প্রাককথন
আমাদের দেশে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। গত এক দশক যাবত পিছনে আরএসএস আর সামনে বিজেপি’কে রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের নামে যে বন্দোবস্তটি চলছে আমরা পার্টির তরফে তাকে কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাত (কর্পোরেট-কম্যুনাল নেক্সাস) বলে চিহ্নিত করেছি। এ হল যাকে বলে একশো কথার এক কথা। অর্থাৎ বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সরকার যা কিছু করেছে, করে চলেছে সেইসব কিছুকে একজায়াগায় এনে বিচার-বিশ্লেষণ-বিবেচনা করলে যা দাঁড়ায় তাকেই এক কথায় প্রকাশ করা। তবু এমন নামকরণের আরও কিছু ব্যখ্যা প্রয়োজন, কেননা প্রসঙ্গটি গুরুতর। তাই এই প্রতিবেদন।
এর উদ্দেশ্য খুবই সহজ। কর্পোরেটরা যে সরকারে থাকা দলের পিছনে বিপুল পয়সা যোগাচ্ছে সে কথা যখন শুধু বলা হত, প্রচার করা হত অনেকেই ভাবতেন ব্যাপারটা হয়ত শুধুই রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য প্রচারের কর্মসূচি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সুবাদে নির্বাচনী বন্ডের হিসাব প্রকাশ্যে এসে যাওয়ায় এখন স্পষ্ট- কারা কাকে পয়সা যুগিয়েছে, আসলে পয়সার বিনিময়ে নিজেদের বেলাগাম মুনাফা লুটের অবৈধ বন্দোবস্তটা পাকা করতে চেয়েছে। কিছুদূর পেরেছেও। কিন্তু এখানেই ব্যাপারটা শেষ হয় না। আরও একটি অংশ রয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারের নির্বাচনেও দেশের জনগণকে ধর্মের নামে, জাতের নামে, বর্ণের নামে এমনকি ভাষা-রুচি-সংস্কৃতির নামেও আলাদা করে রাখাই আরএসএস-বিজেপি’র হাতিয়ার। তাই ওরা সবসময় নানা কায়দায় জনগণের বিভিন্ন অংশকে একে অন্যের প্রতি ঘৃণা করতে শেখায়, অবিশ্বাস করতে শেখায়। এমনকি প্রয়োজন পড়লে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে মানুষকে সন্ত্রস্থ করতেও পিছপা হয় না। বিগত কয়েকবছরের অভিজ্ঞতায় এসবই আমাদের রাজ্যের মানুষের জানা কথা।
অমন বিভাজনের রাজনীতি ব্যতীত আর কিছুই ওরা পারেনি, পারে না, পারবেও না। এই অবস্থায় আমরা জনসাধারণকে একজায়গায় নিয়ে আসতে চাইছি। খেটে খাওয়া সমস্ত মানুষ একজায়গায় দাঁড়ালে এদেশের মাটিতে আরএসএস-বিজেপি ও তাদের ধামাধরারা কুল কিংবা কিনারা কোনটাই পাবে না। আমাদের রাজ্যে এমন ধামাধরা দলই হল তৃণমূল কংগ্রেস। শ্রমজীবী মানুষ যাতে কিছুতেই একজোট হতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই আজকের ধনতন্ত্র (কর্পোরেট) হাত মিলিয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে। এরা দুই পক্ষ একে অন্যের স্বার্থরক্ষা করছে। তাই আজকের ভারতে পুঁজিবাদের ক্ল্যাসিক অবস্থার মতো করে সবটা মিলিয়ে দেখলে মিলছে না, মিলবেও না। নয়া উদারবাদের যুগে আমাদের দেশে পুঁজিবাদের নিজস্ব বৈশিষ্টেরই নাম কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাত।
সুকুমার আচার্য
ধর্ম-কর্ম নিয়ে ভারতের পুঁজিপতিরা অতীতে কোনদিন ভাবেনি এমনটা নয়। একসময় কথা এমন ছিল যে- টাটারা মন্দিরে খরচ করে না, ওরা শ্রমিকদের কিছু বাড়তি দিয়ে মন জয় করে নেবার চেষ্টা করে। আর বিড়লাদের দেখো- কারখানার পাশেই ঠিক একটা হনুমানজির বা ওই রকম একটা কোন ঠাকুরের মন্দির খুলে বসে আছে। সেখানে রোজ শ্রমিকরা যাচ্ছে, আর ঠাকুরদের প্রণাম করে গদগদ হয়ে বিড়লার জয়ধ্বনি দিচ্ছে। দুভাবেই শ্রমিকদের আন্দোলনের পথ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা। কিংবা আদপেই যাতে আন্দোলনের পথেনা যায় তার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পেট বড় বালাই। নিজের অভিজ্ঞতায় শ্রমিকরা গেছে আন্দোলনের পথে, তাকে আটকে রাখা যায়নি। তবে স্বাধীনতার পর থেকে বেশ কয়েক দশক ভারতের পুঁজিপতিরা ধর্ম-কর্ম নিয়েখুব বেশি মাথা ঘামায়নি। এমনকি সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী অবস্থানও তারা নিয়েছিল। কারণ তারা ভালো করেই জানতো সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিলে দেশে দাঙ্গা বাঁধবে, অশান্তিও বাড়বে, আর পুঁজির চলাচল ব্যাহত হবে।
এখনঅধিকাংশ পুঁজিপতি ধর্মচর্চা শুরু করে দিয়েছে। রাম মন্দির নিয়ে অন্তত তেমনটাই দেখা গেল। এই চর্চায় তারাএকেবারে উদ্দাম। প্রথম যখন নরসিমারাও-এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস মন্ত্রিসভা তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আমাদের দেশে স্পষ্টভাবে পুঁজির বিশ্বায়নের নিয়মগুলি লাগু করতে শুরু করল, তখন কর্পোরেটরা ছিল কংগ্রেসের পাশেই। সেই সময় আরএসএস বরং প্রকাশ্যে বিদেশি দ্রব্য বর্জনের স্লোগান তুলেছিল। কোলগেট নয়, বাবুল ধরো -এইসব আওয়াজ উঠেছিল। কংগ্রেসের দুর্নীতি, বিদেশী পুজির বিরোধিতা এবং পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ফলে জনগণের মধ্যে সঞ্চিত ক্ষোভকে ব্যবহার করে বিজেপি যখন ক্ষমতায় এল, ততদিনে সে বিদেশি পুঁজির বিরোধিতার আওয়াজ দিয়ে ভারতে পুঁজিপতি শ্রেণীর একাংশকে পাশে পেয়ে গেছে। বিজেপির প্রশাসনিক ও সরকারি মদতে ধর্মচর্চা বাড়তে শুরু করল, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের চর্চা। ধর্মস্থানের অনৈতিহাসিক ধর্মীয় মহিমা সরকারি মদতে যেন জীবন্ত হতে লাগল। বিপুল সমাগম হতে থাকলধর্মস্থানগুলিতে।এক এক করে ধর্মস্থানগুলি ক্রমে ক্রমে পরিণত হতে লাগল বাজারে। ভক্তিতে গদগদ হয়ে মানুষ জিনিস কিনতে লাগল। এইভাবে ক্রমশঃ ভক্তি পরিণত হল পণ্যে।
ভারতের পর্যটন শিল্প বহুমাত্রিক। যেমন- প্রাকৃতিক অর্থাৎ পাহাড়, পর্বত, নদী, ব-দ্বীপ, অরণ্য ইত্যাদি। স্থাপত্য অর্থাৎ তাজমহল, কুতুব মিনার, বিভিন্ন গুহাএবংগুহাচিত্র ইত্যাদি। ধর্মীয় অর্থাৎ তিরুপতি মন্দির, কামাক্ষা মন্দির ইত্যাদিনানা মন্দির, মসজিদ, চার্চ, গুরুদোয়ারা। স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করেও পর্যটন হয়।এইরকম নানা বিষয় আছে, যাকে কেন্দ্র করে পর্যটন গড়ে ওঠে।এর মধ্যে ধর্মীয় পর্যটনের ব্যবস্থা আলাদাভাবে খুবএকটা ভাবা হাত না। আলাদাভাবে এখন তাকে নিয়ে আসা হচ্ছেএকেবারে সামনের সারিতে। পুরী বেড়াতে গেলে জগন্নাথ মন্দিরটাও দেখা হয়। পুরীর সমুদ্র, জগন্নাথ মন্দির, কোনারক, নন্দনকানন, দেখা তো আর আলাদা আলাদা ভাবে হয় না। কম-বেশি সব আকর্ষণই একসাথে। তবে মানুষের মধ্যে সুপ্ত যে কুসংস্কার ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রতি গুপ্ত অন্ধ আগ্রহ ছিল, তা নানা রকম সরকারি বদান্যতায় এখন ভালোভাবে বেড়ে উঠেছে। এখন এমন মাত্রায় বেড়ে উঠেছে যে, সরকারও জানাচ্ছে ভবিষ্যতে জ্যোতিষ শাস্ত্র নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীও নাকিদেওয়া হবে। ধর্মীয় পর্যটনে মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে ভিত্তি করে বেড়ে উঠেছে বিনিয়োগ এবং সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ লাভ। বেড়াতে গিয়ে হোটেলে থাকার কথা না হয় বাদই দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাম মন্দির উদ্বোধনের আগে রাম মন্দিরের রেপ্লিকা বিক্রি, বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতার নানা ধাতুর মূর্তি বিক্রি, জ্যোতিষ চর্চার উপর ভিত্তি করে নানা ধাতুর অলংকার বিক্রিএবং মাদুলি-হার (মাদুলি-হার নিয়ে কোনো ধর্মেই কম চর্চা হয় না)ইত্যাদি তথাকথিত গ্রহ মোচন অলংকার বিক্রি, নানা রকম কাল্পনিক বই, ধর্মগ্রন্থ, পুরোহিত শাস্ত্রাদি বিক্রি ইত্যাদি নানা চর্চা নিয়ে পুঁজিবিনিয়োগের এক মহাক্ষেত্র এখনতৈরি হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন কল্পিত গল্প নিয়ে নানা ভেষজ ওষুধ তৈরি হচ্ছে, যার কোন প্রামানিক সত্যতা নেই। জড়িবুটি ছাড়া এইগুলিআর কিছু নয়। আয়ুর্বেদের সাথে এর কোন মিল নেই। একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ- পতঞ্জলি। সুপ্রিম কোর্ট যার বিজ্ঞাপন দেওয়া নিষিদ্ধ করেছে এবং আর্থিক জরিমানাও করেছে।
বিজেপি তার শাসনকালে পুঁজিপতি শ্রেণীর মধ্যে এমন পুঁজিপতিও সে তৈরি করেছে, যা তার পছন্দের। রামদেবের পতঞ্জলি তার একটা উদাহরণহতে পারে। যেহেতু যোগচর্চা করে, অতএব সেই প্রতিষ্ঠান এবং তার প্রস্তুত করা পণ্য আয়কর মুক্ত। বলা যেতে পারেবিজেপি সরকারই যেনতৈরি করেছে আদানিকে। ১৯৮৮ সালে কেবলমাত্র একটি আমদানি-রপ্তানির ছোট প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিল সে। বিজেপির শাসন তাকে খনি, বন্দর, পর্বত, জল, তেল, রেল -যা ছিল সব যেন তার সামনেউজাড় করে দিয়েছে। বহু অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে, আর আদানির বিরুদ্ধেও। আম্বানির ১৯৭১ সালে প্রায় তেমন কোন সম্পদ ছিল না। প্রথমে সে ছিল যেনসমাজবাদী পার্টির চারপাশে। তার কাছ থেকে কংগ্রেস নিজের কাছে সরিয়ে এনে আম্বানিকে উজাড় করে এমন সম্পদ দেওয়ার চেষ্টা করল, যার ফলে হেলিকপ্টার হয়ে গেল তার কাছে পত্নীকে উপঢৌকন দেবার মত একটা খেলনা। পরে বিজেপির সময়ও জিও-তে প্রধানমন্ত্রী নিজে তাঁর পদের অমর্যাদা করে বিজ্ঞাপন দাতার ভূমিকা নিয়েঘোষক হয়ে গেলেন। আর সাথে সাথে বিজেপি তাকে ছিনিয়ে নিল কংগ্রেসের কাছ থেকে। প্রতিবছর নানাভাবে ট্যাক্স ছাড়, ব্যাংকের ঋণ মুকুব করে বিজেপি বড় অংশের পুঁজিপতি শ্রেণীকে পেয়ে গেছে তার পাশে। বিশ্বের পুঁজিপতি শ্রেণীর সংহতির মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ ভারতের এইশ্রেণীটিও আজ চায় চরম দক্ষিণপন্থা। সেই দক্ষিণপন্থা, যে উদার হাতে দেশের সম্পদ পুঁজিপতি শ্রেণীকে উপহার দেবে, আর নির্মম হাতে নিষ্ঠুর ভাবে জনগণের প্রতিবাদকে দমন করবে, গণতন্ত্রকে হত্যা করবে, পারলে সংবিধান কেও। কারণ সংবিধানে যে সীমিত গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণকে দেওয়া আছে, সেটুকুও আজ পুঁজিপতি শ্রেণীর কাছে বিপদ। এই নিষ্ঠুর হত্যা কেবলমাত্র লাঠি গুলি বা মিলিটারি দিয়ে সম্ভব নয়। জনগণের ঐক্যকে ভাঙতে হয়। জাতের ভিত্তিতে ভাঙতে হয়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাঙতে হয়। সেই ক্ষেত্রে বাধা হচ্ছে সংবিধান, সেখানে লেখা আছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। অতএব প্রধানত হিন্দু ধর্মের চর্চাকেই হাতিয়ার করে মানুষের মধ্যে অন্ধত্বের সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। এটা ভারতে হলে হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করা, আরবাংলাদেশ বা পাকিস্তান হলে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করার বিষয়টা এসে যায়। সবমিলিয়ে যাকে বলা যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়িকতাবাদের প্রয়োগ। সংখ্যাগরিষ্ট সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রয়োগ করার সাথে সাথে আপনা-আপনি ভাবেই সংখ্যালঘিষ্ট সাম্প্রদায়িকতা প্রযুক্ত হয়ে যাবে।তাহলেই শাসন আর শোষণ সহজ হবে। এই সত্যটাই বুঝে নিয়েছে শাসক বিজেপি এবং শাসক শ্রেণী হিসেবে পুঁজিপতির শ্রেণীর বড় অংশটা। কিন্তু সমগ্র পুঁজিপতি শ্রেণীর মধ্যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও বড় বড় কর্পোরেট বলতে যাদের বোঝায়, তারা প্রায় সবাই আজ বিজেপির পাশে। নির্বাচনী বন্ডে প্রাপকের তালিকায় বিজেপির নাম সেই জন্য বহু উঁচুতে। রাম মন্দিরকে ঘিরে পুঁজিপতিদের নক্ষত্র সমাবেশের রাজনৈতিক তাৎপর্য এখানেই। তবুও বলা যায় নিরঙ্কুশ ভাবে পুরো সবাইকে যে বিজেপি পাশে পেয়েছে এমনটা নয়।
রাম মন্দিরের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত নির্দেশের ফলেসরকারি উদ্যোগে একটি ট্রাস্ট হয়েছে, তার নাম ‘শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র’। গত কয়েক বছর ধরে সে তুলেছে ৩৫০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে ১৮০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, বাকিটা জমা আছে (সূত্র- thehindubusinessline.com)। এর মধ্যে কতজন পুঁজিপতি দিয়েছে তা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু রাম মন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে দাতাদের তালিকার খুব সংক্ষিপ্ত রূপটা এইরকম-
আম্বানি- ২.৫১ কোটি টাকা, হেভেলস- বিস্তৃত এলাকায়পুরো আলোর সরঞ্জাম, ডাবর ইন্ডিয়া- ১৮.৬ কোটি টাকা, কথাবাচক মুরারি বাপু- ১৮.৬ কোটি টাকা। গৌতম আদানী (কত জানা যায়নি) পক্ষকাল ধরে সমস্ত দর্শনার্থী মানুষের খাবার, গুজরাটেরহীরা ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার ১০১ কেজি সোনা (সূত্র- Newsninelive.com) ইত্যাদি। এছাড়া বেদান্ত'র অনিল অগ্রবাল, রেমন্ডের গৌতম সিংহানিয়া সহ অনেক শিল্পপতিই নিজে উপস্থিত থেকে মোটা অংকের প্রণামী দান করেছেন।টাটাও বেশ কিছু নগদে দান করেছে। কিন্তু রাম মন্দিরের মাহাত্ম্যে উদ্বেলিত হয়ে তিনি ২৫ হাজার কোটি টাকার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। বিশ্বে দুর্লভ মানের আকর্ষণীয় তিনটি হোটেল বানাবেন ওই টাকায়। শুধু ২২ জানুয়ারি প্রণামী বাবদ পাওয়া গেছে নগদ ৬ লক্ষ টাকা এবং চেকে ৩ কোটি টাকা।সাধারণ মানুষ হিসেবে কেউ কাউকে বা এমনকী তার পছন্দের কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও যদি দান করেন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই কারো কিছু বলার নেই। কিন্তু কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এমন হয় যে সে তার কর ফাঁকি দিচ্ছে, ব্যাংকের ঋণ-খেলাপি করে দিচ্ছে আর সরকার সেই খেলাপির বৈধতা দিচ্ছে, তাহলে সেই দানের ক্ষেত্রে যে কোনো মানুষের বক্তব্য থাকবেই। যে কর দিতে পারবেনা বলে কর ছাড় করিয়ে নেয়, যে ব্যাংকের ঋণ দিতে পারবে না বলে ঋণ মুকুব করিয়ে নেয়, -সে দান করার মতো টাকা পায় কোথা থেকে ? জনগণের প্রাপ্য অর্থের ক্ষতি হচ্ছে, তাই জনগণের সেইসব দান সম্পর্কে প্রশ্ন থাকবেই। একই সাথে সরকার যদি প্রচলিত বিধিব্যবস্থা নিয়ে নিয়ম ভাঙে তবে তো সেখানেও প্রশ্ন থাকবে।
বন্যার মত টাকা যাতে পাওয়া যায়, সরকার পুঁজিপতি শ্রেণীর কাছে সেই রকমই আবেদন করেছে একটি নিয়মের মাধ্যমে। রাম মন্দিরে দানের ব্যাপারেসরকারি ঘোষনায় বলা হয়েছে আয়ের ১০% টাকা দিলে মোট দানের পরিমাণের ৫০% ট্যাক্স ছাড় পাবেন। অথচ কোম্পানি আইন বলছে যে কোনো কোম্পানি তার লাভের ৭.৫% টাকা দান করতে পারে। যত রকম ভাবে পুঁজিপতির শ্রেণীর সেবা করার নিয়ম আছে, তার সঙ্গে নতুন আরেকটা যোগ হল। হয়তো হিসাব করলে দেখা যাবে কোনো কোনো ব্যক্তিকে আর কোন করই দিতে হবে না। অন্যদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কি আছে ? অথচ করটা ছিল সরকারের অর্থাৎ জনগণের পাওনা। সেই টাকা সরকার বা জনগণকে না দিয়ে জনগণের অজান্তে রাম মন্দিরে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল।
শুধু রাম মন্দির নয়, একনাগাড়ে প্রচুর মন্দির সরকারি অর্থে গড়তে চাইছে বিজেপি এবং তার সমস্ত সরকার। এর জন্য উত্তরপ্রদেশ সরকার তার ২০২৪-২৫ বাজেটে ৭.৩৬ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ করেছে। গোটা প্রকল্পটার নাম দিয়েছে ‘স্পিরিচুয়াল ট্যুরিজম’, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক পর্যটন। স্লোগানও তুলেছে- ‘উৎসব উদ্যোগ অউর উমিদ’ (উৎসব উদ্যোগ এবং আশা বা আকাঙ্ক্ষা)। এখানেই কর্পোরেটরা আর বিজেপি তাদের আশা পেয়েছে। শুধু রাম মন্দির নয়, কৃষ্ণলীলা মন্দির হবে, চন্দ্রোদয় মন্দির হবে, বিরাট রামায়ণ মন্দির হবে, বৈদিক প্লানেটরিয়াম মন্দির হবে, পরে পরে আরও কত মন্দির হবে, তাকে ঘিরে বড় বড় রাস্তা হবে, বিস্তৃত রেলপথ হবে, বিমানবন্দর হবে. নতুন নতুন আরও কত কি হবে। বরাত পাওয়ার জন্য, এমনকি কিনে নেবার জন্য বসে আছে আদানি আম্বানিরমত কর্পোরেটরা। হয়তো একসময় কোনো মন্দির গোটাটাই লিজে নিয়ে নেবে, যেমন করে লালকেল্লা লিজে নেওয়া যায়।প্রচুর লোক আসবে তীর্থক্ষেত্রের জৌলুষ দেখতে। সবই হবে রামের নামে, পরে পরে হবে হিন্দু ধর্মের নামে। হিন্দু ধর্ম ক্রমে হয়ে উঠবে বৃহৎ পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র। তীর্থক্ষেত্রের ঔজ্জ্বল্যে আসা পতঙ্গের মত মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে নিজের জীবন যন্ত্রণায়। তবু ধর্মের মাহাত্ম্য মাথায় নিয়ে সে আসতেই থাকবে বংশ পরম্পরায়। বিজেপি আশা করে এই ভাবে সফল হবে আরএসএস-এর ‘হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তানে’র স্বপ্ন। কর্পোরেট আশা করে এইভাবে প্রায় নিরুপদ্রবে সফল হবে তার সিন্দুক স্ফীত করার স্বপ্ন। রাম ধামে তাই মহাযজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত এবং আদানি আম্বানিদের সহাস্য উপস্থিতি সেখানে। এ এক চক্র- ত্রয়ীচক্র, বিজেপি আরএসএস এবং কর্পোরেট।
আসলে হিন্দু ধর্মকে এই চক্র হাজির করেছে পুঁজির নাগরদোলার যন্ত্র হিসেবে। পুঁজি যত ঘুরছে, তত তার মুনাফা বাড়ছে। চালক যন্ত্রটি হল সেই মন্দিরটি, যাকে ঘিরে গড়ে উঠছে পর্যটন কেন্দ্র। ধর্মের মহিমা বিচ্ছুরিত হচ্ছে কেবলমাত্র জনগণের জন্য, যাতে তীব্র ঔজ্জ্বল্যে ধাঁধিয়ে গিয়ে সে এর মর্মবস্তুর কখনো যেন হদিস না পায়। একটি মারাত্মক বিষয় লক্ষ্য করে দেখুন। পুঁজি যেদিকে ছুটবে, ছোট বড় পুঁজিবাদী দলও সেই দিকে ছুটবে। কেউ কম - কেউ বেশি কিংবা কেউ জোরে - কেউ আস্তে। আর কেউ আজ যাচ্ছে, আবার কেউ বা আজ যাচ্ছে না- কাল হয়তো যাবে। রাম মন্দির গড়তে গড়তে আর একজন পাল্লা দিয়ে জগন্নাথ মন্দির গড়ে ফেলছেন কিনা ভাবুন ! শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতাবাদের শরিক হওয়া নয়, ভারতে মন্দির গড়লে পুঁজি আসবে -এমন অবস্থা যখন তৈরি করা হচ্ছে, তখন বড় বড় কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী ছোটখাটো পুঁজিবাদী দল যদি রাজ্য সরকারে থাকে, সে ও হয়তোসেই দিকে যাবে। সবাই মিলে জনগণের টাকা নিয়ে মন্দিরের পিছনে খরচ করবে। আর সেই সাথে সবাই মিলে ভারতের সংবিধানের মূল যে মর্মবস্তু ধর্মনিরপেক্ষতা- রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হবে না -এই কথাটির হয়তোশ্মশান যাত্রা করেই ছাড়বে। একইভাবে নির্বাচন এলে প্রায় সমস্ত পুঁজিবাদী দলগুলো হয়তোঅলিতে গলিতে পর্যন্ত খুঁজে বেড়াবে কোথায় কোথায় মন্দির-মসজিদ-গীর্জা ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে, আর সেগুলিই হয় নগদ দিয়ে আসবে কিংবা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসবে জিতলে সরকারি টাকা সেইসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দিয়ে আসবে। 'ধর্মের নামে ভোট চাওয়া যাবে না' -সংবিধানের এই নির্দেশকে এরা দু'পায়ে মাড়িয়ে যাবে।তফাৎ থাকবে শুধু ছেলে ভুলানো কিছু বুলি, যা একপক্ষঅপরপক্ষের বিরুদ্ধে অহরহবলতে থাকবে, কিন্তু মূল বিষয়টির ক্ষেত্রে তারা সবাইহয়তোথাকবে এক জায়গায়।সেই জন্য চাই ভাবাদর্শগত সংঘাতের তীব্রতা এবং একই সাথে সেই সংগ্রামে জয়ী হবার জন্য বিনম্র রণকৌশল। এই রণকৌশলের মূল কথা হল, প্রধানতম বিবাদ আরএসএস - বিজেপি চক্র এবং তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ঐক্য।
প্রায় ২৫ কোটি মানুষের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ।রাম মন্দির হবার বহু আগে থেকেই দেশী বিদেশী পর্যটকদের ভালো মতো আকর্ষণ এখানে। মন্দির, মসজিদ, দরগা, প্রাচীন স্থাপত্য দেখতে প্রচুর মানুষ আসেন এখানে। অধিকাংশ মানুষই সব কিছু দেখতেআসেন। যতটা সামর্থ, ততটাই দেখতে যান, কোন ভেদাভেদই থাকে ন। কোনটা দেখবেন আর কোনটা দেখবেন না এমন বিদ্বেষপূর্ণ মন নিয়ে প্রায় কেউই আসেন না। গত বছর ২০২৩ সালে এসেছিলেন ৩২ কোটি মানুষ, এর মধ্যে ১৪ লক্ষ বিদেশি। শুধু কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে গিয়েছিলেন প্রায় ১৩ কোটি মানুষ (উত্তরপ্রদেশ সরকারের বিজ্ঞাপন)। আসা-যাওয়ার রাস্তা আর শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা হলেই মানুষ খুশি। প্রত্যেকটা জায়গার নিজস্ব ব্যবস্থাপনাই আছে। আজ অবধি সরকারি ব্যবস্থাপনার দ্বারস্থ কেউই হননি। এমনকি 'নির্মোহী আখড়া', যে হঠাৎ করে পাওয়া রামলালাকে প্রথম থেকে পূজা করে আসছিল, সেও কোনোদিন সরকারি অনুকূল্য চায়নি। বরং ১৯৮৩ সাল থেকে কোর্টের নির্দেশে নিযুক্ত প্রধান পুরোহিত লাল দাস, পুঁজিপতি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএস-এর বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ১৯৯৩ সালে খুন হন। রাম মন্দিরের পুরোহিতদের মধ্যে তিনিই প্রথম বলেছিলেন মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির গড়ার কাজ আসলে একটি রাজনৈতিক কাজ। হিন্দু ধর্ম এই কাজ সমর্থন করে না।তাঁর খুনিরা আজও অধরা।
যে স্থানে ডুব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, এখনও অবধি যা প্রমাণিত, তা হল সেই স্থানটি বর্তমানে গুজরাটের দ্বারকা শহরের কাছাকাছি। এস.আর. রাও -এর তত্ত্বাবধানে সমুদ্র তলদেশে ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৫০০ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই নগরীটি ধরে নেওয়া যেতে পারে এটা একসময় দ্বারকা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং কালক্রমে তা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে।ওখানে যেসমস্ত বস্তু পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার মিল আছে (সূত্র- এস.আর. রাও লিখিত ‘Dawn and Devolution of Indus Civilization’, আদিত্য প্রকাশনী, দিল্লী, পৃষ্ঠা- ১৫১-১৫২)।
কিন্তু প্রশ্ন হল এই যে এই নগরীতে মহাভারতে উল্লেখিত শ্রীকৃষ্ণ বলে কেউ কি থাকতেন কিংবা রাজত্ব করতেন ? যদি হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার কথা ভাবা যায় তাহলে তার অস্তিত্ব ছিল যীশুখ্রীষ্ট জন্মের ১৯০০ বছর আগে থেকে, যীশুখ্রীষ্ট জন্মের ১৩০০ বছর আগে পর্যন্ত। কিন্তু মহাভারতের উল্লেখিত এইরকম ঘটনাবলী বা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যা ঘটেছিল তার এখনো কোনো প্রমাণ নেই। তবে এটা ঠিক যে, মহাভারত প্রথমে লিখেছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব নামে একজন মুনি, পরে পরে তার বহু পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে এবং এটি একটি কালজয়ী উৎকৃষ্ট সাহিত্যে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু যতক্ষণ না প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ মহাভারতে লেখা কাহিনীকে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে মানার কোনো কারণ নেই। যারা মহাভারতের ঘটনাবলীকে ঐতিহাসিক সত্য প্রমাণের চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যেও সময় নির্ধারণ করা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ বলে কেউ ছিলেন কিনা সে প্রশ্ন তো অনেক পরে। প্রধানমন্ত্রী অতল সাগরের জলে ডুবে, ময়ূর পালকগুচ্ছ গভীর জলে রেখে এসে সবাইকে যেন জানিয়ে দিলেন এ নিয়ে আর বিতর্ক করে লাভ নেই। যেন ইতিহাস চর্চা, পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণেরও আর কোনো দরকার নেই, যুক্তিরও কোনো দরকার নেই। সব সমস্যার এখানেই শেষ, এটাই কৃষ্ণের দ্বারকা, তা সে কৃষ্ণ রাজত্ব করেছিলেন কিনা তা প্রমাণেরও কোনো দরকার নেই। বিশ্বাস করলেই হল যে ওখানেকৃষ্ণ রাজত্ব করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কেউ কি এই কাজ করতে পারেন ? যতক্ষণ পর্যন্ত তার পুরাতত্ত্ব দপ্তর এবং ইতিহাস চর্চা বিভাগ স্থানটাকে কৃষ্ণের দ্বারকা হিসেবে ঘোষণা না করছে, ততক্ষণ তিনি এ কাজ করতে পারেন কি ? তিনি স্থানটাকে বড়জোর 'দ্বারকা' বলতে পারেন, 'কৃষ্ণের দ্বারকা' বলতে পারেন না। এই কাজ করলে তাঁর সরকারের অধীন এই সমস্ত দপ্তরগুলিকে অবজ্ঞা করা হয়। তাদের সিদ্ধান্তগুলিকে অবজ্ঞা করা হয় এবং তাঁর বিশ্বাসকে তিনি ব্যবহারের মাধ্যমে সকলের বিশ্বাসের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছেন -এটাই প্রমান হয়। এই কাজ স্বৈরাচারী প্রবণতারই লক্ষণ। তবু তিনি করবেন।কারণ তাঁর কর্পোরেটদের প্রায় সবাই চায়ধর্মীয় পর্যটনের মাধ্যমে তাদের লগ্নি বাড়াতে।
তবে এদের এই ধরনের ভন্ডামি এই প্রথম নয়। প্রাকৃতিক ঘটনাবলীকে নিয়ে কাল্পনিক মাহাত্ম্য দিয়ে তাকে নিজেদের সম্প্রদায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এর আগেও বেশ কয়েকবার এরা চেষ্টা করেছে। প্রধানত আরএসএস - বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এই ধরনের সংগঠনগুলো করেছে। তার মধ্যে বড় উদাহরণ হল ‘রামশিলা’। রামশিলা আসলে কোনো শিলা নয়। তাতে রামায়ণের কল্পকাহিনী জুড়ে দিয়ে রামায়ণে কথিত রামের ঐতিহাসিক বাস্তবতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
ঘটনাটা এইরকম- দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রতীরে এক ধরনের কঠিন পাথরের মতো দেখতে প্রবাল খন্ড পাওয়া যায়। এগুলো জলে ভাসে। এক ধরনের রামায়ণে রামচন্দ্রের লঙ্কায় পায়ে হেঁটে যাওয়ার কাহিনী আছে। সমুদ্রের উপর কিভাবে হাঁটা যায়? কল্পনায় এল- এই ধরনের পাথরগুলো দিয়ে ভারত শ্রীলংকার মাঝখানে সেতু তৈরি করা হয়েছিল। এই রকম দীর্ঘদিনের ভাবনায় কল্পনার ডানায় ভর করে জন্ম নিল 'রামশিলা' শব্দটি। এখন উপগ্রহ থেকে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মাঝখানে সমুদ্রগর্ভে এক ধরনের শিলাস্তরের চিত্রও পাওয়া গেল। এবার প্রচার করে দেওয়া হল এই ধরনের সেতু হাজার হাজার বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল, আর তা রামই করেছিলেন। সেতুর বাস্তবতা ছিল, অতএব রামচন্দ্রের বাস্তবতা ছিল।
কিন্তু পরে তলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখা গেল যুক্তিটি রামশিলার মতই ফোঁপরা। রামশিলা আসলে ফোঁপরা, সেই জন্য বাতাসে ভর্তি থাকে ফোঁপরা জায়গাগুলো। আর সেই জন্যই সেটা জলে ভেসে থাকতে পারে। রামশিলার ফোঁপরা হবার বিষয়টি রয়েছে তার গঠনপদ্ধতির মধ্যে। সমুদ্রের যে সমস্ত স্থান অত্যন্ত স্বচ্ছ, সেই সমস্ত স্থানে সূর্যালোক অনেক দূর অবধি যেতে পারে। সেই সমস্ত স্থানে চিংড়ির মত ছোট ছোট প্রাণী জন্মায়। সেইগুলি শামুকের গঠনের মত প্রবাল নামে পরিচিত এক ধরনের প্রাণী খেতে আসে। তারা সেখানেই বংশবিস্তার করে মারা যায়, আবার নতুনজন্মায়। এইভাবে তাদের জীবনচক্র চলতে থাকে। মারা যাবার পর খোলস সহ মৃত প্রাণীটা নীচে পড়ে যায়। এইভাবে অসংখ্য মৃত প্রাণী পড়ে সমুদ্রের তলদেশে জমা হতে থাকে। তারা পাথরে পরিণত হয়। যেহেতু তারা শামুকের মতো, তাই পাথরে শূন্যস্থান থাকে। সমুদ্রের তলদেশ নিস্তরঙ্গ, তাই প্রবালস্তর অক্ষত থাকে। সমুদ্রের উপরিতলে যখন চুড়াগুলো জমতে জমতে চলে আসে, তখন সমুদ্রের উপরিতলে জলস্রোতের ধাক্কায় সেগুলো ভেঙে যায়। ভেতরে ফাঁপা ও বায়ুভর্তিপ্রবালখণ্ডগুলো হালকা বলে ভাসতে ভাসতে সমুদ্র তীরে চলে আসে। তখন ভারতে তার নাম হয় রামশিলা। অন্য কোথাও এই রকম নাম নেই। সমুদ্রগর্ভে বহু প্রবাল প্রাচীর আছে। ভারতের তার নাম 'রামসেতু'। অন্য কোথাও তার এই নাম নেই।
একটি বিষয় লক্ষ্য করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন, ১৯৯৩ সালে সারাদেশে যখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তথাকথিত রামশিলাকে নিয়ে 'রামশিলা পূজন' কর্মসূচি নিয়েছিল, তখন সেই কর্মসূচি জনমানসে খুব একটা দাগ কাটেনি। তার কারণ এটাই ছিল যে, ভারতে পুঁজিপতির শ্রেণীর সর্বাধিক অংশটা সেদিন তাদের পাশে ছিল না। কিন্তু এখন প্রধানমন্ত্রী দ্বারকা পরিকল্পনায় কৃষ্ণ জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, জনমানসে দাগ কাটতে পারে, কারণ ভারতের পুঁজিপতির শ্রেণীর বড় অংশটা এখন তাদের ইচ্ছার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
প্রশ্ন উঠবে ক্ষতি কি ? পর্যটন কেন্দ্র হবে, কর্পোরেটরা লাভ না হয় করবে, বহু মানুষ তো কাজ পাবে। তাহলে আপত্তি কেন ? শুধুমাত্র পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে সমাজের ক্ষতি নেই বরং লাভ। কিন্তু কেবলমাত্র ধর্মকে কেন্দ্র করে অবৈজ্ঞানিক গল্পগুলোকে সত্যের মোড়কে চালান করে পর্যটন কেন্দ্রগড়ে তুললে মানুষের মনে অবৈজ্ঞানিক পশ্চাদপদ চিন্তার প্রসার ঘটানো হয়। আর কোন একটি ধর্মকে কেন্দ্র করে করলে বিদ্বেষের বীজও গোপনে রোপন করা হয়। কর্মস্থানের জৌলুসে বারবার আবর্তিত হতে হতে যেকোনো মানুষই অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারমূলক চিন্তার চারপাশে আবর্তিত হতে থাকবেন -এটাই স্বাভাবিক। ফলে একজন মানুষ এই অবস্থায় তার চারপাশের পৃথিবীর কোথায় কি পরিবর্তন হচ্ছে, তার খোঁজও রাখতে পারবেন না। হাজার হাজার বছর আগের লেখা, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তেরকথা এবং বর্তমান পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কহীন মিথ্যাকেই তিনি বেদবাক্য হিসেবে সত্য মনে করবেন। ফলে সমাজটা আর এগোবে না, বরং পশ্চাৎপদ চিন্তারবশবর্তী হয়ে সভ্যতা পশ্চাদগামী হবে। শোষণ - কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মন ইত্যাদি নানা বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি অসম্ভব হয়ে উঠবে। ধর্ম একটা অলীক সূর্য, যা মানুষের চারদিকে ততক্ষণ ঘোরে, যতক্ষণ মানুষটা নিজের চারিদিকে না ঘুরতে পারছে। নিজের চারিদিকে ঘুরে সবকিছু জানার চেষ্টা করলে মানুষ নিজেকে চিনতে পারবে, নিজের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারবে, নিজের মুক্তির পথও খুঁজে পাবে। তখন তার কাছে ধর্মের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।লালনের একটা গান আছে- ‘আপনারে আপনি চিনে নে’। ঈশ্বর নয় - চিনতে হবে নিজেকেই, জানতে হবে নিজেকেই।
আমাদের বক্তব্যের প্রধানতম কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ফ্যাসিবাদ বিনির্মাণের বিষয়টি। রাম মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিজেপি - আরএসএস - কর্পোরেট চক্র চাইছে ভারতের বুকে ফ্যাসিবাদ বিনির্মাণ করতে। মানুষের নির্মল ধর্মবিশ্বাসের সাথে বিদ্বেষ ও অন্ধত্বকে যুক্ত করে এমনকোনো মসীহাকে তৈরি করতে চাইছে, যে হবে ভবিষ্যতে এই দেশে কোনো এক ফ্যাসিস্ট শাসক। এই প্রক্রিয়া এখনো অবধি রাম মন্দির বিনির্মাণছাড়া অন্য কোন মন্দিরে দেখা যায়নি। ভারতে প্রচুর হিন্দু ধর্মের মন্দির আছে। তাকে ঘিরে অঘোষিত ভাবে অনেক পর্যটন কেন্দ্রও হয়ে গেছে। সরল বিশ্বাসে, মুক্ত মন নিয়ে সেগুলি দেখতে নানা ধর্মের নানা মতের বহু মানুষ এখনও যাচ্ছেন। কোথাও কোনো সমস্যা কোনোদিন হয়নি। এগুলোকে কেন্দ্র করে শাসকশ্রেণী রাম মন্দিরের মতো বাসনাও ব্যক্ত করেননি। বরং এগুলোতে সকলের প্রবেশ করা ও পূজা করার অধিকার নিয়ে কমিউনিস্টদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস অতীতে ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। অতীতে কেরালায় গুরুভায়ুর মন্দিরে দলিতদের প্রবেশ করার অধিকার নিয়ে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড এ কে গোপালনের নেতৃত্বে সংগ্রাম হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কেরালার শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ করার অধিকার নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ও কেরালার বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সরকার সংগ্রাম করে। এই সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল আরএসএস, বিজেপি। পশ্চিমবাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চৈতন্য, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মত বহু মনীষীর দেখানো পথই কমিউনিস্টরা অনুসরণ করে চলেছে। কমিউনিস্টরা চায় এদেরই যোগ্য, সময়োপযোগী উত্তরাধিকার হতে। এই পথ যে প্রধানমন্ত্রীর 'রাম মন্দির' পথেরই বিপরীত -এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে যা করছেন, সবটাই মনুসংহিতার সংবিধানকে সামনে রেখে।
ভারতে এখন এই ব্যাপারে যা হচ্ছে তা আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নতুন কোন আবিষ্কার নয়। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে সৌদি আরবের সুলতান ঘোষণা করেছিলেন তাঁর দেশে ছাত্রদের একই সাথে ইসলাম ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে। আসলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়া নয়, প্রযুক্তি নিয়ে পড়া। বিজ্ঞান পড়লে যুক্তির চর্চা করা হয়, প্রযুক্তি পড়লে সমাজজীবনে যুক্তির চর্চা না করলেও চলে।উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে বহিরাঙ্গে জৌলুস দেখাবার জন্য। অপরদিকে মননে সঞ্চয় করা হবে হাজার হাজার বছর আগের অপ্রয়োজনীয় পরিত্যক্তকথাগুলিকে। যুক্তিহীন নিঃশর্ত ও প্রশ্নাতীত ভাবেসেগুলি মেনে নিতে বলাহবে। প্রশ্ন করলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বাইরে আলো আর ভিতরে নিকশ কালোর হাড় হিম মেলবন্ধন। বহিরাঙ্গেসবকিছুই হবে ঝাঁ-চকচকে -যেন কত উন্নত! আর মনের জগতে পেছাতে পেছাতে চলে যাবে মধ্যযুগীয় বর্বরতায়। রাষ্ট্র-সমাজ সবই পিছিয়ে যাবে সেইমত।এই পথেই এগিয়েছেন তুরস্কের এরদোগান। সেই দেশের মসজিদগুলোকে ভিত্তি করে গড়ে তুলেছেন ধর্মীয় পর্যটন ব্যবস্থা। তার জৌলুসে আকর্ষিত হয়ে প্রতিবছর পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। সেখানে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পর্যটকবেড়েছে ৩২%। পুঁজিপতিরা প্রচুর লাভ করেছে। আর সৌদি আরবে যা লাভ হয়েছে তার সিংহভাগ নিশ্চিতভাবেই তুলেছেন সুলতান এবং তার পরিষদবর্গ। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তাকে ঘিরে থাকা ত্রয়ী চক্রের বলয় এই পথেরই পথিক, যে পথের দ্বারোদ্ঘাটন করেছেন সৌদি আরবের সুলতান। সম্প্রতি মোদি বলেছেন- ‘আমি যা করে যাব ১০০০ বছর ধরে মানুষ তা মনে রাখবে’। কিন্তু প্রশ্ন হল- কে কাকে মনে রাখবে? কেন মনে রাখবে ? হিটলারকে তো মানুষ আজও মনে রেখেছে এবং আরও হাজার বছর ধরে মনে রাখবে। ইতিহাসের চাকা মাঝে মাঝে পশ্চাদগামী হয়, সময়ে সময়ে সে পিছিয়ে যেতে পারে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে অগ্রগতিই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটাই চিরসত্য এবং এটাই ‘ন হন্যতে’ সত্য।
ওয়েবডেস্কের তরফে প্রাককথন: সৌভিক ঘোষ
ব্যবহৃত ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া