ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র পলিটব্যুরো নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রকাশ করেছেঃ
গতকাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার জারী করা কৃষি সংক্রান্ত তিনটি অধ্যাদেশেরই (অর্ডিন্যান্স) সম্পুর্ন বিরোধিতা করছে সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো।
প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলীতে দেশের মানুষের জন্য খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে যেভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে তার ফলে পণ্যের দাম এবং যোগানের ক্ষেত্রে কার্যত আইনের শাসন আর থাকবে না। এর ফলে মধ্যস্বত্বভোগী এবং অসাধু ব্যাবসায়ীদের হাতে বাজারে পণ্য যোগানের ক্ষেত্রে নকল ঘাটতি তৈরি করে ফাটকাবাজির দ্বারা মুনাফা লুটে নেবার পরিস্কার রাস্তা খুলে যাবে যার বিপরীত প্রভাবে খাদ্য সুরক্ষা আইন দুর্বল হবে। নির্দিষ্ট এলাকায় মন্ডিগুলীকে এড়িয়ে গিয়ে বিভিন্ন রাজ্যগুলির অন্তর্গত এবং বাইরের বাজারে খেয়াল খুশি মতো কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি হবে কারণ এক্ষেত্রে কার্যকরী বিধিনিষেধগুলি অকার্যকর হয়ে পড়বে। ফলত এই সব রাজ্যগুলিতে ফরওয়ার্ড কন্ট্রাক্ট বা আগাম বানিজ্য চুক্তির দ্বারা চাষের কাজ করিয়ে নেবার অবাধ অবস্থা তৈরি হবে। কৃষিজাত পণ্যের ব্যাবসাবানিজ্যের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ট্রেডিং’র সুযোগ আসলে ঐ ক্ষেত্রে সংগঠিত ফাটকাবাজিকেই সুযোগ করে দেবে। এরই সুযোগ নিয়ে কৃষিজাত পণ্যের বাজারে মাথা গলাবে কৃষিপণ্যের ব্যবসা করে এমন বহুজাতিক সংস্থাসমূহ আর বড় বড় কর্পোরেটরা এবং তারা বিনা বাধায় ভারতের কৃষিউৎপাদনের উপরে দখল নেবে।
মহামারী এবং দেশজুড়ে সার্বিক লকডাউনের কারনে ইতিমধ্যেই যখন দেশের কৃষিক্ষেত্র গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে ঠিক সেই সময়েই ক্যাবিনেটের পক্ষ থেকে এধরণের প্রস্তাব জানানো হয়েছে। যখন দেশের কৃষিজীবীদের সবচেয়ে বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন তখনই এই প্রস্তাবনা উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ন্যুনতম এবং যথাযথ সহায়ক মুল্যকে অনিশ্চিত করে তুলবে।
এতে সুবিধা ভোগ করবে একমাত্র মধ্যসত্বভোগীরা, কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসাদারেরা এবং আর্থিক ক্ষেত্রে দালালি চক্রের পান্ডারা যারা সমস্ত ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে গলা টিপে ধরবে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনের সাথে যুক্ত চাষিদের এবং সেই পণ্যের স্বাভাবিক ক্রেতাদের। সারা দেশে গনবন্টন ব্যাবস্থার ধ্বংসাবশেষ হিসাবে যেটুকু আজও টিকে রয়েছে এইসব প্রস্তাবনায় সেটুকুও মুছে যাবে।
কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী যেভাবে এই প্রস্তাবনাগুলিকে দেশের কৃষিজীবীদের জন্য “প্রকৃত মুক্তি” বলে উল্লেখ করেছেন তা অত্যন্ত আপত্তিজনক। তিনি দাবী করেছেন ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলেও দেশের কৃষকেরা তখন স্বাধীন হন নি। স্বাধীনোত্তর ভারতে বহু বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত দুর্বলভাবে হলেও দেশের কৃষিজীবীদের এবং খাদ্য সুরক্ষাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। মোদী সরকারের নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহনের ব্যাগ্রতা বস্তুত সেই সুরক্ষাকে নস্ট করে দিয়ে ব্রিটিশ ভারতে চাষিদের উপরে সংগঠিত ভয়াবহ শোষণের ব্যবস্থারই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।
দেশের সংসদে এই বিষয়ে বিধিসম্মত বিস্তারিত আইনানুগ আলোচনা, বিতর্ক না হওয়া অবধি এইধরণের প্রস্তাবনাগুলীকে কার্যকর হতে দেওয়া যাবে না বলে সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কৃষিক্ষেত্রে সংসদের নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি যতদিন না এই প্রস্তাবনাগুলীর ব্যাপারে বিশদে আলোচনা না করা অবধি এগুলিকে আইন হিসাবে কার্যকর হতে দেওয়া যাবে না।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী দেশের কৃষিক্ষেত্র আসলে রাজ্যগুলির আওতাধীন বিষয়। কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট এই সবকটি অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) একতরফাভাবে জারী করেছে রাজ্যসরকারগুলীর সাথে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই। এমনকি দেশের সংসদ যদি এই প্রস্তাবনাগুলিকে আইন হিসাবে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় তখনো আইন মোতাবেক আগে রাজ্য বিধানসভাগুলির থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছাড়পত্র লাগবে, কখনই কেন্দ্র এককভাবে এইধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র পলিট ব্যুরো দাবী জানাচ্ছে এই সবকটি অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
শেয়ার করুন