Alakesh Das On Dalit

মেঘে ঢাকা তারা

অলকেশ দাস

ফলস ট্রুথ। কাশ্মীর ফাইলস। নিখুঁত পরিকল্পনা। উদ্দেশ্যমূলক চিত্রনাট্য। বিবেক অগ্নিহোত্রীর। যার নিজের মুখের কথা-Who said facts are facts? সুতরাং নির্মানই শেষ কথা নয়। প্রকরণ, সত্য, মিথ্যা, আংশিক সত্য, এক সত্যকে অপ্রকাশিত রাখা তার কৌশল। যাই হোক, নির্মাণ নির্ভর করে নির্মাতার শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির উপর ।

স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব দিয়ে সবকিছু ঢেকে দেওয়ার এক ব্যাপক আয়োজন চলছে। এর মধ্যে ইতিহাস ঢেকে দেওয়ার আয়োজনও আছে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে যে ইতিহাসের উপাচার তাতে সরকারি আনুকূল্য। ইতিহাস নির্মিত হচ্ছে এক অবিভাজ্য ভাবনায়, একমাত্রিক চিন্তাধারায়। বহুমাত্রিকতা, বৈচিত্র্য, জটিলতা এবং যাবতীয় দ্বন্দ্বের দিককে কার্যত উপেক্ষা করা হয়েছে। উপনিবেশের মুক্তির লড়াইতে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সেই প্রসঙ্গে তৎকালীন ইতিহাস নীরব থেকেছে। অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্যে কংগ্রেসের জয়যাত্রায় ব্যস্ত থেকেছে সেই ইতিহাস। যেন স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইতে আর কেউই ছিল না। কৃষকদের বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, আদিবাসীদের সুবিস্তৃত ভূমিকা, ভারতের মুক্তিসংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর লক্ষ্যনীয় ভূমিকা, কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ স্বাধীনতার স্লোগান, পেশোয়ার  থেকে মিরাট হয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র মামলা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল, চল্লিশের দশকের লড়াই, 'ভারত ছাড়ো'র পর যখন কংগ্রেস একদম নীরব- তখনও বামেরা স্বাধীনতার আন্দোলনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আই এন এ বন্দীদের মামলা, তেভাগা, তেলেঙ্গানা, পুনাপ্পা-ভায়ালার আন্দোলন। তিন ধারার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম একটি ধারাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর এক ধারাকে তো প্রায় হঠকারী বানিয়েই ছেড়েছে।

যদিও ইতিহাস গবেষণা নতুন মৌলিক গুণগত ধারার প্রক্রিয়াতেই চলছে। মাইক্রো ও ম্যাক্রো উভয় লেভেলেই। সেটা বুঝেই স্বাধীনতার লড়াইতে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা যারা করেছে, দালালি করেছে ইংরেজের সঙ্গে, তারাই নিজেদের হাত ধুতে নেমে পড়েছে।

এ দেশে আধুনিক ইতিহাস বিকৃতি তিন পর্বে। প্রথম জনতা সরকারের আমলে যখন ‘হেলেন অফ ট্রয়’র মতো জনসঙ্ঘ এবং আর এস এস’রা প্রশাসনে ঢুকে গিয়েছিল। তারাই পাঁচটা পাঠ্য বই, রেফারেন্স বই বাতিল করেছিল সরকারি নির্দেশ দিয়ে।  বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকে বাতিল করে সাম্প্রদায়িক ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়ার মতলব ছিল। হাসিল হলো না সরকার পাল্টে যাওয়ার ফলে। দ্বিতীয়টি ২০০০ সালে। এনডিএ সরকার। বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বস্তুনিষ্ঠ স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হবে ১০ খন্ডে। দু’খন্ড মুদ্রণ হয়ে গিয়েছিল। বাজপেয়ীরা ওই দু’খন্ডের প্রকাশ নিষিদ্ধ করে। আসলে ব্রিটিশরা নিজেদের দিকে ঝোল টেনে যে ‘ট্রান্সফার অফ পাওয়ার’ এর ইতিহাস লিখেছিল সেটাকেই সঙ্ঘীরা বজায় রাখতে চেয়েছিল। এবার তৃতীয় পর্ব ২০১৪ থেকে। বিজেপি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ইতিহাস বিকৃতির ঢালাও আয়োজন চলছে। বেইমানরা নিজেদের দেশপ্রেমীক প্রতিপন্ন করে তোলার আপ্রাণ প্রয়াস চালাচ্ছে। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পুনঃনির্মাণ চলছে গৈরিকখাতে, সাম্প্রদায়িকতার মিশেলে। রজনী পাম দত্ত এদেশের ব্রিটিশ শাসনকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। গোড়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ৫০-৬০ বছর। ১৭৫৭ থেকে ১৮১৩ সময়কাল অবধি। মহাজনী পুঁজির সময়কাল। উনবিংশ শতক ছিল শিল্পপুঁজির। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে লগ্নি বা বৃত্ত পুঁজি অর্থাৎ ফিনান্স ক্যাপিটালের বিকাশ ঘটছে ভারতে। ঔপনিবেশিক শোষণেরও চরিত্র বদলে যাচ্ছে এ কথার উত্থাপন এই প্রসঙ্গে যে পলাশীর যুদ্ধে জেতার পর মুর্শিদাবাদের অর্থাৎ তৎকালীন বাংলার রাজধানীর সম্পদ দেখার পর লর্ড ক্লাইভ বলেছিলেন –‘Murshidabad is richer than London’। সেই সময় বিশ্ব বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ এ'দেশ নিয়ন্ত্রণ করে। যা ১৯৪৭’র সময় চলে এল ২-৩ শতাংশে। সেই বাণিজ্যের সিংহভাগই ছিল কটন টেক্সটাইল, সিল্ক, হস্তশিল্প। এর মুখ্য এবং সিংহভাগে যুক্ত ছিল তথাকথিত নিম্নবর্গীয়রা- জাতের সিঁড়িতে যারা অনেক নিচে, সমাজের পিছনে- অন্ধকারে।

