দুটি রিপোর্ট ও দুটি দৃষ্টিভঙ্গী

একটি ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

সরিৎ মজুমদার

এই মুহূর্তে মোদির ‘নয়া ভারত’ যে পরিসংখ্যান নিয়ে লাফাচ্ছে সেটা হল সাংহাইস্থিত ‘হুরুন রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর ২৫ মার্চে প্রকাশিত রিপোর্ট। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মুম্বাই এখন “এশিয়ার স্বপ্ন নগরী” হয়ে উঠেছে ! বেজিং-কে পেছনে ফেলে আম্বানি-আদানিদের মুম্বাইতেই এশিয়ার সবথেকে বেশি বিলিয়নেয়ারের বসবাস। হুরুনের রিপোর্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে গোটা বিশ্বের বিলিয়নেয়ারদের বসবাসের শহরের নিরিখে তৃতীয় স্থানে রয়েছে মুম্বাই। সংখ্যার হিসাবে - ৯২জন বিলিয়নেয়ার। প্রথম নিউ ইয়র্ক -১১৯ জন বিলিয়নেয়ার,দ্বিতীয় লন্ডন - ৯৭জন। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে গোটা ভারতে এই মুহূর্তে মোট বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ২৭১ জন। গোটা বিশ্বের নিরিখে ভারত তৃতীয়। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ভারতের স্থান।

বিলিয়নেয়ার মানে মোটামুটি যার বর্তমান ব্যক্তিগত সম্পদের মূল্য ১০০কোটি ডলারের সমান বা তার বেশি, ভারতীয় মুদ্রায় বর্তমানে দাঁড়ায় মোটামুটি ৮১০০কোটি টাকা। ভারতে এদের মধ্যে সবার ওপরে আছে অবশ্যই মুকেশ আম্বানির নাম, মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার (৯লক্ষ ৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি)। দ্বিতীয় স্থানে মোদির আরেক পছন্দের ধনকুবের, ‘নয়া ভারত’-এর অন্যতম ‘কারিগর’, গৌতম আদনি। আদানির মোট সম্পদ ৮৬বিলিয়ন ডলার(৭লক্ষ১৬হাজার কোটি টাকার বেশি)। হুরুনের রিপোর্ট বলছে,”রিলায়েন্সের মুকেশ আম্বানি 'এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি'-এর খেতাব বজায় রেখেছেন। তার সম্পদের সাথে আরো ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করে তিনি তার স্থান ধরে রেখেছেন। গৌতম আদানির সম্পদ ৬২% বেড়ে তিনি বিশ্বের ধনীতমদের মধ্যে পঞ্চদশ স্থানে রয়েছেন।” হুরুনের এই সাম্প্রতিক রিপোর্টে আগের রিপোর্টের পর থেকে নতুন ৯৪ জন ভারতীয় এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ! ৯৪ জন নতুন করে তালিকাভুক্ত হওয়াটা ২০১৩ সাল থকে সর্বোচ্চ।

অর্থাৎ,হিসাবটা সহজ করার জন্য যদি ধরে নেওয়া হয় ২৭১ জন ১০০ কোটি ডলারেরই মালিক, একটাকাও বেশি না, তাহলে গোদা হিসাবে তাদের মোট ব্যক্তিগত সম্পদের বর্তমান মূল্য ২১লক্ষ৯৫হাজার১০০কোটি টাকা।২০২২-২৩ সালে দেশের জিডিপি ছিল ২৬৯.৫০লক্ষ কোটি টাকা,মানে দেশের মোট সম্পদের ৮ভাগের মালিক ২৭১ জন ! নির্মলা সীতারামণ ২০২৪-২৫-এর অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে ব্যয়বরাদ্দের মোট হিসাব ধরেছে ১১.১১ লক্ষ কোটি টাকা। মানে স্রেফ ১০০কোটি ডলারেরই মালিক ২৭১ জন এইভাবে হিসাব করলে দেশের ১৪০কোটি মানুষের জন্য যে ব্যয় বরাদ্দ কেন্দ্রের সরকার বর্তমান অর্থবর্ষে ঠিক করেছে তার পরিমাণ ২৭১ জনের মোট সম্পদের অর্ধেকের সমান। আরেকটু বাস্তবসম্মত ভাবে হিসাব করলে, স্রেফ আদানি আর আম্বানির সম্পত্তি যোগ করলে দাঁড়ায় ১৭লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি, যা দেশের সরকারের বাজেটের ব্যয়বরাদ্দের থেকে ৬লক্ষ কোটি টাকা বেশি।

