যে উত্তরাধিকার আজও অনুসরণযোগ্য

যে জীবন, যে সংগ্রামের ধারা আজও অনুসরণ করতে হয়

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

 (১)

আগ্নেয়াস্ত্র থেকে সর্বহারা রাজনীতির আঙ্গিনায়

সরোজ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শহরের দক্ষিনপ্রান্তের একটি বাড়ি ভাড়া করে কিছু মানুষ বাস করতে শুরু করেছেন, বাড়ির মালিক শুনেছেন এনারা পূর্ববাংলা থেকে আগত একটি সম্ভ্রান্ত বাঙালী পরিবার। সেই পরিবারের কর্তা স্বভাবগম্ভীর স্থিতধী মানুষ, কথাবার্তা কম বলেন। বাড়ির মালিকের কৌতূহল নিবৃত্তি করতে পরিবারের জন্য ভাড়ার বন্দোবস্ত করতে আসা যুবকটি জানালো বয়স্ক কর্তাটি আসলে পরিবারের খুড়োমশায়, সংক্ষেপে কাকাবাবু। সবাই তাকে কাকাবাবু বলেই চিনলেন।

ভারতের বুকে কমিউনিস্ট আন্দোলন যাদের হাত ধরে শক্তি অর্জন করেছে এমনই একজন বিপ্লবী ছিলেন মুজফফ্‌র আহ্‌মদ, আজকের প্রজন্মের পার্টি কর্মীরাও তাকে কাকাবাবুই বলতে শিখছেন। তাদের জেনে রাখা ভাল সেদিনের সেই ভাড়া বাড়িটি ছিল কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের একটি গোপন কেন্দ্র, পার্টি সেন্টার। গ্রেপ্তারি এড়িয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাওয়া কমিউনিস্টদের শিখতেই হয়, এদেশেও তার অন্যথা হয় নি। মুজফফ্‌র আহ্‌মদ সেই কাজে পার্টি কর্মীদের শিক্ষিত করতেন, কোন নেট প্র্যাকটিস না – লড়াইয়ের শিক্ষা হত লড়াইয়ের ময়দানে নেমেই, সংগ্রামরত অবস্থাতেই। সেদিন তার পরিচয় দিতে গিয়ে যে যুববয়সী পার্টি কর্মীটি তাকে কাকাবাবু বলেন তার নাম সরোজ মুখোপাধ্যায়। পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য, কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তের মৃত্যুর পরে সরোজ মুখোপাধ্যায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। আজ তার জন্মদিবস, ১৯১১ সালের ১৪ই জানুয়ারি বর্ধমানের বাহাদুরপুরে তার জন্ম হয়।

(২)

সাম্রাজ্যবাদের বিরদ্ধে লড়াইয়ের পথ ধরে এগিয়ে চলা

Binay Choudhury
বিনয় চৌধুরী

২০’র দশকের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে একদিকে যেমন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস আন্দোলনের পরীক্ষা চলছে, আরেকদিকে সশস্ত্র পথে ইংরেজদের শাসনকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা জানাচ্ছেন যুববয়সী বিপ্লবীরা – ইংরেজ সরকারের আইনে তারা সন্ত্রাসবাদী (টেররিস্ট)। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর নামের দল তখন ব্রিটিশ শাসনের মাথায় মৃত্যুভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে, তারই প্রতিরোধে সাম্রাজ্যবাদী শাসন নামিয়ে এনেছে অত্যাচার, নিপীড়ন। ১৯২৮ সালে যুগান্তর দলে নাম লেখানো একটি যুবক - বিনয়ের জেল হল অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে - সময়টা ১৯৩০ সাল। ততদিনে বিনয় নামের সেই যুবক নিজের অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর হাত ধরে একসাথে কংগ্রেস দলেও যুক্ত হয়েছে – তাদের চোখে তখন একটাই স্বপ্ন, ইংরেজকে তাড়াতে হবে, দেশ স্বাধীন করতে হবে। একদিন এভাবেই তারা দুজনে পরিচিত হল আব্দুল হালিমের সাথে। আব্দুল হালিম খোঁজখবর নিয়ে তার বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলেন “বিনয় বন্দুকের রাজনীতি ছেড়েছে?” – সেই যুবক বিনয় চৌধুরী। ১৯১১ সালের ১৪ই জানুয়ারি সরোজ মুখোপাধ্যায়ের মতোই তারও জন্মদিবস। পরবর্তীকালে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব হবেন সেদিনের অগ্নিপথে চলা যুবক। কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হালিমকে অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে দেখে গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন সেদিনের যুবক - দুঃসাহসিক ডাকাতি করে পার্টির জন্য তহবিলের পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় – গ্রেপ্তার হয়ে যান বিনয়। সরোজ মুখোপাধ্যায় ততদিনে সর্বহারা রাজনীতির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের সাথে নিজেকে স্থিতধী করে নিতে পেরেছেন। তাই সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কিছুটা পরে বিনয় চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়েছিলেন – সশস্ত্র পথে স্বাধীনতা, দেশের মানুষের মুক্তি সম্পর্কে তার বিশ্বাস ছিল আরও কটা দিন বেশি।

(৩)

“দুটি হিরার টুকরো পাঠালাম.....”

ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত

দুই বন্ধুই শিক্ষার্থী হিসাবে অত্যন্ত ভাল ছাত্র ছিলেন। বিজ্ঞানের স্নাতক হিসাবে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। একইরকম আকর্ষণ ছিল সাহিত্যের প্রতি, অনেক পরে সরোজ মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায় ব্রিটিশ পুলিশের সামনে রিভলভার ধরা বিনয় একসময় কবিতা অবধি লিখেছেন, এমনকি দুজনে একইসাথে একই কবিতার একেকটি লাইন রচনা করেছেন। বিপ্লবী রোম্যান্টিকটাই তাদের সাহিত্যের দিকে টেনে রেখেছে সারাজীবন। পার্টির দৈনিক সংবাদপত্র গনশক্তি প্রকাশিত হতে শুরু করলে সরোজ মুখোপাধ্যায় তার প্রথম সম্পাদক হন, তার আগে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি তিনি স্বাধীনতা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন।

কলেজের ছাত্র থাকার সময় তারা পরিচিত হন ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে। এদেশের বুকে প্রকৃত দিনবদলের লক্ষ্যে অবিচল ভূপেন্দ্রনাথ ততদিনে ভারতের ছাত্র-যুব বয়সীদের কমিউনিস্ট রাজনীতিতে শিক্ষিত করতে রাজনৈতিক শিক্ষাক্রম শুরু করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ নিপীড়নের প্রতিরোধে আগ্নেয়াস্ত্রে মুক্তির পথ খুঁজে চলা দুই দুঃসাহসী যুবক তার কাছেই শুনলেন, শিখলেন, উপলব্ধি করলেন সমাজের গোড়া থেকে টেনে উপড়ে তুলতে হবে, সর্বহারাদের মুক্তি না হলে মানবসভ্যতার অভিশাপ কাটবে না। এই নতুন বিপ্লবের কাজে অনেক বেশি ত্যাগ, তিতিক্ষা ও পরিশ্রমী মেধার প্রয়োজন, এতদিন যারা নিজেদের মতো সাহসীদের খোঁজ করতেন তারাই শুনলেন, বুঝলেন এবং নিজেদের কাজ হিসাবে চিহ্নিত করলেন একটা গোটা শ্রেণীকে সমাজ বদলের উদ্দেশ্যে সাহসী করে তুলতে হবে।

ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সামনে বসে দুই যুবক শিখেছিলেন সাম্যবাদী দর্শন, রাজনীতির পাঠ। ভূপেন্দ্রনাথের থেকে খবর নিয়ে তারা এরপরে আব্দুল হালিমের সাথে দেখা করতে শুরু করলেন, যা শিখেছেন তাকে কিভাবে কাজে লাগাতে হয় সেই পাঠ শুরু হল। আব্দুল হালিমের সাথে কথা বলার সময় একদিকের বারান্দায় চেয়ারে কোট প্যান্ট পরে একজন বসে থাকতেন, কথা বলতেন খুবই কম, চুপচাপ আলোচনা শুনতেন – তার দিকে দুই বন্ধুর চোখ যেত, সেই মানুষটি দুই চোখ দিয়ে মানুষের ভিতর অবধি চিনে নেওয়ার দৃষ্টিশক্তি অর্জন করেছিলেন। হালিম সাহেবের কাছে বসেই দুই বন্ধু জানলেন, চিনলেন মিরাট মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবীদের অন্যতম ঐ ব্যক্তিটিকে, তারই নাম মুজফফ্‌র আহ্‌মদ।

(৫)

বিপ্লবের ঐতিহ্য, বিপ্লবীর উত্তরাধিকার

আব্দুল হালিম

অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, কারাগারে অবরুদ্ধ জীবন সবটা পেরিয়ে দুই বন্ধু কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব হিসাবে নিজেদের পরিণত করেছিলেন। পার্টির সম্পাদক হিসাবে কিভাবে কাজ করতে হয় তা শিখিয়ে দিতে লিখে গেছেন ‘শাখা সম্পাদকের কাজে ধারা’ – সেইসময় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রস্তুত হওয়ার ইতিহাস, সংগঠন গড়ে তোলার ইতিহাস লেখা হয়েছে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা’র পাতায়। সরোজ মুখোপাধ্যায়ের লেখা এই দুটি রচনা আজও পার্টি কর্মীদের অবশ্যপাঠ্য।

বিনয় চৌধুরী সম্পর্কে প্রথমদিকে কিছুটা সতর্ক ছিলেন আব্দুল হালিম। বন্ধু সরোজ মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “বিনয় বন্দুকের রাজনীতি ছেড়েছে?”। গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস কাটিয়ে বাইরে আসা বিনয় চৌধুরীকেই সরাসরি বললেন “এদেশের কৃষক – শ্রমিক জনতার মধ্যে সংগঠন গড়ার কাজ করতে হবে, নিজেরা বেছে নাও কে কোথায় কাজ করবে”। মুজফফ্‌র আহ্‌মদ তাকে পাঠিয়ে দিলেন আসানসোলে শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে। সেই শিক্ষাকেই সারাজীবন প্রয়োগ করে গেছেন বিনয় চৌধুরী, পরে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হলে তারই নেতৃত্বে শুরু হয় ‘অপারেশন বর্গা’। মুখে ভূমিসংস্কারের কথা বললেও আসলে জমিদারি শাসনকে বাঁচিয়ে রাখার যে পথ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সরকারগুলি নেয় তার পাল্টা হিসাবে আমাদের রাজ্যে সরকারের উদ্যোগে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে জমিদারি কর্তৃত্বের অবসান ঘটানোর ঐতিহাসিক কর্মসূচি পালিত হয়। জমির উপরে নিজেদের অধিকার পায় মেহনতি মানুষ। যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন এই ইতিহাস কোনদিন ম্লান হবে না। শ্রেণী রাজনীতির ময়দানে বুর্জোয়া সুলভ বিনয় চলে না – বিনয় চৌধুরী নিজেই তার সবথেকে বড় প্রমান রেখে গেছেন। তার গোটা জীবন আজকের প্রজন্মের জন্য একটা আস্ত পাঠ্যক্রম।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে - সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন