পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালনায় তেইশ বছর ধরে আমরা নিযুক্ত আছি। সীমাবদ্ধ ক্ষমতা, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য এবং সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত অংশের মানুষের অবস্থার উন্নতিকল্পে বিভিন্ন কর্মসূচীর রূপায়ণে আমরা জোর দিয়ে চলেছি। তফসিলী জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য সবকিছু বন্দোবস্ত করা যায়নি। তাঁদের বিষয়ে অধিকতর নজর দেওয়া যেমন প্রয়োজন, তেমনি তাঁদের শ্রেণিচেতনায় বেশি করে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। তা নাহলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্ভব হবে না। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল এবং ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকার সীমিত ক্ষমতা স্বত্বেও বিকল্প পথের অনুসরণ করার চেষ্টা করে চলেছে।
![1977 Satgachia](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/07/WhatsApp-Image-2020-07-07-at-11.23.36-PM.jpeg)
পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কারের যে কর্মসূচী নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম তার সুফল পাওয়া গেছে। উদ্বৃত্ত জমির উদ্ধার ও বন্টনে আমাদের রাজ্য যথেষ্ট অগ্রগতি দেখিয়েছে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের নির্বাচন হচ্ছে। এই সংগঠনের মাধ্যমে আমরা প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে গণউদ্যোগ ও স্থায়ী সম্পত সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের গ্রামীণ ক্ষেত্রে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এরফলে যে সামাজিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে, তা শিল্পের বিনিয়োগে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দিচ্ছে। শহরাঞ্চলে যেসব অসুবিধা এখনো আছে সেগুলি কাটিয়ে উঠতে আমরা বদ্ধপরিকর। পরিকল্পনা মতোই অগ্রসর হতে চাইছি। আর্থিক ও অন্যান্য সমস্যার তীব্রতা স্বত্বেও সেগুলির মোকাবিলায় আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে চলেছি। কিছু কিছু ব্যাপারে উন্নতি হয়েছে। নেতিবাচক দিকও আছে। দুটো দিকই অতিক্রম করতে হবে। আত্মসমীক্ষা ও আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের সরকার কাজ চালিয়ে যেতে চায়। সারা ভারতে বেকার সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। পশ্চিবঙ্গেও এই সমস্যা আমাদের চিন্তার বিশেষ কারণ। এ ব্যাপারটি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আমরা দেখছি। বর্তমান রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রে পুনরুজ্জীবন নিশ্চিতভাবে ঘটছে। কেন্দ্রে শিল্পনীতিতে গত কয়েক বছরে কিছু পরিবর্তন হওয়াতে রাজ্যের শিল্পবিকাশের সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগানোর চেষ্টা করে চলেছি। বড়ো বড়ো কয়েকটি শিল্প প্রকল্প হয় নির্মিয়মাণ, নয় প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজ শেষ করেছে। হলদিয়া পেট্রো-কেমিক্যালস প্রকল্প আগামি ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রা শুরু করবে। পরিকাঠামোর উন্নতিতে আমরা সব থেকে বেশি নজর দিয়েছি। এ কাজে সকলের সহযোগিতা ও সমর্থন পাবো বলে মনেকরি।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/07/IMG-20200707-WA0098.jpg)
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/07/IMG-20200707-WA0095.jpg)
বিরোধী দরে থাকার সময়ে এবং পরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে চলেছি। সে সবের পৃথক চিত্র পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরার জায়গা এটা নয়। দেশে ও বিদেশে নানা উপলক্ষে আমাকে যেতে হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের যেসব ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে এবং আমাদের কার্যক্রম ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করার যে সমস্ত সুযোগ পেয়েছি সেগুলি আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান অভিজ্ঞতা। সোভিয়েত রাশিয়া, চিন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবা ও অন্য অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশ সহ ব্রিটেন, আমেরিকা, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ, নেপাল,ভুটান প্রভৃতি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা জগতের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকল মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও মত বিনিময়ের মাধ্যমে বর্তমানকালের মৌলিক প্রবণতা, সমস্যা ও সম্ভাবনার বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করেছি। আগামী শতকের রূপরেখার কিছু আন্দাজ তাই করতে পারি। লন্ডন স্কুল অব্ ইকনমিকস এবং অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও ভাষণদানের কর্মসূচীতে একাধিকবার যোগ দিয়েছি। আমেরিকায় বার্কলে ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুসেটস্ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকদের সভায় মিলিত হয়ে ভাষণ দিয়েছি। বিদেশে ভারতীয় ডাক্তার, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পপতিদের নানা সংগঠনের তরফে যেসব আলোচনাচক্র ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রন পেয়েছি সেগুলি অনেক কিছু সরাসরি জানার ও বোঝার সুযোগ দিয়েছে। বামপন্থী সংগঠন ও বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে যেসব কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছি সেগুলিও আমার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। সাম্প্রতিকালে কয়েকটি বিদেশ সফরে আমাদের রাজ্যে শিল্প বিনিয়োগে যাঁরা আগ্রহী তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে এসেছি। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর নিয়মনীতির পরিধির মধ্যেই কথাবার্তা হয়েছে।
বিদেশে আমার অনেক সফর ও দায়িত্ব নির্বাহের মধ্যে যে কর্মসূচী আমাকে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতার স্বাদ দিয়েছে তা হলো ১৯৯৬ সালে মহাকবি শেক্সপিয়রের জন্মস্থান ইংল্যান্ডের স্ট্যাটফোর্ড অন অ্যাভনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মূর্তির উদ্বোধনের অনুষ্ঠান। এইটা উদ্বোধন করার সুযোগ লাভ করে প্রভুত আনন্দ পেয়েছি।
একবিংশ শতাব্দীকে স্বাগত জানানোর মুহূর্তে আমাদের দেশের নিজস্বতা রক্ষা, সামাজব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাস ও অর্থনৈতিক বিকাশৈর পন্থা নির্ধারণ প্রভৃতি কাজ সুসম্পন্ন হতে পারে সে ব্যাপারে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আমাদের দেশের ঐতিহ্য। একটি বহুজাতিক, বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মীয় ও বহু সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজের বৈচিত্র্যকে আমাদের দেশ রক্ষা করে চলেছে। এই ঐতিহ্য যাতে কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, তা দেখা সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তৃব্য। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মজবুত করে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করে যাওয়া প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব। জনজীবনের নৈতিকতাকে সুউচ্চ রাখতে হবে। নৈতিকতার ব্যাপারে মূল্যবোধহীনতা ও কদাচার যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, প্রশাসনিক কঠোর ব্যবস্থা এ-ক্ষেত্রে যেমন প্রয়োজন, তেমনই ব্যাপক সদিচ্ছা জরুরি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুফলকে সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার প্রশ্নে কোনোরকম বিলম্বের অবকাশ নেই। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে নতুন শতাব্দীর মুখে দাঁড়িয়েও দেশের জনসংখ্যার শতকরা চল্লিশ ভাগ মানুষ আজও দারিদ্র্য সীমার নীচে। এই পরিস্থিতির সুরাহার জন্য এমন এক দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন-কৌশলের ওপর জোর দিতে হবে যার দ্বারা সাম্য ও সামাজিক ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে জনসাধারণের খাদ্য-বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা কর্মসংস্থান, পানীয় জলের মতো ন্যূনতম প্রয়োজনগুলির সমাধান হতে পারে।
একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব-পরিস্থিতি সম্পর্কেও আমার মতো মানুষের কিছু ভাবনা আছে। সাম্প্রতিকালে রাষ্ট্রসংঘ প্রকাশিত মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলি পড়লে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সেখানে বলা হচ্ছে, বিশ্বায়ন প্রধানত সবল ও ক্ষমতাবান দেশের স্বার্থে তার ভুমিকা পালন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উন্নত দেশের কাছে উন্নয়নশীল দেশের অধীনতা বেড়ে চলেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দারিদ্র মানুষের জীবনে আকস্মিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পড়েছে।
কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাঙ্কের সভাপতি স্বীকার করেছেন যে, দারিদ্র হ্রাস করাই বিশ্বব্যাঙ্কের যাবতীয় কর্মকান্ডের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আই-এম-এফ-র প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাইকেল ক্যামডেসাসও বলেছেন, নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে আই-এম-এফ-র ভূমিকা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তিনি পৃথিবীব্যাপী মন্দা সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করেছেন।
আজকের বিশ্বে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এমনভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে যাতে তাদের স্থানীয় শিল্প-বাণিজ্য এবং আর্থিক বাজারগুলিতে যে-অসম প্রতিযোগিতা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার মোকাবিলা সম্ভব হতে পারে। আধুনিক উন্নতব্যবস্থার সঙ্গে সব দেশকেই যুক্ত হতে হবে। কিন্তু নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রেখে ও স্বাবলম্বনকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশ্বক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার জন্য সক্ষম হয়ে উঠতে হবে।
সমাজবাদ সাময়িকভাবে কিছু বিপর্যয়ের মধ্যে রযেছে ঠিকই। কিন্তু এটা সত্য, ধনতন্ত্র মানবসভ্যতার শেষ কথা নয়। বিশ্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অবশ্যই এগিয়ে যাবে। কার্ল মার্কস তাঁর ‘দ্য এইটিনথ ব্রæমেয়ার অব্ লুই বেনোপার্ট’ রচনায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘মানুষই তার ইতিহাস গড়ে তোলে। তবে তা তার পছন্দমতো সে গড়ে তুলতে পারে না। তাদের পছন্দসই ঘটনার ভিত্তিতেও তা তৈরি হয় না। অতীত অভিজ্ঞতার নিরিখে বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলার মধ্য দিয়ে তা গড়ে ওঠে।’
একবিংশ শতাব্দীতে আমরা অপেক্ষা করব, এক সমাজবাদী, শোষণমুক্ত, মানবধর্মী সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের জন্য। এই সমাজব্যবস্থা হবে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার প্রথম পর্যায়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন মানুষের ও উন্নততর মানব সভ্যতার জন্য আমরা অপেক্ষা করবো। সচেতন ও প্রত্যয়নিষ্ঠ জনগণ নতুন ইতিহাসের জন্ম দেবে এই বিশ্বাস রখব।
[‘দেশ’ ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সংখ্যায় (৬৭ বর্ষ ৪ সংখ্যা) প্রকাশিত (পৃষ্ঠা : ৩৭-৪২) এই প্রবন্ধ ওই পত্রিকায় বসুর প্রথম লেখা। বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী। ওই সংখ্যায় ‘দেশ’-র প্রচ্ছদ নিবন্ধ ছিল ‘বাঙালির ৭৫ বৎসর : দেশবন্ধু থেকে জ্যোতি বসু’। অমিতাভ চৌধুরী তখন ‘দেশ’-র সম্পাদক। বসুর প্রবন্ধটির আগের পাতায় পত্রিকার তরফে যে নোটটি ছাপা হয়েছিল তা এখানে পুনর্মুদ্রিত করা হলো –
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/01/IMG_20210117_063450.jpg)
“পার্টি সদস্য এবং সর্বক্ষণের কর্মী নিযুক্ত হওয়ার সময়, ১৯৪০ সাল থেকে জ্যোতি বসুর লাল পতাকাবাহী জীবনের ছয় দশক, ষাটটি বৎসর পূর্ণ হয়ে গিছে এই ১৯৯৯-তেই। একটি শতাব্দীর অধিকাংশেরও বেশি তিনি থাকলেন বাঙালির ভাগ্যের সদস্য এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে। পার্টির মুখপত্রগুলির বাইরে জ্যোতি বসুর এই প্রথম লেখা - ‘দেশ’ পত্রিকার পক্ষে অদ্বিতীয় মর্যাদা। একটি ক্ষিপ্র তুলিতে জ্যোতি বসু তাঁর দেখা শতাব্দীর একটি প্রতিলিপি দিয়েছেন। বলেছেন, ভবিষ্যতের নির্দেশ, বিশেষত সমাজতন্ত্রের পথ কী হতে পারে, বহুজাতিক, বহু ধর্মাবলম্বী এই দেশের ওপরে যে চোট এসে লাগছে, অশীতিপর মুখ্যমন্ত্রীকে তা বিষন্ন করে দিচ্ছে সময় সময়। কিন্তু এখনো তাঁর বিশ্বাস অনমনীয়। লিখছেন, একবিংশ শতাব্দী হবে সমাজতন্ত্রের নতুন অধ্যায়।”
এছাড়া, ‘দেশ’-র এই সংখ্যায় সম্পাদকীয়ও ছিল বসুকে নিয়ে। শিরোনাম - “জ্যোতি বসু, আগামী শতাব্দীতে”। সম্পাদকীয়র পুরো বয়ান এখানে ছাপা হয়েছিল –
“এই শতাব্দীর শেষ তেইশ বছর ধরে যিনি একটানা পশ্চিমবাংলা সরকারের কর্ণধার হয়ে রইলেন, সেই জ্যোতি বসু দু’হাজার সালেও মুখ্যমন্ত্রী থেকে যাবেন, তাঁর দলের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। স্বাস্থ্যের কারণে তিনি অবসর নিতে চেয়েছিলেন, যদিও তাঁর পদক্ষেপের গতি ও দৃঢ়তা দেখে কখনো তাঁকে বয়েসের ভারে ন্যুব্জ মনে হয় না। অবশ্য, বার্ধক্যে শরীরের কিছু কিছু প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে পরা অবধারিত, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্ক পূর্ণ সচল, যে-কোন বিষয় বা ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়ায় শিথিলতা আসেনি। পশ্চিবঙ্গ সরকারে তাঁর দলের প্রধান ভূমিকা থাকলেও যেহেতু তিনি নানা দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গড়েছেন, সেই সমন্বয়ের পরিচালক হিসেবে তিনিই এখনো পর্যন্ত যোগ্যতম।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/01/IMG_20210117_063302.jpg)
সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁর সাফল্যের তালিকাটি সুদীর্ঘ, ব্যর্থতার তালিকাটিও নিতান্ত সংক্ষিপ্ত নয়। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, তাঁর প্রথম সাফল্য বিরোধী দলনেতা হিসেবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী নেতার ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিধানচন্দ্র রায়ের মতোন কঠিন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুখ্যমন্ত্রীর আমল থেকে সিদ্ধার্থ রায়ের মতোন চঞ্চল অপরিণামদর্শী মুখ্যমন্ত্রীর আমল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিরোধী নেতার ভ‚মিকা পালন করে গেছেন। বিশেষত সাম্প্রতিককালে এই রাজ্যে বিরোধী দলগুলির দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অপটু আচরণ দেখে জ্যোতি বসুর সেই সাফল্যের কথা বেশি মনে পড়ে। তখন মনে হতো, তিনি সারা জীবন বিরোধী নেতা থেকে যাওয়ার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন, ক্ষমতা দখলের কোনো ব্যস্ততা ছিল না।
তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বে ভারতের অন্যান্য বেশ কয়েকটি রাজ্যের তুলনায় পশ্চিম বাংলা শিল্প-বাণিজ্যে অগ্রসর হতে পারেনি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেকখানি পিছিয়ে গেছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি, কখনো দাঙ্গা বাধার উপক্রম হলেই তা দমন করা হয়েছে কঠিন হস্তে। আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা খুব একটা আহা মরি না হলেও অরাজকতা প্রশয় পায়নি, কলকাতা শহরে মহিলারা সন্ধের পরেও একাকী গমনাগমন করতে পারেন, যা ভারতের অন্যান্য কয়েকটি বৃহৎ শহরে সম্ভব নয়। বিচ্ছিন্নতাবাদ শিকড় গাড়তে পারেনি, দার্জিলিঙে সুভাষচন্দ্র ঘিসিং-র মতোন উগ্রপন্থী নেতাকেও এমন সুকৌশল নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, যা ভারতের অন্যত্র দৃষ্ঠান্ত-স্বরূপ হতে পারে। কংগ্রেসী আমলে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, গণ টোকাটুকি ও নির্ধারিত সময় থেকে বছরের পর বছর পিছিয়ে পড়ছিল, সেই অবস্থার আশ্চর্য উন্নতি হয়েছে এবং তাতে এ রাজ্যের সুনাম ছড়িয়েছে। অবশ্য সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করা দরকার যে, রাজ্য সরকারের শিক্ষা নীতির দোলাচল ও অব্যবস্থচিত্ততায় শিক্ষাবিস্তারের ক্ষতিও হয়েছে যথেষ্ট।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/01/IMG_20210117_063406.jpg)
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/01/IMG_20210117_062940.jpg)
এ রাজ্যে ভূমি সংস্কারের সাফল্য সর্বজন স্বীকৃত। তার সুস্পষ্ট ফলও দেখা যায় গ্রামজীবনে। অন্যদিকে রুগ্ণ ও বন্ধ কলকারখানাগুলিতে এবং অনাহারের সম্মুখীন লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবনদৃশ্যে কি মার্কসবাদ প্রচন্ড ধাক্কা খায়নি? সে যাই হোক, এসব নিয়ে ভারতেই সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কংগ্রেস দল যখন ভাঙœ ও পচন ধরায় কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়, মৌলবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি যখন খুব বেশি শক্তিসম্পন্ন হয়নি, তখন তৃতীয় একটি অসাম্প্রদায়িক জোটের কাছে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার একটি দুর্লভ সুযোগ এসেছিল এবং সেই জোটের অধিনায়ক হবার প্রশ্নাতীত যোগ্যতা জ্যোতি বসু ছাড়া আর কার? দুই দশক ধরে তিনি একটি রাজ্যে অনেকগুলি রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত জোট পরিচালনা করেছেন, একটি দলও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি, এরকম অভিজ্ঞতা অন্য কোনো নেতার নেই। তৃতীয় জোটের অগ্রগণ্য সব নেতাই জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে চেয়েছিলেন, জ্যোতি বসু নিজেও সে গুরুদায়িত্ব নিতে অসম্মত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর দলের গরিষ্ট অংশ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে জ্যোতি বসুকে নিরস্ত করেছিলেন। হয়তো দেবগৌড়ার মতন তুলনায় অপরিপক্ক একজন নেতার বদলে জ্যোতি বসু দায়িত্ব নিলে তৃতীয় শক্তি জোট অমন সহজে ভেঙে যেত না, বিজেপি-র অভুত্থানও ত্বরান্বিত হতো না। সিপিএম দলের এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তকে স্বয়ং জ্যোতি বসুও বলেছেন, হিমালয়সদৃশ ভ্রান্তি। আমরা অনেকেই এখনো সেই সিদ্ধান্তের জন্য মর্মাহত।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/01/IMG_20210117_063604.jpg)
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/01/IMG_20210117_063639.jpg)
প্রত্যাখ্যানেরও একটা মহত্ত আছে। যখন ভারতের প্রায় সব নেতাই নির্লজ্জভাবে ক্ষমতালোলুপ, তখন পশ্চিবাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলের নির্দেশ অমান্য না করে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ প্রত্যাখান করেছিলেন, এ কথাও ইতিহাসে লেখা থাকবে। প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে শতায়ু হতে বলা আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত। জ্যোতি বসু শতায়ু হন বা না হন, তিনি আরও দীর্ঘকাল সুস্থ ও সক্রিয়ভাবে দেশের কাজে জড়িয়ে থাকুন, এই আমাদের আন্তরিক আকাঙ্খা।”
প্রথম পর্বের লিংক নিচে দেওয়া হল
একবিংশ শতাব্দী : কিছু ভাবনা ,কিছু পুরানো কথা (১ম পর্ব)
শেয়ার করুন