একবিংশ শতাব্দী : কিছু ভাবনা ,কিছু পুরানো কথা (১ম পর্ব)

১৭ জানুয়ারি ২০২১

,রবিবার
জ্যোতি বসুর একাদশতম প্রয়াণ দিবসে রাজ্য ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে ১৯৯৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটি পুনরায় তুলে ধরা হল...

একবিংশ শতাব্দীকে স্বাগত জানাতে এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে বিপুল আয়োজন চলছে। নানা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায়, প্রযুক্তির উন্নতিতে, জনচেতনার সম্প্রসারণে, সামাজিক দায়িত্বের বিকাশে ও রাজনৈতিক শক্তির সুবিন্যাসে এই শতাব্দী সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, এমন আশা করি। তবে, কোনো কিছুই হঠাৎ ঘটে না। কার্য-কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে, ধারাবাহিকতার নিয়মে ইতিহাসের এক পর্ব আর এক পর্বে পৌঁছায়। বিংশ শতাব্দীর সামর্থ্য ও দুর্বলতার দায়ভার একবিংশ শতাব্দীতে কিছু পরিমাণে থাকবে এবং এর মধ্য থেকেই এই নতুন সময় তার যাত্রাপথ খুঁজে নেবে। ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করাই হলো আধুনিকতার মূল কথা।

পরিবারের সাথে ছেলেবেলার জ্যোতি বসু ...
 
একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপট হিসাবে বিংশ শতাব্দীতে আমরা কি দেখলাম ও পেলাম তা বলতেই হয়। সেই অভিজ্ঞতার কয়েকটি দিক তুলে ধরার এখানে চেষ্টা করছি। সঠিক পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে সাহায্য করার জন্য কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে। আমার জন্ম এক অরাজনৈতিক পরিবারে। কলকাতায় স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, বিপ্লবীদের সংগ্রাম, ইংরেজ রাজশক্তির অমানবিক শাসন ও শোষণ অজান্তেই হয়তো আমার মনকে নাড়া দিয়েছিল। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়ার সময় চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের অস্ত্রাগার দখল করার খবরে আলোড়িত হয়েছিলাম। ১৯৩০-এ গাঁধীজি অনশন শুরু করার দিন মন খারাপ হয়ে যায়। বাবাকে বলে স্কুলে যাইনি।
জ্যোতি বসু
 

সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তৃতা শুনতে গিয়ে একবার পুলিশের লাঠি খাই। আমার জ্যাঠামশাই মেছুয়াবাজারে বোমার মামলার জন্য গঠিত স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের জজ নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর ঘরে বিপ্লবীদের জেরা থেকে পুলিমের বাজেয়াপ্ত করা নানা বই দেখার সুযোগ পাই। কিছু পরে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ পাঠ করি। এ-সব কিছুর মধ্য দিয়ে কোনো বিশেষ চেতনা হয়তো আমার মধ্যে নাড়া দিয়েছিল। ১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ড আইন বিষয়ে আমি পড়াশুনা করতে গিয়েছিলাম। সেখানে থাকার সময় মার্কসবাদ ও বামপন্থী রাজনীতিতে আগ্রহী হই। তখন অর্থাৎ তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ব ইতিহাসে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটতে শুরু করে। মুসোলিনের আবোসিনিয়া দখল, জাপানের চীন আক্রমণ, হিটলারের নাৎসি পার্টির সারা বিশ্বকে পদানত করার উদ্যোগ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও তখন আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠা আমার চিন্তা-চেতনাকে নতুন খাতে বাহিত করতে থাকে। ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে প্রভাবিত হই। সেই সময় ইংল্যান্ডে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক আলোচনা তীব্রতা লাভ করে। অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভাষণ শুনতে বহু মানুষ সমবেত হতেন। ইন্ডিয়া লিগ, লন্ডন মজলিস ও স্টুডেন্ট ফেডারেশনের মতো কয়েকটি প্রগতিশীল সংস্থা তখন লন্ডনে ভারতের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজ করছিল। লন্ডন, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের ছাত্ররা কমিউনিস্ট গ্রæপ গড়ে তোলেন। আমরা মার্কসবাদী পাঠচক্রে যেতে শুরু করি। হ্যারি পলিট, রজনী পাম দত্ত, ক্লিমেন্স দত্ত এবং বেন ব্রাডলের মতো ব্যক্তিত্বরা আমাদের ক্লাস নিতেন। লন্ডন মজলিসের আমি ছিলাম সম্পাদক। অন্যান্য সংগঠনগুলির সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। লন্ডনে ইন্ডিয়া লিগের নেতা কৃষ্ণ মেনন নেহরুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। আমি নেরুকে বলি : আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। নেহরু বলেন : আমাদের সামনে এখন প্রধান কাজ ভারতের স্বাধীনতা অর্জন। এ বিষয়ে তোমরা আমার সঙ্গে একমত কি? আমি বলি : আমরা একমত। নেহরু সেই সময়ে দুবার ব্রিটেনে যান এবং লন্ডন মজলিসের তরফে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীমতী বিজয়লক্ষী পন্ডিত, ভুলাভাই দেশাই, ইউসুফ মেহের আলি প্রমুখকে লন্ডন মজলিসের তরফে আমরা সংবর্ধনা জানিয়েছিলাম। পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদের বিপদ ক্রমশ বেড়ে ওঠে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। দেশে ফেরার আগে কমিউনিস্ট পার্টির সারাক্ষণের কর্মী হিসাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।
 

