অর্ণব রায়
সমসাময়িক বিশ্বপরিস্থিতিতে পরিবেশ ও জলবায়ুর ক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছে তাকেই মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করতে চাইছি। এই সংকট ব্যখ্যায় ইতিমধ্যেই বহুবিধ মতামত সামনে এসেছে যার প্রতিটি আলোচনাই কোনও না কোনও রাজনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে নির্মিত। আমাদের আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গিটি সরাসরি মার্কসীয় বিশ্ববিক্ষা- একথাটি প্রথমেই বলে রাখা ভাল।
প্রকৃতি থেকে আমরা যা কিছু পেয়েছি তা যদি অপরিবর্তিতই রয়ে যেত তবে আজকের পৃথিবী অধরাই থেকে যেত। মানুষ প্রকৃতি থেকে যা পায় তার বদল ঘটায়, সেই ধারাতেই বিবিধ পণ্য সামগ্রীর উৎপাদন ও পরিষেবা ব্যবস্থার সুত্রপাত ঘটে। মানবসভ্যতার যে চেহারাটি আজকের দুনিয়ায় অতি স্বাভাবিক তার জন্য পণ্য-পরিষেবার ভূমিকা অপরিহার্য। প্রকৃতিজাত বস্তুকে বদল ঘটানোর সেই প্রক্রিয়াতে মানবসমাজ উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রত্যেককে জুড়ে রাখে। রাজনৈতিক অর্থনীতিকে ব্যখ্যা করতে গিয়ে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি এই জন্যই পণ্যের প্রসঙ্গে (অথবা পণ্য উৎপাদনের প্রসঙ্গে) ও মূল্যের শ্রমতত্ত্বে নিবিষ্ট থাকে। পুঁজি (ক্যাপিটাল) লিখতে বসে মার্কস শুরুই করেছেন সেই পণ্য ও তার উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করে। মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ককে কোনও একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার সংশ্লিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কের পরিসরেই বিবেচনা করতে হয়। ঐ প্রেক্ষিতেই সামাজিক উৎপাদন ও শ্রমশক্তির ভূমিকা একে অন্যের সাথে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে পরস্পরের উপরে নির্ভরশীল হয়, একে এড়িয়ে গেলে আলোচনার সারবত্তা হারিয়ে যায়।
পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রসঙ্গে কি মার্কসবাদে আদৌ কিছু রয়েছে? মার্কস নিজে এই সম্পর্কে কিছু বলেছেন কি? এখান থেকেই শুরু করা যায়। এই মুহূর্তে পরিবেশের সংকট প্রসঙ্গে একাধিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সক্রিয় আন্দোলনে যুক্ত রয়েছেন। তাদের এক বড় অংশই এই লড়াইতে মার্কসবাদকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করেন, প্রকৃতির লুট প্রসঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলস কোনওরকম আলোচনাই করেননি- এমন কথাও বলেন। পরিবেশ আন্দোলনের এক বিরাট অংশের মধ্যেই সেই ভাবনার প্রভাব রয়েছে। তাদের এমন বক্তব্যের ভিত্তি কি? এদের বিবেচনায় মার্কস পুঁজিবাদকে প্রমেথিয়ান শক্তি বলে ধরে নিয়েছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদ যেভাবে উৎপাদন শক্তির প্রভূত বিকাশ ঘটিয়েছে মার্কসবাদ নাকি সেই সমারোহের ব্যখ্যাতেই সীমাবদ্ধ। মার্কসের ব্যখ্যায় প্রযুক্তির বিকাশ ও তার ব্যবহার নিয়েই পুঁজিবাদের সবটুকু, প্রকৃতির ধ্বংস নিয়ে নাকি তেমন কিছু নেই। এরা আসলে মার্কসবাদ বলতে কমিউনিস্ট ইশতেহারের একটি অনুচ্ছেদেই আটকে থাকেন। সেই অনুচ্ছেদে কি রয়েছে?
‘সামাজিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বুর্জোয়াদের একশো বছর পেরিয়েছে। এই একশো বছরে তারা উৎপাদনের যে বিপুল সমারোহ গড়ে তুলেছে তাতে ইতিমধ্যেই পূর্বতন সমাজব্যবস্থার যাবতীয় ঐতিহ্য, অহংকার ধুলোয় মিশে গেছে। পুঁজিবাদ মানুষের ইচ্ছার সামনে প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে মাথা নত করতে বাধ্য করেছে। মেশিনপত্র-যন্ত্রপাতির আবিষ্কার, কারখানার উৎপাদন থেকে কৃষিকাজ অবধি রসায়ন বিদ্যার প্রয়োগ, বাস্পশক্তির ব্যবহার, রেলপথ ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার প্রবর্তন সহ সেচ ব্যবস্থার বিস্তৃতি ও কৃষিজ বিকাশের প্রয়োজনে এই ব্যবস্থা বড় বড় জনবসতিকেও উচ্ছেদ করেছে। সমস্ত উৎপাদনেই সামাজিক শ্রমের ভূমিকা ছিল, কিন্তু সেই সামাজিক শ্রমশক্তিকে আগেকার কোনও সমাজ ব্যবস্থা এভাবে কাজে লাগানোর কথা কল্পনাও করতে পেরেছে কি?’১
কার্ল মার্কস আসলে একজন প্রমেথিয়ান দার্শনিক যিনি পুঁজিবাদের উৎপাদন সমারোহে বিভোর – এই হল পরিবেশ আন্দোলনে মার্কসবাদ বিরোধীদের মূল কথা। এমন মনোভাব আজকের বিষয় বলে ভাবলে ভুল হবে, অনেকদিন ধরেই এইসমস্ত কথাবার্তা চলছে। প্রমেথিয়ান দর্শনের প্রসঙ্গকে এরা ইচ্ছা করেই টেনে আনেন যাতে মার্কসবাদকে অপ্রাসঙ্গিক প্রমান করার ফাঁকে নিজেদের মনগড়া মতামতকে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া যায়। এরা দেখাতে চান পুঁজিবাদের অভিঘাতে পরিবেশের ধ্বংস সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলস নাকি উদাসীন ছিলেন। মার্কসবাদের শিক্ষায় কিছুটা গভীর চর্চা রয়েছে এমন যে কেউই উপলব্ধি করবেন এহেন মন্তব্য কতদুর ভ্রান্ত। পুঁজিবাদী উৎপাদন যেভাবে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে বিদ্যমান ভারসাম্যে অদল-বদল ঘটায় তা নিয়ে মার্কস যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, তার লেখাতেই সেই উল্লেখ রয়েছে। দুনিয়াজুড়ে মার্কসবাদীদের আলোচনায় এই প্রসঙ্গে বহু আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। একে মেটাবলিক রিফট বলে অভিহিত করা হয়। এর অর্থ কি? প্রকৃতি ও মানুষের যুগপৎ অস্তিত্বের স্বাভাবিক ভারসাম্য। মার্কসবাদকে যারা পরিবেশ আন্দোলনে অপ্রাসঙ্গিক মনে করেন তাদের যুক্তি হল পরিবেশ ও মানুষের মধ্যেকার ভারসাম্যের অদল-বদল প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজেও ঘটেছিল, কিন্তু পুঁজিবাদ সেই বদলকে এমন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে যেখান থেকে যা তা আর কিছুতেই আগেকার অবস্থায় ফিরতে পারে না, ভারসাম্যটি কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়। এহেন মতবাদের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন কোহেই সাইটো। তিনি বললেন- একদিকে প্রকৃতি আরেকদিকে মানুষের শ্রমশক্তি পুঁজিবাদ দুইই শোষণ করে। এখানেই থেমে গেলে খুব একটা সমস্যা হত না, মার্কসও এমনই কিছু কথা বলেছিলেন। কিন্তু সাইটো আরও কিছু বললেন- পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান দ্বন্দ্বটি নাকি সেই ভারসাম্যের প্রশ্নেই নিহিত রয়েছে। এখানেই আমাদের বিশেষ সতর্ক হতে হয়। সাইটোর মতামতের বিরোধিতা জানিয়েছিলেন অনেক মার্কসবাদীই, মাইকেল রবার্টস তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। রবার্টস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রধান দ্বন্দ্বটি নিহিত থাকে তার অর্থনৈতিক কাঠামোয়, পরিবেশের সাথে ভারসাম্যে নয়। এ হল পুঁজিবাদ প্রসঙ্গে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির বুনিয়াদী অবস্থান। মার্কসের লেখাজোখা অনুসরণ করলে বোঝা যায় পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়ে তিনি ক্রমশই আরও আরও বেশি মনযোগী হয়েছিলেন, কিন্তু পুঁজিবাদ প্রসঙ্গে তার বুনিয়াদী চিন্তাভাবনার বদল করেননি। আর তাই বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় প্রধান দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া চলে না। সাইটোর কথাবার্তার সমালোচনা প্রসঙ্গে মাইকেল রবার্টস সেই ভুমিকাই পালন করেন।
পুঁজিবাদের ব্যখ্যায় প্রমেথিয়ান দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এই বিষয়ে আলোচনার পথেই আমরা বিশ্বউষ্ণায়ন ও পরিবেশের সংকটকে বুঝতে চাইব। এই সমস্যাগুলির শিকড়ও চিহ্নিত করা যাবে। প্রমেথিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি মানে কি? পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা আমাদের এক বিপুল উৎপাদিকা শক্তির সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলতে বাধ্য করে, তখন আর এই ব্যবস্থা জনিত ধ্বংসের দিকটি বিবেচনায় আসে না। মনে হয় সেই বিরাট শক্তি এমনই অভূতপূর্ব কিছু করেছে যা সমালোচনার উর্ধে। এই হল প্রমেথিয়ান মানসিকতা। মার্কসবাদ যে ওরকম মোহগ্রস্থ কোনও দর্শন না একথা বলাই বাহুল্য। উত্তর-আধুনিক কিংবা নয়া গান্ধীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রসঙ্গে কেমন অবস্থান গ্রহণ করে? তারা সকলেই মনে করে প্রাক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বদাই প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যেকার ভারসাম্যটি যথাযথরূপে সুরক্ষিত ছিল। আসলে এরা ধরেই নেন আধুনিক পুঁজিবাদ বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শিল্প বিপ্লবের আগে অবধি প্রকৃতির সেভাবে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। যদিও ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা আমাদের শিখিয়েছে শুধু পুঁজিবাদ নয়, লিখিত ইতিহাস রয়েছে এমন সমস্ত সমাজ ব্যবস্থাতেই মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ছিল যার ক্রমবিকাশ ঘটেছে- ব্যাপারটাকে অনড়-অটল গোছের কিছু ভেবে নেওয়া একেবারেই ভুল হবে। কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রাচীন যুগের মানুষও বনজঙ্গল কেটে পরিস্কার করত- কেউই একে অস্বীকার করতে পারবে না। প্রাচীন যুগ থেকে প্রাকপুঁজিবাদী পর্ব অবধি এক বিরাট সময় জুড়ে প্রকৃতির কোনও রকমফের ঘটেনি এমন কিছু ভাবার অর্থ ইতিহাসকেই মুছে ফেলা। মানুষ বনাম প্রকৃতির ভারসাম্যে পুঁজিবাদ গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে একথা ঠিক। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জ্বালানী হিসাবে জীবাশ্ম-জনিত তেলের ব্যবহারই সেই পরিবর্তনের সূচনা করে। উনবিংশ শতাব্দী থেকেই এমন জ্বালানীর ব্যবহার বেড়ে যায়। জীবাশ্ম জ্বালানী কি কি? কয়লা, লিগনাইট, পিট সহ পেট্রোলিয়াম এবং এদের উপজাতসমূহ। উপজাত হিসাবে পেট্রোল, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদির ব্যবহারই সর্বাধিক। কলকারখানা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার সময় এসব থেকেই কার্বন নির্গমন ঘটে, অর্থাৎ জ্বলার সময় পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এরই প্রভাবে পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটে। আমাদের চারপাশের স্বাভাবিক বায়োস্ফিয়ারের উপরেও সেই কার্বনের ভয়ানক কুপ্রভাব পড়ে। গাছপালা-বনজঙ্গল, জীবজগৎ সবকিছুই সেই প্রভাবের অন্তর্গত হয়ে পড়ে। এমনকি কৃষিজ উৎপাদন অবধি এর দ্বারা আক্রান্ত হয়।
জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে আজ পৃথিবীর বুকে প্রাণের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই কারণে কি জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টিকেই এক ঐতিহাসিক ভুল পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা উচিত? কেউ কেউ আছেন যারা ঠিক সেভাবেই ভাবনা চিন্তা করেন। তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েও একথা বলতেই হচ্ছে আমরা এমনটা ভাবতে পারিনা, এরকম ভাবনা আগাগোড়া ভুল। কেন? ধরে নেওয়া যাক ইতিহাসের একটি পর্যায়ে এসেও যদি মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করতে না শিখত তবে তৎকালীন সামাজিক চাহিদার চাপে আরও বেশি করে কাঠের ব্যবহার করতে হত। এমন হলে বনজঙ্গল কেটে ফেলার ঘটনা এতটাই বেড়ে যেত যার ফলে পৃথিবী থেকেই প্রাণের অস্তিত্ব মুছে যেত। উৎপাদিকা শক্তির ক্রমবিকাশ মানব সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা, এর অন্যথা করতে গেলেই বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়। জীবাশ্ম জ্বালানির আবিষ্কার শুধু আমাদের চাহিদাই পূরণ করেনি, সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির প্রভূত বিকাশ ঘটতেও উপযুক্ত রসদ যুগিয়েছে। এখন সেই জ্বালানির ব্যবহারই মানুষের অস্তিত্বকে সংকটের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এই হল পরিবেশগত সমস্যার সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিত।
উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে পুঁজিবাদের বিরাট ভূমিকা প্রসঙ্গে অবহিত থেকেও মার্কস পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়ে মনোযোগী হয়েছিলেন। এই বিষয়ে তিনি কিংবা এঙ্গেলস কখনোই উদাসীন ছিলেন না। রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনায় বইয়ের (আউটলাইনস অফ আ ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি) ভূমিকায় এঙ্গেলস উল্লেখ করেছেন জমির উপরে ব্যক্তিগত মালিকানা একদিকে যেমন মুনাফার তাড়নায় ছুটে চলেছে আরেকদিকে প্রকৃতিকেও সমানুপাতে ধ্বংস করছে। ১৮৪৩ সালে রচিত তাঁর সেই লেখায় রয়েছে -
‘আজকাল জমির হাতবদল যেভাবে ঘটছে তাকে একমাত্র ফেরিওয়ালার বিক্রির সাথেই তুলনা করা যায় - আমাদের খেয়াল রাখা উচিত জমি হল সেই বস্তু যা আমাদের অস্তিত্বের অন্যতম শর্ত - প্রকৃতিজাত সেই জমিকেই বিকিকিনির তুচ্ছ সামগ্রীতে পর্যবসিত করেছে বুর্জোয়ারা। যে পথে তারা এগোচ্ছে তাকে ফেরিওয়ালা বৃত্তির শেষ ধাপ বলা চলে কারণ এর থেকে আর নিচে নামা চলে না। এর পরে আর যা সম্ভব তাতে নিজেদের মানবিক সত্ত্বা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। ব্যাপারটা এক ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধে আরেকধরনের এবং আরও নিকৃষ্ট ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার মতোই। বিপুল পরিমাণ জমির উপরে গুটিকয়েকের একচেটিয়া ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে এক বিরাট অংশের মানুষকেই আসলে সেই সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে যা মানুষ প্রকৃতির থেকে পেয়েছে এবং সেইসব আমাদের অস্তিত্বের অন্যতম শর্তও বটে। পুঁজিবাদের চরিত্রে অনৈতিক অনেক কিছুই রয়েছে কিন্তু জমির প্রশ্নে তারা যে মনোভাব নিয়েছে এর থেকে অন্যায্য বোধহয় আর কিছুই হয় না।’২
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে মার্কস-এঙ্গেলস এক বিশ্ববিক্ষা গড়ে তোলেন, তাকেই মার্কসবাদ বলে। পরিবেশের সংকট, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাপে পরিবেশগত স্বাভাবিক অবস্থার ক্রমাবনমন এসব কখনোই তাদের চোখের আড়াল হয়নি। বানর থেকে মানুষের রুপান্তরে শ্রমের বিশেষ ভূমিকায় এঙ্গেলস স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন-
‘প্রকৃতির উপরে নিজেদের ইচ্ছাকে সফলভাবে চাপিয়ে দিতে পেরে আমরা যেন বিজয়োল্লাসে আত্মহারা না হয়ে পড়ি। এমন প্রত্যেকটি জয়ের পরেই প্রকৃতি আমাদের উপরে প্রতিশোধ নেয়। যে সমস্ত ফলাফলের উপরে ভিত্তি করে আমরা জিতে গেছি বলে মনে হয় সেইসব আসলে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলিতে একেবারেই বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়, এমনকি তখন প্রাথমিক পর্বের ফলাফলগুলি কার্যত অকেজো বলে প্রতিভাত হয়।.... প্রকৃতি সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা আদৌ তার উপরে বিজয় অর্জন করতে পারিনি, বড়জোর তাঁর নিয়মগুলিকে আবিষ্কার করেছি মাত্র। আমরা কোনোদিনই প্রকৃতিকে শাসন করতে পারি না, আমাদের মস্তিস্ক, গায়ের হাড়, চামড়া থেকে শুরু করে মাংস অবধি শরীরের সবটাই সেই প্রকৃতিরই অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় আমাদের বাড়তি দক্ষতা এই যে প্রকৃতির নিয়মগুলি উপলব্ধি করে তাকে নিজেদের কাজে যথাসাধ্য প্রয়োগটুকু আমরা করতে পারি। এটুকুই আমাদের বিশেষ বৈশিষ্ট।’৩
পরিবেশের সংকট মোকাবিলায় পুঁজিবাদ এক অসম্ভব বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। মুনাফার লোভই হল সেই বাধা। একে ব্যখ্যা করার আগে কিছু বুনিয়াদী বোঝাপড়া সম্পর্কে কথা বলে নেওয়ার দরকার আছে। প্রথম- প্রকৃতি কিংবা শ্রমশক্তি দুয়েরই শোষণ না করে পুঁজিবাদ টিকে থাকতে পারে না, তাই শোষণহীন কায়দায় পরিবেশের সংকট মোকাবিলায় পুঁজিবাদ অপারগ। দ্বিতীয়- পুঁজিবাদ নিজেকে সর্বদা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সক্রিয় রাখে।
পুঁজিবাদ এমন একটি ব্যবস্থা যা কেবলমাত্র মুনাফার স্বার্থেই পরিচালিত হয়। আগেকার সমাজ ব্যবস্থায় যা কখনো হয়নি পুঁজিবাদে ঠিক সেটাই ঘটে। এই বন্দোবস্তে উৎপাদন প্রক্রিয়ার পুরোটাই প্রতিযোগিতার পরিসরে বাঁধা পড়েছে। উৎপাদক হিসাবে শোষিত এবং মালিক হিসাবে পুঁজিপতি উভয়েরই অস্তিত্ব সেই শিকলে জড়িয়ে রয়েছে। সেই শিকল ছিঁড়ে গেলে পুরো ব্যবস্থাটারই ওলট-পালট ঘটে যাবে, পুঁজিবাদ বলেই আর কিছু থাকবে না। যতক্ষণ মুনাফার স্বার্থটি সুরক্ষিত রয়েছে ততক্ষণই ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান, মুনাফাই এর প্রাণভোমরা। তাই আরও আরও মুনাফার দিকে এগিয়ে চলা ছাড়া, নিজেকে আরও সম্প্রসারিত করা ছাড়া পুঁজিবাদের অন্য কোনও উপায় নেই। এমন ব্যবস্থায় প্রকৃতি ও পরিবেশ অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন হবেই কেননা মুনাফার লক্ষ্যে পুঁজির চলার পথ অন্তহীন। ক্রমবিকশিত পুঁজিবাদ নিরন্তর আগের তুলনায় আরও বেশি ভয়াবহ সংকটের জন্ম দেয়। সেই সংকট প্রতিহত করতে যে সকল কায়দায় এই ব্যবস্থা নিজেকে ক্রমাগত বিকশিত করে তুলেছে সেগুলিকে অবরুদ্ধ করাই একমাত্র পথ। তৃতীয় বৈশিষ্টটি দ্বিতীয় অর্থাৎ পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতামূলক চরিত্রেরই অনুসারী। পরিবেশ ও জলবায়ুর সংকট কোনও স্থানীয় বিষয় না, এর প্রভাব যেমন সার্বিক- এর পিছনের কারনগুলিও দুনিয়াজোড়া কর্মকাণ্ডেরই ফলাফল।
দুনিয়াজোড়া সমস্যা হওয়া স্বত্বেও সমস্ত দেশ মিলে এর প্রতিকারে সক্রিয় হতে পারছে না কেন? কারণ একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার যেকোনো বন্দোবস্তই আসলে পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে চলে যায়। তাই পরিবেশের সংকট মোকাবিলায় দুনিয়াজোড়া সহযোগিতার ব্যাপারটা এই মুহূর্তে কিছুটা কষ্টকল্পনায় পর্যবসিত হয়েছে বলেই মনে হয়।
আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তার ভিত্তিতে বলা যায় পরিবেশ রক্ষার নামে আগেকার অবস্থায় (প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের মতো) ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা আদৌ কোনও কাজের কথা না। সামাজিক বিকাশে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, তাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। আজকের পৃথিবীতে পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নকে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের ফলাফল হিসাবেই বিবেচনা করতে হবে। আমাদের যা প্রয়োজন তা বোধহয় উন্নততর এক প্রযুক্তি যা জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসাবে কাজ করবে। পরিবেশের সংকটকে প্রযুক্তিগত সংকট বলে ভেবে নেওয়ার একটা চল রয়েছে, সেই মনোভাব সঠিক নয়।
পরিবেশের রক্ষার সমস্যাকে সামাজিক উৎপাদনের কাঠামোর বৃহত্তর প্রেক্ষিতেই উপলব্ধি করতে হবে। বিজ্ঞান চেতনা ব্যতিরেকে এমন সমস্যার সার্বিক মোকাবিলা করা যায় না ঠিকই, কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে বাতিল না করা অবধি প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের কোনোরকম সমাধান খুঁজে বের করা যে অসম্ভব এই সার সত্যটুকু কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া চলে না।
*মূল প্রবন্ধটি ইংরেজিতে লেখা,
রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে তারই অনুবাদ করেছেন সৌভিক ঘোষ।
লেখায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতির ভাষান্তরও অনুবাদকের নিজস্ব।
ইংরেজি উদ্ধৃতিগুলি উল্লেখের ক্রমানুসারে নিচে দেওয়া হল-১। “The bourgeoisie, during its rule of scarce one hundred years, has created more massive and more colossal productive forces than have all preceding generations together. Subjection of Nature’s forces to man, machinery, application of chemistry to industry and agriculture, steam-navigation, railways, electric telegraphs, clearing of whole continents for cultivation, canalisation of rivers, whole populations conjured out of the ground — what earlier century had even a presentiment that such productive forces slumbered in the lap of social labour?”
K. Marx & F. Engels: Communist Manifesto
২। “To make land an object of huckstering – the land which is our one and all, the first condition of our existence – was the last step towards making oneself an object of huckstering. It was and is to this very day an immorality surpassed only by the immorality of self-alienation. And the original appropriation – the monopolisation of the land by a few, the exclusion of the rest from that which is the condition of their life – yields nothing in immorality to the subsequent huckstering of the land.”
F. Engels: Outlines of a Critique of Political Economy (1843)
৩। “Let us not, however, flatter ourselves overmuch on account of our human victories over nature. For each such victory nature takes its revenge on us. Each victory, it is true, in the first place brings about the results we expected, but in the second and third places it has quite different, unforeseen effects which only too often cancel the first. … Thus at every step we are reminded that we by no means rule over nature like a conqueror over a foreign people, like someone standing outside nature – but that we, with flesh, blood and brain, belong to nature, and exist in its midst, and that all our mastery of it consists in the fact that we have the advantage over all other creatures of being able to learn its laws and apply them correctly.”
F.Engels: The Part played by Labour in the Transition from Ape to Man
ছবি - সোশ্যাল মিডিয়া