পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে সারা রাজ্য চলছিল তীব্র খাদ্য সংকট। তার ওপর মূল্যবৃদ্ধির দাপট। সরকারি সংগ্রহব্যবস্থা ছিল না, ছিল না রেশন সরবরাহের নিশ্চয়তা। বামপন্থী ফ্রন্টের ডাকে জুন মাসে হলো সাধারণ ধর্মঘট। বর্ষার শেষে খাদ্য পরিস্থিতির আরও অবনতি হল। তিন পর্যায়ের আইন অমান্য কর্মসূচী চূড়ান্ত হয়। রাজ্যব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে জেলায় জেলায় আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের আইন অমান্য আন্দোলন। দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হলো ২০শে অগাস্ট- চলল ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ পর্যায় শুরুর আগেই নেতৃত্ব গ্রেপ্তার হন। ১৮ই অগস্ট বসুমতীর সংবাদ: "১৫ জন বামপন্থী বিধায়ক গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তার হয়েছেন নিরঞ্জন সেন, বিনয় চৌধুরী, ভবানী সেন, গণেশ ঘোষ, মনোরঞ্জন রায়, সমর মুখার্জি, বিশ্বনাথ মুখার্জি, রবীন মুখার্জি, গোপাল বসু, যতীন চক্রবর্তী, নীরেন ঘোষ, প্রশান্ত সুর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ১৯শে আগস্ট রাত ৮টায় পুলিশ কমিউনিস্ট পার্টি রাজ্য দপ্তরে তল্লাশি চালায়। জ্যোতি বসু এবং চিত্ত বসুর বাড়িতে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে তাঁদের পায়নি।" জ্যোতি বসু আসাম-মণিপুরে সভা করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ২৫শে অগাস্ট বিবৃতি দিলেন: "বিনা বিচারে আটক করার জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হইয়াছে। অবশ্য আমি বারবার সরকারি নির্দেশ অমান্যকারী খাদ্য চোরদিগকে এবং উহাদের পৃষ্ঠপোষক মন্ত্রী শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে গ্রেপ্তার করার আবেদন জানাইয়া বিফল হইয়াছি।" ২৭শে অগাস্ট আনন্দবাজারের সংবাদ: "সারা রাজ্যে গ্রেফতার ৬৪০৮ জন। সমস্ত নেতৃবৃন্দই গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তার হয়েছেন নিবর্তনমূলক আটক আইন বা নিরাপত্তা আইনে। বিনা বিচারেই তারা কারারুদ্ধ। বহু নেতাই আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন সংগঠিত করেছেন।"
৩১শে আগস্ট
মনুমেন্ট ময়দানে(শহীদ মিনার) অনুষ্ঠিত হয় বিশাল সমাবেশ। সমাবেশ শেষে আইন অমান্যের জন্য মিছিল এগিয়ে চলে। এসপ্ল্যানেড ইস্টে (সিধু কানু ডহর) পুলিশ মিছিলে গতিরোধ করে। প্রথম দফায় গ্রেপ্তার হবার পর দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হতে গেলেই আক্রমণ। পরেরদিন স্টেটসম্যান পত্রিকায় লিখছে; "পুলিশ ইচ্ছা করিয়াই তাহাদের বেষ্টনীর মধ্যে ফাঁক রাখিয়াছিল।" বসুমতীর সম্পাদকীয়তে আরও স্পষ্ট করে লিখেছে, "ঐ ফাঁকটি আসলে ফাঁদ। জনতাকে অগ্রসর হতে প্রলুব্ধ করার জন্যই ফাঁক রাখা হয়েছিল, যাহাতে সুযোগমতো পুলিশ তাহাদের পেটাইতে পারে। এরপর বীভৎস পুলিশি তান্ডব ধর্মতলার বিস্তীর্ণ এলাকায়। ৮০ জন নিহত- হাজার হাজার আহত। প্রতিবাদে পরের দিন ধর্মঘটী ছাত্রদের মিছিল। এদিনের ঘটনায় যুগান্তর লিখছে; "মিছিলের সম্মুখভাগ ডাক্তার রায়ের বাড়ি (মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়)ছাড়াইয়া গেলে একদল পুলিশ প্রিন্সেপ স্ট্রিট হইতে বাহির হইয়া আসিয়া মিছিলটি তাড়া করে।… লাঠি চালাইতে চালাইতে ছাত্রদের পিছু ধাওয়া করে।" দুইদিনই দেখা গেল বিনা প্ররোচনায় পরিকল্পনামাফিক আক্রমণ। স্বাধীনতা পত্রিকা ২রা সেপ্টেম্বর লিখছে; "১লা সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় ঘরের দরজা বন্ধ করার সময় ১৮৫ বহুবাজার স্ট্রিটের সুধাকর মন্ডল এবং তার শিশুপুত্র চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র মেঘনাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।" হিংস্র আক্রমণের চেহারা ছিল এমনই।সেদিনের সঙ্কট পরবর্তী পরিবর্তন
সরকারি নীতির ফলেই ছিল খাদ্য সংকট। জোতদারদের নির্মম অত্যাচার ছিল কৃষকের ওপর। স্বাধীনতার পর তারাই হল শাসক দলের নেতা। কৃষক জমি পেলো না। খাদ্যের মজুতদারি চলত অবাধে। স্বাধীনতার এক যুগ পরে কৃষকের মোহমুক্তির বহিপ্রকাশ ঘটল এ আন্দোলনে। পরিণতিতে শাসকশ্রেণীর বিচ্ছিন্নতা শুরু হলো। '৬৬-র গণসংগ্রাম সে বিচ্ছিন্নতাকে যথেষ্ট বৃদ্ধি করে। তারপর ২০১১ পর্যন্ত কখনও শাসকশ্রেণী এই রাজ্যে জয়ী হতে পারেনি। মাঝে ছিল '৭২-এর জালিয়াতি পর্ব। '৬৭-র পরিবর্তনে জমির লড়াই ছড়িয়ে যায়। রাজ্যব্যাপী রাজ্যের মানুষ পেলো নতুন স্বাদ। রাজ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্য হলো পরিবর্তিত। এরপর প্রতিক্রিয়ার দীর্ঘ নির্মম আক্রমণের পর বামফ্রন্ট সরকার। জোতদারদের কর্তৃত্ব শেষ। জাগ্রত গ্রামবাংলায় মজুতদারী ছিল অসম্ভব। খাস ও বেনাম জমি গরিবের হাতে, বর্গা অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া সেচ ব্যবস্থার বিপুল প্রসার। ফলে সারা দেশে যখন কৃষি উৎপাদন কমেছে, এখানে তখনো বৃদ্ধি অব্যাহত। তাই খাদ্য সংকটের বিষয় এখানে অবান্তর।বর্তমান পরিস্থিতি ও গণসংগ্রাম
দেশের চরম প্রতিক্রিয়ার শক্তিরাই শোষকশ্রেণীর আশীর্বাদধন্য। রাজ্যেও শাসকদের হিংস্র অংশটিই ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত। ফলে খাদ্য ও মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা ক্রমশ গভীরতর হচ্ছে। এ সমস্যায় বিপন্ন গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত অংশ। তারাই জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ। মানব উন্নয়ন রিপোর্টে দেখা যায় অপুষ্টির কবলে পৃথিবীর মানুষের অধিকাংশই রয়েছে ভারতবর্ষে। বিপরীতে এদেশে ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ১০০ কোটির বেশি সম্পত্তি '১৮-'১৯ এ ৭৭ টি পরিবার থেকে '২০-'২১ সনে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২৩৬টি পরিবারে। পিকেট্টির তথ্য অনুযায়ী '৮২ সনে ১% মানুষের কাছে যেত জাতীয় আয়ের ৬%। '১৩-'১৪ সনে তাদের অংশ দাঁড়ায় ২২ শতাংশে। ফলে খাদ্যগ্রহণ থেকে শুরু করে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই সংকট। পুষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের দেশ পৃথিবীতে ১২৭ তম স্থানে। সাম্প্রতিক কৃষি আইনেরর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের সংকট গভীরতর হবে। গুদামের খাদ্য পচবে- মানুষ খেতে পাবে না। ছয় দশক আগের তুলনায় মূল্যবৃদ্ধির দাপট বেড়েছে। এ উপদ্রবের হোতাও সরকার। বর্তমান বছরে প্রত্যক্ষ কর ৫ শতাংশের বেশি কমিয়ে পরোক্ষ করকে বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষকে দিতে হবে। প্রত্যক্ষ কর সাধারণত ধনীদেরই দিতে হয়। তাই এ করের অনুপাত কমানো হয়। অপর একটি পথ পেট্রোল-ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ট্যাক্স চাপিয়ে দেড় লক্ষ কোটি টাকার বেশি বোঝা চাপাচ্ছে জনগণের উপর। তাছাড়া আংশিক তেল রপ্তানি করার জন্য সবটার উপর উৎপাদন শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে আম্বানিরা। বিদেশে শোধনের ব্যয় চার টাকা লিটার প্রতি। অথচ এখানে ৪ টাকাই আদায় করা হচ্ছে জনগণের থেকে। অর্থাৎ অকারণে তেলের দামের সাথে বিপুল অর্থ মানুষের কাছ থেকে আদায় হচ্ছে। আম্বানিদের বাড়তি আয় হচ্ছে ৩৫০০ কোটি টাকা। ছয় দশক মানুষের বাঁচার প্রয়োজনে বামপন্থীদের নেতৃত্বে সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে। যা রাজ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করে। আজ, পুঁজির লুঠ অনেক প্রসারিত। জীবনযাত্রা কঠিনতর অবস্থায়। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরে সাম্রাজ্যবাদ নতুন পথে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের উপর আক্রমণ তীব্রতর করে বর্তমান সংকট তৈরি করেছে। সমাধানের কোনো পথ তাদের নেই। শ্রেণীসংগ্রাম তীব্রতর করেই মানুষকে বাঁচাতে হবে। সারা পৃথিবীতে সংগ্রাম চলছে। সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেই সংগ্রাম এগোবে। সেদিনের সংকটের বিরুদ্ধে বিকল্প নীতির ভিত্তিতে সংগ্রাম এগিয়েছিল। আজও পুঁজিবাদের বিকল্প আরও অনেক বেশি জরুরী হয়ে উপস্থিত। সংগ্রামের পথপরিক্রমা কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবিলায় সক্ষম হবে।