সত্যেন সরদার
স্বাধীনতার পর তেভাগার লড়াই থেকে শুরু করে ১৯৫৯ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন এবং গণআন্দোলনের ঢেউ বুঝিয়ে দিয়েছিলো, চেষ্টা করলেই অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। জমিদার, জোতদারদের অত্যাচার থেকে কংগ্রেসী স্বৈরাচারের অপশাসন, প্রতিটি অন্যায়ের সামনে বুকটান করে দাঁড়িয়েছিলেন একমাত্র বামপন্থীরাই। গরিব, প্রান্তিক, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষই ছিলেন লালঝান্ডার এই লড়ইয়ের আসল কারিগর। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মেহনতি জনতার এই দৃঢ় মেলবন্ধন মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও লড়াইয়ের ময়দানে টেনে এনেছিলো। যা কার্যত অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল, লালঝান্ডা হাতে তাকেই বাবরবার সম্ভব করে তুলছিলেন জনতা জনার্দন৷ জনগণের ক্রোধকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করছিলেন একমাত্র লালঝান্ডার অগ্রনী সৈনিকরাই। কোনও শর্টকাট পথে নয়, নির্বাচনী পাটিগণিতের আঁক কষেও নয়, রক্তের বিনিময়েই বারে বারে এই সাফল্য ধরা দিচ্ছিলো। একমাত্র লালঝান্ডাই গ্রামের মাঠে-প্রান্তরে, হাটে-খামারে আর শহরের রাজপথে মরিয়া লড়াই লড়ছিলো। সাথে মেহনতি জনগন। তাঁরা মার খাচ্ছিলেন। মরছিলেন। পালটা মারও দিচ্ছিলেন।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পথ ধরেই যুক্তফ্রন্ট সরকার থেকে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার
১৯৬৭, দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর হক আদায়ের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলায় তৈরি হলো প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। নির্বাচন হয়েছিলো ফেব্রুয়ারি মাসে। তুমুল খাদ্য আন্দোলনের জেরে সেই সময় আরামবাগের মতো কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটিতেও মুখ থুবড়ে পড়েছিলো প্রফুল্ল সেনের বিজয়রথ। বাংলা কংগ্রেসের সভাপতি অজয় মুখোপাধ্যায়ের কাছে পরাজিত হন দোর্দন্ড প্রতাপ প্রফুল্ল সেন।
প্রথম যুক্তফ্রন্ট দরকার গঠনের সময় সিপিআই(এম)-র ভূমিকাই ছিলো মুখ্য। যুক্তফ্রন্টের ফার্স্ট পার্টিও সিপিআই(এম)। কিন্তু জোটের স্বার্থেই মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়া হলো বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায়কে। যদিও প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার ৯ মাসের বেশি টেঁকেনি। পিছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন সেই প্রফুল্ল সেন এবং তাঁর দলবল। ষড়যন্ত্রের পথে হেঁটেই ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করলো কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকার। এর প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে ৪৮ঘন্টার হরতাল হলো। আর বিশ্বাসঘাতকদের যা পরিনতি হওয়ার সেটাই হলো। প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ফেলে দিয়ে প্রফুল্ল সেনের নেতৃত্বে যে সংখ্যালঘু সরকার তৈরি হয়েছিলো সেই বিশ্বাসঘাতক সরকার তিন মাসের বেশি টিঁকলো না। কারন, প্রফুল্ল সেন বুঝেছিলেন, মানুষের সাথে গদ্দারি করার পর বিধানসভায় আস্থা ভোটে জেতা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার। ফলে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলো। ঘোষণা করা হলো মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিনক্ষন। সেই নির্বাচন হলো ১৯৬৯ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি। এবারে আর বাংলা কংগ্রেস বিরোধী জোটের নেতৃত্বে নয়। কংগ্রেস বিরোধীরা লড়লেন সিপিআই(এম)-র নেতৃত্বে। সেই প্রথম ফ্রন্টের দলগুলি আলাদা করে নির্বাচনী ইসতেহার প্রকাশ না করে একসাথে একটি অভিন্ন কর্মসূচী প্রকাশ করলো।
কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ার ফল পেলো বিরোধীরা। ২৮০ আসনের বিধানসভায় ২১৪টা আসনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় এলো দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। কংগ্রেস নেমে গেলো মাত্র ৫৫টি আসনে। সেই প্রথম ভোটে জিতে পশ্চিমবঙ্গে বৃহত্তম দল সিপিআই(এম)। যুক্তফ্রন্টের দলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি, মোট ৮০টি আসনে সিপিআই(এম জয়ী হয়েছিলো। কিন্তু মাত্র ৩৩টি আসন পেয়েও মুখ্যমন্ত্রীর পদ দাবি করে বসলো বাংলা কংগ্রেস। কংগ্রেস বিরোধী ঐক্য অটুট রাখার যাবতীয় দায়ভার নিজের কাঁধে নিলো সিপিআই(এম)।
কংগ্রেসের অজয় মুখার্জিকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মেনে নিয়ে জ্যোতি বসু উপমুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেন। জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার ক্ষেত্রে গণআন্দোলনের নিরবিচ্ছিন্ন ধারা এবং যুক্তফ্রন্টের অভিজ্ঞতা থেকে রাজ্যের মানুষ বুঝে নিলেন তাঁদের প্রকৃত নেতৃত্ব বামপন্থীরাই দিতে পারেন। কিন্তু কেন্দ্রের স্বৈরাচারী শাসন সেই দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারকেও টিঁকতে দিলো না। ফের রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হল। পরে ১৯৭২ সালে নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হয়েছিল। এই নির্বাচনকে মান্যতা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিপিআই(এম)। আর সিপিআই গেলো কংগ্রেসের সাথে। পরের পাঁচ বছর বিভিন্ন আসনে জয়ী বামপন্থীদের মধ্যে সিপিআই(এম)’র কেউ বিধানসভার কাজে অংশগ্রহণ করেননি। সিপিআই(এম)-র কোন বিধায়ক ভাতা কিংবা অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও নেন নি। কংগ্রেস নেতা সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে মানুষের উপরে ব্যাপক হারে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করা হয়েছিল। কমিউনিস্টদের সাথে সাথে জনগণের উপরেও সেই আক্রমন নেমে এসেছিল। গোটা ভারতকেই গিলে ফেলেছিলো কেন্দ্রের তৎকালীন ইন্দিরাগান্ধী সরকারের স্বৈরাচারী শাসন। ১৯৭৫ সালে দেশজুড়ে জরুরী অবস্থা জারি। আর মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের হাত ধরে আমাদের রাজ্যে তখন আধা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের কালো দিন। কলকাতা এবং সমস্ত জেলাগুলির হাজার হাজার সিপিআই(এম) কর্মী ঘরছাড়া হলেন। আমাদের পার্টির প্রায় ১৩০০ কর্মী খুন হলেন। পার্টির অসংখ্য নেতা এবং কর্মী জেলে গেলেন।
সেই অন্ধকার দিনেরও অবশ্য অবসান হলো। ১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয় ঘটলো। গোটা দেশজুড়েই মানুষের বাঁধ ভাঙা উল্লাস। জনতা দল কেন্দ্রে সরকার গড়লো। রাজ্যের বুকে সিপিআই(এম)-র নেতৃত্বে উত্তাল গণ আন্দোলন এবং দেশের এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়লো পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে। জনতা পার্টির বাড়তি আসনের দাবির কাছে মাথা না নুইয়ে বামফ্রন্ট একসাথে লড়লো। সিপিআই তখনো কংগ্রেসের সাথে। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হলো বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ২১শে জুন বামফ্রন্ট সরকারের শপথ।
অশোক মিত্র সেদিনকার কাহিনী লিখেছেন 'আপিলা- চাপিলা'-য়। তিনি লিখেছিলেন, ’’রাজভবনের প্রাঙ্গনে মস্ত শামিয়ানা খাটানো, তা হলেও মাত্র কয়েকশো জনের জায়গা করা সম্ভব হল তার তলদেশে। বাইরে জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার। একশ চুয়াল্লিশ ধারা উধাও, রাজভবনের উত্তর-পুব দ্বার থেকে শুরু করে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট ধরে বিবাদী বাগ-রাইটার্স বিল্ডিং পর্যন্ত উদ্দাম মানুষের ভিড়। শপথগ্রহণ ও চা-চক্র অনুষ্ঠানান্তে কাতারে-কাতারে মানুষ জ্যোতি বাবুর গাড়ি ছেঁকে ধরে, ওরকম স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের ব্যঞ্জনা কদাচিৎ দেখা যায়, মুখ্যমন্ত্রীকে জনতা প্রায় শোভাযাত্রা করে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে পৌঁছে দিলেন। জ্যোতি বাবু দোতালায় অলিন্দ থেকে জড়ো-হওয়া সরকারি কর্মচারী ও জনতার উদ্দেশে ভাষণরত: আমরা জনতার নির্বাচিত সরকার, জনতার অনুশাসন অনুসারে এই সরকার চলবে, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বসে নয়’’।
জ্যোতি বসুর লেখা 'যতদূর মনে পড়ে' -তে অবশ্য 'রাইটার্স বিল্ডিং' প্রসঙ্গটি একটু আলাদা এবং আমরাও সেটাই জানি। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘‘আমরা শুধু রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার চালাব না‘‘।
লেখা তো এককথায় খুবই সহজ। কিন্তু এই সাফল্যের পথ এক কদমও মসৃণ ছিলো না। উত্তাল গণআন্দোলন এবং সিপিআই(এম)-র বহু কমরেডের জীবন আর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথ ধরেই আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার তৈরি হয়েছিলো। যা আজকের দিনের লড়াই সংগ্রামের প্রসঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক।
আজ কেমন আছে আমাদের স্বদেশ ভূমি? কেমন আছে বাংলা?
