South 24 PGS GE 24 Cover

ভয় ভাঙানিয়া গানে জাগছে ডায়মন্ডহারবার

অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্র বাংলার একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত নির্বাচন ক্ষেত্র। এখানকার সাংসদ ছিলেন কিংবদন্তী জ্যোতির্ময় বসু। পরবর্তীকালে তাঁর গর্বের উত্তরাধিকার বহন করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী অমল দত্ত, তরুণ ছাত্রনেতা ও ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সম্পাদক শমীক লাহিড়ী। এঁরা সবাই সংসদে মানুষের সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু তারপর? পদমর্যাদায় যিনি সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক, যদিও জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মাপকাঠিতে তৃণমূল কোনও সর্বভারতীয় দলই নয়, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ! পদমর্যাদা তাঁর যাই হোক, কয়লা পাচার, বালি পাচার, নিয়োগ দুর্নীতি সহ নানা সতেরো অভিযোগে এক চরম মর্যাদা হানিকর ভাবমূর্তিতে তিনি কালিমালিপ্ত। ই ডি, সি বি আই-এর ডাকে তাঁকে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়। ছুটতে হয় সুপ্রীম কোর্টে বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বাঁচার জন্য। সংসদে যাবার বা মানুষের কথা তুলে ধরার সময় কোথায়? তাই তাঁর সংসদে উপস্থিতি মাত্র ১৫ শতাংশ, গত ৫ বছরে সংসদে তাঁর উত্থাপিত প্রশ্নের সংখ্যা মাত্র ২টি। এহেন ব্যক্তি এবারেও ডায়মন্ডহারবারে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী। মানুষের মুখে মুখে যে কথা ঘুরে বেড়ায় সারা ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্র জুড়ে তা হল, এই কেন্দ্র নাকি তাঁর খাসতালুকে পরিণত হয়েছে। তাই এখানে বছরের পর বছর কোনও নির্বাচনেই বহু সংখ্যক মানুষ ভোট দিতে পারেন না। বিশেষ করে বিরোধী দলের সমর্থকদের ভোট দেবার অধিকার নেই, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পঞ্চায়েত-পৌরসভা ভোটে প্রার্থী হবারও অধিকার নেই তৃণমূলের দুই নম্বর নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রীর 'ভাইপো'র তথাকথিত খাসতালুকে। এক দমবন্ধ করা সন্ত্রাসের আবহে হাসফাঁস করছে এখানকার মানুষ। পুলিশ প্রশাসন, সাধারণ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা 'ভাইপো'র অঙ্গুলি হেলনেই চলেন এখানে। গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা সবই এখানে প্রহসন মাত্র। একটু কান পাতলেই বাতাসে ভেসে বেড়ানো এহেন অভিযোগ  আর হাহুতাশ যে কেউ শুনতে পাবেন।

ডায়মন্ডহারবার লোকসভা আসনটি যে সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্র নিয়ে গঠিত সেগুলি হল-ডায়মন্ডহারবার, ফলতা, বিষ্ণুপুর, সাতগাছিয়া, বজবজ, মহেশতলা ও মেটিয়াবুরুজ। এর মধ্যে ডায়মন্ডহারবার, ফলতা ও বজবজ সম্পূর্ণ সন্ত্রাস কবলিত হিসেবে ধরা যায়। বাকিগুলোয় আংশিক। এবারের নির্বাচনে মূলত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল যদিও খাতায় কলমে তিনটি কিন্তু আসল লড়াই সিপিআই(এম) বনাম তৃণমূল। ‘সেটিং’ সূত্র অনুযায়ী বিজেপি প্রার্থী প্রচারে ম্রিয়মান। বামফ্রন্ট মনোনীত জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী তরুণ নেতা প্রতীক উর রহমান তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে ‘ভয় ভাঙানিয়া’ গানে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন সন্ত্রাস কবলিত সমগ্র লোকসভা কেন্দ্রের মানুষকে। প্রত্যন্ত গ্রামের লড়াকু ছেলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও আইনেও স্নাতক। রাজ্যের শাসক দলের অসংখ্য মামলা, গ্রেপ্তার, লাঠির আঘাতের মুখোমুখি হয়েও লড়াই চালিয়ে গেছেন, হয়েছিলেন রাজ্য এসএফআই-র সভাপতি। ডায়মন্ডহারবারকে ক্রিমিনালমুক্ত করার সংগ্রামে প্রতীক উর সেনাপতি। এর জন্য আর এক ক্রিমিনাল দল দাঙ্গাবাজ বিজেপি’র কোনও প্রয়োজন আছে বলে মানুষ মনে করছে না।

এই মুহূর্তে যদিও তামাম ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রের মানুষের প্রধান সমস্যা নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারবেন কিনা এটা ঠিক, তার পাশাপাশি এই কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সমস্যাও কম নয়। সেই সমস্যাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বজবজ-বিড়লাপুর জুড়ে চটকলগুলি ধুঁকছে, বাটানগরের বিখ্যাত ‘বাটা’ জুতো কোম্পানিরও অবস্থা তথৈবচ।কোথাও আধুনিকীকরণ, সম্প্রসারণ, নতুন নিয়োগের কথা নেই। একদা প্রখ্যাত শিল্পাঞ্চলে আজ যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। আমতলা, বিষ্ণুপুরে ডায়মন্ডহারবার রোড জুড়ে অসংখ্য ছোটো বড়ো কারখানা হয় বন্ধ না হয় উঠে গেছে। অথচ বর্তমান রাজ্য শাসক দলের প্রতিশ্রুতি ছিল বন্ধ কারখানা খোলার। বর্তমান সাংসদের এসব নিয়ে কোনও মাথাব্যথাও নেই। তিনি ব্যস্ত নিজেকে বাঁচাতে আর জাঁকজমক পূর্ণ ‘এমপি কাপ’ ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে। সন্ত্রস্ত এলাকার সন্ত্রস্ত মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এহেন ক্ষোভের কথা একান্ত আলাপচারিতায়। একদা রমরমিয়ে চলা শিল্পগুলির এই দুরাবস্থার মধ্যে নতুনভাবে শিল্পায়ন বা কর্মসংস্থান যে সুদূরপরাহত ভাবনা তা মানুষ ভালোভাবে বুঝে গেছে। বরং তোলাবাজি, বন্ধ কারখানার জমি ঘিরে প্রোমোটার চক্র গড়ে তুলেছে 'ভাইপো' বাহিনী। আর 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' সহ কয়েকটি সরকারি প্রকল্পকে হাতিয়ার করে চলছে উন্নয়নের ফানুস ওড়ানো। যদিও মানুষ জেনে গেছে এইরকম প্রকল্প ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যে চালু আছে, সেগুলিতে এখানকার তুলনায় অধিক অর্থও বরাদ্দ হয়। তাই মানুষই প্রশ্ন তুলছে, এত উন্নয়নের  আখ্যান সত্ত্বেও বজবজ ট্রাঙ্ক রোডের দুরাবস্থা কেন? সর্বত্র ভাঙাচোরা, অপ্রশস্ত রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলছে আর দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে কেন? বেকার যুবকদের সামনে সৎভাবে রোজগারের রাস্তা খুলছে না কেন?

বাম-কংগ্রেসের প্রার্থী প্রতীক উর’র প্রচারে উপরোক্ত সমস্যাবলী সমাধানের রাস্তা হিসেবে সংসদে বাম ও সহযোগী শক্তিগুলির প্রতিনিধিদের বেশি করে নির্বাচিত করার কথা উঠে আসছে। উঠে আসছে ‘দাদা-দিদি’র বাইরে বেরিয়ে বিকল্প নীতির কথা। কারণ ‘দাদা-দিদি’র কথা তো অনেক হল! এবার সামনে আসুক রুটি-রুজি-হকের কথা। দেশ বাঁচানোর কথা। জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কথা। আর সবথেকে বড়ো কথা, সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ নয়, নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই বেছে নিতে হবে নিজের পছন্দের সাংসদ-সেই কথা। মানুষও মুখিয়ে আছে তাদের হারিয়ে যাওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগের অপেক্ষায়। আর তা যদি ঘটে উল্টে যাবে অনেক হিসেব।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন