ইউক্রেনে যুদ্ধপরিস্থিতিতে আইএমএফ’র ভূমিকা

প্রভাত পট্টনায়েক

গনমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চলছে, ইউক্রেন ন্যাটো’র অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছে বলেই নিজেদের দেশের সুরক্ষার প্রসঙ্গে রাশিয়া উদ্বিগ্ন। এই ঘটনায় ন্যাটো’র মতোই আইএমএফ’র সমান্তরাল ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা উঠলেও সেভাবে কেউ মাথা ঘামায় নি। আইএমএফ’র কাজই হল একের পর এক দেশে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে চলা, পুঁজিপ্রধান দেশগুলির জন্য ‘বিনিয়োগ বান্ধব’ বন্দোবস্ত সুনিশ্চিত করতে জনবিরোধী ও শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী কর্মসূচি প্রণয়নে তারা সেইসব দেশগুলিকে বাধ্য করে। এহেন সুনিশ্চিতকরণে দেশের জমি এবং যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে পূঁজির দখল কায়েম করা হয়। নিজেদের ঘাটতি মেটাতে বিভিন্ন দেশ আইএমএফ’র সামনে দরবার করলে তারা দেয় ঋণের শর্তাবলী হিসাবে এধরনের বন্দোবস্ত চাপিয়ে দেয়। ঋণের এহেন বন্দোবস্ত করার সাথেই ‘শীতল যুদ্ধ’র লক্ষ্যপূরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসাবে আইএমএফ বিশেষ এক ভূমিকাও পালন করে। পূঁজির স্বার্থে ইউক্রেনে মুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার পাশাপাশি প্রথম থেকেই তারা সেই দায়িত্বও পালন করেছে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাণিজ্যচুক্তি প্রসঙ্গেই আইএমএফ ইউক্রেন’কে শর্ত হিসাবে নিজেদের দেশে আর্থিক সংস্কারের চাপ দেয়। আইএমএফ’র শর্ত ছিল ইউক্রেনে আর্থিক সংস্কার পরিকল্পনায় মজুরি কমাতে হবে, সেদেশের প্রধান দুটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কমাতে হবে, ইউক্রেনের সমস্ত জনগনের জন্য সুলভে প্রাপ্ত জ্বালানি গ্যাসে বরাদ্দ ভর্তুকি কমাতে হবে – সুত্রঃ ব্রাইস গ্রিন, ফেয়ার, ২৪ ফেব্রুয়ারি। এধরনের আর্থিক সংস্কারে জনগণের উপরে ব্যাপক বোঝা চাপবে বলে রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ আইএমএফ’কে না বলে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করতে মনোযোগ দেন।
ইয়ানুকোভিচ ও পুতিন
ইউক্রেনের এহেন মনোভাবই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত হয়। আইএমএফ’র শর্তাবলী অগ্রাহ্য করার অর্থ নয়া উদারবাদ প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক পূঁজির কর্তৃত্বকেই অস্বীকার করা, বিশেষ করে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রধান হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অস্বীকার করা অর্থাৎ ন্যাটো’কে অস্বীকার। অন্যভাবে বলা চলে ভিন্ন পরিসরে বিভিন্ন নিজস্ব পরিকল্পনা রুপায়নে ব্যস্ত থাকলেও কার্যত আইএমএফ এবং ন্যটো একই লক্ষ্যে কাজ করে। অকস্মাৎ ইয়ানুকোভিচ আইএমএফ’কে না বলে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করতে গেলে ইউক্রেনকে সমঝে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই অনুযায়ীই ইউক্রেনের নাৎসি গোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে আমেরিকা সমর্থিত ইয়ানুকোভিচ বিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত হয়, ক্যু দে তা’র মাধ্যমে ইয়ানুকোভিচ অপসারিত হলেন। ক্যু’তে অংশগ্রহণকারী সেই সকল গোষ্ঠীকেই সরকারি সিদ্ধান্তে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আজভ ব্যাটালিয়নে যুক্ত করে নেওয়া হয়। এর আগে এই ব্যাটালিয়ন ছিল ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের অতি-দক্ষিণপন্থি ভলান্টিয়ার মজুত বাহিনী। ২০১৪ সালে ইয়ানুকোভিচ অপসারিত হলে নতুন সরকার প্রাকৃতিক গ্যাসের দামে অর্ধেক ভর্তুকি ছাঁটাই করে, তাদের এহেন সদিচ্ছায় সন্তুষ্ট হয়ে পুনরায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কথাবার্তা শুরু হয়, বাণিজ্য চুক্তি সমাপনে আইএমএফ ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মঞ্জুর করে। এই ঋণের শর্তে একাধিক উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, প্রথমত একই পরিস্থিতিতে অন্য কোন দেশের জন্য আইএমএফ সাধারনত যতটা ঋণ মঞ্জুর করে তার প্রায় ছয়গুণ পরিমান বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয়। দ্বিতীয়ত ইউক্রেনে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে, এমন অবস্থায় আইএমএফ কখনো অন্য কাউকেই কোনরকম ঋণে মঞ্জুরি দেয় নি। তৃতীয়ত, যেহেতু প্রথম থেকেই জানা ছিল ইউক্রেনের পক্ষে এই বিশাল পরিমান ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব না, সুতরাং অনন্যোপায় হিসাবে আন্তর্জাতিক পূঁজির হাতে ইউক্রেনের জমি এবং প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় যার মধ্যে প্রধান ছিল প্রাকৃতিক গ্যাস। ২০১৪ সালে ইউক্রেন সম্পর্কে আইএমএফ’র সিদ্ধান্তেই প্রমানিত হল পূঁজির স্বার্থে দেশসমূহের অর্থনীতিকে মুক্ত করার পাশাপাশি তাদের আরেক কর্মসূচি হল ‘শীতল যুদ্ধ’র লক্ষ্যপূরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগীতা প্রদান করা। মঞ্জুরিপ্রাপ্ত ঋণের তুলনায় অনেক কম অর্থের বিনিময়েও আন্তর্জাতিক পূঁজির স্বার্থে ইউক্রেনের জমি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করা যেত। তবু ঐ বিপুল পরিমান অর্থের জোরে চাপা দেওয়া হল এক আঁতাত যার মধ্যে রয়েছে মার্কিন প্রশাসন (যারা ইউক্রেনকে নিজেদের পক্ষে টেনে আনতে চায়), ইউক্রেনের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলি (যারা ডলার কিংবা ইউরো’র মাধ্যমে নিজেদের সম্পত্তিকে দেশের বাইরে সুরক্ষিত রাখতে চায়), রয়েছে ক্যু-পরবর্তী ইউক্রেন সরকার (যারা এধরনের অন্যান্য সহযোগিতার বন্দোবস্ত করতে মরিয়া) এবং আইএমএফ (উপরোক্ত লক্ষ্যে খরচ যোগানো যার দায়)।
ন্যাটো এবং ইউক্রেন
রশিয়ার আক্রমনের সম্মুখীন হয়ে ইউক্রেন পুনরায় আইএমএফ’র সাহায্যের দাবী জানিয়েছে। সংস্থার কর্ণধার ক্রিস্টালিনা গিওর্গিয়েভা আইএমএফ’র বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের সামনে ইউক্রেনের দাবীর পক্ষেই সুপারিশ করেছেন। এবারের সাহায্য খাতে আর্থিক বরাদ্দের পরিমান এখনও অস্পষ্ট হলেও একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে, চলতি সংকটের পরিস্থিতি কেটে গেলে ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় গ্রীসে পরিণত হতে চলেছে। গ্রীসের ক্ষেত্রেও আইএমএফ নিজেদের সাধারণ মঞ্জুরির তুলনায় অনেকটা উচ্চমূল্যের ঋণের যোগান দিয়েছিল। সেই ঋণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের ব্যাংকগুলি যারা গ্রীসকে ধার দিয়েছিল, তারা জাতে নিজেদের প্রাপ্য ফেরত পায়। এখন গ্রীস এক অনন্ত ঋণের জালে আটকে রয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিন থেকে আজ অবধি আইএমএফ’র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ব্রেটন উডসে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৪ সালে, তখন এরা আন্তর্জাতিক ক্ষমতাধরের অংশমাত্র হয়ে সক্রিয় ছিল যারা অতিদ্রুত গতিসম্পন্ন অর্থনৈতিক কৌশল অনুসরণ করত। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস’ই এহেন অতিদ্রুত গতিসম্পন্ন (ডিরিজিস্ট) অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রবক্তা। আন্তর্জাতিক ক্ষমতা সংক্রান্ত ধারনার নির্মাণে আমেরিকান প্রতিনিধি হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইটের সাথে তিনিই ছিলেন প্রধান চিন্তাবিদ। যদিও সব দেশই বাণিজ্য ও পুঁজিতে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সেই বন্দোবস্তই অব্যাহত রেখেছে, তা স্বত্বেও যদি কোন একটি দেশে অর্থপ্রদান সংক্রান্ত ভারসাম্যের সমস্যা দেখা দেয় তবে তারা নিজেদের অর্থনীতিকে "স্থিতিশীল" করার জন্য আইএমএফ থেকে আর্থিক ঋণ নিতে পারে – এই ছিল লক্ষ্য। এভাবেই আইএমএফ যে কোন দেশের "কাঠামোগত সুস্থিতি" বজায় রাখতে কাহিনীর নায়কের মতোই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।  অর্থ প্রদান সংক্রান্ত ভারসাম্য হারানোর সংকটজনিত সমস্যার মোকাবিলা করতে ঋণ দেওয়া ছাড়াও  (কোন অর্থনীতিতে অর্থপ্রদান সংক্রান্ত ঘাটতির ভারসাম্য পুনরায় "স্থিতিশীল" হওয়া পর্যন্ত) আইএমএফ সরাসরি নয়া-উদারবাদের পক্ষে প্রচার করতে শুরু করে। সমস্ত বাণিজ্যে ও পুঁজির উপর থেকে যাবতীয় নিয়ন্ত্রণকে অকেজো করে দেওয়া, সরকারি সম্পদের বেসরকারিকরণ, "শ্রমবাজারের নমনীয়তা" (যার অর্থ হয় ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের উপরে আক্রমণ) প্রবর্তন করাই হয়ে দাঁড়ায় তাদের নীতি।
আইএমএফ ও তার কর্মসূচি
অতি দ্রুত অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করার বন্দোবস্তের (ডিরিজিস্ট ব্যবস্থা) প্রচারক হিসাবে যাত্রা শুরু করে, এক কথায় বলতে গেলে ক্রমশ সেই বন্দোবস্তেরই (ডিরিজিস্ট ব্যবস্থা) ধ্বংসকারী হয়ে ওঠে আইএমএফ। তারা নিজেদের রুপান্তরিত করে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির ধ্বজাধারী হিসাবে। বর্তমানে এরাই আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। দুনিয়ার সর্বত্র লগ্নী পূঁজির অনুপ্রবেশ ঘটাতে এরা সক্রিয়। এরা যে কেবল আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির একটি উপকরণ তাই নয়; পশ্চিমের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলির একটি হাতিয়ার হিসাবেও এরা কাজ করে চলেছে। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে, প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিসমূহের পক্ষে জবরদস্তিমূলক আদানপ্রদানের যন্ত্রটি এরাই বয়ে নিয়ে চলেছে। পুতিন যা করছেন তাকে কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই বলা যায় না। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির স্বার্থে কাজ করে এমন সংস্থার হাতের পুতুল কোন প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যের বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করার মতো কোনও সমাজতান্ত্রিকও তিনি নন। তার উদ্বেগ শুধুমাত্র রাশিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত, ন্যাটোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা রাশিয়ার এলাকাতেই সেই দুশ্চিন্তা সীমাবদ্ধ৷ আইএমএফ’র তরফে দেয় ‘সহায়তা’র বদলে ইয়ানুকোভিচকে তিনি যে বিকল্প সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তারও উদ্দেশ্য ছিল এটুকুই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে আইএমএফের ভূমিকা নিয়েই তিনি চিন্তাগ্রস্থ, সাধারণভাবে নয়া-উদারনীতির প্রবর্তক হিসেবে আইএমএফের ভূমিকা নিয়ে তার কোন মাথাব্যাথা নেই। নয়া-উদারবাদ যেভাবে জনজীবনে গভীর অসাম্য এবং চূড়ান্ত দারিদ্র ডেকে আনে, পুতিন এখনও অবধি তার চাইতে খুব একটা বেশি কিছু অর্জন করতে পারেন নি এটুকু বলাই যায়।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন