আদানির শেয়ারের দাম পড়েছে ,তো আমার বাপের কী?

৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩


আমেরিকান ফিনান্সিয়াল ফরেনসিক রিসার্চ ফার্ম হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে কনফিডেন্টলি বলল আমার বন্ধু। নিন্দুকে বলে ভক্ত। কথা সত্য! আদানির শেয়ারের দাম পড়েছে তো আমার-আপনার কী? সে তো বামপন্থীরা বলেই, মোদী নাকি আদানির কাছে দেশ বেচে দিচ্ছে। কিন্তু আপনি দেখেছেন কি কোন মুদি দোকানে, শপিং মলে কিম্বা পেট্রোল পাম্পে দেশ বেচা হচ্ছে?
র‍্যাডক্লিফ লাইন বরাবর যুদ্ধ হবে, পেয়াদা দিয়ে CAA-NRC-র হিসেবনামা হবে, ভারত পাকিস্তান ম্যাচ হবে, মগধ-পাটলিপুত্র-কলিঙ্গ; ম্যাপ পয়েন্টিং হবে –এই তো ভক্তদের দেশ। স্টক মার্কেটে আদানি জালিয়াতি করলে, LIC লুটে নিলে, SBI কে ডুবিয়ে দিলে, জলের দরে পোর্ট, এয়ারপোর্ট হাতালে কি দেশ বেচা বলা যায়? কথায় তো পয়েন্ট আছে!
ফ্রি-মার্কেট ইকনোমির বাই-প্রোডাক্ট ‘স্টক মার্কেট’। ‘স্টক’ মানে কোম্পানির মালিকানার পার্ট। বিভিন্ন কোম্পানি স্টকের একটা পার্ট মার্কেটে ছেড়ে রাখে ব্যবসার জন্য। চাইলে আমি-আপনি, যে কেউ, সেই স্টক কিনতে পারি। কোম্পানির প্রফিট হলে, স্টকের ডিম্যান্ড বাড়ে। ডিম্যান্ড-সাপ্লাইর বেসিক নিয়মে স্টকেরও দাম বাড়ে। আপনার লাভ হয়। আর উল্টো হলে আপনার লোকসান। বেসিক মেকানিজম এটাই!
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট বলছে, আদানি গ্রুপের যে ২৫% স্টক মার্কেটে আছে, তার বড় অংশই, আদানি গ্রুপ, মরিশাস, ক্যারিবিয়ানের মত ‘ট্যাক্স-হেভেন’ দেশে ভুয়ো কোম্পানি রেজিস্টার্ড করিয়ে, অ্যাকাউন্টেস জালিয়াতি করে, নিজেরাই কিনে রেখেছে। এতে আদানির স্টকের জন্য মার্কেটে ‘ফেক’ ডিম্যান্ড তৈরি হয়েছে। স্টকের ভ্যালু বেড়েছে। চড়া দামে সেই স্টক বিক্রি হয়েছে। যেখানে কোন স্টকের ভ্যালু দ্বিগুণ হলেই অসাধারণ মনে করেন মার্কেট এক্সপার্টরা, সেখানে শেষ তিন বছরে আদানির স্টকের ভ্যালু বেড়েছে ৩০-৪০গুণ। আর এই কেরামতির নিট ফল আদানির সম্পত্তির ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১২০ বিলিয়ন ডলারে লাফ!


এই পর্যন্ত শুনে ভক্তরা ভাবছেন এতো সিম্পল কেস অফ আর্থিক জালিয়াতি। আদানিকে ‘স্ক্যামস্টার’ বলা যায়। কিন্তু মোদীজি তো স্টিল ধোয়া তুলসী পাতা! তাই না? আজ্ঞে না!
কারণ, দেশের বেসরকারি বিমা সংস্থাগুলিকে ছাপিয়ে আদানি গ্রুপের স্টকে সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী সংস্থা LIC ! প্রশ্ন হচ্ছে, বিনিয়োগের এই টাকা LIC কোথায় পেল? LIC-র পয়সা ছাপানোর মেশিন আছে? না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক লুটের জন্য মানি হেইস্টের প্রফেসর আছে? LIC-র বিনিয়োগ করা টাকা আসলে আমার-আপনার প্রিমিয়ামের টাকা। এখন যখন হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের পর আদানির গ্রুপের লোকসান গায়ে মেখে একদিনে LIC-র ২৩হাজার কোটি শেয়ার মার্কেট থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে তখন এই টাকা ভরপাই হবে আমার-আপনার LIC-র প্রিমিয়াম বাড়িয়ে কিম্বা রিটার্ন কমিয়ে! মানে আদানি জালিয়াতি করবেন, LIC গোত্তা খাবে আর আমি-আপনি আমি তিন গুনা লগান দেবো! সিম্পল! ঐ যে ভক্তরা বলে, মোদীজি নে কিয়া হোগা তো কুছ সোচ সমঝকেই কিয়া হোগা!
কাহানী মে টুইস্ট আরও আছে! হিন্ডেনবার্গ বলছে জালিয়াতির দরুন আদানি গ্রুপের সম্পদ ৮৫%-ই ‘ওভার প্রাইসড’। গোদা বাঙলায়, আদানির সম্পদ ১০০ টাকা দেখানো হলে বাস্তবে তা ১৫ টাকার। বাকিটা ফেক। ইকনমির ভাষায় ‘ম্যানুফ্যাকচারড বাবেল’। অথচ এই বিপুল সম্পদ দেখিয়েই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ কোটি লোন নিয়েছে আদানি গ্রুপ। মোট ২ লক্ষ কোটি। যার মাত্র ১০% বেসরকারি ব্যাঙ্কে। বাকিটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। মূলত SBI। এখন ঋণে ডুবে আদানি যদি নব্য বিজয় মালিয়া, নীরব মোদীর হয়ে ওঠেন তাহলে SBI-র লোকসানের ভরপাই করবে কে? আপনি-আমি। আমরা ফিক্সড ডিপোজিটে সুদ কম নেব। রেকারিং-এ রিটার্ন কম নেব! লোনে সুদ বেশি দেব। অভ্যাস তো আছেই! ঐ যে ভক্তরা বলে, মোদীজি নে কিয়া হোগা তো কুছ সোচ সমঝকেই কিয়া হোগা!

আসলে এই বিপুল লোন আদানি গ্রুপ তো কেবল নিজের জন্য নেয়নি। বরং ইলেক্টরাল বন্ড কিনে পার্টি ফান্ডে জমা করেছে আর বিনিময়ে সহজে টেন্ডার হাতিয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যে যেতেই হবে না। তৃণমূলকেই দেখুন। রাজ্যে আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ আপাতত দুই। হলদিয়া, তাজপুর। এছাড়া কয়েক লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ করে দেউচা পাঁচামী লুটের ব্লু-প্রিন্ট রেডিই। তাজপুরে ১১২৬ একর জমি, ৯৯ বছরের জন্য রাজ্য সরকার আদানি দিয়েছে জাস্ট ১ টাকা লিজে। দিতে হয়নি স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন চার্জ। তুলে দেওয়া হয়েছে করা হয়েছে মাল ওঠা নামার ঊর্ধ্বসীমা। লঘু হয়েছে সরকারী নজরদারি। নেই কর্মসংস্থানের গ্যারেন্টি ক্লজও। বাই দ্যা ওয়ে, তৃণমূলের ইলেক্টরাল বন্ড মারফত এবছর আয় বেড়েছে ৫২৮ কোটি। ঘাসে মুখ দিয়ে না চললে তো হিসেব মেলাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
হিন্ডেনবার্গ যা বলেছে এক্সাক্টলি এই কথা গুলোই ২বছর আগে বলেছিলেন সাংবাদিক সুচেতা দালাল। তারপর যা হয়। সব জেনেও SEBI, RBI আঙুল চুষেছে। আই-টি সেল সুচেতা দালালকে শ্লাট শেমিং করেছে। আর সরকার পিছনে ইডি সিবিআই লেলিয়ে দিয়েছে। আদানির বিরুদ্ধে লেখার জন্য পরঞ্জয় গুহুঠাকুরতার মত বর্ষীয়ান সাংবাদিককে স্রেফ পয়সার জোরে নাকে দড়ি দিয়ে আজ বান্দ্রা কাল আমেদাবাদ কোর্টে হেনস্থা করা হয়েছে।


যারা ভাবছেন আদানি এবারও হুব্বা গিরি করবেন আর হিন্ডেনবার্গ নস্যি হয়ে যাবে। তাদের বলি, কেসটা সোজা না। হুব্বা তো হর্ষ মেহেতা, অনিল আম্বানিও ছিলেন। আর হিন্ডেনবার্গের এসব কাজ রোজকারের। ২০২০তে ঠিক একই ভাবে হিন্ডেনবার্গ জালিয়াতির অভিযোগ এনেছিল নিকোলা মোটরস নামে আমেরিকার কোম্পানির বিরুদ্ধে। নিকোলা মোটরসের শেয়ারে তো ধ্বস নামেই। চেয়ারম্যান ট্রেভর মিল্টণ রিজাইন করতে বাধ্য হন এবং পরে আর্থিক জালিয়াতিতে দোষী সাব্যস্ত হন। আর ১৯৯২-এ জর্জ সরস আর ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ক্লাসিক কেস স্টাডি তো আজকাল মার্কেট অ্যানালিস্টদের সিলেবাসে পড়ানো হয়। জর্জ সরসের একটা রিপোর্টে ইংল্যান্ডের সর্ববৃহৎ ব্যাঙ্কও পাউন্ডের মাটিতে গড়াগড়ি আটকাতে পারেনি।
ভক্তদের গত সপ্তাহটা খারাপ গেছে। বিবিসির ডকুমেন্টারি, পাঠানের ক্রেজ শেষে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে মোদীর মালিকের জালিয়াতির নেকেড ড্যান্স। আসলে LIC ডুবলে লগান আমাদের সঙ্গে ভক্তদেরও দিতে হবে। SBI-র লোকসানে আমাদের সঙ্গে ভরপাই ভক্তদেরও করতে হবে। মোদীজি দেশ বেচলে পকেট আমাদের সাথে ভক্তদেরও কাটা যাবে। বিরাট হিন্দু বীর সেজে ভক্তরা ছাড় পাবে না! অবশ্য ভক্তদের একটা অ্যাডভান্টেজ তো আছে। মোদী যদি কষিয়ে পশ্চাৎদেশে লাথিও মারে তবুও ভক্তরা অম্লান বদনে বলবেন, মোদীজি নে মারা হ্যা তো, কুছ সোচ সমঝকেই মারা হোগা!


শেয়ার করুন

উত্তর দিন