আমরা স্তালিনের ভাষাতেই কথা বলি
সিপিআই(এম) স্তালিনের ভাষায় কথা বলছে - এমনও অভিযোগ করছেন কেউ। আমরা কি হিটলারের ভাষায় কথা বলবো নাকি? হিটলারের অনুগামিদের সামনে আমরা স্তালিনের ভাষাতেই কথা বলি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম গতকাল এই কথা বলেছেন।
গতকাল ৫ই অগাস্ট, বৃহস্পতিবার ছিল ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার অন্যতম ব্যাক্তিত্ব কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের ১৩৩ তম জন্মদিবস। কলকাতায়, প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে মুজফ্ফর আহ্মদ স্মৃতি ট্রাস্টের পক্ষ থেকে মুজফ্ফর আহ্মদ স্মৃতি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
যথাবিহিত কোভিড বিধি অনুসারেই প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনের অডিটরিয়ামে এই অনুষ্ঠান পালিত হয়েছে।
প্রতি বছর ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রগতিশীল, গবেষণামূলক সাহিত্যসমূহের মধ্যে থেকে বাছাই করে মুজফ্ফর আহ্মদ স্মৃতি ট্রাস্টের পক্ষ থেকে মুজফ্ফর আহ্মদ স্মৃতি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। শোষণের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে দেবার কাজে এই অনুষ্ঠান আসলে এক বিপ্লবী সংস্কৃতির চর্চা। কমিউনিস্টদের এহেন চর্চা জারী রাখতে হয়।
মুজফ্ফর আহ্মদ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত দুটি বইয়ের অন্যতম ‘মিশন বেঙ্গল: এ স্যাফ্রন এক্সপেরিমেন্ট’ (লেখকঃ স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য) -এর উল্লেখ করে সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, তৃণমূলের শাসনে কীভাবে এরাজ্যে বিজেপি শক্তিবৃদ্ধি করেছে তার গবেষণাধর্মী বিবরণ বইতে রয়েছে। তৃণমূল যে বিজেপি’র সঙ্গে বারবার জোট করেছিল, ওদের ছত্রছায়াতেই যে বিজেপি এরাজ্যে বেড়ে উঠেছে সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড মৃদুল দে পুরস্কার প্রাপ্ত আরেকটি বই "প্রাগ ইতিহাস - ভারতবর্ষে পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন" (লেখিকাঃ মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়) সম্পর্কে বলেন বিশ্বজুড়েই মানুষের অরিজিন সম্পর্কে বহু গবেষণা হচ্ছে, বাংলা ভাষায় এধরণের কাজ এক নজীর, এধরণের গবেষণা আমাদের সত্যের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে, ভাবাবাদী ব্যাখ্যায় যেমনটা বিশ্বাস করতে, না জেনে না বুঝে মেনে নিতে শেখানো হয় তার বিপরীতে গবেষণাধর্মী এমন চর্চা মানুষের প্রকৃত আধুনিকতা চিহ্নিত করে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু, ভাষণ দেন সূর্যকান্ত মিশ্র এবং মহম্মদ সেলিম।
কমিউনিস্টরা কঠিন সময় বলে ঘরে বসে থাকে না
বিমান বসু বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে না পারলে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য রক্ষা করা যাবে না। আজকের দিনে যারা পার্টির কাজ করবেন তাদের এই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কঠিন পরিস্থিতির অজুহাতে কমিউনিস্টরা ঘরে বসে থাকে না। কঠিন সময় উত্তরণের জন্য কাকাবাবুদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে জনগণের ঐক্য ও সম্প্রীতি সুদৃঢ় করে, তরুণ প্রজন্মকে আরও অনেক অনেক সংখ্যায় সাথে নিয়ে লড়াই - সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এই পথের বিকল্প নেই।
পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এদিনের আলোচনায় উল্লেখ করেন বিজেপি আর পাঁচটা দলের থেকে চরিত্রগত ভাবে আলাদা, বিজেপি'কে চালায় আরএসএস - ভারতে আর কোন রাজনৈতিক দলের এই বৈশিষ্ট নেই। আর এস এস কারা? যারা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল।
কেউ কেউ বিজেপি'র বিরুদ্ধে লড়াইতে তৃণমূল কংগ্রেসকে বিপ্লবী দল হিসাবে দেখাতে চান, কিংবা তৃণমূলকে দিয়ে বিজেপি’কে রুখতে চান তারা আসলে বিজেপি’রই সুবিধা করে দেন। বহুবিধ সঙ্কটগ্রস্থ মানুষ বিকল্প চাইছেন, মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। সাময়িকভাবে সেই অসন্তোষ চাপা দেওয়া গেলেও বামপন্থীদের গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিজেপি মানুষের অসন্তোষকে ব্যাবহার করে লাভবান হতে চায়। এর বিপরীতে কেউ আবার বিজেপি’কে দিয়ে তৃণমূলকে হটানোর কথা বলেন, এহেন রাজনীতি বিপদের বার্তা। সারা দেশে বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইতে বিরোধীদের একজোট করার প্রচেষ্টা চলবেই, কিন্তু আমাদের রাজ্যে যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আমরা লড়াই করেছিলাম সেটাই ঠিক। বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার পথ থেকে কমিউনিস্টরা সরতে পারে না। তৃণমূলের নেত্রী আরএসএস’এর বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের দেশপ্রেমিক বলেছিলেন এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরএসএস তাঁর প্রশংসা করেছিল এটাও তো মিথ্যা নয়। জ্যোতি বসু বারবার বলতেন, তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ ওরা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’কে ডেকে এনেছে।
কিভাবে গণমাধ্যম এবং সোস্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে এদিন সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন কর্তব্য হিসাবে শ্রমিকশ্রেণির দৃঢ়তা বনাম বুদ্ধিজীবীর দোদুল্যমানতার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হয়, কমিউনিস্টরা এই জন্যই স্তালিনকে মনে রাখে।
মিশনারি থেকে রেভলিউশনারি হয়ে ওঠার চর্চা করতে হবে
মহামারীতে রেড ভলান্টিয়াররা সারা রাজ্য জুড়ে যে কাজ করেছে তাকে সেলাম জানিয়ে সেলিম বলেছেন, এভাবেই অঙ্কুরোদ্গম হয়, হবে। চারের দশকে মন্বন্তরের সময়ে কমিউনিস্টরা মানুষকে বাঁচাতে সেবামূলক কাজ, লড়াইয়ের বার্তা দিতে সাংস্কৃতিক কাজ করে। সেই ঐতিহ্য মাথায় রেখেই পথ চলতে হবে। সূর্যকান্ত মিশ্রও রেড ভলান্টিয়ারদের কাজের প্রশংসা করে বলেন, সাধ্যমতো সমাজে এভাবেই ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করতে হয়। কিন্তু শুধু সেবামূলক কাজেই আটকে থাকা উদ্দেশ্য নয়, বৈপ্লবিক পরিবর্তনই হল লক্ষ্য। মিশনারি থেকে রেভলিউশনারি হয়ে ওঠাই তরুণ কমরেডদের চর্চা করতে হবে। কাকাবাবুর স্মরণে সেটাই হবে প্রকৃত উত্তরাধিকার বহন।