কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২ - প্রাথমিক পর্যালোচনা

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২ – কোন প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে?

অতিমারি সারা পৃথিবীর সাথে ভারতেও জনজীবনকে দুর্দশাগ্রস্ত করেছে। দেশের সরকার অতিমারি প্রতিরোধে যথাযথ বন্দোবস্তই করেনি। সংক্রমণে মৃত মানুষের দেহ দাহ করা হয়েছে ফুটপাথে, নাহলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে নদীর জলে। এই অবস্থায় যখন ভারতে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, ওমিক্রন সংক্রমণ হচ্ছে দ্রুতগতিতে সেই সময়েই দেশের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামন ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করেছেন আজ।

করোনা সংক্রমণ শুধু জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় ঘটায়নি, দেশের ২৩কোটি পরিবার শেষ দুবছরে দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে, শহরে কাজ হারিয়ে শ্রমিকেরা ‘পায়ে পায়ে’ ঘরে ফিরেছেন। তাদের হাতে কাজ নেই, গ্রামীণ একশো দিনের রোজগার প্রকল্পে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। এমজিএনআরইজিএ (MGNREGA) প্রকল্পে কাজের আবেদন জানিয়েছেন ৪.৫৯ কোটি মানুষ। এই প্রকল্প ঘোষণা হওয়ার পর থেকে কখনো এত আবেদন জমা পড়েনি। এটুকু তথ্যেই পরিস্কার বোঝা যায় ভারতে কাজের সুযোগ কমেছে। শেষ চার দশকে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ হয়েছে এই পর্বেই। বিশ্ব ক্ষুধা সুচকে ভারতের অবস্থান আগের চাইতে আরও নিচে নেমেছে, অন্তত ২০ কোটি কর্মক্ষম ভারতীয়ের এই মুহূর্তে কোন রোজগার নেই।

সামগ্রিক বিচারে পাইকারি মূল্য সূচক বিপদসীমায় (১২ শতাংশ) পৌঁছেছে, মূল সমস্যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে ব্যাপক হারে। জনগনের হাতে বেঁচে থাকার ন্যূনতম সামগ্রী কেনবার অর্থ নেই, অথচ কেন্দ্রীয় সরকার বারে বারে আয়কর সীমার বাইরে থাকা পরিবারগুলির হাতে নগদ ৭৫০০ টাকা দেওয়ার দাবিকে অগ্রাহ্য করছে। চাহিদার সংকটকে যোগান বাড়িয়ে মোকাবিলা করতে চাইছে মোদি সরকার। সিএমআইই’র প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে জুলাই মাসের মধ্যেই কাজ হারিয়েছেন ১ কোটি ৯০ লক্ষ বেতনপ্রাপ্ত কর্মী, তাদের কতজন বর্তমানে কাজে যুক্ত হয়েছেন সরকারের কাছে তার কোন হদিশ নেই। মানুষের হাতে কাজ না থাকলেও সমস্যার সমাধানে কর্পোরেটদের কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, প্রথম পাঁচ বছরে মোদি সরকার কর্পোরেট কর ছাড় দিয়েছে মোট ৪.৩ লক্ষ কোটি টাকা, দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসে কর্পোরেট কর ছাড় দেওয়া হয়েছে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার (২০১৯ সালের হিসাব)।

২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে দেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে মোদী সরকারের একমাত্র পদক্ষেপ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সহ সমস্ত জাতীয় সম্পদের ব্যাপক বিলগ্নিকরণ। স্ট্র্যাটেজিক এবং নন-স্ট্র্যাটেজিক খাতের নামে করে জাতীয় সম্পদগুলিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়াই এহেন পরিকল্পনার ভিত্তি। সম্প্রতি বিশাল আর্থিক দায় মাথায় নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে – বলা হচ্ছে এর ফলে উৎসাহ পাবে কর্পোরেট শক্তি।

করোনা সংক্রমনের ধাক্কায় দেশের সংসদের একের পর এক অধিবেশন খারিজ হলেও বারে বারে অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) জারি করে নয়া কৃষি আইন, শ্রম আইন পাশ করানো হয়েছে। দেশের কৃষকরা ফসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সহ কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রাস্তায় বসে আন্দোলন করেছেন, সেই আন্দোলনের চাপে প্রধানমন্ত্রী কৃষি আইন বাতিলের মৌখিক ঘোষণা করেছেন – যদিও সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের অন্যান্য দাবিগুলি এখনও আদায় হয়নি। আগামী মার্চ মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখে দুইদিন ব্যাপী ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছে সারা দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নগুলি। কার্যত ভারতের কৃষক সমাজ এবং শ্রমিক-মেহনতি মানুষ লড়াই চালাচ্ছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে, সেই সংগ্রামে প্রতিদিন সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত বাজেটকে দেখতে হবে।

এই বাজেটে দেশ কি কি পেল?

বাজেট বক্তৃতার ঘোষণা অনুযায়ী সমস্তরকম আমদানিকৃত দ্রব্যে দাম বেড়েছে। পোশাক ও চামড়াজাত দ্রব্য, বৈদ্যুতিন সামগ্রী, মোবাইল ফোন, মোবাইল ফোনের চার্জার, মিথানল-সহ নির্দিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্যে, ইমিটেশন গয়না, হিরের গয়নার দাম কমেছে। ঘোষিত বাজেটের প্রধান দিক চারটিঃ

১) স্বাধীনতার ৭৫ থেকে ১০০ বছর সময়কে ‘অমৃতকাল’ হিসাবে ঘোষণা, দেশের অর্থনীতিতে সমান্তরাল দুই ব্যবস্থা চালু করার নামে একদিকে পরিকাঠামো খাতে ব্যাপক বেসরকারি বিনিয়োগ আরেকদিকে তফশিলি জাতি, উপজাতি মানুষ সহ মহিলাদের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে সার্বিক বাজেট। এহেন লক্ষ্যের আড়ালে রাজনীতি স্পষ্ট, খোলাখুলি কর্পোরেটদের হাতে আরও আরও বেশি করে সম্পদ তুলে দিয়ে জনগনের জন্য সরাসরি সরকারি ব্যয়বরাদ্দের দায় অস্বীকার করা।

২) অতিমারির ধাক্কা, আর্থিক পরিস্থিতির সার্বিক অবনমন, কর্মসংস্থান হ্রাস, সামগ্রিক চাহিদায় সংকোচন এবং ভয়াবহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও সারা পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হবে ৯.২ শতাংশ হারে। কোন অর্থনীতির সূত্রে এহেন অসাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছান যাবে তার অবশ্য সদুত্তর নেই, আছে শুধু নির্ভার দৃপ্ত ঘোষণা এবং সমানুপাতে বিজেপি সাংসদদের টেবিল চাপড়ানি। করোনা অতিমারির সময় জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয়ের দায় রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে মোদি সরকার, তাই আজ বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যোদ্ধার সম্পর্কিত ঘোষণা করলে চমকে উঠতে হয় বৈকি!

৩) দেশের আর্থিক উন্নতির লক্ষ্যে চাহিদার সংকোচন মোকাবিলা করতে আয়কর সীমার বাইরে থাকা পরিবারগুলিকে নগদ আর্থিক সাহায্যের দাবিকে বারে বারে অস্বীকার করা হয়েছে, অথচ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোকে এই বাজেটে লক্ষ্য বলে ঘোষণা করা হল। মানুষের হাতে সামগ্রী কেনার মত যথেষ্ট অর্থ না থাকলে বাজারে যোগান বাড়লে কিভাবে সমস্যার সমাধান হবে কেউ জানে না। কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনে পিছু হটেছে মোদি সরকার, কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা সত্ত্বেও বাজেটে উৎপাদিত ফসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে কিছু নেই, ফসল কেনায় সরকারি মান্ডি ব্যবস্থা সম্প্রসারণের কোন কথা নেই, এমনকি ক্ষুধার সমস্যা মেটাতে শক্তিশালি গনবন্টন ব্যবস্থা সম্পর্কেও কিছু নেই। শ্রমিক-মেহনতি মানুষকে দুর্যোগের সময় বাড়তি সহায়তা দেওয়ার বদলে শ্রম কোড বাতিল সম্পর্কে কোন কথা নেই। এরই সাথে একটি ছোট তথ্য – আমাদের দেশের রাজস্ব ঘাটতি (Fiscal Deficit) ৬.৪ শতাংশ, বলা হয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে এই ঘাটতিকে ৪ শতাংশের নিচে নিয়ে যাওয়া হবে।

৪) দেশের যে কোন বিষয়কেই ডিজিটাইজড করার কথা ইদানিং খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এতদিন বিবিধ সরকারি সুযোগ সুবিধার জন্য আবেদন জানানো, স্ট্যাটাস রিপোর্ট জানা এবং অন্যান্য সরকারি কিংবা সরকার পোষিত পরিষেবা (যেমন ব্যাংকিং)-কে ই-প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত হতে দেখা গেছে। এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী একটি গোটা ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা করেছেন। সারা দেশে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় যখন বহু ছাত্র-ছাত্রী ডিজিটাল ডিভাইডের শিকার, তখন এই ঘোষণা সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবাহি যে এই কেন্দ্রীয় সরকার ডিজিটাল ডিভাইডকে আরও বেশি করে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারায় নিয়ে যাবে। দেশের শিল্পমহলের সাথে হাত মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল স্কিল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করবে ঘোষণা হয়েছে, অর্থাৎ পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল যারা তাদের জন্য সস্তা দরে শ্রমিক হওয়াকেই দস্তুর করতে চাইছে সরকার – এই পরিকল্পনাই জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল।

এই চারটি বিষয় ব্যতীত বাকি যা কিছু ঘোষণা সেইসব কিছুকে দুভাগে ভাগ করা যায়। এক যে সমস্ত বিষয়ে সাধারণ জনজীবনের কোন প্রত্যক্ষ নির্ভরতা নেই, যেমন কর্পোরেট সারচার্জ কমানো, বন্দে ভারত ট্রেন পরিষেবা, ড্রোন ব্যবহার করে স্টার্ট আপ, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার, অ্যানিমেশনে টাস্ক ফোর্স, এক স্টেশন এক দ্রব্য কিংবা এক দেশ এক রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেকভাগে রয়েছে এমনসব ঘোষণা যেগুলি সম্পর্কে জনগনের অবস্থা ঘর পোড়া গবাদি পশুর মতোই! নোট বাতিল, জিএসটি এবং অন্যান্য যেকোনো ঢক্কানিনাদে মোদী সরকার যখনই দেশের এবং দেশবাসীর কল্যাণের কথা বলেছে ফল হয়েছে বিপরীত। এই বাজেটেও পরবর্তী পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থান, প্রতিরক্ষায় দেশীয় প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উৎপাদন বাড়ানো, ডিজিটাল কারেন্সির (ডিজিটাল রুপি) প্রচলন এধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য সমস্ত সমালোচনা ব্যতিরেকে একটি ঘোষণাকে প্রচার করতেই হয়, আর কিছু না হোক ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশের জনগণ যাতে সহজে বিদেশ যাত্রা করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে অত্যাধুনিক চিপযুক্ত ই-পাসপোর্ট পরিষেবা চালু করছেন! আপনার না পোষালে চলে যান – এটুকুই মোদি সরকারের তরফে জনগণের উদ্দেশ্যে উপহার!

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন