ভারত সরকারের আরোগ্য সেতু অ্যাপটি ইন্সটল করেছেন ? করেননি ? সেকি ! ট্রেনে উঠলে কিন্তু বাধ্যতামূলক এই অ্যাপ !
তা করুন বা নাই করুন, কিছু 'বাস্তব' জানলে কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগবেই ! কৌতূহল বড় নাছোড়বান্দা রোগ ! সে আমার-আপনার কাছে নাহয় স্মার্টফোন আছে, কিন্তু যাঁদের নেই ?
শুরু হবে চতুর্থ পর্যায়ের লকডাউন। গোটা দেশে বর্তমানে তিন রঙের রমরমা, লাল, কমলা ও সবুজ। ‘রেড, অরেঞ্জ ও গ্রীণ জোন’ তৈরি করে বিভিন্ন উপায়ে চলছে করোনা মোকাবিলার কাজ। ভারত সরকার COVID-19 প্রবণতা ও উপসর্গ সম্পর্কে অবহিত থাকতে ভরসা করছে আরোগ্য সেতু নামে একটি অ্যাপ্লিকেশনের উপরে। নীতি আয়োগ সিইও অমিতাভ কান্তের মতে, ২ এপ্রিল চালু করা হয়েছে এই অ্যাপ এবং জাতীয় তথ্য বিজ্ঞান কেন্দ্রের (এনআইসি) তৈরি এই অ্যাপ্লিকেশনটি বর্তমানে ১০ কোটিরও বেশি ডাউনলোড হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে নাগরিকদের কাছে জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর ভাষণে এই অ্যাপটি ডাউনলোড করার আবেদন করেছিলেন।
আপনি যে স্মার্টফোন সর্বদা বহন করেন তাতে একটি অ্যাপ্লিকেশন থাকবে, যা পার্শ্ববর্তী অন্যান্য ফোনগুলির নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করে ভার্চুয়াল আইডি লগ তৈরি করবে। আপনি যদি কোভিড১৯ পজিটিভ হন, তবে আপনার ডিভাইসে ভার্চুয়াল আইডি লগের প্রত্যেককে অবহিত করা হবে। সাধারণত এটি সেই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে যেখানে আপনি আক্রান্ত ব্যক্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন, অথবা হচ্ছেন।
আরোগ্য সেতু অ্যাপ ১১ টি ভাষায় পরিষেবা প্রদানে সক্ষম। অ্যাপটি ডাউনলোডের সময় আপনার অনুমতি পাওয়ার পর এটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আপনার কাছে অনেকগুলি প্রশ্ন উত্থাপন করে। এতে আপনার নাম, লিঙ্গ, বয়স, অবস্থান, মোবাইল ফোন নম্বর এবং আপনি গত ৩০ দিনের মধ্যে কোনও বিদেশ ভ্রমণ করেছেন কিনা তার বিশদ বিবরণ জানাতে হয়। ট্র্যাকিং-এর জন্য ফোনের ব্লুটুথ এবং জিপিএস অন করতে হয়। অ্যাপটি আপনার আশপাশের মানুষের ফোনে তথ্য প্রেরণ করে যদি আপনি কোভিড১৯ পজিটিভ হন, এছাড়াও প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর অন্তর আপনার লোকেশন ট্র্যাক করে।
এই অ্যাপে আপনাকে একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) এর গাইডলাইনের উপর ভিত্তি করে অ্যাপটি আপনাকে আপনার ঝুঁকির সম্বন্ধে জানান দেয়। প্রতিবার ‘স্ব-মূল্যায়ন পরীক্ষা’র সময় আপনার অবস্থানের ডেটা এনআইসি দ্বারা পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের সার্ভারে প্রেরণ করা হয়।
গত ২রা মে, কেন্দ্রীয় সরকার তার সমস্ত কর্মচারীদের জন্য অ্যাপ্লিকেশনটির ডাউনলোড ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে এবং সমস্ত কর্মচারীদেরও ফোনে আরোগ্য সেতু অ্যাপ্লিকেশন নিশ্চিত করার জন্য বেসরকারী সংস্থাগুলিকেও অনুরোধ করেছে। "কর্মীদের মধ্যে এই অ্যাপ্লিকেশনটির ব্যবহার নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির প্রধানের দায়িত্ব।" মন্ত্রকের এই ঘোষণা বহু মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল, বিশেষ করে যারা ইন্টারনেট ও গোপনীয়তা সম্পর্কে একটু আধটু চর্চা করেন। সম্প্রতি এক এথিকাল হ্যাকার জানিয়েছিলেন আরোগ্য সেতু অ্যাপটি হ্যাক করা সম্ভব। সরকার এর বিরোধিতা করে জানিয়েছিল আরোগ্য সেতু কোনও ভাবেই হ্যাক করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র আবার বলছে অন্য কথা। মেনএক্সপি নামক এক সর্বভারতীয় সংবাদ পোর্টালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি সরকার অ্যাপটিকে ‘সুরক্ষিত’ ঘোষণা করার ৪ ঘণ্টার মধ্যেই বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আরোগ্য সেতুর ‘কোড’ ভেঙ্গে ফেলেন। নিজের ফোনে এই অ্যাপ ইন্সটল করতে চাইছিলেন না ওই ইঞ্জিনিয়ার। খুব সুকৌশলে ৪ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় ভেঙ্গে ফেলেন কোড। নাম, বয়স, লিঙ্গ, বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস এবং কোভিড১৯ উপসর্গের মতো ব্যক্তিগত তথ্যের জন্য নির্দিষ্ট পেজটিকে বাইপাস করতে সক্ষম হন। এমনকি অ্যাপ্লিকেশনটিকে ফোনের জিপিএস এবং ব্লুটুথের মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্র ব্যবহারের অনুমতি না দিয়েই ইন্সটল করেন। নিজের কোনও বিবরণ না দিয়েই নিজেকে কোভিড১৯ থেকে "নিরাপদ" হিসাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। ওই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের মতে অ্যাপ এর বিষয়ে একটু জ্ঞান থাকলেই আরোগ্য সেতু থেকে ‘ফেক পজিটিভ’ রিপোর্ট জেনারেট করা সম্ভব। অর্থাৎ সরকার তথ্য সুরক্ষার কথা বললেও যে আসলে তা বিশবাঁও জলে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বেঙ্গালুরু নিবাসী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
আরোগ্য সেতুর গোপনীয়তার ক্ষেত্রে আরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। আধার তথ্যের অপব্যবহার নিয়ে এর আগে বহু মানুষ ও সংস্থা সরব হয়েছে, এক্ষেত্রেও দেশের প্রধান বিরোধী দল সহ বহু সংস্থাই উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। দেশের জনসংখ্যা ও স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যার নিরিখে অ্যাপটি বাধ্যতামূলক করা সত্যিই চিন্তার বিষয়।
ডিজিটাল গোপনীয়তার অন্যতম শীর্ষ সংস্থা ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (আইএফএফ) মতে, একটি দৃঢ় ও শক্তিশালী তথ্য সুরক্ষা আইন না থাকায় জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী অ্যাপ্লিকেশনটির অপব্যবহারের সম্ভাবনা বেশি।
আইএফএফ, আরোগ্য সেতু ডাউনলোড বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে যে যুক্তিগুলি তুলে ধরেছে তার মধ্যে একটি হ'ল, ভারতের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম। আইএফএফ বলছে, "বিশেষত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে এই অ্যাপ।" ভারতে বর্তমানে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ কোটি অতিক্রম করেছে, কিন্তু আইডিসি-র তথ্য অনুযায়ী এখনও প্রায় ৫৫ কোটি মানুষ ‘ফিচার ফোন’ ব্যবহার করেন, এবং তার মধ্যে ৪৫ শতাংশ মানুষের ফোনের দাম ১০০০ টাকার কম। আরোগ্য সেতু অ্যাপ্লিকেশনটি ফিচার বা অ্যানালগ ফোনে কাজ করবে না, তাহলে সেই প্রান্তিক মানুষগুলোর কী হবে ? উত্তর কোথাও নেই। গত মাসে উত্তর প্রদেশের নয়ডার একটি শপিং মলের ভেতর ওষুধের দোকান খোলা থাকা সত্ত্বেও ওষুধ না নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন এক ব্যাক্তি, কারণ তাঁর ফোনে আরোগ্য সেতু অ্যাপটি ইন্সটল করা ছিল না। নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে দোকানে ঢুকতেই দেননি। শুধু নয়ডা নয়, দেশের বহু জায়গা থেকে বহু মানুষ একই অভিযোগ করেছেন।
অ্যাপটির বিবরণ ও একটি দুর্বল গোপনীয়তা নীতি ছাড়া অ্যাপটি সম্পর্কে আর খুব বেশি কিছু জানা যায় না। সরকারি পরিষেবা ভেবে, সরকারের কথার উপর বিশ্বাস করে অনেকেই হয়ত অ্যাপটি ব্যবহার করবেন, কিন্তু কেউ কোভিড১৯ পজিটিভ না হওয়া সত্ত্বেও যদি সেই মানুষ সম্পর্কে ‘ফলস পজিটিভ’ রিপোর্ট জেনারেট হয়, তাহলে মানুষের মধ্যে অযথা বিভ্রান্তি বাড়বে। কিছু ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সামাজিক বিশৃঙ্খলাও দেখা দিতে পারে। এ এক বড় ভয়ের কারণ। আইএফএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, “অ্যাপটি মূল সার্ভারে বহু সরকারি ডেটাবেসের সাথে যুক্ত, এর ফলে গণ নজরদারি ব্যবস্থার অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যায়। অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশন কেবল একটি পয়েন্টে তথ্য সংগ্রহ করে, কিন্তু আরোগ্য সেতু ব্যক্তিগত এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্য যোগাড়ের জন্য একাধিক পয়েন্টে ডেটা সংগ্রহ করে, যা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকি বাড়ায়।”
এই অ্যাপের মাধ্যমে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোনেও সব ব্যাক্তিগত তথ্য জমা থাকে। আপনি যদি কোভিড১৯ পজিটিভ না হন, তাহলে ৪৫ দিন পর এই তথ্য নিজে থেকেই ডিলিট হয়ে যায়। আপনি যদি কোভিড১৯ পজিটিভ হন, তাহলে তথ্যের স্থায়িত্ব ৬০ দিন। কিন্তু কেউ যদি পজিটিভ হওয়ার পর অ্যাপটি ডিলিট করে দেয়, তাহলে তথ্য কি জমা থাকবে ? নাকি তা আলাদা করে ডিলিট করতে হবে ? আক্রান্ত ব্যাক্তিকে ট্র্যাক করাই বা হবে কোন উপায়ে ? বিস্তারিত জানাতে অক্ষম টিম আরোগ্য সেতু।
আরোগ্য সেতু অ্যাপ্লিকেশনটি ডাউনলোড না করলে শাস্তির ঘোষণা করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু নয়ডার চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। যারা নয়ডা এবং গ্রেটার নয়ডায় বসবাস করেন, তাদের ফোনে অ্যাপটি ইন্সটল করা না থাকলে ১০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা ৬ মাসের জেলও হতে পারে। বাইরে থেকে নয়ডায় যারা আসছেন তাদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তবে যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না, তারা কীভাবে এই আদেশ মেনে চলছেন সে সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাহলে আদৌ কাজের কাজ হচ্ছে কি? প্রশ্ন থেকেই যায়।
গোপনীয়তা থেকে শুরু করে কাজের পদ্ধতি, সবই অন্ধকারে। একমাত্র ‘অ্যাপ ফ্রন্ট-এন্ড’ ও সাধারণ কিছু বিবরণ ছাড়া আরোগ্য সেতু সম্পর্কে বেশি কিছু জানার উপায় নেই। অ্যাপটি ব্যবহার করার সময় সাধারণ তথ্যের পাশাপাশি আমাদের বহু সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্যও মূল সার্ভারে প্রেরণ করে। তথ্যের আদান-প্রদানে নেই কোনও বাধা, নেই কোনও নিষেধ। এই পরিস্থিতিতে দেশে অবিলম্বে শক্তিশালী তথ্য সুরক্ষা আইন প্রয়োজন, নইলে আরোগ্য সেতু একটি গণ নজরদারির অ্যাপে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
তথ্যসূত্রঃ
মূলঃ https://www.peoplesreporter.in/…/6571-aarogya-setu-app-and-…
১) https://www.firstpost.com/…/narendra-modi-asks-citizens-to-…
২) https://www.firstpost.com/…/coronavirus-outbreak-what-is-co…
৩) https://www.theweek.in/…/as-centre-mandates-download-of-aar…
৪) https://www.firstpost.com/…/workers-sign-petition-urging-go…
৫) https://www.firstpost.com/…/aadhaar-security-breaches-here-…
৬) https://internetfreedom.in/45-organizations-and-105-promin…/
৭) https://www.news18.com/…/smartphone-users-in-india-crossed-…
৮) https://economictimes.indiatimes.com/…/articl…/72950192.cms…
৯) https://www.newindianexpress.com/…/denied-medicine-for-pare…
১০) https://internetfreedom.in/is-aarogya-setu-privacy-first-n…/
১১) https://indianexpress.com/…/aarogya-setu-app-fine-jail-noi…/
১২) https://www.mensxp.com/…/76158-a-bangalore-programmer-hacke…