Source: Internet

লক্ষনীয় যে ২০১৪ সাল থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম নরেন্দ্র মোদি। মনরেগার টাকা কমিয়ে দেওয়া,বিদ্যুৎ আইনের বদলের নামে বৈদ্যুতিক পরিকাঠামো বিক্রি করা,দেশের সম্পদ দেদার লুঠ করার অবাধ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে সবথেকে বেশি এই মোদির জমানাতেই। দেশের সরকার ন্যাশনাল মনিটাইজেশান পাইপলাইনের নামে, যদিও খুব একটা সফল হয়নি এখনো, বড়লোকদের দালালি করছে,লাখপতি হয়েছে কোটিপতি,কোটিপতি হচ্ছে এখন ‘ডলার বিলিয়নেয়ার’।

আসলে মুম্বাইয়ে আম্বানির ‘অ্যান্টিলিয়া’র পাশের ‘ধারাবি’টাই,যা এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি, এইদেশের প্রবলতম বাস্তব। ঠিক একইরকম আরেকটা বাস্তব আমাদের সামনে এসেছে। ভারতের যুবসমাজের অংশীদারিত্ব দেশের মোট বেকারদের মধ্যে প্রায় ৮৩%। এবং মোট বেকার যুবদের মধ্যে মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবদের অংশ ২০০০ সালের ৩৫.২% থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২০২২ সালে ৬৫.৭% হয়েছে। বর্তমানে দেশের বেকারদের মধ্যে ৭৬.৭ জন শিক্ষিত যুবক এবং ৬২.২ শতাংশ শিক্ষিত যুবতী। ২৬মার্চ ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি) যৌথভাবে সমীক্ষা করে এই রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছে। মঙ্গলবার রিপোর্টটি প্রকাশ করেন দেশের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরন। অতীতেও পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভের(PLFS) একাধিক রিপোর্টেও এইরকম ভয়াবহ তথ্য সামনে এসেছে যাকে পরিসংখ্যানের কারিকুরি দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করতে কোন উপায়ই মোদি সরকার ছাড়েনি।

এই ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে কর্মসংস্থানের বেশিরভাগই ছিল স্ব-নিযুক্ত এবং নৈমিত্তিক(casual)। প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মশক্তিই অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে(informal sector) নিযুক্ত। নিয়মিত কর্মসংস্থানের অনুপাত, যা ২০০০-এর পরে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, ২০১৮-এর পরে হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ কোভিডের প্রকোপে, যা কিনা ২০১৯-এর শেষভাগের থেকে প্রভাব ফেলেছিল দুনিয়ার অর্থনীতিতে,  নিয়মিত কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়ার যে যুক্তি মোদি সরকার দেওয়ার চেষ্টা করে তারও কোন সারবত্তা নেই এই রিপোর্টে। সামগ্রিক ভাবে নিয়মিত কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়াটা মোদি সরকারের নীতিরই প্রতিফলন। একদিকে অসাম্য বাড়ছে, ‘INCOME AND WEALTH INEQUALITY IN INDIA, 1922-2023: THE RISE OF THE BILLIONAIRE RAJ’ - এর যে বিস্তারিত রিপোর্ট আমাদের সামনে আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে অসাম্য কীভাবে বাড়ছে।টমাস পিকেটি-এর মত অর্থনীতিবিদরা বলছেন ব্রিটিশ রাজের থেকেও অসাম্যের মাত্রা বেড়েছে ভারতে এই বিলিয়নেয়ার রাজের আমলেই।

‘নয়া ভারত’, ৮১কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশান দেওয়া,দুর্নীতি সমূলে উৎখাত- এর কোনটাই আসলে ‘মোদির গ্যারান্টি’ না। মোদির কোন গ্যারান্টিই “মেরে পেয়ারে দেশবাসীও” এর জন্য না। মোদির গ্যারান্টি “মেরে পেয়ারে বিলিয়নেয়ারও”- এর জন্য। ১৪০কোটি ভারতবাসী, যার মধ্যে ৯৬.৯ কোটি মানুষ যারা নথীভুক্ত ভোটার। ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেবেন। ২৭১ জনের যে ক্ষমতা তার থেকে ১৪০ কোটি জনতার ক্ষমতা যে কত কোটি গুণ বেশি, এই সাধারণ নির্বাচন সেই জোর দেখানোর সুবর্ণ সুযোগ, এই সুযোগ কোনমতেই হাতছাড়া করা যাবে না।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন