না করা হলে পরের পরীক্ষাটি করে এই সমস্যার মোকাবিলা করা যাবে না।

এরই সাথে রাজ্যে করোনায় আক্রান্তদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রকাশ করতেই হবে সরকারকে। এক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা দেখা যাচ্ছে। কিছু ব্যাপার স্পষ্ট হওয়ার প্রয়োজন। যে সমস্ত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে যারা মারা যাচ্ছেন সেইসব ব্যাক্তির মৃত্যুর কারণ নিউমনিয়া হোক, হার্টের বিকল হওয়াই হোক বা অন্য যাই হোক না কেন তাদেরকে করোনার কারনেই মৃত্যু বলে ধরতে হবে। একতাহ তো ইতিমধ্যেই বারে বারে বলা হয়েছে কয়েকটি গুরুতর শারীরিক সমস্যা যেমন সিওপিডি, ডায়াবেটিস কিংবা ব্লাডপ্রেসারের সমস্যা যাদের রয়েছে এই রোগে তাদের মৃত্যু হবার সম্ভাবনা বেশি। তাই মৃত্যুর সঠিক রিপোর্ট প্রকাশ করতেই হবে, ডেথ সার্টিফিকেটেও সেই উল্লেখ থাকতে হবে। তা নাহলে মানুষের মধ্যে এই সংক্রমণ সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে, নির্দিষ্ট এলাকা যেখানকার রোগী মারা গেছেন যদি সেই এলাকার মানুষ এই নিয়ে ধন্দে থাকেন তবে তাদেরকে কিছুতেই সচেতন করা যাবে না এবং তার ফলে এই সংক্রমন ছড়িয়ে পড়ার বিপদ আরও বাড়বে। করোনাজনিত মৃত্যুতে কিছু বিমার টাকাপয়সা পাওয়ার সুযোগ থাকে - সঠিক রিপোর্ট দেওয়া না হলে মৃতের পরিবার সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবেন।

এক্ষেত্রে রোগ চিহ্নিত করার পরীক্ষা কম করা হচ্ছে বলেই কেন্দ্র অথবা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে হটস্পট সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে পরীক্ষা কম করানো হচ্ছে বলেই সরকার সার্বিক লকডাউন তুলে নির্দিষ্ট জোন চিহ্নিত করতে পারছে না।

আরও একটি গুরুত্বপুর্ন বিষয়ে নজর দিতে হবে। এই সময়ে বিভিন্ন গুরুতর রোগ নিয়ে যারা বাড়িতে আটকে রয়েছেন কিন্তু যাদের নিয়মিত চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে যেমন কারোর ক্যান্সার অথবা নিয়মিত কেমোথেরাপি বা ডায়ালিসিসের দরকার হয় যাদের, সেইসব রোগীদের জন্য সুরক্ষা বিধি মেনেই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি আউটডোর চালু করতে হবে। যেসব হাসপাতালে করোনা আক্রান্তদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হয়েছে সেইসব ওয়ার্ডে যেন অন্যান্য রোগীরা না ভর্তি হন সেই নিয়ে সতর্ক হতে হবে। করোনার চিকিৎসায় কাজ করা ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এখনও সুরক্ষা পোশাকের ব্যাবস্থা অপর্যাপ্ত রয়েছে। এই সমস্যা মেটাতেই হবে। একাজে কেন্দ্র-রাজ্য দুপক্ষকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

সারা দেশের মানুষ লকডাউনের ফলে গৃহবন্দী থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অবস্থায় সবচেয়ে সমস্যায় পড়ছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা এবং গরীব মানুষ যারা দৈনিক আয়ের উপরে নির্ভরশীল। কাউকেই অনাহারে যেন মরতে না হয় সেই ব্যাবস্থা করতে হবে সরকারকেই।অবিলম্বে জনধন যোজনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কে ব্যাবহার করে তাদের হাতে টাকা পাঠানোর সাথে সাথে প্রত্যেককে প্রতি মাসের হিসাবে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করুক সরকার। এই কাজে সমস্যা হবার কথা নয়, সরকারের মজুতে খাদ্যশস্যের অভাব নেই। দেশের ধনী কর্পোরেটদের বিরাট অংকের কর ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এই সময় কৃষিঋণ মুকুব করে কৃষিক্ষেত্রে সংকট মোকাবিলা করতে হবে। কেরালার সরকার ফসল কাটার কাজকে ইতিমধ্যেই অত্যাবশ্যকিয় পরিষেবা হিসাবে মঞ্জুরি দিয়ে তাদের রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। এই রাজ্যে যদি সেরকম কিছু নাও করা যায় তবে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের আওতা ১০০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৫০ দিন করতে হবে নয়তো ঐ আইনেই সুযোগ রয়েছে ঐ কাজে যুক্ত নথিভুক্তদের জন্য ভাতা দেবার। যারা কাজ হারিয়েছেন বা রোজগার বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়াতে এইধরনের ভাতার ব্যাবস্থা করতেই হবে। সহজ কথায় লকডাউন চলাকালীন কেউ যেন অনাহারে না মারা যান সেই ব্যবস্থা করতেই হবে সরকারকে।

যতদূর খবর পাওয়া গেছে এখনও অবধি এই রাজ্যে আমাদের পার্টি এবং বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের পক্ষ থেকে এখনও অবধি প্রায় দশ হাজার মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া গেছে। এখনও গোটা রাজ্যের সমস্ত রিপোর্ট এসে পৌঁছায় নি, সেই খবর পেলে আরও নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা যাবে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যের জন্য রাজ্যকে হেল্পলাইন খোলার কথা বলা হয়েছিল। যে হেল্প লাইন খোলা হয়েছে তা পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যের পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাদের অসুবিধা অনুযায়ী সরকারের উদ্যোগ নেই। রাজ্যগুলির মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।

অন্যান্য রাজ্যে আমাদের রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আটকে রয়েছেন, তাদের ফিরিয়ে আনতে স্পেশাল ট্রেনের ব্যাবস্থা করা যায় কিনা দেখা উচিত। একইভাবে অন্যান্য রাজ্য থেকে এসে আমাদের রাজ্যে লকডাউনের কারনে আটকে পড়েছেন যারা তাদের সবার জন্য সুরক্ষিত আশ্রয় এবং খাদ্যের ব্যাবস্থা করতে হবেই। এই কাজে বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজের বাড়িগুলিকে ব্যাবহার করতে হবে।

সবশেষে আরেকটি ভীষণ গুরুত্বপুর্ন বিষয়েও আমাদের সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের মোকাবিলা করতে গিয়ে সারা দেশে এবং আমাদের রাজ্যেও আরেকটি বিপদের সাথে মানুষকে লড়াই চালাতে হচ্ছে। সেই ভাইরাসের নাম সাম্প্রদায়িকতা। দিল্লিতে তবলিঘি জামাত'র ঘটনা সামনে আসার পর থেকেই মানুষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় সম্পর্কে ঘৃণা ছড়ানোর অপচেস্টা শুরু হয়েছে, এই অবস্থায় সারা দেশের মানুষ একসাথে মিলে এই বিপদের মোকাবিলা না করলে তার ফলাফল ভয়ঙ্কর হবে। দিল্লিতে তবলিঘি জামাত'র ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তাদের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে - অথচ ঐ সমাবেশে যারা বিদেশ থেকে এসেছিলেন তাদেরকে ভিসা দেওয়া হয়েছে, জমায়েতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখন সেই নিয়ে নিজেদের দায় অস্বীকার করে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। এই ভয়ংকর অপচেস্টা আমাদের সবাইকে এক হয়ে রুখে দিতে হবে। মানুষকে বুঝতেই হবে সবাই এক হয়ে লড়াই না করলে করোনা ভাইরাসের বিপদ আরও বাড়বে।



এই বিবৃতির ভিডিও দেখতে নিচের লিংক ব্যবহার করুন

Dr. Surjya Kanta Mishra's Press Brief on 12/04/20
শেয়ার করুন

উত্তর দিন