প্রকৃতির প্রকোপ থেকে বাঁচানোর লড়াইয়ের সাথেই বানভাসি মানুষকে সংকীর্ণ রাজনীতির হাত থেকেও বাঁচাতে হবে

বানভাসি মানুষ প্রতি বছর সর্বহারা হতেই থাকবে?

Shamik Lahiri

শমীক লাহিড়ী

২৬মে, সন্ধ্যা ৮.৩৫ মিনিট। পাথরপ্রতিমার প্রায় ২৫০টি বুথ প্লাবিত। গোসাবার প্রায় সব পঞ্চায়েতই জলপ্লাবিত। সাগরের ৯টি পঞ্চায়েতের নদী সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত। বাসন্তীর ৫টা পঞ্চায়েত এলাকা জলপ্লাবিত। রায়দীঘির বেশকিছু এলাকায় বাঁধ ভেঙে ও উপচে জল ঢুকে পড়েছে। নামখানার মৌসুনি দ্বীপ সহ নদী সংলগ্ন সব গ্রাম প্লাবিত। কাকদ্বীপের চেহারাও একই। ওদিকে কুলতলীর বিস্তীর্ণ স্থানে বাঁধ ভেঙেছে। ভেসে গেছে বহু গ্রাম। এদিকে কুল্পী ও ডায়মন্ড হারবারের নদী সংলগ্ন এলাকাগুলিও প্লাবিত।

একে ভরা কোটাল, তার ওপর ঝোড়ো বাতাস। রাতের জোয়ারে আরও কত মানুষ নতুন করে অন্ধকারে সর্বস্ব হারাবে কে জানে! এক কথায় ভয়াবহ। এই বিপদ আগামীকালও থাকবে।

উদ্ধারকারী দল বেশিরভাগ গ্রামেই পৌঁছাতে পারেনি। এখনও প্রশাসনের স্পীড বোট/নৌকা প্রায় কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন জায়গার কর্মীদের সাথে লাগাতার যোগাযোগ করে এইসব হৃদয় বিদারক সংবাদ সকাল থেকেই পাচ্ছি।

প্রতি বছর বানভাসি হচ্ছে সুন্দরবন কোস্টাল এলাকার অসংখ্য গ্রাম। কেন?

সুন্দরবনের ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের অংশের মধ্যে ১০২টি দ্বীপ আছে। এর মধ্যে ৫৪টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে এবং ৪৮টি দ্বীপ ঘন জঙ্গলে আবৃত।

মানুষের বসতি এলাকায় মোট নদীবাঁধের দৈর্ঘ্য ৩৬৩৮.১৮২ কিমি (বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট ২০১৪)। ২০২০ সালে এই বাঁধের দৈর্ঘ্য কমে আনুমানিক ৩৫০০ কিমি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

এই বাঁধ মূলত কাঁচা মাটি দিয়েই বেশিরভাগ জায়গায় নির্মিত। ফলে এই বাঁধ ভঙ্গুর। এই বাঁধের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করলেও একথা বলা চলে, এই বাঁধের বেশিটাই ইংরেজদের আমলে বসতি স্থাপনের সাথে সাথে নির্মাণ করা হয়েছিল। এইগুলির মালিক জমিদারী ব্যবস্থা থাকাকালীন তারাই ছিল। স্বাধীনতার পর জমিদারী ব্যবস্থার আইনি বিলোপের সাথে সাথে ১৯৬০ এর দশকে সরকারের সেচ দপ্তরের অধীনে চলে আসে বাঁধগুলির মালিকানা। এখন এই বাঁধগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের।

ঝড়, অতি বৃষ্টি, ভরা কোটালের জলচ্ছাস সহ নানা কারণে এই বাঁধ ক্রমেই ক্ষয় হয়েছে, দুর্বল হয়েছে।

২০০৯ সালে আয়লা ঝড়ে ইদানীং কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নদীবাঁধগুলির। কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো সমীক্ষক দল সব জরিপ করে জানায়, মোট ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের দৈর্ঘ্য ৭৭৮ কিমি। এর জন্য তৎকালীন মনমোহন সিং-এর সরকার বরাদ্দ করে ৫০৩২ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই সময়ে তৎকালীন বামফ্রন্ট পরিচালিত রাজ্য সরকারকে অর্থ যাতে না দেওয়া হয়, তার জন্য সুন্দরবন এলাকারই একটি লোকসভা কেন্দ্র, মথুরাপুরের তৃণমূল সাংসদ শ্রী চৌধুরী মোহন জাটুয়া প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লিখেছিলেন।

এরপরই রাজ্যে তৃণমূল সরকারে আসে। ৭৭৮ কিমি ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের মধ্যে মাত্র ৭০কিমি বাঁধ মেরামতের কাজ হয়। টাকা খরচ করতে না পারার জন্য ৪০০০কোটি টাকা ফেরত চলে যায়। এরপর ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে। তারা আর এক টাকাও সুন্দরবনের বাঁধ মেরামতের জন্য দেয়নি।

বিজেপির উদাসীনতা আর তৃণমূলের সঙ্কীর্ণ রাজনীতির জন্য প্রতি বছর সর্বস্ব হারাচ্ছে সুন্দরবন এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ।

খোলা আকাশই কি সুন্দরবন এলাকার মানুষের জন্য বরাদ্দ থাকবে? বানভাসি মানুষ প্রতি বছর সর্বহারা হতেই থাকবে? চোখের সামনে বাড়ি ভেসে যাবে প্রতি বছরই?

প্রতিকার নেই এর? অবশ্যই আছে। সুন্দরবন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের দৈর্ঘ্য এখন ১০০০/১২০০ কিমি হবে হয়তো। কেন্দ্রীয় সরকারকেই এই অর্থ দিতে হবে।

নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন, হেলিকপ্টারে উড়ে সুন্দরবনের কাকদ্বীপে এসে।

এখন সুন্দরবন এলাকার সব মানুষকে একটা দাবিতেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে হবে - সুন্দরবনে পাকা নদীবাঁধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অর্থ দিতে হবে। রাজ্য সরকারকে স্বচ্ছতার সাথে এই মেরামতের কাজ করতে হবে।

এখনই, এখনই এই দাবিতে সবাই এগিয়ে আসুন। ত্রাণকাজের পাশাপাশি এই দাবি আদায়ের লড়াই লড়তেই হবে। বাঁচান আমাদের সুন্দরবনের মানুষগুলোকে।

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত


শেয়ার করুন

উত্তর দিন