প্রথম পর্ব
দেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অটুট রাখতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে বিজেপি বিরোধী ২৬টি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’ সংক্ষেপে ‘ইন্ডিয়া’-তে সি পি আই এম-এর উপস্থিতি নিয়ে মিডিয়া এবং আর.এস.এস-বিজেপি-টি.এমসি-র আইটি সেলের সুকৌশলে প্রচারিত ভাষ্যের (এ রাজ্যের গণতন্ত্রকে ধ্বংসকারী তৃণমূলকে একসাথে নিয়ে সিপিআই(এম) জোটে যাবে কেন) ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই ওদের প্রচারে গা ভাসালেও শুরুর দিকে এই অপপ্রচারের যতটা নেতিবাচক প্রভাব ছিল আমাদের অবস্থান সম্পর্কে, দিন দিন তা শিথিল হচ্ছে, সারা দেশের প্রেক্ষিতে বাংলার মানুষ আসল সত্য এবং পরিস্থিতিকে অনুধাবন ও উপলব্ধি করতে পারছেন। বিজেপি বিরোধী ঐক্য মঞ্চে পার্টির নেতৃত্বদান ও সক্রিয় অংশগ্রহণে চুরমার হয়ে গেল আর আর.এস.এস-বিজেপি-টি.এমসি-র পরিকল্পিত হেডলাইন- বিজেপি বিরোধী ঐক্য ভাঙল সি.পি.আই(এম)/ কমিউনিস্টরাই বিজেপির এজেন্ট/ বামেরা বিজেপির সুবিধা করে দিল/ বামেরা বিজেপির বি-টিম/ তৃণমূলকে আটকাতে বিজেপিকে মদত বামেদের/ বিজেপির জয়ের পথ মসৃণ করলো বাম/ বা সবশেষে ‘রাম-বাম জোট’/ দিল্লীতে দোস্তি, বাংলায় কুস্তি- ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতদিন ধরে যে মেইনস্ট্রীম মিডিয়াগুলি বামেদের ‘শূন্য’বলে প্রচার করত, দূরবীন দিয়ে খোঁজার উপমা ব্যবহার করতো, রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপি এই বাইনারিতেই আটকে রাখার চেষ্টা করছে, তারা এখন খুব দুশ্চিন্তায় আছে। কারণ, তাদের মালিক আর.এস.এস.-বিজেপি-তৃণমূলকে ভয়ে পেয়েছে। আসল কারণ হল- কোটি কোটি টাকা খরচ করে মিডিয়ায় দিনের পর দিন বাম বিরোধী মিথ্যা ভাষ্য তৈরি করা, আগাম পরিকল্পনা করে হঠাৎ পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা করা, আর এস এস পরিচালিত তৃণমূল-বিজেপির বোঝাপড়া, পুলিশ প্রশাসন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্যপাল থেকে শুরু করে জেলা শাসক, মহকুমা শাসক, বিডিও, ভোট গণনার দায়িত্বে থাকা সরকারী আধিকারিকদের একটি গভীর বোঝাপড়া, অবাধ লুঠ, ছাপ্পা, ব্যাটল বাক্স বদল, বিরোধীদের ব্যালট ফেলে দেওয়া, খুন- সন্ত্রাস-ঘরছাড়া সহ ভোট কুশলী এজেন্সিকে ব্যবহার করেও বামেদের সাফল্যকে আটকাতে পারলো না, ২০২১ এবং ২০২২-এর তুলনায় বামাদের ভোট শতাংশ বাড়ল, বিজেপির ভোট শতাংশ কমে গেল।
ভাতা-উপঢৌকনের রাজনীতির পরেও সংখ্যালঘু ভোটের একটা ভালো অংশ বাম-কংগ্রেস-আই.এস.এফ-এর ঝুলিতে এল। আবারও প্রমাণ হয়ে গেছে ভোট লুট না করলে তৃণমূল এবং সাম্প্রদায়িক হিংসা-ধর্মীয় উস্কানি না ছড়ালে বিজেপি জিততে পারবে না। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়ই একই কায়দায় পরিকল্পনা করে সংবিধান, সামাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাক্ষেত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সম্প্রীতি, বাক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের অধিকার- প্রতিমুহূর্তে আক্রমণ নামিয়ে আনছে জনগণের উপর, শাসকের কোপ পড়ছে সর্বত্র। বাড়ছে বেসরকারিকরণ, মৌলবাদী প্রবণতা ও ফ্যাসিস্ট কায়দায় আক্রমণ। কর্মসংস্থানের জন্য নতুন শিল্প নয়, শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক মন্দির তৈরির কার্যকলাপ। লুঠ হচ্ছে দেশের খনিজ সম্পদ, জাতীয় সম্পদ। যেখানেই শাসকের বিরোধিতা করা হয়, সেখানেই মুখ বন্ধের চেষ্টা হচ্ছে। প্রতিদিন নানা ভাবে নিজের অধিকার থেকে, বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। চাকরি দুর্নীতি, আবাস যোজনায় দুর্নীতি, ধর্ষণ, খুন, শাসক দলের নেতাদের চুরি-দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া-- সব মিলেমিশে আজ এক অরাজকতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আয় ও কর্মের সংস্থান সংকুচিত করে জনসংখ্যার বিরাট অংশকে অনুদান নির্ভর রেখে বেকার যুব বাহিনীকে সংগঠিত ভাবে মৌলবাদী ও ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপে ব্যবহার করার কাজ চালানো হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনের অভ্যন্তরে নিজেদের ইউনিয়ন এবং নিজেদের লোক শিক্ষাঙ্গনের মাথায় বসানোর জন্য দিল্লী থেকে কোলকাতা, সর্বত্র তৃণমূল-বিজেপির বোঝাপড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদিকে সিনেমার গেরুয়া বিকিনিতে তোলপাড় হচ্ছে দেশ, মাটির তৈরি নারীকে দেবি বলে পুজা করা হচ্ছে, অন্যদিকে জীবন্ত নারীকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় ঘোরানো হচ্ছে। ইন্টারনেট পরিষেবাকে ব্যহত করে সমস্ত দোষকে ঢেকে রাখার প্রবণতা চলছে। জয় শ্রীরামের স্লোগান তুলে লাভ জিহাদের নাম করে খুন-সন্ত্রাস চলছে।
দ্বিতীয় পর্ব
২০১৪ সালে মাত্র ৩১শতাংশ ভোট পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় এসেছিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি, যারা আর.এস.এস.-কে আদর্শিক অভিভাবক বলে গণ্য করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাদেরকে অনুসরণ করে চলে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও আর.এস.এস-এর প্রচারক ছিলেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদী বহু কর্মসূচির প্রশ্নে দেশ ক্রমশ এদের (একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে আসার ফলে) আগ্রাসী চেহারা দেখতে পাচ্ছে। একদিকে তারা কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থবাহী অর্থনৈতিক নীতি নিচ্ছে, অন্যদিকে ধর্মীয় স্বার্থ রক্ষার ধুয়ো তুলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভেকধারি সংগঠন রূপে হিন্দুত্ব-র ব্যানারে হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে (২০২৫সালে সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার ১০০বছরের কর্মসূচি হিসাবে) অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্থলে রাম মন্দির নির্মাণ, ভাগবত গীতাকে ‘রাষ্ট্র গ্রন্থ’ ঘোষণা, গরুকে ‘জাতীয় পশু’ বা ‘রাষ্ট্র মাতা’ হিসেবে ঘোষণা করা, গরু–নিধনকে নিষিদ্ধ করা, এমনকি গো হত্যা করার সাজা হিসাবে ফাঁসি দেওয়ার পুরনো দাবি তারা ঝুলি থেকে এক এক করে বার করছে। বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনের আগে তারা এই দাবিগুলি তুলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে কোথাও কোথাও সফলও হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি তথা- যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, নাগরিকের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, সংসদীয় শাসনব্যবস্থা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সার্বজনীন ভোটাধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে মধ্যযুগীয় বর্বরতা, মনুবাদ ও ধর্মকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে কেন্দ্রের সরকার। প্রতিদিন লুণ্ঠিত হচ্ছে সংবিধানের অধিকার, সংবিধানে উল্লিখিত প্রতিটা শব্দ। উগ্র হিন্দুজাতীয়তাবাদের সঙ্কীর্ণ রাজনীতির প্রতিফলনের মাধ্যমে ভারতের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, নৃত্যকলা, সংগীত, লোকনাট্য, স্থাপত্যশৈলী, চিত্রকলা, বিবাহবন্ধন, খাদ্যাভ্যাস ও পোষাকপরিচ্ছদের উপর আক্রমণের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলছে সর্বত্র। দেশের সমস্ত সম্পদ নির্বাচিত গুটিকয়েক অনুগামী পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিতে মানুষের জোটবদ্ধ আন্দোলনে ফাটল ধরাতে, মানুষকে বিভক্ত করতে ধর্মের নামে ত্রিশূল-তলোয়ারের ভাবাবেগকে সুড়সুড়ি দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাঙ্কে গচ্ছিত জনসাধারণের হাজার হাজার কোটি টাকা নীরব মোদি, মেহুল চোকসি প্রমুখ বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া ও তাদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হচ্ছে। নোটবন্দি, মনিপুর-হরিয়ানা-উত্তর প্রদেশ সহ বিভিন্ন রাজ্যে নক্কার জনক ঘটনা, বুল্ডোজার পলিটিক্স, প্রগতিশীল যুক্তিবাদী লেখক–সাংবাদিক হত্যা, দ্বিমত পোষণ করলে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা, সি.এ.এ-এন.আর.সি-এন.পি.আর, নির্বাচনী সাফল্যের জন্য পুলওয়ামা-সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করা হচ্ছে। নির্বাচিত জয়ী সরকারকে পেছন দরজা দিয়ে ফেলে দিয়ে হর্সট্রেডিং এর মাধ্যমে বিজেপির পক্ষে সরকার গঠন করা, বাছাই করা কিছু অনুগ্রহপ্রার্থী দেশি–বিদেশি পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধির বিকৃত ও অবৈধ প্রচেষ্টা, সংখ্যার জোরে রাজ্য সভা এবং লোকসভায় বিভিন্ন জনবিরোধী বিল পাস করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন ইতিহাসকে বিকৃত করা, ১৫লক্ষ টাকা প্রতি অ্যাকাউন্টে দেওয়া এবং বছরে ২কোটি বেকারের কর্মসংস্থানের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বদলে নতুন নতুন স্ট্যাচু উদ্বোধন, বিভিন্ন স্থান-সংস্থার নাম বদল, বিদেশ সফরে গিয়ে মিথ্যা ভাষণ, শ্রমিক কর্মচারীদের হকের অধিকার হরণ, ইতিহাসের পাতা থেকে দেশগঠনের অবদানকারীদের অস্বীকার করতে নাম পরিবর্তনের পদক্ষেপ করা হচ্ছে। এই সব মিলিয়ে সারা দেশে এখন নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকারের ভাবমূর্তির পারদ নিম্নমুখী।
এই অবস্থায় ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে তারা আবার সাম্প্রদায়িক জিগির তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একদিকে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে, অন্যদিকে আর.এস.এস-এর সংখ্যালঘু সেলের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনী বিভিন্ন সভায়, নানা সাংবাদিক সম্মেলনে, পার্লামেন্টের ভাষণে নিজেদেরকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসাবে বিভিন্ন ধরণের বক্তব্য রাখছে আর.এস.এস-এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নেতারা। দেশের নতুনসংসদ ভবন উদ্বোধনে দেখা গেল দেশের জ্ঞানীগুণী বিশিষ্টজন ও রাষ্ট্রপতিকে বাদ দিয়ে বেশি গুরুত্ব পেল সাধু, সন্ন্যাসী, মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞ, হোম ইত্যাদি। ২০২৩-এ দাঁড়িয়েও সরকারী কাজের দপ্তর সংসদ ভবনে ধর্মীয় রীতিনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ হিন্দুত্বের প্রাধান্য প্রতিফলিত হল, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য খুব বিপজ্জনক।
নিবন্ধটি ৪টি পর্বে প্রকাশিত...