শ্রুতিনাথ প্রহরাজ
পূর্ণ স্বরাজের দাবি আজও প্রাসঙ্গিক
এদেশে প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, উপনিবেশ বিরোধী, সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়েছে। কমিউনিস্টরাই প্রথম পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুলেছিল ১৯২১-২২ সালে জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ ও গয়া অধিবেশনে যা গৃহীত হয় ন'বছর বাদে ১৯২৯ সালে লাহোর অধিবেশনে। এই পূর্ণ স্বরাজের স্লোগানের অভিমুখ ছিল শুধু স্বাধীনতা নয় তার সাথে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অর্থনৈতিক শোষণ মুক্তির নির্দিষ্ট কর্মসূচি স্থির করা। লক্ষ্য ছিল, নির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে এদেশের উপনিবেশবাদের মুক্তির সাথে সাথে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার জনমুখী পরিবর্তন, জমিদারতন্ত্রের বিলোপ, সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের অবসান।
পরাধীন ভারতে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে এদেশের সামন্ততান্ত্রিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শোষণ, নিপীড়ন ও পশ্চাদপদ ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াইয়ের সাথে সম্পৃক্ত করবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সেই কারণে, ব্রিটিশ শাসকের আনুকূল্যে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিতে পেরেছে কমিউনিস্টরা। নিজেদের জীবন বাজি রেখে এ ধরনের আপোষহীন জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলা ও নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে পেশোয়ার- কানপুর- মিরাট একের পর এক ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে যেতে হয়েছে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকে। বারবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিকে। ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের মহাফেজখানার নথি আজও প্রমাণ দেয়, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকের চোখে সবচাইতে বিপজ্জনক অংশ হিসেবে চিহ্নিত ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের এই বিপ্লববাদী ধারার অংশীদারগণ, যারা পরবর্তীকালে এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদের অনেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে আন্দামান সেলুলার জেলে দীর্ঘ সময় বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, আদতে তারাই ছিল ব্রিটিশদের অনুচর। এদের কেউ মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজেকে 'বীর' প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করেছে, আবার কেউ ধারাবাহিকভাবে ব্রিটিশ শাসকের পদলেহন করে এদেশের ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সেদিনের সেই দেশদ্রোহীরাই এখন এদেশের শাসন ক্ষমতায় আসীন।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই
সেই পূর্ণ স্বরাজের দাবি এদেশে আজও প্রাসঙ্গিক। সামন্তযুগীয় অবশেষ আজও গ্রামীণ ভারতে বিদ্যমান। পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, কুপমন্ডূকতা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে গরিব শ্রমজীবী মানুষকে। ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারি আজ চরমে। এই শোষণ বঞ্চনাকে আড়াল করতে ধর্ম জাতপাতের রাজনীতির নতুন নতুন ন্যারেশন তৈরি করা হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম সাধন পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী। তাই, স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও এদেশের কমিউনিস্টদের কাছে আজও দেশবাসীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ মুক্তির লড়াই প্রতিদিনের লড়াই-সংগ্রামের প্রধান এজেন্ডা।
সিপিআইএম ১৯৬৪ সালের সপ্তম কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে উল্লেখ করেছিল, "স্বয়ং-সঙ্গতিপূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তোলা তো দূরের কথা দেশ আজ এমনকি খাদ্য এবং বর্তমানের শিল্পগুলিতে উৎপাদন বজায় রাখবার জন্য সাম্রাজ্যবাদী আর্থিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। আয় এবং সম্পদের বৈষম্য হ্রাস করা এবং জীবনধারণের মানের বড় ধরণের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পরিকল্পনার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃত ফল লাভ হয়েছে তার বিপরীত। একদিকে একচেটিয়ারা বিপুলভাবে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে, অপরদিকে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের মানের ভীষণ রকমের অবনতি ঘটেছে। বেকার দশা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সর্বোপরি সরকার মজুতদার ও ফাটকাবাজদের সমগ্র সমাজের বিরুদ্ধে বল্গামুক্ত করে ছেড়ে দিয়েছে। জনগণের সমস্ত অংশের উপরই এদের লুন্ঠনবৃত্তি অবর্ণনীয় দুর্দশা সৃষ্টি করেছে।"
তার পর থেকে প্রতিটি পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে এই লুণ্ঠন, শোষণ, নিপীড়ন, শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার বিবরণ আরো প্রকট হয়েছে। একই সাথে এর নিরসনে সুনির্দিষ্ট আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের দায়িত্ব কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু দুর্দশার বিবরণ নয়, বিকল্প নীতি ও পথের কথা ও এগুলির বাস্তবায়নে চালু অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম তীব্রতর করবার কথা উল্লেখ করেছে সিপিআইএম। ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত ষোড়শ কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে এই বিকল্প নীতি গুলির কথা বলতে গিয়ে আমূল ভূমি সংস্কার ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সরকারি প্রকল্প সমূহের সার্থক রূপায়ণের ভিতর দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারের সম্প্রসারণ ঘটানো, কৃষি উৎপাদনের হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো, একটি সুষ্ঠু গণ-বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সমস্ত অঞ্চলে ১৪ টি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা, প্রাথমিক শিক্ষা, সাক্ষরতা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রসার ঘটানো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক রাজ্যগুলিকে আরও বেশি পরিমাণে আর্থিক সম্পদ বন্টন করবার কথা বলা হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালে ২৩ তম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কাজ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে "নয়া উদারনীতির ফলশ্রুতিতে জনগণের উপরে চাপিয়ে দেওয়া তীব্র অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সমস্ত অংশের মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করতে হবে, এক্ষেত্রে জীবন-জীবিকার সমস্যাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই লক্ষ্যে উদ্ভূত সমস্ত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনেই পার্টি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হবে এবং আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াতে চেষ্টা করবে।"
শুধু বিকল্প নীতির উল্লেখ নয়, সীমিত সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরায় রাজ্য সরকারে এসে তা কার্যকর করবার চেষ্টা চালিয়েছে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বাম-গণতান্ত্রিক জোট। ভূমি সংস্কার, নির্বাচিত পঞ্চায়েত-পৌরব্যবস্থা চালু করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার প্রসার, সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ সহ নিবিড় কৃষি প্রথা চালু, শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করা ইত্যাদি নানাবিধ কর্মসূচীর সার্থক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে যা সারা দেশের ক্ষেত্রে মডেল হিসেবে চিহ্নিত। শুধু সরকারের মধ্যে থেকে নয়, বাইরে থেকে নির্ধারী শক্তি হিসেবে একশ দিনের কাজ, আদিবাসী সমাজের জল জঙ্গলের অধিকার ইত্যাদি জনমুখী প্রকল্প রূপায়নের প্রশ্নেও সিপিআইএম নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পালনে সচেষ্ট থেকেছে। কর্পোরেট পুঁজির ক্রমবর্ধমান আক্রমণ মোকাবিলায় সামনের সারিতে থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে কমিউনিস্টরা। ধান্ধার ধনতন্ত্রে খুল্লমখুল্লা লুটের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই সংগ্রামে সামনের সারিতে আছে বলেই কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এত কুৎসা, এত আক্রমণ সংগঠিত হয়েছে, হচ্ছেও। যুক্তফ্রন্ট থেকে বামফ্রন্ট ও বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বিকল্প নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের কাজ এদেশে জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে সন্দেহ নেই। এই অভিজ্ঞতা, জণগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে আগামীর পথ প্রশস্ত করবে।
মতাদর্শগত অবস্থানে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ
সিপিআইএম বরাবর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতার নীতিকে মান্যতা দিয়ে এসেছে। মতাদর্শগত অবস্থানের প্রশ্নে স্বাতন্ত্র বজায় রেখে দৃঢ়সংকল্প থেকেছে। এর জন্য কারোর লেজুড়বৃত্তি করতে হয়নি অথচ সিপিআইএমকে হেয় করবার জন্য কখনো চীনপন্থী আবার কখনো রাশিয়াপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বরং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা বা ত্রুটি চিহ্নিতকরণের প্রশ্নে সিপিআইএম কখনো পিছপা হয়নি। গত শতকের ষাটের দশকের শেষ ভাগে দুই বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক দেশের অবস্থান প্রসঙ্গে অষ্টম পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, " এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, গত আট বছর ধরে, সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের আধুনিক সংশোধনবাদী তত্ত্ব ও কার্যকলাপ গুলি সমাজতন্ত্রী শিবির ও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর গুরুতর অনৈক্য, বিভেদ এবং ভাঙ্গন চাপিয়ে না দিলে, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাফল্যগুলি আরও বেশি এবং আরও উল্লেখযোগ্য হতো। আধুনিক সংশোধনবাদী তত্ত্ব গুলি পরাস্ত ও পরিত্যক্ত না হলে, বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবির ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্য যেমন সুনিশ্চিত করা যাবে না তেমনই আরো বিভেদ ও ভাঙ্গনের বিপদকে এড়ানো যাবে না। তাছাড়া, আরেকটি বড় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আধুনিক সংশোধনবাদের সাথে তার সংগ্রাম চালাতে গিয়ে ভ্রান্তভাবে, বিশ্ব আধিপত্যের জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মিত্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে গণ্য করেছে, তাকে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পরিধির বাইরে রাখছে, এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার সাথে ঐক্যবদ্ধ কাজকর্ম করাকে নীতিগতভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। আমাদের পার্টির সুচিন্তিত মত এই যে, চীনের পার্টির এই ভ্রান্ত অবস্থান, সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে এবং বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ঐক্য পুনরুদ্ধারের জন্য নীতি সম্মত সংগ্রামটিতে সাহায্য করে না।" এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিগত সময়ে এ ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু মতাদর্শগত বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়েছে সিপিআইএম কে। নির্দিষ্ট পরিস্থিতির বিশ্লেষণের সাহায্যে পার্টি তার অবস্থানে দৃঢ়সংকল্প থেকেছে। মার্কসবাদ লেলিনবাদের মতাদর্শকে ঊর্ধ্বে রেখে পার্টি তার লড়াই জারি রেখেছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে গৃহীত কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাবে চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়া প্রমুখ সমাজতান্ত্রিক শিবিরভুক্ত দেশগুলির অবস্থান সম্পর্কে পার্টি পরিস্থিতির উপযোগী বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছে। যে কেউ তা পড়ে দেখে নিতে পারেন।
কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমরা
চরম হিন্দুত্ববাদী শক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং তার রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর আজ এদেশের সংবিধান বিপন্ন। রাষ্ট্রক্ষমতায় আরএসএসের নিয়ন্ত্রণ বাড়ায় একই সাথে বিপন্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি। কমিউনিস্টরা দেশের এত বড় বিপদের সময় প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে থাকতে পারে না। সি পি আই এম ২০০০ সালে পার্টি কর্মসূচি সংশোধনের সময় সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছিল, বিজেপিকে আর পাঁচটা সাধারণ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের সাথে মিলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। কর্পোরেট পুঁজি তাদের শ্রেণী স্বার্থে মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে এ নিয়ে মোহজাল তৈরি করে। সেই ফাঁদে আমরা পা দিলে বিপদ আরো বাড়বে। ভুললে চলবে না, এদের পেছনে আছে আরএসএস, যারা উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি, হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তা। তাই বিজেপি হল চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল। তাদের প্রতিক্রিয়াশীল মর্মবস্তুর ভিত্তি হল অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদী জাত্যভিমান। এই হিন্দুত্বের মতাদর্শ সাম্প্রদায়িকতাকে মদত দেয়। যা সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু উভয় মৌলবাদী শক্তির বিকাশে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। আর এস এস এভাবেই তাদের কাজ হাসিল করে। তাই, কমিউনিস্টদের প্রধান কর্তব্য হল এই বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে হঠানো ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। কারণ, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে যাদের সংগঠিত করা কমিউনিস্টদের প্রধান কাজ, সেই সর্বহারা শ্রমজীবী মানুষের একটা বড় অংশ এখন এই চরম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শিকার। এদের রক্ষা করতে না পারলে জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে এগোনো সম্ভব নয়। পার্টি কর্মসূচিতে নির্দিষ্ট করে এ বিষয়ে কমিউনিস্টদের কর্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।
পার্টি কর্মসূচি সময়োপযোগী করার প্রায় বার বছর আগে ১৯৮৮- ৮৯ সালে অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, "স্বৈরতন্ত্রী সরকারকে পরাস্ত করতে, সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিচ্ছিন্ন করতে এবং অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের দূরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপ থেকে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল শক্তিগুলিকে সমবেত করার মহান প্রচেষ্টা হল বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য পার্টি সংগ্রামের এক অখন্ড অংশ।"
এই সময়ে এদেশের কমিউনিস্টদের কাছে প্রধান কাজ হল হিন্দুত্ব সম্প্রদায়িক শক্তির দেশবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা। আরএসএস বিজেপিকে রাষ্টক্ষমতা থেকে পরাস্ত করতেই হবে। এ রাজ্যে এদের সহায়ক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস। বলা যায় আরএসএস -এর ভরসা স্থল। তাই, বিজেপিকে হঠাতে তৃণমূল কংগ্রেসকেও পরাস্ত করতে হবে। একই সাথে নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে, জাতীয় সম্পদের লুট রুখতে, সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সহ খনিজ সম্পদের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপকতম অংশকে সমবেত করে লড়াই আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে ধারাবাহিকভাবে শ্রেণী ও গণ আন্দোলনের অগ্রগতি ঘটাতে পারলে এ কাজ করা সম্ভব। পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবসের প্রাক্কালে এই প্রত্যয়ে আমাদের সকলের অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া জরুরী।