সব্যসাচী চ্যাটার্জি
'মানুষ খারাপ হলে সরকার কি করবে?', 'পুলিশ কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছে,বেশ করছে এই নিয়ম না মানা জানোয়ার গুলোকে গুলি করে মেরে দেওয়া উচিৎ। ' ' সাঁকরাইলে বাচ্চার দুধ আনতে গিয়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে মৃত্যু যুবকের' কিংবা 'ক্ষিদের জ্বালায় বিস্কুট কিনতে গিয়ে লাঠির আঘাতে প্রাণগেল যুবকের''
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_170012.jpg)
এখন রাজনীতি করবেন না, এটা এসবের সময় নয়'।
'থালা বাজান' বাতি জ্বালুন,এর ঘাড়ে,ওর ঘাড়ে দোষ চাপাতে থাকুন। সরকার কী করবে? মানুষই খারাপ হয়ে গেছে। রাজনীতি করে আর সমাজটাকে উচ্ছন্নে দেবেন না প্লিজ। এই শব্দ,বাক্য, বক্তব্য গুলো ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট, ডিজিটাল ও সোস্যাল মিডিয়ায় গত কয়েকদিনের ছোট বড় হেডলাইন, আপ্তবাক্য বা ছয়ের পাতার বাঁদিকের কোণার খবর বা মধ্যবিত্ত জ্ঞান বন্টন।
যার আসল কথা হল মানুষ খারাপ হয়ে গেছে, সে সোস্যাল ডিসট্যান্সিং মানছেনা, সে প্রধাণমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনছে না, সে পুলিশের কথা শুনছে না তাই এদেরকে শাসন করতে পুলিশ লাঠিপেটা করবে না তো কি ফুল চন্দন ছুঁড়বে??
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_171152.jpg)
তাই পুলিশের সমস্ত পদক্ষেপই লকডাউনে হতাশ তথাকথিত মিডিয়াকেন্দ্রিক মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। সোস্যাল ডিসট্যান্সিং! এয়ি হ্যায় কোরনা কা রাম বাঁট এহলাজ।
এক ধাক্কায় মানবাধিকার, পুলিশের লাঠি, রাষ্ট্রীয় হত্যা সব, সব ইষ্টে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। করোনা কালান্তরের সামাজিক অভিযোজনগুলি মানুষের মগজকে পুনর্গঠিত করছে। সরকার কি করবে, মানুষ যদি খারাপ হয়! রাজনীতি করবেন না প্লিজ।পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির সঙ্গে আমাদের দেশে এখন কোনো সাংবিধানিক জরুরী অবস্থা চলছে না চলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পথ মেনে লক ডাউন।
কিন্তু কোভিড ১৯ এর প্রকোপে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংকট জনিত কারনে আমাদের অসংখ্য জরুরী নিয়ম কানুন মেনে চলতে হচ্ছে। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে ও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে এই জরুরি ভিত্তিক নিয়ম গুলি মেনে চলতে হচ্ছে। যেমন লক ডাউনের ফলে আমাদের চলা ফেরার অধিকার আজ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এবং আমাদের উপর রাষ্ট্রের নজরদারি চলছে প্রতিনিয়ত। ভাইরাসের কারন ছাড়া এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র জরুরী অবস্থার সময়েই সংবিধান সিদ্ধ হয় নইলে অসাংবিধানিক।
গণতন্ত্রে রাষ্ট্র ও মানুষের সম্পর্ক আবর্তিত হয় সংবিধানের দ্বারা। এবং একটি সংবিধানের কার্যকারিতা নির্ভর করে দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলির সাংবিধানিক সুরক্ষার মধ্য দিয়ে। মূলত নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমানাধিকার ও জীবনের অধিকার রক্ষাই গণতান্ত্রিক সংবিধান দ্বারা পরিচালিত বর্তমান স্বাস্থ্য সংকট এই সাংবিধানিক অধিকার গুলির প্রয়োগের ক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ নামিয়ে এনেছে যার ফলে আমাদের চিরপরিচিত দিন যাপনের সংস্কৃতি সাময়িক সময়ের জন্য হলেও রাষ্ট্র দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত। ধরা যাক সামাজিক দূরত্বের কথাই, এটি নিছক একটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি ভিত্তিক পদক্ষেপ।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_165751.jpg)
এই অবস্থা কেটে গেলেই আমাদের সংবিধান অনুযায়ী তা কার্যকর হবার কথা নয়।বরং করোনা পরবর্তী বিশ্বে স্বাস্থ্যসংকট কাটলে যে সংকট মাথা চাড়া দেবে সেটি হল আর্থিক সংকট। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এই সংকটের পূর্বাভাষ দিয়েছেন। কয়েক কোটি মানুষের কাজ হারানোর সম্ভাবনা প্রবল, যা পৃথিবীতে ১৯৩০ সালের বিশ্ব অর্থনীতির মহামন্দার চেয়েও ভয়াবহ হতে চলেছে। এই পরিস্থিতেই উভেল নোয়া হারারির মত ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে আমরা কিভাবে বাঁচব তা নির্ভর করবে দেশে দেশে সরকার গুলি গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংবিধান ও তার দ্বারা প্রাপ্ত মানবাধিকার গুলির উপর কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নেয়।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_181847.jpg)
নোয়াম চমস্কি, বলেছেন যে মানুষ করোনা ভাইরাসকে জয় করে নিলেও তার সামনে থাকবে সুটি ভয়ঙ্কর বিপদ। এক পারমানবিক যুদ্ধের বিপদ আর ভূ-উষ্ণায়নের বিপদ। করোনা অতিমারির আসল কারণ যদি নব্য-উদারবাদের আমলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুনাফা সর্বস্বতা হয় তাহলে পারমানবিক যুদ্ধ ও ভূ-উষ্ণায়ন রুখতে প্রথম বাধা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের নীতি। পরিবেশ সংক্রান্ত যে কোনো আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে তারা প্রথম থেকেই আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে এসেছে। মনে রাখা দরকার আর্থিক সংকটের মোকাবিলার প্রশ্নে এই সরকার গুলির কাছে দুটি রাস্তা খোলা আছে। এক, আরো আগ্রাসী হয়ে আর্থিক মন্দার দায়ভার সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া তাদের দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের লড়াইয়ের ফলে অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি টুঁটি টিপে স্তব্ধ করে দেওয়া অথবা সাধারণ মানুষকে আরো অধিকার দিয়ে তাদের সমস্যা মোকাবিলায় পাশে থাকা। এই পথ বাছার মধ্যদিয়েই গণতন্ত্র সম্পর্কে সরকারগুলির অভিমুখ আমরা বুঝতে পারি।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_165227.jpg)
ধরুন হাঙ্গেরির সরকার এই স্বাস্থ্য সংকটের কারন দেখিয়ে ইতিমধ্যেই সেই দেশের সংবিধানের জরুরী অবস্থার অনির্দিষ্টকালীন প্রয়োগ ঘটিয়েছে। ভারতে ইতিমধ্যেই কাজের ঘন্টা বাড়াবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মানুষের শরীরে ভাইরাস আছে কিনা জানতে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে যার ফলে রাষ্ট্রের কাছে আমাদের শরীরের তথ্য চলে যাচ্ছে। প্রশ্ন হল আমরা কি স্বাস্থ্য সংকট কেটে গেলেও বা না থাকলেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিতাম বা দেবো নাকি দিতে চাইব?
অনেকেই এর উত্তরে না বলবেন। কিন্তু আধিপত্যের জোরে ইতিমধ্যেই আমাদের ব্যক্তিপরিসরের বহু তথ্যই রাষ্ট্রের কাছে আমরা তুলে দিয়েছি বিনা প্রশ্নে। বিনা প্রতিবাদে।রাষ্ট্র জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার নামে এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার নামে বহু তথ্যই সংগ্রহ করেছে যা শুধু আমাদের ব্যক্তিপরিসরের অধিকারকেই খর্বিত করতে পারে তা নয় বরং জনগনের রাষ্ট্র নির্ভরতা বা রাষ্ট্র নেতা নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়। গণতন্ত্রের পক্ষে এটা খুবই বিপদজ্জনক।বাবা সাহেব আম্বেদকার ভারতের সংবিধানের প্রণয়নের সময়েই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন,ধর্মে ভক্তি বলতে আমরা যা বুঝি রাজনীতিতে তা কায়েম হলে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে এবং তা স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের পথকে প্রশস্থকরে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_181806.jpg)
আমাদের গণতান্ত্রিক সংবিধান একনায়ক তন্ত্র বা স্বৈরাচার কখনো অনুমোদন করেনা।তাই আমাদের এই স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার সময়ে চোখ কান খোলা না রাখলে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার গুলি হাঙ্গেরির মত কেড়ে নেওয়া হতে পারে। আরো একটা উদাহরন দেওয়া যাক সেটা ইসরায়েলের, সেখানে সংবিধান প্রণয়নের পরেই জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছিল আজও সেই দেশে জরুরি অবস্থা জারী আছে।প্রথমত স্বৈরতন্ত্র সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে এবং এবং স্বৈরতন্ত্রের মেয়াদকে অনির্দিষ্টকাল রাখতে প্রয়োজন কয় জনগনকে শাসক নর্ভর করে তোলার।স্বাস্থ্য মানুষের জীবনের এমন একটি সমস্যা যাকে কেন্দ্র করে মানুষ অনেক ত্যাগকেই স্বীকার করে নেয়।অধিকারবোধ বিস্মৃত হয়।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_165028.jpg)
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_165151.jpg)
কেউ জানুক বা না জানুক পৃথিবীর সব স্বৈরতান্ত্রিক শাসকই জানেন সে কথা।গনতন্ত্র কিন্তু বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল।প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্ন,যুক্তি ও অধিকারবোধের ভিত্তিতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংবিধান পরিণত হয়।সারাবছর গোমূত্র খাওয়ার বিজ্ঞাপন করে একদিনে দেশের মানুষকে বিজ্ঞানের পথে নামানো যায়না। তাতে থালা বাজাতে বললে শোভাযাত্রা বেড়িয়ে আসে বা বাতি জ্বালাতে বললে অকাল দীপাবলী নেমে আসে।করোনা মোকাবিলার প্রশ্নেও তাই বার বার উঠছে আমাদের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার গুলির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন। আদৌ তাঁরা সমস্যার মোকাবিলা করতে চাইছেন তো?
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/IMG_20200425_164545.jpg)
নাকি সমস্যা মোকাবিলার বদলে সমস্যাকে জিইয়ে রেখে নিজেদের স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন?জনগনকেই চাইতে হবে জবাব।আমাদের পুর্ববর্তী প্রজন্মের আত্মত্যাগের মূল্যে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মূল কথাই হল বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাই কোনো মুল্যেই সমালোচনার অধিকার,প্রশ্ন করার অধিকার ছাড়া চলবে না।নইলে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার গুলিই ভবিষ্যতের ডিটেনশন ক্যাম্পে পরিণত হয়ে যেতে পারে! পুনশ্চ ইনিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে কোয়ারেন্টাইম সেন্টারে মোবাইল রাখা নিষদ্ধ হয়েছে এবং দেশ জুড়ে আনন্দ তেলতুম্বডের মত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীকে আটকে রাখেছে এন আই এ।স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন বিমান বসু সূর্যকান্ত মিশ্ররা,ত্রাণ দিতে গিয়ে আটক হচ্ছেন বামপন্থীরা............
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/93903972_1398403220353362_8887464637499441152_o.jpg)
তাহলে কি ধরে নিতে হবে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থাকে দীর্ঘতম জরুরী অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে ভারতের স্বৈরতন্ত্র মোদী মমতাদের হাতধরে?উত্তর চাইতে হবে আমাদের।স্বাস্থ্য বিধি মেনেই বিকল্প ও সৃজনশীল পথে।
ছবি:Google Image
শেয়ার করুন