১৯৪০ সালে আমি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হই। ব্যারিস্টার হিসাবে ওই সময়ে কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করি। প্র্যাকটিস করা হয়ে ওঠেনি। পার্টির কাজেই নিজেকে নিয়োজিত করতে হয়। কাকাবাবু (মুজফ্ফর আহমেদ) আমাদের পার্টির গোড়াপত্তনের যুগের মানুষ। তিনি নানা পরামর্শ দিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার উজাড় করে আমাদের পাশে সর্বদা থাকতেন। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনে, বিশেষ করে রেলে ইউনিয়ন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেকদিন কাজ করেছি। ১৯৪৬ সালে সীমাবদ্ধ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে আইনসভার যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আমি রেলওয়ে কেন্দ্রের প্রার্থী ছিলাম। অসম বাদে সমগ্র বিএ রেলওয়ে ছিল এই নির্বাচন কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত। আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলেন হুমায়ন কবীর। সেই নির্বাচনে জয়লাভ করে আমি প্রথম আইনসভায় প্রবেশ করি। আমাদের পার্টির রতনলাল ব্রহ্মন ও রূপনারায়ন রায়ও জয়ী হন। সেই সময় থেকে আইনসভার ভেতরে ও বাইরে পার্টির নির্দেশে আমি কাজ করে যাই। সে কাজ আজও করে চলেছি। গণতান্ত্রিক ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সংগঠক, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির একসময়ের সম্পাদক ও বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা হিসেবে অতীতে দায়িত্ব পালনকরতে হয়েছে, এখন একটানা তেইশ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ববার বহন করে চরেছি। মানুষের পাশে থাকার এই সুযোগ পেয়ে অনেক কিছু দেখেছি ও শিখেছি।

রাজ্যেরও দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা ভাঙা-গড়া এই সময় যেমন চরেছে, তেমনি সারা বিশ্বের নানা ঘটনা ও পর্বান্তর আমাদের আলোড়িত করেছে। এই শতাব্দীতে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম জয়লাভ করেছে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৪৯-এ চীনে বিপ্লব ঘটেছে। বহু দেশে সমাজতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠা এই সময়কালের পক্ষে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীর প্রায় এক-চতুর্থাংশে সমাজতান্ত্রিক শিবির একসময় বিস্তৃত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ এবং চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবা পর্যন্ত এই শিবির প্রসার লাভ করেছিল। বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সমাজতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে এক বিরাট আঘাত। কিন্তু এটা আশা করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয়ের এই পর্যায়ে কেটে যাবে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন ও অন্যান্য বেশ কিছু দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেই সব দেশের অবলম্বিত নীতির অনুসরণ বর্তমান সময়ে সমাজতন্ত্রের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন। একবিংশ শতাব্দী সমাজতন্ত্রের পক্ষে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে মনে করি।


আমাদের দেশের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং অবশেষে স্বাধীনতা লাভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সশস্ত্র সংগ্রাম ও অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এই দুই ধারার অবদানকে যথোচিতভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। ইতিহাসকে জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য কেউ যেন বঞ্চিত না হন, সে-ব্যাপারে ঐতিহাসিক, গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ থাকতে হবে।

বাংলার মানুষের সংগ্রামী চরিত্র সুবিদিত। দু’শো বছরের ইংরেজ শাসনকালে বাংলার জনসাধারণ বারবার প্রতিবাদে, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহে সরব হয়েছেন। বেশ কিছু বিদ্রোহ বাংলার বুকে সংঘটিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সংস্কারমূলক কর্মকান্ড ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের পটভূমি প্রস্তুত করেছিল। প্রগতিশীল চিন্তার প্রসারে ও জাতীয় আন্দোলনের বিস্তারে বাংলার মানুষ এগিয়ে গেছেন নির্ভয়ে, কোনো পিছুটান না-রেখে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশ ভাগ করে স্বাধীনতা এলা। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হলো। বাংলা ভাগ হবার ফলে লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। কয়েক দফায় পশ্চিমবঙ্গে ৭০ লক্ষ মানুষ ওখান থেকে চলে এসেছেন। উদ্বাস্তু সমস্যা জাতীয় সমস্যার রূপ নেয়। কেন্দ্রীয় সরকার পঞ্চাশ বছর পরেও এ-ব্যাপারে কোনো সুষ্ঠ সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারেননি। আমরা সরকারে আসার আগেও পরে এই সমস্যার সুরাহাকল্পে নির্দিষ্ট প্রস্তাব রেখেছি। এই সমস্যা শুরু হওয়ার পর বহু আন্দোলন ও সংগ্রামে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। সে সবের জন্য আমাদের জেলে পোরাও হয়েছে। গত তেইশ বছরে এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের আওতার মধ্যে পড়ে এমন সব ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলি নিয়ে কেন্দ্রের কাছে ধারাবাহিকভাবে আমরা বলে আসছি। আনন্দের কথা, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত মানুষেরা এখানকার সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনে শামিল হযেছেন। বহু ক্ষেত্রে তাঁরা অবদান রাখছেন। জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

আমার স্মৃতিতে বিশেষভাবে ধরা আছে দেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পর্যায়ের এমন কিছু প্রসঙ্গ যা এখান উল্লেখ করছি।....
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে রাজনৈতিক প্রচারকে আমরা ছাড়িয়ে দিয়েছিরাম। সোভিয়েত-সুহৃদ সমিতি (এফ-এস-ইউ) ও ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘের স্থাপনার মাধ্যমে মানুষকে সংগঠিত করার কাজ প্রসার লাভ করে। আমি ছিলাম এফ-এস-ইউ-র প্রথম সম্পাদক। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য ফ্যাসিবাদের পরাজয় সেদিন জরুরি ছিল। যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ গভীর মর্মপীড়া অনুভব করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হবার পর আমাদের পার্টি থেকে আমাকে ও অধ্যাপক সুরেন গোস্বামীকে শান্তিনিকেতনে কবির কাছে পাঠানো হয়েছিল। যখন আমরা ওখানে পৌঁছাই, তখন কবি খুব অসুস্থ ছিলেন। সাক্ষাৎ তাই হয়নি, ওঁর সচিব অনিল চন্দ আমাদের সঙ্গে দেখা করে যুদ্ধের মোকাবিলায় কবির মনোভাব ও আমরা কি করতে পারি জানিয়ে দিলেন। সোভিয়েত সুহৃদ-সমিতির কর্ম পরিকল্পনাকে কবি স্বাগত জানিয়েছেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়ের আশা কবি ব্যক্ত করেছেন বলে অনিলবাবু জানান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে শ্রমিক-কৃষকের ধর্মঘট, ডাক-তার কর্মীদের ধর্মঘট ও তাঁদের সমর্থনে সাধারণ ধর্মঘট, নৌবিদ্রোহ, রেল ধর্মঘট ইত্যাদি ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষের সোচ্চার প্রতিবাদের এক একটি জ্বলন্ত প্রকাশ। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে ত্রাণের কাজে বহু মানুষকে সমবেত করা গিয়েছিল। জনরক্ষা সমিতি আমাদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল। ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল রিলিফ কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ আমরা গঠন করি। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডা: বিধানচন্দ্র রায়। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্ট ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা শুরু হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্ররোচনায় হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদী গোষ্ঠীগুলি এই দাঙ্গা বাধায়। এই বীভৎস ঘটনার সময় মানুষের অমানবিকতা যেমন দেখেছি, তেমনি দুই সম্প্রদায়ভুক্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা কিভাবে পরস্পরের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাও প্রত্যক্ষ করেছি। এই দাঙ্গা বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না - দিল্লী, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, বিহারে ছড়িয়ে গিয়েছিল।

স্বাধীনতা ঠিক পূর্বে অবিভক্ত বাংলায় ‘তেভাগা’ আন্দোলন কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশেষ ঐতিহাসিক তাৎপর্য চিহ্নিত। বিধানসভার ভেতরে ও বাংলার বিভিন্ন জেরায় এই তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে বক্তব্য রাখা, রিপোর্ট সংগ্রহ করা ও আন্দোলনের গতি প্রকৃতি দেখার কাজ আমার ওপর ন্যস্ত হয়েছিল।

সাম্প্রদায়িক শান্তির লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে গাঁধীজি কলকাতার বেলেঘাটায় ক্যাম্প করেছিলেন। শান্তি ফিরিয়ে আনতে যাঁরা উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাঁরা গাঁধীজির সঙ্গে মিলিত হচ্ছিলেন। আমাদের পার্টির তরফ থেকে এ ব্যাপারে সকলরকম চেষ্টা চালানো হচ্ছিল। পার্টির নির্দেশে ভুপেশ গুপ্ত ও আমি গাঁধীজির সঙ্গে দেখা করলাম ও তাঁর উপদেশ চাইলাম। তিনি আমাদের বললেন, একটি সর্বদলীয় শান্তিকমিটি গঠন ও সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় মিছিলের আয়োজন করা এই সময় উপযুক্ত কাজ হবে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে দু’বছর আগে। উপনিবেশবাদের ফলে দু’শো বছর ধরে আমাদের দেশের সম্পদের শোষণ, মানুষের অধিকার হরণ ও সার্বিক পরাধীনতা চলেছে। স্বাধীনতা লাভের পর দেশের মানুষের মনে অনেক আশা-আকাঙ্খা জেগেছিল। কিন্তু সেসব আশা ও স্বপ্নের অনেকটাই এখনো সফল রূপ নিতে পারেনি। দেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়ন অবশ্যই ঘটেছে। কিন্তু বহু কাজ এখনো বাকি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মোকাবিলায় সঠিক কার্যক্রম রূপায়ণে জাতীয় ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেওয়া দরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, আবাসন ও গ্রামীণ বৈদ্যুতিকীকরণের মতো জনসাধারণের মৌলিক চাহিদাগুলি অপূর্ণ থাকলে, নতুন শতাব্দীতে ভারতবর্ষ কীভাবে এগোতে পারবে? এসব বিষয়ে নজর দেওয়া ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করা এখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের দেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, আছে যথেষ্ট সংখ্যক মেধাবী মানুষ ও কর্মক্ষম বিপুল জনগোষ্ঠী। এসব কিছুকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ সফল হবে।
 

জাতীয় স্তরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলিতে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হলে গত অর্ধ-শতাব্দীতে দেশ আরও এগিয়ে যেতে পারতে। অতিকেন্দ্রিকতা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে হানিকর প্রভাব ফেলেছে। বিকেন্দ্রীকরণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে একান্তভাবে প্রয়োজনীয় বরে আমরা মনে করি। দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলিতে উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকারে ত্রæটি থাকার জন্য জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে। বিশেষত অন্য অঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যের তুলনায় পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি নানান অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র থেকে রাজ্যের হাতে আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিকে জোর দেওয়ার জন্য আমরা বলে চলেছি। গ্রামস্তর পর্যন্ত প্রশাসন ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণে আমি বিশ্বাসী। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সম্পর্কের সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিত বিন্যাস ঘটাতে পারলে জাতীয় ভিত্তি আরও বলিষ্ট হবে। জাত-পাত, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মভিত্তিক ভোটব্যাংক তৈরি, টাকার খেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, পেশিশক্তির ব্যবহার, অপরাধ জগতের সঙ্গে রাজনীতির আঁতাত ইত্যাদি অশুভ প্রবণতা সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কলুষিত করছে, এগুলি থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর জনসাধারণের সজাগ প্রহরা সর্বদা দরকার, মানুষও অনেক সময় ভুল করেন। তাঁরাই আবার ভুল সংশোধন করে সঠিক পথে অগ্রসর হন। ইতিহাসে তাঁরাই প্রকৃত নিয়ন্তা।

স্বাধীনতার পর ভারতের শাসকদল যে ধনতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন সে পথেও দেশের জনসাধারণের অনেক প্রয়োজন মেটানো যেত যদি সামন্ত্রতন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা করার নীতি থেকে তাঁরা বিরত থাকতেন, যদি ভূমি সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কিছুটা চেষ্টা করতেন। রাষ্ট্রক্ষেত্রের শিল্পসংস্থাগুলি পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে পরিচালিত বলে অনেকটাই সুফল পাওয়া যেত। এ পর্যন্ত সারা দেশে দশ থেকে পনেরো শতাংশ মানুষের কেবল উন্নতি হয়েছে। বাকি আশি থেকে পঁচাশি শতাংশ মানুষ উপেক্ষিত থেকে গেছেন। জাতীয়স্তরে স্বাবলম্বনের নীতি পরিহার করে দেশীয় একচেটিয়া পুঁজির ও বহুজাতিক সংস্থার ওপর নির্ভরশীলতা এবং বিশ্বব্যাঙ্ক ও আই-এম-এফের মতো সংগঠনের নির্দেশাবলীর প্রতি অন্ধমান্যতা দেশের অর্থনীতিতে সংকটসঙ্কুল করে তুলেছে। বিশ্বের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ অনেক শক্তি আছে, সেগুলি ঠিকমতো ব্যবহারের কোনো চেষ্টা নেওয়া হয়নি বলে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের অর্থনীতিতে সরকারী ক্ষেত্র, যৌথক্ষেত্র এবং বেসরকারী ক্ষেত্রের ভূমিকা আছে, সবক্ষেত্রে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের ভিত্তিতে কাজ করলে অবস্থার উন্নতি হবে। অনেক ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত দুর্বলতা আছে। সেই দুর্বলতাকে কীভাবে কাটানো যায় তার বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগী হতে হবে। প্রত্যেক পক্ষকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ হতে হবে। রুগ্ণ ও বন্ধা শিল্পসংস্থাগুলির ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আধুনিকীকরণ ও সামগ্রিক পুনরুজ্জীবনের কর্মসূচী গ্রহণ করা আবশ্যক। এই বিষয়টিত আমরা বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বাকি লেখার অংশটির লিংক নীচে দেওয়া হল ...পরবর্তী লিঙ্কে দেওয়া হল।

একবিংশ শতাব্দী : কিছু ভাবনা কিছু পুরানো কথা (২য় পর্ব)
শেয়ার করুন

উত্তর দিন