আজকের এই মোদী-মমতার জমানা দেশ আর আমাদের বাংলায় যেন যেন ফের অন্ধকার দিনের প্রতিচ্ছবি। কৃষকের ফসলের দাম নেই। আমাদের দেশে গড়ে প্রতিদিন ৪০জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথ। দেশজুড়ে কাজের হাহাকার। ভারতের তরুন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, ৪৫.৮ শতাংশ বেকার। বলছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির রিপোর্ট। যে রিপোর্ট ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছে। ভারত সরকারের প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুর কথায়, ভারতে যুব বেকারত্বের হার বিস্ময়করভাবে বেশি। প্রায় ১৫ বছর ধরে এর বৃদ্ধি ঘটলেও গত ৮ বছরে ভারতে বেকারত্ব রকেটের গতিতে বেড়েছে। একে কাজ নেই, তার উপর কাজ হারাচ্ছেন কোটি কোটি মানুষ। কোভিড মহামারীর লকডাইনের সময় ভারতে ১২কোটির বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন। লকডাউন অনেক দিন হলো উঠে গেছে। কিন্তু কাজ-হারাদের অধিকাংশই আর কাজ ফিরে পাননি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এবারের মে দিবসে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতে ২২ শতাংশ চাকরি কমে যাবে। আর চলতি বছরের এপ্রিলেই আমাদের দেশের বেকারত্বের হার গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বলছে সেই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সমীক্ষা রিপোর্ট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অমৃতকালের অমৃতভান্ড থেকে গরল ঝরে পড়ছে। বিকলুল চুপসে গেছে আচ্ছে দিনের ফানুস। ভারতে আত্মহত্যার সংখ্যা রেকর্ড গতিতে বাড়ছে। প্রতি সাড়ে ৪ মিনিটে ভারতে একজন করে আত্মহত্যা করছেন। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে ২০২১ সালে আমাদের দেশে ১লক্ষ ৬৪হাজার ৩৩জন আত্মহত্যা করেছেন। যাঁদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ পুরুষ। সংখ্যাটা ১লক্ষ ১৮হাজার ৯৭৯। ঘটনাক্রম জানিয়ে দিচ্ছে বেকারত্বের জ্বালা, কাজ হারানোর যন্ত্রনাই এইসব আত্মহত্যার প্রধান কারন। এর পাশাপাশি মোদী সরকারের সর্বনাশা নীতির ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থায় এবং কৃষকের জীবনে যে চরম সঙ্কট নেমে এসেছে তার পথ ধরে কৃষক এবং খেতমজুরদের আত্মহত্যাও ভয়ঙ্কর ভাবেই বেড়ে গেছে। ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। বলছে ২০২১ সালের সরকারী নথী। ২০২১ সালে দেশে মোট ১০হাজার ৮৮১জন কৃষক এবং খেতমজুর আত্মহত্যা করেন। ওটাই এখনো পর্যন্ত সর্বশেষ সরকারী পরিসংখ্যান। এরপর দেশে কৃষির সঙ্কট আরো বেড়েছে। তার সাথে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা।
এতো গেলো কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সর্বনাশা জমানার একটা দিক। বেসরকারিকরণের হুজুগে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের পাশাপাশি জঙ্গল, পাহাড়, নদী, মাটির নিচের খনিজ সম্পদ জমি সবকিছুই বেচে দিচ্ছে বেচুরাম মোদী সরকার। কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে কৃষকের ভরতুকি। সেচের জল, বীজ, সার কিংবা কৃষিঋণ- কৃষকরা সবক্ষেত্রেই বঞ্চিত। মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া। কর্পোরেট ঋণে ছাড় দেওয়া হচ্ছে চোখের পলকেই। কিন্তু দেশের মানুষের পাতে থাবা বসাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আকাশছোঁয়া দাম। সাথে দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ। জাতি হিংসায় মণিপুরের গণহত্যা। হরিয়ানায় সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন, সংখ্যালঘু মানুষের মহল্লায় বিজেপি সরকারের বুলডোজার। শাহিনবাগের অত্যাচার। সাথে আরো কত কি।
আমাদের রাজ্যেও কাজ নেই। নতুন শিল্প নেই, কর্মসংস্থানের কোনো উদ্যোগ নেই। আছে শুধু গালভরা ভাঁওতা। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নেই। চা বাগানগুলোতে হাহাকার। সেখানে না খেতে পেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে গত দেড় বছরে আমাদের রাজ্যের ১০০জনের বেশি পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তথ্য বলছে, এ'রাজ্যে কাজের অভাবে, অনাহারে গড়ে প্রতিদিন একজন আদিবাসী মানুষের মৃত্যু ঘটছে। কৃষির সঙ্কটে এবং ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃষক আত্মহত্যার সেই ঘটনাগুলিকে অস্বীকার কারছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। গত বছর একটি আরটিআই-য়ে জানা গিয়েছিলো ২০২১ সালে শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ১২২জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। যথারীতি সেই আরটিআই-য়ের জবাবকে মিথ্যে বলে দাবি করেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। বর্ধমানের কৃষক নেতারা জানাচ্ছেন, গত ছয় মাসে পূর্ব বর্ধমান জেলায় ১৫০ জনের বেশি কৃষক এবং দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকেই এই ১৫০ জন গরিব মানুষের লাশের হিসাব মিলেছে। এখানেই শেষ নয়। রাজ্যে মিড ডে মিলের খাবার পায়না শিশুরা। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে শিশু আর গর্ভবতী মায়েদের জন্য ডিম আর সবজির টাকা বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। তৃণমূল নেতাদের বেপরোয়া লুট আর মোদী সরকার চরম বজ্জাতি করে টাকা না দেওয়ায় গ্রামে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। এলাকার গরিব মানুষের জন্য নির্দিষ্ট রেশন পেতেও তৃণমূল নেতার সুপারিশ দরকার। তৃণমূলের মদতে গ্রামাঞ্চল জুড়ে মাইক্রোফিনান্সের মহাজনি কারবারের দাপট। আমফান কিংবা বুলবুলের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভিটেমাটি হারানো মানুষের জন্য বরাদ্দ ত্রাণের টাকাও ঢোকে তৃণমূলীদের পকেটে। রাজ্যের প্রতিটি বাজারেই আগুন। শাসক-ফড়ে গাঁটছড়ায় কৃষক মরছেন, সাধারন মানুষের জীবন ছারখার হচ্ছে। আর উৎসব, মেলা, খেলার ঝকমারিতে মাতিয়ে রেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও আমাদের রাজ্যের মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছেন। মানুষের ভাতের লড়াইকে দুর্বল করতে চাইছেন।
গোটা বিশ্বজুড়ে মানুষের ক্ষুধা আর অপুষ্ঠির হিসাব যেখান থেকে মেলে, সেই জি এইচ আই-র ওয়েবসাইট বলছে, ক্ষুধার সুচকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং নেপালের পিছনে ভারত। ১২১টি দেশের মধ্যে ভারত ১০৭ নম্বরে। গোটা দেশজুড়েই যে অনাহার বাড়ছে, গরিব মানুষ আরো গরিব হচ্ছেন তা এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। আমাদের পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যাতিক্রম নয়।
খিদের লড়াইয়ে একদিন শহীদের লাশ কুড়িয়েছে আমাদের এই বাংলা। এ'বাংলা জেনেছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোই ধর্ম। এ'বাংলা চেনে হক আদায়ের লড়াই। বাংলার মানুষ জানেন কোনটা অধিকার আদায়ের সঠিক সংগ্রামী পথ।
তাই আবারও গর্জে উঠেছেন মানুষ। লালঝান্ডার নেতৃত্বে মানুষ আবার জোট বাঁধছেন। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও মানুষের এই জোট বাঁধার, ঘুরে দাঁড়ানোর বেশকিছু ঘটনার সাক্ষী আমরা হয়েছি। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৭-র লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা এবং কাহিনী আমাদের রাজ্যের গরিব, প্রান্তিক ও মেহনতি মানুষকে অধিকার আদায়ের প্রতিজ্ঞায় ফের বলিয়ান করছে। লালঝান্ডার শপথে, ওয়াদায় ফের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে জোট বাঁধছেন মানুষ। ইতিহাস জানে, রাজপথ আঁকড়ে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই একমাত্র জয় আদায় করা সম্ভব। ইতিহাস জানে, মানুষই, একমাত্র মানুষই ইতিহাস রচনা করেন।