পক্ষ নিন প্রকাশ্যে - বাবাই সাহা

তৃতীয় পর্ব

পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতিতে হিন্দুত্ববাদ প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈদিক, বেদাঙ্গ, জ্যোতিষ পড়ানো ইত্যাদিতে ধর্মীয় বিভাজন ও হিন্দুত্ববাদকে বাড়াতে সহায়ক হবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আসলে মূল্যবৃদ্ধি সহ দৈনন্দিন সামাজিক সমস্যা, নাগরিকের প্রতিদিনের চাহিদা যা সংবিধানে উল্লিখিত আছে তা পূরণ করতে না পেরে, সেখান থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে জাতপাতের নামে ভোট ব্যাঙ্ককে রক্ষা করতে হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িকতার শক্তি বৃদ্ধির পথ প্রশস্থ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে RSS পরিচালিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে ব্যবহার করে আর.এস.এস ২০২৫সালে তার শতবর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে হিন্দুনেসকে প্রচার করার মাধ্যমে দেশজুড়ে বিভিন্ন উগ্রহিন্দুত্ববাদী কর্মসূচির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। দেশজুড়ে আর. এস এস-এর বর্তমান শাখার সংখ্যা ৫৬,৮২৪ থেকে বাড়িয়ে আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ (এক লক্ষ) করার পরিকল্পনা নিয়েছে। পাশাপাশি আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে মন্ডল স্তরে এবং শহরাঞ্চলে ওয়ার্ড স্তরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করেছে।


পশ্চিমবঙ্গে আর.এস.এস-এর বর্তমান শাখার সংখ্যা ১,৯০০ থেকে আগামী ২বছরে শাখা বাড়িয়ে ৩০,০০০টি শাখার লক্ষ্য নিয়েছে সংঘ। এই লক্ষ্যেই পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন সংঘ চালক মোহন ভাগবত। সাচ্চা দেশপ্রেমিক ভেকধরে সারা বাংলায় ছড়িয়ে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামের অখ্যাত বা স্পল্পখ্যাত বীর নায়কদের ভূমিকা, প্রতিষ্ঠান ও স্থানগুলিকে আবিষ্কার করে জাতীয়তাবাদী জিগির তুলে এবং ধর্মের আস্ফালনের মাধ্যমে জনগণের মধ্য তথা মূল টার্গেট তরুণদের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ বছর বছর বাড়তে থাকা তারকেশ্বরে জলযাত্রীদের সংখ্যা বা সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, সর্বত্র ধর্মীয় নির্ভরশীলতার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে সমাজের খেটে খাওয়া গরীব শ্রমজীবী অংশ এবং ১৮-৩০বছরের যুবক-যুবতিদের, যারা সংসদীয় রাজনীতিতে মূল ভূমিকা পালন করে।

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখেই অন্যান্য অ্যাজেন্ডার সাথে ‘একদেশ, এক আইন’-এর নামে নতুন করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড পরিবর্তনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার এবং নির্দেশমূলক নীতির মধ্যে ভারসাম্য না রেখে নিরঙ্কুশ প্রাধান্যর মাধ্যমে সংবিধানের সম্প্রীতি নষ্ট করছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। বর্তমানে বিশ্বের ১৬৩টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থানের আসল তথ্য কেন্দ্রের সরকারের ‘আচ্ছে দিন’-এর যে মিথ্যা প্রচার চলছে, তার আসল চেহারাকে সামনে এনে দিচ্ছে। তথ্য বলছে মানব উন্নয়নে ১৩২নং, খাদ্য সুচকে ১০৭নং, সুখ সূচকে ১২৬নং, মানব স্বাধীনতা ১১৯নং, বাচ্চাদের অধিকারে ১১৩নং, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় ১৬১নং, শান্তি সূচকে ১৩৫নং, বাসযোগ্যতা সূচকে ১৪১নং, আর্থিক স্বাধীনতায় ১২১নং, পরিবেশগত কর্মক্ষমতায় ১৮০নং, যুব উন্নয়নে ১২২নং, নির্বাচনী গণতন্ত্রে ১০৮নং, বৈষম্য কমানোয় ১২৩নং, সামাজিক উন্নয়নে ১১০নং স্থানে রয়েছে আমাদের দেশ।

চতুর্থ পর্ব

এমতবস্থায় বিজেপি-তৃণমূল উভয় সরকারের প্রতিদিনের ছলচাতুরী, বঞ্চনা, দুর্নীতি, কর্মসংস্থানহীণতা, আর মানুষের জোটবদ্ধ আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে এসে, দেশের সংবিধান রক্ষা-রুজি-রুটি-হকের অধিকারের লড়াইতে দেশ ও রাজ্যের রাজনীতিতে ক্রমশ উৎসাহ বাড়ছে বামপন্থীদের ঘিরে, মানুষের আস্থা ফিরছে লাল ঝান্ডায়। সংসদীয় রাজনীতিতে পশ্চিমবাংলায় শূন্য থেকে বামপন্থীদের গ্রাফ ক্রমশই উপরের দিকে উঠছে। এই পরিস্থিতিকেই আড়াল করতে রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল ও বিজেপির বাইনারি তৈরি করে প্রচারের কাজে ব্যস্ত রাজ্যের মিডিয়াগুলি, শাসকের দুর্বলতা-ত্রুটি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে বাম বিরোধী বিভিন্ন খবর তৈরি করা হচ্ছে। হার নিশ্চিত জেনেও প্রতিটা নির্বাচনের আগে কোটি কোটি টাকার বিনিময় শাসকের পক্ষে গড়া প্রি-পোল সমীক্ষার মাধ্যমে প্রভাবিত করা হয় জনগণকে। প্রতিদিন তৃণমূল এবং বিজেপি কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন কোম্পানি ও তাদের নিজস্ব আইটি সেল দিয়ে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজ করে চলেছে।

গণতন্ত্র প্রিয় ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষের স্বার্থে বাংলার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে আমাদের অবস্থান পরিস্কার, এরাজ্যের বাস্তবতা অনুযায়ী তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে সমান ভাবে আমাদের সমস্ত লড়াই চলছে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। আইনি লড়াইতেও পার্টি লড়ছে আজ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। যে পথে পার্টি আছে, ধৈর্য্য ধরে সেই পথে হাল ধরে থাকতে হবে। ধৈর্য ধরে সতর্কতার সাথে কাঁটা বেছানো পথ অতিক্রম করে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। রাজ্যের গত ১২-১৩বছরের অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে সাধারণ শ্রমজীবী (শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর) মানুষের ঐক্যকে আরও শক্তিশালী করে ছাত্র-যুব-মহিলাদের অগ্রণী বাহিনীতে এনে সাম্প্রদায়িক শক্তি, লুঠেরা, দুর্নীতিবাজদেরকে পরাস্ত করতে হবে, সমূলে উৎখাত করতে হবে। রাজ্য থেকে তৃণমূলকে উৎখাত না করতে পারলে আর এস এস কে উৎখাত করা যাবেনা (উল্লেখ্য স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবাংলায় আর এস এস একটাও সভা করতে পারে নি), পাশাপাশি কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে উৎখাত না করতে পারলে বঙ্গে বামপন্থাকে আটকাতে তৃণমূলের জমি শক্ত করবে বিজেপি। স্বাধীনতার আগে থেকে আজ পর্যন্ত যেভাবে দেশের জনগণের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রথম সারিতে থেকেছে বামপন্থীরা, ভবিষ্যতেও এই ধারা বজায় রাখতে হবে আমাদের। সাগরদিঘি মডেলকে আরও শক্তিশালী করে বাম, বৃহত্তর বাম, কংগ্রেস, আই.এস.এফ ও গণতন্ত্র প্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ সকল (তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী) শক্তির বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে জনগণকে সাথে নিয়ে জনসংযোগের নিবিড় সেতুবন্ধন করতে হবে আমাদের। সংখ্যার জোরে পাস করিয়ে নেওয়া বিভিন্ন জনবিরোধী বিল-আইনের বিরুদ্ধে নিবিড় প্রচার চালাতে হবে। মতাদর্শে শাণ দিয়ে এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে RSS-এর বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে মিডিয়ার বাইনারির বিরুদ্ধে, আকাশছোঁয়া অস্বাভাবিক দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদেরকে বেশি বেশি করে প্রচার করতে হবে- আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভুমিকা নিয়ে। পাশাপাশি তুলে ধরতে হবে- স্বাধীনতা আন্দোলনে সাভারকার বাহিনী তথা সঙ্ঘ পরিবারের ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দেওয়া ইত্যাদি, সত্যাগ্রহ-আজাদ হিন্দ ফৌজ-নৌবিদ্রোহ-অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধীতা-দেশভাগ সহ গান্ধী হত্যাকারী আর.এস.এস-এর ভুমিকা নিয়ে। দিকে দিকে গড়ে উঠা মানুষের প্রতিরোধের প্রাচীরকে আরও মজবুত করতে হবে। আমাদের বিরুদ্ধে সমস্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আসল সত্যকে মানুষের সামনে জোরের সাথে তুলে ধরতে হবে। আমাদের বিকল্প নীতি, বিকল্প কথা, বিকল্প ভাবনাকে আরও বেশি বেশি করে বুথ স্তরের সমস্ত জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। পার্টির স্বার্থে সচেতনতার সাথে সক্রিয় ভাবে সামাজিক মাধ্যমের নানান ধারাকে কাজে লাগিয়ে ক্রমাগত এই কাজেই আমাদের মনোনিবেশ করে যেতে হবে।

লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, ততই বাড়বে উগ্র মৌলবাদী ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ যুদ্ধ জিগীর। সমস্ত রকম গুজবে চোখ-কান খোলা রেখে সতর্ক ও সক্রিয় ভাবে সত্যের পক্ষে থাকতে হবে। বহু বছরের চলিত প্রথা ও কুসংস্কারকে দূর করতে বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে এবং চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। গড়ে তুলতে হবে জোরদার বিজ্ঞান আন্দোলন, অভ্যাসে পরিণত করতে হবে পাঠচক্রকে। প্রতনিয়ত আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য। রেড ভলেন্টিয়ার থেকে পাহারায় পাবলিক- সর্বত্র সক্রিয় থাকতে হবে। দৃঢ় বিশ্বাস আমরাই পারবো, এই লড়াই আমাদের জিততেই হবে, আর আমরাই জিতবো।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন