দিলীপ ঘোষ
ভারতে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন চলছে। ৭দফার তিনটি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, চতুর্থ দফার ভোট আগামি ২০শে মে হবে। আমাদের জেলায় নির্বাচনের তারিখ ঐ দিন।
হাওড়া জেলায় নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিত যেমন জাতীয় পরিস্থিতির সাধারণ বৈশিষ্টের অন্তর্গত তেমনই জেলার নির্দিষ্ট সমস্যার প্রসঙ্গও এতে জড়িয়ে রয়েছে।
হাওড়া জেলায় সদর এলাকা ও উলুবেড়িয়া মোট দুটি লোকসভা আসনে লড়াই হবে। এছাড়াও জেলার ভূগোলে হুগলীর শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ২টি বিধানসভা এলাকা রয়েছে। শ্রীরামপুর আসনের নির্বাচনও হবে ঐ একই দিনে।
হাওড়ায় তৃণমূল-বিজেপির অপশাসনের বিরুদ্ধে জেলা বামফ্রন্ট ও জাতীয় কংগ্রেস একসাথে লড়াই করছে। হাওড়া কেন্দ্রে সব্যসাচী চ্যাটার্জি, উলুবেড়িয়া কেন্দ্রে আজাহার মল্লিক এবং শ্রীরামপুর কেন্দ্রে দীপ্সিতা ধর তিনজনই প্রচারে বেরিয়ে জনসাধারণের বিপুল আবেগ, উদ্দীপনা ও সমর্থন পাচ্ছেন। নির্বাচনের দিন মানুষ যাতে বিনা বাধায় নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেটাই আমাদের সবার লক্ষ্য। ২০শে মে আমাদের জেলার জনসাধারণ নিশ্চিন্তে সেই অধিকার প্রয়োগ করতে পারলে দু-দলই পরাজিত হবে- একথা সুনিশ্চিত। সেই লড়াইতে আমরা মানুষের পাশে ছিলাম, রয়েছি এবং থাকব।
আমাদের জেলায় বিগত নির্বাচনগুলিতে অভিজ্ঞতা কেমন? শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস গায়ের জোরে অথবা সেরকম কিছু করতে না পারলে সরকারী আধিকারিক, পুলিশ ও প্রশাসনিক যাবতীয় ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে, কার্যত নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করেছে। শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলের হয়ে পুলিশ ও প্রশাসন নির্লজ্জ দলদাসের মতো আচরন করেছে। প্রচারে বাধা দেওয়া, হুমকি ইত্যাদিতে কাজ না হওয়ায় ভোটের দিন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে যেকোনো উপায়ে ভেস্তে দেওয়া, গননার দিন কেন্দ্রগুলিতে হামলা চালানো এসবই তারা করেছে। সরকারী অফিসারদের মদতে নির্বাচনের ফলাফলকে নিজেদের ইচ্ছামতো বদলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসবই মানুষ দেখেছেন এবং আরও একবার তারা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেস শাসনে মানুষের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে- বলা ভালো করে দেওয়া হয়েছে। মানুষ এই অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, এবারের নির্বাচনে সেই মেজাজ রাজ্যের সর্বত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, আমাদের জেলাতেও পরিস্থিতি তেমনই।
একই অবস্থা গোটা দেশে। আরএসএস-বিজেপির সরকার চলছে দশ বছর। দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে, দেশের সংবিধান আক্রান্ত। ধর্মের নামে, জাতির নামে, খাদ্যাভ্যাসের নামে এমনকি ভাষার নামেও প্রতিদিন মানুষকে বিভক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপি’র ছোট-মাঝারি ও বড় মাপের নেতা-নেত্রীরা সাম্প্রদায়িক বিষ নির্ভর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। রুজি-রোজগার আক্রান্ত, নতুন কর্মসংস্থান হওয়া তো দূর অস্ত কার্যত পুরানো কাজও অনেকেই হারিয়ে ফেলেছেন, এর সাথে যুক্ত হয়েছে অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। যাতে এইসকল ইস্যুতে খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ একজোট না হতে পারেন, জনজীবনের প্রকৃত সমস্যাগুলিকে তুলে না ধরতে পারেন তাই বিভাজনের রাজনীতিকে সামনে আনা হচ্ছে। এখন নির্বাচন চলে আসায় ‘মোদীর গ্যারেন্টি’ ইত্যাদি বলা হচ্ছে, কিন্তু দশ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে যারা দেশের যাবতীয় সাংবিধানিক গ্যারান্টিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে তাদের মুখে আর যাই হোক ওসব কথা যে মানায় না তা বলাই বাহুল্য।
এই প্রতিবেদন লেখার সময়ই ইউএপিএ ধারার অপপ্রয়োগে গ্রেফতার হওয়া জনবিজ্ঞান আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা প্রবীর পুরকায়স্থ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মুক্তি পেয়েছেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রথম থেকেই গণমাধ্যমকে কব্জা করতে এবং বিকল্প মাধ্যমগুলিকে নির্লজ্জের মতো দখল করতে চেয়েছে। মোদীর অপশাসনের মুখোশ খুলে দিতে একনিষ্ঠ পোর্টাল ‘নিউজ ক্লিক’-এর পরিচালনায় প্রবীরের মতো বিশিষ্টরা যখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কুৎসা ও মিথ্যাচারের ভিত্তিতে নির্মিত অভিযোগের জাল কেটে মাথা উঁচু রেখে জেলের বাইরে আসেন; গনতন্ত্রপ্রেমী সকলের জন্য সেই খবর অবশ্যই স্বস্তিদায়ক। হাওড়া জেলার ক্ষেত্রে বিষয়টি সামান্য হলেও বাড়তি আনন্দের, আজকের আইআইইএসটি, পূর্বতন শিবপুর বি ই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন প্রবীর পুরকায়স্থ।
তাই আমরা বারে বারে বলছি মিডিয়াকে দখলে রেখে ওরা যতই এই নির্বাচনকে দুই পক্ষের লড়াই বলে প্রচার করুক না কেন, এবারের ভোটে ঐ ‘বাইনারি পলিটিক্স’ আর কাজে আসছে না, আসবেও না। ইলেক্টোরাল বন্ডের মতো লুটের কাহিনী সকলেই জেনে গেছেন। আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পিছনে আসল কারসাজি ওটাই। দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়েছে গোটা দেশে নির্বাচনী বন্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দল যেমন বিজেপি, আমাদের রাজ্যে সেই লুটের টাকার বড় হিস্যাদারের নাম তৃণমূল কংগ্রেস। এটুকু মাথায় রাখলেও স্পষ্ট বোঝা যায় একে অন্যের সাথে ওদের সেটিং কত গভীর। কৃষকরা ফসলের দাম পান না, ঋণের দায়ে জড়িয়ে যাচ্ছেন। গরীব-দুস্থ পরিবারগুলি মাইক্রো ফিনান্সের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে, তার থেকে বাঁচতে রাজ্যের বাইরে কাজের সন্ধানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আইনানুগ জব কার্ড থেকেও নেই, দখল করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় মাতব্বরেরা। সঞ্জীব গোয়েংকার সংস্থা বিদ্যুতের দাম বাড়ালে কেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চুপ থাকেন নির্বাচনী বন্ডের হিসাব সে রহস্যের সমাধান করেছে। বিদ্যুতের লাগামহীন দামবৃদ্ধি অবশ্য তাতেও কমেনি, এখন আবার স্ল্যাবের হেরফের করে বাড়তি টাকা আদায় করা চলছে। দুর্নীতির পাহাড়চূড়ায় যেমন বন্ডের টাকার প্রসঙ্গ আসবে তেমনি আসবে পশ্চিমবঙ্গে সরকারী চাকরিতে নিয়োগ দুর্নীতির কথা। শিক্ষামন্ত্রী সহ রাজ্য সরকারের একাধিক আমলা, আধিকারিক সহ গোটা একটি ব্যবস্থা চরম দুর্নীতির সাথে জড়িত। সরকারী নিয়োগ থেকে গ্রামীণ কর্মসংস্থান, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, যাবতীয় কাজে লুটেরা সিন্ডিকেট ও কাটমানির বন্দোবস্তকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারায় পরিণত করেছে তৃণমূল শাসন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় অসহায় মানুষের সহায়তা সামগ্রীও লুট করেছে এরা। চাল-ত্রিপল-কয়লা-বালি থেকে শুরু করে গোটা রাজ্যের ভবিষ্যৎটাই গিলে খেতে চাইছে এরা। এসবকিছুতে ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিক্রিয়া এমনই যার ধাক্কায় ইদানিং আর ‘সততার প্রতীক’ সম্বলিত বিজ্ঞাপনটি কারোর চোখে পড়ে না, অবশ্য পড়লেও ওসবের দিকে কেউ দেখত কিনা সে নিয়েও কারোর সন্দেহ নেই। যারা ওয়াকফ বোর্ডের তহবিল থেকে দেওয়া ইমাম ভাতাকে নিজেদের দান বলে প্রচার করে তাদের রাজনীতির দেউলিয়া অবস্থা সম্পর্কে একটিও নতুন বিশেষণের প্রয়োজন হয় না।
আমাদের জেলায় বন্ধ কলকারখানা একটিও নতুন করে খোলা হয়নি, নতুন কারখানা একটিও হয়নি। জেলার দর্জি ও জরি শিল্পের নাভিশ্বাস উঠছে- কারোর হেলদোল নেই। কেন্দ্র এবং রাজ্যের দুই শাসকদলই নির্বাচনের আগে অবধি ঝুড়ি ঝুড়ি প্রস্তাব দেয়- নির্বাচন এলেই একদিকে কাঁদুনি গাওয়া আরেকদিকে ভয় দেখানো চলতে থাকে। তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি’র রাজনৈতিক প্রচারের কায়দা ওটাই, একে অন্যের নামে ভয় দেখিয়ে, ভুল বুঝিয়ে মানুষের প্রকৃত সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া। বাইনারি তৈরি করে মানুষের ভোট ভাগাভাগি করার অপচেষ্টা ছাড়া এ আর কিছুই ন্য। এরা ক্যামেরার সামনে বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার নাটক করে অথচ আমাদের রাজ্যেই এই দুদলের নেতা, মন্ত্রী ও সাংসদরা যেকোনো সময় একবার এদল আরেকবার ওদলে লাফালাফি করে চলেছেন। এবারে লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতা ব্যানার্জি সরকারের একটিই প্রচার- তারা পরাজিত হলে নাকি ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে! জরুরী সরকারী প্রকল্প কে সরকারে বসেছে তার উপরে নির্ভর করে না, মানুষের ন্যায্য অধিকার তারা পাবেনই। এই জেলায় বিজেপি’র প্রচার কি- তারা নাকি ভোট জিতে দুর্নীতির অবসান করবে। হাওড়া জেলার মানুষ এমন কথায় হাসবেন। গত আটবছর হাওড়া জেলায় পুরবোর্ড নেই, কারন নির্বাচনই হয় না। নির্বাচিত বোর্ডের মেয়াদ শেষের আগেও তৃণমূল কংগ্রেসের দখলেই পুরবোর্ড পরিচালিত হচ্ছিল, সেদিনের পুরপ্রধান যার নামে দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ স্পষ্ট তিনিই এবার হাওড়ায় বিজেপি’র প্রার্থী! মিথ্যা ও ঘৃণা প্রচারে ওরা এমনিতেই প্রসিদ্ধ; নির্বাচনের আবহে জনসংখ্যায় সংখ্যালঘুদের জন্মহার নিয়ে ইচ্ছাকৃত প্রচার চালাতে চাইছে যারা তারা কি আমাদের দেশে আদমশুমারি ও জাতিভিত্তিক জনগণনার মতো জরুরী কাজ কেন একচুলও এগোল না তার উত্তর দেবেন? এসব প্রসঙ্গে আর চুপ থাকা ছাড়া পথ নেই বলেই ওরা নিরন্তর মানুষকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে চাইছেন- এধরণের প্ররোচনা থেকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে, অন্যদেরও সচেতন করতে হবে। নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে এটাও জরুরী কাজ।
এহেন বিজেপি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে একথা সাধারণ মানুষ তো দূর ওদের অনেক কর্মী, সমর্থকরাও বিশ্বাস করেন না। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী বিগত লোকসভাতেও সাংসদ ছিলেন, কি করেছেন কেউ জানে না। সংসদের আলোচনায় সিএএ আইন পাশ হওয়ার সময় তিনি বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন, ভোট দেননি এবং সেভাবেই কার্যত বিজেপিকে সমর্থন যোগান দিয়েছেন। উলুবেড়িয়া কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদও ঐ আইন পাশের সময় নিস্ক্রিয় থেকেছেন। এসব কথা আর গোপন নেই, জেলার মানুষ সবটাই জানেন। এর প্রতিফলনও ঘটছে, প্রচারে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েই বুঝছে তাদের পালে হাওয়া নেই। তাই পুলিশ ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে নানাভাবে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা হচ্ছে। আমাদের জেলার সাধারণ মানুষ সেই ভয়কে জয় করেই ভোট দেবেন। এবারের নির্বাচন যেমন দেশের সংবিধান, সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক কাঠামো ও আইনের শাসন বাঁচানোর লড়াই তেমনিই দেশবাসীর নিজেদের মর্যাদা রক্ষারও লড়াই।
হাওড়া জেলার ভোট হবে সেই মেজাজেই।