ব্রিটিশরা এদেশে আসার পর থেকেই সামাজিক সিঁড়িতে (Social ladder) নিম্নবর্গীয়দের আরো নিচে নামাতে শুরু করে। সেই ইতিহাসেরও রয়েছে আরেক প্রেক্ষাপট। ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থে বৃটিশদের দরকার ছিল ভারত সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের। অতীত, প্রথা, ধর্মীয় ঐতিহ্যসমূহ, আইন বিন্যাস প্রভৃতি। এদেশের ঐতিহ্যের নামে প্রাচীন গ্রন্থ অনুবাদ করালো তারা। যাদের দিয়ে করালো তারা ‘নেটিভ বিশেষজ্ঞ’। এরা সব উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ। খুবই স্বাভাবিকভাবে এরা প্রথম অনুবাদ করলো ‘মনুস্মৃতি’। এইভাবে ব্রিটিশদের ‘ভারতবীক্ষা’ করানো হলো। জাতিভেদ সম্পর্কে ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শ ব্রিটিশদের বোঝানো হলো। জাতিভেদ জাঁকিয়ে বসলো উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে। ১৮৯১’তে জাতপাত, ইসলাম ধর্ম শ্রেণীবদ্ধ করে জনগণনা হলো। সামাজিকভাবে যা প্রযোজ্য ছিল সেই জাতিভেদের অবস্থানকেই অনড় করিয়ে নেওয়া হলো সরকারিভাবে। জাতি আর জাতের সংযোগ ঘটলো। উঁচু জাতের লোকেরা আরও বলতে শুরু করলো যে তারা উন্নত জাতির প্রতিনিধি। তারা বলতে লাগল জাত হচ্ছে প্রকৃতির অংশ। এই সময় উচ্চবর্ণের আধিপত্য যেমন বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে দলিত নিম্নবর্গের আন্দোলনের গর্জন বাড়ছে। এই সময়ে যেমন জাতপাতের মাধ্যমে শোষণ হচ্ছে ঠিক তেমনি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে রাজনৈতিক জমায়েত হচ্ছে যাতে দলিত, নিম্নবর্ণ ,আদিবাসীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ রয়েছে। আরেকদিকে ব্রিটিশরা প্রাণপণে জাতপাতকে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিভাজন করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

শুধু প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধে চোখ ফেললেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন ঝালকারীবাই। ছোট জাতের পরিবারে জন্ম তার। কোরি জাতের এই মেয়ের পুঁথিগত লেখাপড়া ছিল না। সাধারণ পরিবার। অস্ত্র চালায়, আবার ঘোড়ার পিঠেও চড়তে জানে। ছোটবেলায় নিজের গ্রামে লড়তো বন্য জন্তুর সঙ্গে, গ্রামে যখন ডাকাত পড়তো তখন তাকে আটকানোর জন্য লড়াই করতো। এমন পরিচিতির জোরেই তিনি ঝাঁসির রানীর নজরে পড়েন। রানী তাকে নিজের মহিলা সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। ঝালকারির সঙ্গে লক্ষ্মীবাঈয়ের চেহারায় খুবই মিল ছিল। তাকেই কাজে লাগায় ঝালকারী। রানীর ছদ্মবেশে যুদ্ধে সে দায়িত্ব নেয় সেনাবাহিনীর। বিরোধী শিবিরে জানের পরোয়া না করেই সে প্রবেশ করে। দলিত মহিলার সেই সংগ্রামের ইতিহাসকে বলা চলে ‘মেঘে ঢাকা তারা’। মেঘ দিয়ে ঝালকারীবাইকে ঢেকেছেন কঙ্গনা রানাওয়াত। ‘মণিকর্নিকা- দ্য কুইন অফ ঝাঁসি’ সিনেমাতে। সেখানে কোথাও ঝালকারির সাহস, বীরত্বের কথা নেই। নিম্নবর্ণের স্বাক্ষরটুকু রাখেননি পরিচালক অঙ্কিত লোখান্ডে।

সিপাহী মহাবিদ্রোহে আরেক দলিত কথন উড়া দেবী আর মাক্কা পাসি। স্বামী-স্ত্রী যোদ্ধা দম্পতি, দলিত। এরা ২০০ জনের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লখনৌর কাছে নিহাটে। ব্রিটিশ সেনাদের হত্যা করে তারা। মাক্কা পাসি যুদ্ধে ব্রিটিশের গুলিতে নিহত হন। উড়া দেবী ছিলেন আওয়াধ মহিলা সেনাবাহিনীর সেনাপতি। তার সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল দলিত এবং নিম্নবর্ণের। যুদ্ধে নিহত হওয়ার আগেও ১২ জন ব্রিটিশ সেনাকে তিনি নিজেই হত্যা করেছিলেন।

আর একজন কুইলি। কমান্ডার ইন চীফ। শিবাগংগাই’র রাণীর। তামিলনাড়ুর দক্ষিণ অংশে রামানাথপুরমে সেই জায়গা। আমি প্রথম লড়েছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ১৭৮৩তে। যুদ্ধে শিবগঙ্গাই’কে রক্ষা করতে কুইলি প্রাণপণ লড়েন। শেষ অবধি প্রাণ বিসর্জন দেন। তার গুনমুগ্ধরা তাকে ‘ভীরথালাপথি’ অর্থাৎ সাহসী কমান্ডার বলে ডাকতো। তথাকথিত ছোট জাতে তার জন্ম হয়। তার বাবা রাণীর চর হিসাবে কাজ করতেন। তিনিই তাকে পরিচয় করান রানীর সঙ্গে। রানী তার সাহসের পরিচয় শুনে নিজের দেহরক্ষী হিসেবে তাকে নিয়োগ করেন। বেশ কয়েকবার তিনি রানীর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।

জওহরলাল নেহরু ‘কুইন অব দি নাগাস’ বলেছিলেন। আসল নাম রাণী গাইডিনলিড। জন্ম পশ্চিম মনিপুরে। উপনিবেশের রাজত্বকে অসহ্য বর্ণিত করে আওয়াজ তুলেছিলেন- কেন ট্যাক্স দেব? অন্যদেরও ক্ষেপিয়েছিলেন। আসাম- মনিপুর- নাগাল্যান্ড এই করিডরে সেনাদের মসৃণ যাতায়াত রুখতে চেয়েছিলেন। তার জন্য ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। তাকে গ্রেফতার করার জন্য ব্রিটিশরা স্পেশাল আসাম রাইফেলসের সেনাবাহিনী পাঠায়। পায়ে হাঁটিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে সুদূর কোহিমা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। তার সঙ্গীদের কারো জেল, কারো ফাঁসি হয়। তাকেও জেলে আটকে রেখে পচানো শুরু হয়। স্বাধীনতা আসার পরেই তার মুক্তি ঘটে। শেষ জীবনে পেছিয়ে পড়া অংশের মানুষদের মধ্যে তিনি কাজ করেন।

Dalits in india

দলিত, বহুজন, আদিবাসীদের এই মুক্তি সংগ্রামের যুদ্ধ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, স্থানীয় আঞ্চলিক স্তরের লড়াই, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই যা তাদের প্রান্তিকতা বা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল সেইসব ইতিহাসে উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে ঠাঁই পায়নি।

এ দেশে দলিতদের আন্দোলন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ত্রিমুখী ধারায় বয়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বের সম্মুখভাগে ছিল যারা তাদের বড় অংশ ছিল ভূস্বামী এবং বর্ণহিন্দু মত দ্বারা পরিচালিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমি সংস্কারের প্রয়োগে অনাগ্রহ তাকে আরও স্পষ্ট করেছে। সেই জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতৃত্বই নিম্নবর্নীয়দের ব্রাত্য করে রেখেছিল। কিন্তু সাঁওতাল বিদ্রোহ,স্বাধীনতার অজস্র ছোট-বড় লড়াই, সিপাহী বিদ্রোহ , বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে অসংখ্য দলিত, আদিবাসী মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তন্তুবায় বিদ্রোহ, নীল চাষীদের বিদ্রোহ, রেশম চাষীদের বিদ্রোহ, মালঙ্গী, লবণ শিল্পের বিদ্রোহ - এইসব বিদ্রোহ ছোট , কিন্তু প্রভাবের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্নবর্গীয়দের এই সব আন্দোলনে ঈর্ষনীয় অংশগ্রহণ। দ্বান্দ্বিকভাবে  পূর্বশর্ত হিসাবে সিপাহী বিদ্রোহের ক্ষেত্রে এগুলো ঘটেছিল। এমনকি সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পূর্বে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ সিপাহী বিদ্রোহে রূপান্তরের ভূমিকা নিয়েছে। স্ফুলিঙ্গ যদি দাবানল সৃষ্টি করে তবে দলিত, আদিবাসীদের বিদ্রোহ গাঁথা সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলবে কিনা এই প্রসঙ্গে বহুযুগ ধরে জর্জরিত দলিত, নিম্নবর্ণীয়, আদিবাসীরা সন্দিহান ছিল। তার কারনও ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হিসাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বেই অনাস্থা ছিল তাদের। কংগ্রেসে এক বড় অংশই ছিল উচ্চবর্ণীয়, ভূস্বামী এবং জাতপাতের গন্ডীতে আবদ্ধ। বাল গঙ্গাধর তিলক ছিলেন চিৎপাবন ব্রাহ্মণ। তিনি বলেছিলেন জাতীয়তাবাদী হওয়ার অন্যতম শর্ত বর্ণাশ্রম সমর্থন। জাত না থাকলে হিন্দু ধর্ম টিকে থাকত না। হিন্দু রাস্ট্রের একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে জাত। তিনি বলতেন অব্রাহ্মণদের লেখাপড়া তাদের ক্ষতিই ডেকে আনে। তিলক, লালা লাজপৎ রায় ইত্যাদিরা  হিন্দুরাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন। এমনকি তিলক ধর্মনিরপেক্ষতারও বিরোধী ছিলেন। সামাজিক অংশগুলির মধ্যে যে বহুমুখীনতা ছিল তাকে জাতীয়তাবাদের পক্ষে একমুখী করার অবস্থান কংগ্রেসের ছিল না। দলিতদের সংখ্যা এবং প্রভাব সমাজে কোনভাবেই উপেক্ষার নয়। এটা বুঝেই মহাত্মা গান্ধী এবং কংগ্রেস সবসময় চেষ্টা চালিয়েছে বিভিন্ন সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দলিতকে নিজেদের সঙ্গে রাখার। সে কারণেই মদনমোহন মালব্যকে সভাপতি করে কংগ্রেসকে অস্পৃশ্যতা বিরোধী কমিটি প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। দলিতদের অসন্তুষ্টি ও বিক্ষোভকে প্রশমণ করতেই সেই পদক্ষেপ। সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের পক্ষে চাপ তৈরি করতে দলিতদের সমবেত করতে হয়েছে।

Gandhi

মহাত্মা গান্ধী পৃথক ইলেকটোরেট এবং যৌথ ইলেকটোরেট দুটোরই বিরোধী ছিলেন। দলিতদের মেজাজ দেখে তিনি শেষ অবধি যৌথ ইলেকটোরেটে রাজী হলেন। তিনি নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন যাতে দলিতরা জাতীয় স্কুলে ভর্তি হয়। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। দলিত যখন বোঝে যে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কথা বললেও বর্ণভেদকে গান্ধী ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলেছেন- তখন তারা হতাশ হয়। গোলমাল বেঁধে যায় যখন গোল টেবিল বৈঠকে দলিতদের প্রতিনিধি হিসেবে ইংরেজরা আম্বেদকরকে আহ্বান করে। কংগ্রেস তার নিজের দলিত দুর্গকে স্থায়ী রাখতে সতর্ক হয়। দলিতদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।

হিন্দু মহাসভা, নিজেদের পক্ষে সমর্থন কমছে বুঝে হিন্দু রাষ্ট্রের শ্লোগানে নেমে পড়ে। যে আরএসএস ব্রিটিশদের মিত্র আর মুসলমানদের শত্রু বিবেচনা করেছিল স্বাধীনতা পর্বে তারাও গলা মেলাচ্ছে যে দলিতদের নাকি স্বাধীনতা আন্দোলনে কোন ভূমিকা নেই।

ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে ভেঙে পড়া সাভারকার এবং বাজপেয়ীর দিকে চেয়ে থাকলে এরকমই ভাবার কথা।

মনুবাদই সেই রাস্তা দেখাচ্ছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন