কলকাতায় কদম রসুল, নোয়াখালিতে লালমোহন সেন, লড়াইয়ের প্রতি পর্যায়ে সেনানী কমিউনিস্টরা

চন্দন দাস

ফেব্রুয়ারিতে কদম রসুল, অক্টোবরে লালমোহন সেন, ১৯৪৬ দুই শহীদের আত্মদানে কোনও বৈশিষ্ট্য আছে? আছে — দু’জনের শহীদ হওয়ার বছর এক। কিন্তু মাস আলাদা। আর ওই ছ’-সাত মাসের ব্যবধানেই লুকিয়ে আছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগ্রামী শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তর আকাঙ্খা আর শাসকদের চক্রান্তের দ্বন্দ্বের ছবি।

দুই শহীদের জীবন আসলে আয়না ১১ই ফেব্রুয়ারি ছিল রসিদ আলী দিবস। ১৯৪৬। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে উত্তাল কলকাতা। সেই রেশ চলেছিল পরবর্তী ৩-৪ দিন। তার মধ্যেই ‘আন্দোলনে উসকানি’ দেওয়ার অপরাধে অনেক জায়গায় গুলি চালালো সামরিক বাহিনী। বাহিনীর গুলিতে শহীদ হলেন কমরেড কদম রসুল, তিনি ছিলেন গ্যাস শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মী

ঢাকুরিয়া গোবিন্দপুরের কমরেড সুধাংশু চক্রবর্তীও শহীদ হলেন। মিলিটারির গুলিতেই। ওই সময়েই। নারায়নগঞ্জের কাপড় কলের ধর্মঘটী শ্রমিকদের উপর পুলিশের গুলি চলে ওই সময়ে। শহীদ হন — কমরেড প্রাণগোপাল চক্রবর্তী, কমরেড সুধীর উকিল, কমরেড পবিত্র দে এবং কমরেড বলরাম গোপ। আর তার কয়েকমাস পরেই নোয়াখালির সন্দ্বীপে শহীদ হন কমরেড লালমোহন সেন। মৌলবাদীদের ছুরির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছিলেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সেনানী লালমোহন সেন। ১৯৪৬-র ১১ই অক্টোবর। শহীদের তালিকা লিখতে বসিনি। শহীদদের জীবনদানের সময়কালের দিকে নজর দিলে একটি বিশেষ মাত্রা চোখে পড়বে। একই বছরে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাইয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিত ছিল সরাসরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, স্বাধীনতাকামী। আগস্ট থেকে তার চেহার হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, দাঙ্গা ঠেকানো।

’৪৬ দাঙ্গার বছর, ’৪৬ লড়াইয়ের বছর। আর এই দুটি প্রেক্ষাপটেও অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিল কমিউনিস্টরা। শক্তি কম ছিল। তবু জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল অনেক ক্ষেত্রে। তেভাগা থেকে শ্রমিক এবং ছাত্র আন্দোলনগুলির নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্টরাই মূলত। তবু দুই বাংলার সর্বশেষ ঐক্যবদ্ধ ‘প্রাদেশিক সম্মেলনে’ সিপিআই কার্যত স্বীকার করেছিল — সব তারা বুঝতে পারেনি। বুঝথে পারেনি বুর্জোয়ারা কত মারাত্মক, জঘন্য হতে পারে।
                                                       লালমোহন সেন

উপমহাদেশের ইতিহাস জনতার মুখরিত সংগ্রাম আর শাসকের দাঙ্গার চক্রান্তের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের এক বিবরণ। এবং অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের আন্দোলন যখন ক্রমশঃ উত্তাল হয়ে উঠছে, তখনই সাম্প্রদায়িকতার চক্রান্ত হাজির হয়েছে। যা ১৯৪৬-এ ঠিক। তা ২০২১-এ সত্যি। ইতিহাস বেইমানি করে না। ১৯৪৫-র ২১ শে নভেম্বর থেকে ১৯৪৬-র জুলাই — বাংলা উত্তাল ছিল। এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ছাত্ররা। দিল্লির লালকেল্লায় তখন আই এন এ বন্দীদের বিচার চলছে। ১৯৪৬-র ১২ই ফেব্রুয়ারির পর থেকে বেশ কয়েকটি দিন — ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে কলকাতা, শহরতলী উত্তাল। হিন্দু, মুসলমান সবাই আছেন। শ্রমিক আছেন। ছাত্র আছেন। মহিলা আছেন। কংগ্রেস আছে। কমিউনিস্ট আছে। সেনাবাহিনী নেমেছিল। ১৩ই ফেব্রুয়ারি কুড়িটি জায়গায় গুলি চলল। প্রায় ১৫জনের মৃত্যু হল। ১৯৪৬ ছিল প্রায় শ্রমিক অভ্যুত্থানের বছর। সরকারি হিসাবে সে বছর মোট ১৬২৯টি ধর্মঘট হয়। ধর্মঘটের মোট শ্রমদিবস ছিল ১কোটি ২৭লক্ষ ১৮ হাজার। অংশ নিয়েছিলেন ১৯লক্ষ ৬২ হাজার শ্রমিক। তারপরই আগস্ট। পরিস্থিতি প্রায় সম্পূর্ণ বদলাতে শুরু করল। ১৯৪৬-র ১৬ই আগস্ট ছিল মুসলীম লীগের আহুত ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে।’ তাকে কেন্দ্র করে মারাত্মক দাঙ্গা হয় কলকাতায়, নোয়াখালির মত কিছু জায়গায়। গান্ধী পারেননি জিন্নাহ্‌, সুরাবর্দীদের বিরত করতে।

কমিউনিস্ট পার্টির উপলব্ধি কী? ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মোলন হয়েছিল কলকাতায়, ১৯৪৭-র ৪ঠা থেকে ৬ই অক্টোবর। তার খসড়া রাজনৈতিক রিপোর্টের প্রথম দলিলে লেখা হয়,‘‘১৯৪৫ ও ৪৬ সাল বিপ্লবী অভিযানের যুগ। এই যুগে সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের উন্মাদনা জাগিয়েছিল। নৌ-বিদ্রোহ হইতে আরম্ভ করিয়া ভিয়েটনাম(তখন এই বানানই লেখা হত) দিবসে ছাত্রদের সংগ্রাম, শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘট হইতে দেশীয় রাজ্যের গনসংগ্রাম এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সমর্থনে গণসমাবেশ হইতে আরম্ভ করিয়া রসিদ আলী দিবসে কলিকাতার নাগরিকদের সশস্ত্র প্রতিরোধ — এই সমস্ত ঘটনায় সাম্রাজ্যবাদীর মনে আতংক জন্মিয়াছিল। সাম্রাজ্যবাদী বুঝিতে পারিয়াছিল যে, তাহার দিন ফুরাইয়া আসিয়াছে, বিপ্লব আসিতেছে।’’ কিন্তু তারপর? সিপিআই-র আক্ষেপে মূর্ত হয়ে উঠল উপমহাদেশের আর এক ক্রুর ছবি — ‘‘আমরা ভাবিতেছিলাম, বিপ্লবী গণসংগ্রামের দিকেই দেশ অগ্রসর হইবে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের নীতি যে দাঙ্গা সৃষ্টি করিতে করিতে বদ্ধপরিকর সে সম্বন্ধে আমাদের পূর্ণ চেতনা ছিল না। দেশবাসীর উপর বুর্জোয়া নেতৃত্বের প্রভাব কী অপরিসীম তাহা আমরা দাঙ্গার ভিতর দেখিয়াছি, কিন্তু দাঙ্গার পূর্বে ভাবিতে পারি নাই যে বুর্জোয়া নেতৃত্ব দেশবাসীর মনে এত বড় মারাত্মক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইবে।’’

’৪৬-র অক্টোবরে লালমোহন সেন শহীদ হলেন কেন? ১৬ই আগস্টের ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’ ডে’র পর কলকাতায় দাঙ্গা ছড়ায়। তারপর নানা জায়গায় — মুম্বাই থেকে বিহার। এবং নোয়াখালিতে। তখন মানুষ মরছিলেন। আগুন জ্বলছিল। ধর্ষণ চলছিল। লীগ ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা দেশে রাজত্বের আকাঙ্খায় তীব্র। কংগ্রেস হস্তক্ষেপই করতে পারেনি ঘটনাক্রমে। গান্ধী তখন প্রায় প্রভাবহীন। একই বাড়িতে থেকেও নির্বাচনের কোনও বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বল্লভ ভাই প্যাটেল তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনাই করে না — এমন অভিযোগ ধরা পড়ছে গান্ধীর সেই সময়কার চিঠিতে। সাম্প্রদায়িক উসকানি, দাঙ্গার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস-ও। নিরুপায় গান্ধী পদযাত্রা শুরু করেন বেলেঘাটা থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত এলাকায়। তাঁর আক্ষেপেরও সমালোচনা করে সুরাবর্দী পরিচালিত সরকারের মন্ত্রীরা। এমন সময়ে কমিউনিস্টরা দাঙ্গা ঠেকাতে রাস্তায় নেমেছিলেন। দেশপ্রেমের পতাকা তখন তাঁদের হাতে। তাঁদেরই একজন কমরেড লালমোহন সেন। নোয়াখালীর কুখ্যাত দাঙ্গা রোখার চেষ্টায় লড়ছিলেন আন্দামান ফেরত মানুষটি। মাত্র দু’ মাস আগে, আগস্টে জেল থেকে বেরিয়েছিলেন। আন্দামানের সেলুলার জেলে প্রায় ১৫ বছর কাটানোর পর তাঁকে পাঠানো হয়েছি12ল ঢাকা জেলে। সেখান থেকে প্যারোলে মুক্তি। বিশ্রাম নেননি। দু’বার ভাবেননি। চলে গেছিলেন নোয়াখালির সন্দ্বীপে। সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের স্নেহের লালমোহন। জেলেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে পরিচয়। জেলেই কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত। জেল থেকে বেরিয়ে পার্টিরই নির্দেশে ফিরে যাওয়া সন্দ্বীপ দ্বীপে। লক্ষ্য — কৃষকদের মধ্যে কাজ। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখার আহ্বান জানানো। মৌলবাদীরা তাঁর মত স্বাধীনতা সংগ্রামীকেও রেয়াত করেনি।

কিন্তু লালমোহন সেনের জীবন প্রমাণ করেছে এই উপমহাদেশের মাটিতে সব যুদ্ধে লড়াইয়ের বর্ণপরিচয় কমিউনিস্টদের রক্তধারায় লেখা। এ কোন দাবি নয়। ইতিহাস। সম্প্রীতি আর মানুষের ঐক্যের জন্য শহীদ হওয়ার হিম্মৎ রাখে কমিউনিস্টরা। আজ কমিউনিস্ট পার্টির ১০১ বছর পূর্ণ হচ্ছে। পার্টির ঐতিহ্যে মিশে আছে এই বীরত্বগাঁথা। ১৯২০-র ১৭ই অক্টোবর পার্টির জন্ম। মাত্র সাতজনকে নিয়ে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কমিটি। সাতজন হলেন —

১) মানবেন্দ্রনাথ রায়,

২) এভেলিনা ট্রেন্ট রায়,

৩) অবনী মুখার্জি,

৪) রোজা ফিটিংগোফ,

৫) মহম্মদ আলি,

৬) মহম্মদ শফিক সিদ্দিকি,

৭) এম প্রতিবাদী আচার্য।

প্রথম সম্পাদক? মুহম্মদ শফিক।

সাতজনের কমিটির দুজন মহিলা।

১৯১৮-তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। তার আগে পৃথিবীর ইতিহাসে জন্ম নিয়েছে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সোভিয়েতের অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার প্রায় প্রতিটি প্রান্তে। ভারত তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে যথেষ্ট আলোড়িত। সশস্ত্র সংগ্রামীরা আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ১৯১৯-র ১৩ই এপ্রিল জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড। তার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি পরিত্যাগ করেছেন। সেই ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন উত্তাপ উপস্থিত করেছে। ১৯২০-র ৪ঠা সেপ্টেম্বর গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ডাক দিয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনের। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বেশ কিছুটা প্রতিফলিত হয় সেই আন্দোলনে। কিন্তু তাল কাটল দু’ বছর পর — ১৯২২-র ১২ই ফেব্রুয়ারি। গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলেন চৌরিচৌরায় ক্ষুব্ধ কৃষকদের থানা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে।

গান্ধীর যে সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত হতাশ হয়েছিলেন জওহরলাল নেহরুর মত অনেকে। কিন্ত অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার হলেও মানুষের বিক্ষোভ থামেনি। ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি’র মত অনেক বিপ্লবী সংগঠন কাজ শুরু করে দেয় দেশজুড়ে — স্বাধীনতার লক্ষ্যে। এমনই পরিস্থিতিতে কমরেড লালমোহন সেন, সতীশ পাকড়াশি, গণেশ ঘোষদের পার্টি — কমিউনিস্ট পার্টির আত্মপ্রকাশ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন