গত ৩ জানুয়ারি কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে গনশক্তি পত্রিকার ৫৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে বক্তৃতা করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত। তার সেই বক্তব্যের সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ চারটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। আজ তারই প্রথম পর্ব।
দক্ষিণপন্থার প্রসঙ্গ উঠলেই সাধারণত যা মাথায় আসে আমি প্রথমেই সেই বোঝাপড়ার বিষয়ে একটা কথা স্পষ্ট করতে চাইব। আমরা সবধরনের দক্ষিণপন্থার কথা আদৌ আলোচনা করছি না। আমরা উগ্র দক্ষিণ পন্থী রাজনীতির বিপদ প্রসঙ্গে আলোচনা করব। মানুষের সমাজে দক্ষিণ পন্থা প্রথম থেকেই ছিল, এখনও আছে। কিন্তু উগ্র দক্ষিণ পন্থা বলতে আরো কিছু নির্দিষ্ট করে বুঝতে হবে। সাবেক দক্ষিণপন্থা বলতে মূলত রক্ষনশীল রাজনৈতিক শক্তিকে চিহ্নিত করা হয়। আজকের পৃথিবীতে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি একে উগ্র দক্ষিণপন্থা কিংবা অতি দক্ষিণ পন্থার উত্থান হিসাবেই বিবেচনা করা উচিত। গত বছর কন্নুরে আমাদের পার্টির ২৩ তম কংগ্রেস আয়োজিত হয়েছে। ২০১৮ সালে হায়দ্রাবাদে আমরা ২২তম কংগ্রেসে মিলিত হয়েছিলাম। সেইবারেই পার্টি কংগ্রেসের আলোচনায় দুনিয়াজুড়ে উগ্র দক্ষিণ পন্থার উন্মেষের বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৮ সালের পরে গত বছরের পার্টি কংগ্রেসে আমরা বলেছি সারা পৃথিবীতেই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান জারী রয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে বুঝতে হবে। সাবেক রক্ষনশীল দক্ষিণ পন্থার সাথে একে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না।
সাবেক দক্ষিণপন্থা সমাজে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেই সন্তুষ্ট ছিল। শাসক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থকে অটুট রাখাই ছিল তাদের একমাত্র কর্মসূচি। আজকের দক্ষিণপন্থা সেই কর্মসূচিতে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। উগ্র দক্ষিণপন্থা গোটা পৃথিবী জুড়ে মানুষকে আরো আরো বেশি দক্ষিণ পন্থী রাজনীতির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছে। সেই অভিমুখ প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের দিকেই সন্নিবিষ্ট রয়েছে। এমন কর্মসূচিকে আমরা উত্তর সত্য (পোস্ট রিজন) নির্ভর উগ্র কিংবা অতি দক্ষিণপন্থী বলছি কেন? বলছি কারন উগ্র দক্ষিণ পন্থা আজকের দিনে আর শুধু রাজনৈতিক প্রবণতা মাত্র নয়। বেশ কয়েকটি দেশে এরা নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এরা নির্বাচনে শুধু লড়াই করছেন এমনটা না, নির্বাচনে তারা জয়ী হচ্ছেন এমনকি সরকার অবধি গঠন করতে পারছেন। এমন ঘটছে কেন?
ঐ সব দেশে জনসাধারণের এক বিরাট অংশ রাতারাতি দক্ষিণপন্থায় আস্থাশীল হয়ে পড়েছেন তা কিন্তু নয়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতের সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন দেশের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির যথাযথ বিবেচনা না করে একে উপলব্ধি করা যাবে না। কি কি পূর্বশর্তের উপরে ভিত্তি করে উগ্র দক্ষিণপন্থা নিজেকে দুনিয়াজূড়ে সংহত করেছে, শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছে এবং অগ্রসর হচ্ছে তাদের চিহ্নিত করতে হয়। আমরা প্রথমে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতের দিকে নজর দিতে পারি।
ইউরোপের বর্তমান অবস্থা ক্রমশ বিপদের সংকেত দিয়ে চলেছে। এই মহাদেশের তৃতীয় সর্ববৃহৎ অর্থনীতি রয়েছে ইতালির। গত নির্বাচনে সেই দেশে একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয়েছে। ইতালিতে দুটি পুরানো রাজনৈতিক দল ছিলই যাদের আমরা সাবেক দক্ষিণপন্থী বলে জানি, তৃতীয় এবং নতুন যে দল সেখানে মাথাচাড়া দিয়েছে এরা অনেকটাই উগ্র দক্ষিণপন্থী। এদের ভিতরেই রয়েছে সেইসব গোষ্ঠী যারা বেনিতো মুসোলিনির উপরে ভরসা করেছিল। এরাই আজ নিজেদের ‘ব্রাদার্স অফ ইতালি’ বলে অভিহিত করছে। মুসোলিনির প্রতি সমর্থন রয়েছে এমন যুব সংগঠনের অন্যতম ব্যাক্তিই বর্তমানে ইতালির প্রধানমন্ত্রী। তিনিই জর্জিয়ানো মেলোনি। একসময় আমরা ফ্যসিস্তদের নেতৃত্বে শুধুমাত্র পুরুষদেরই দেখতে পেতাম। মেলোনি সেই ধারা বদলে দিয়েছেন। নয়া ফ্যাসিবাদ অবধি লিঙ্গ বৈষম্য ভেঙ্গে সামনে এগোচ্ছে! মনে রাখতে হবে রোম দখল করতে মুসোলিনির মার্চ ঘটার ঠিক ৭০ বছর বাদে মেলোনি ইতালির নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এমন ঘটনা যে শুধু ইতালিতে ঘটছে এমনটা না, ইউরোপের অন্যান্য দেশেও পরিস্থিতি এমনই। ফ্রান্সের যে দলটিকে আগে সবাই ন্যাশনাল ফ্রন্ট বলে চিনত তাকেই এখন ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স বলা হচ্ছে। এরা কারা? এদের নেত্রী মারিয়েন লাপেল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৪১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। জার্মানির কি অবস্থা? সেখানে ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ বলে একটি দল সক্রিয়, নির্বাচনে তারা প্রায় ১৫ শংতাংশ ভোট পেয়েছে। স্পেনের সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দলটি একই রকম রাজনীতির লক্ষ্যে কাজ করে, সুইডেনে বিগত তিনমাসে অনুরূপ একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। এরা সকলেই নয়া ফ্যাসিবাদী ধাঁচের পার্টি, যেখানে তারা সরকার গড়তে পারে নি, দক্ষিণপন্থী সরকারগুলিকে বাইরে থেকে সমর্থন যুগিয়েছে, এখনও তাই চলছে।
ইতিহাসের নির্দিষ্ট বাঁক-মোড়ের মুখোমুখি সাবেক দক্ষিণপন্থার কাঠামোয় রূপান্তর ঘটিয়েই অতি-দক্ষিণপন্থা সক্রিয় হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালি ও জার্মানিতে সেই অতি-দক্ষিণপন্থার একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দেখা যায়। আজকের পৃথিবীতে নয়া-নাৎসিবাদ বলে যা কিছু চলছে সেইসব রাজনীতি কার্যত সেই ধারারই কিছুটা সময়োপযোগী চেহারা। এই ঘটনার আগে সেইসব দেশে ক্ষমতাসীন হয়েছে নয়া-উদারবাদ। সেই ব্যবস্থা সংকটে পড়েছে, সংকট সমাধানে আরও বেশি করে অমানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নয়া উদারবাদের সংকট মানে কি? ২০০৮ সালে ফাটকা ব্যবসার বুদবুদ ফেটে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের সুত্রপাত ঘটে। এই ব্যবস্থা আসলে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির কর্তৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ। সেই কর্তৃত্বই একের পর এক দেশকে নয়া-উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মেনে নিতে চাপ দিয়েছে। এতে সমাধানের বদলে সংকট আরও গভীরে পৌঁছে গেছে। সংকটে জর্জরিত হয়েছেন মেহনতি জনসাধারণ। আক্রান্ত হয়েছে অর্জিত মানবাধিকার, আক্রান্ত হয়েছে শ্রমিকের অধিকারও। সমাধানের অযোগ্য সংকটের সম্মুখীন হয়েই নয়া-উদারবাদ ক্রমশ অতি-দক্ষিণপন্থার দিকে সরে গেছে। আজকের পৃথিবীতে অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জন্ম দিয়েছে নয়া-উদারবাদই। ক্ষমতা কায়েম রাখার উদ্দেশ্যেই তাকে আসরে নামিয়েছে। সহজ কথায় বলা চলে আজকের পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে তা আসলে জনসাধারণের উপরে শাসক শ্রেণির চাপিয়ে দেওয়া সমস্যার বোঝা।
কিভাবে এই সংকট ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে? প্রথমে উদ্ভূত সংকট কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন দেশের সরকারকে চাপ দিয়ে বিরাট বিরাট অংকের ‘বেইল আউট প্যাকেজ’ ঘোষণা করা হয়। এই অর্থ কিন্তু জনকল্যাণে বরাদ্দ হয়নি, বড় আর্থিক সংস্থা, ব্যাংক এদের পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ জনসাধারণের টাকায় ব্যক্তিগত সংস্থাসমূহের (যারা এই সংকট নির্মাণের আসল কারিগর) বোঝা বইতে শুরু করল সরকার, স্বভাবিকভাবেই এর ফলে জনজীবনে তার কোনও প্রভাব নেই। দ্বিতীয় যে কারণটি ছিল তা হল এমন বন্দোবস্তকে বৈধতা দিতে তারা জনসাধারণের উপরে ব্যাপক নিপীড়ন নামিয়ে এনেছে। বেতন-মজুরিতে কাটছাঁট হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা তা সরাসরি বাতিল করা হয়েছে, পেনশনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এসবই সংকটকে আরও ব্যাপ্ত করেছে, আরও প্রসারিত করেছে। ফলে সংকট ক্রমাগত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
নয়া-উদারবাদের আঘাতে সাবেক শ্রমিকশ্রেণি ইতিমধ্যেই আক্রমণের মুখে পড়েছিল। এর উপরে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির দাপটে ভারি শিল্পে উৎপাদনের অনেকটাই ইউরোপের হাতছাড়া হয়ে যায়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বহুবিধ কাঠামোগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, এরই প্রভাবে উৎপাদনের মূলধারার নানারকম কাজ অনেকটাই উন্নয়নশীল দেশের মাটিতে সরে আসে (চিন এক্ষেত্রে সঠিক উদাহরণ)। এমনটা হওয়ার কারণ মুনাফার সন্ধানে দুনিয়াজুড়ে লগ্নী পুঁজির বাধাহীন পরিচলন। এর ফলে শুধু পুঁজিবাদের চরিত্র বদলায় এমন না, শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ চেহারাও অনেকটাই ভেঙ্গে পড়ে। ফলে শ্রমিকদের অধিকারের সংগ্রাম দুর্বল হয়।
এমন অবস্থায় শ্রমিক আন্দোলন সহ বামপন্থীদের ধারাবাহিক সংগ্রামের জন্য তৈরি হয় নতুন চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতি। দিশেহারা জনজীবনে ব্যাপক ক্ষোভের সুত্রপাত এভাবেই হয়, সেই ক্ষোভ, হতাশাকেই কাজে লাগায় নয়া-ফ্যাসিবাদ। জনসাধারণের দুর্গতির সুযোগে তারা নিজেদের পায়ের তলার জমি শক্ত করে নিতে পারে। এই উগ্র-দক্ষিণপন্থার বিভিন্ন দেশে নির্দিষ্ট চেহারা যেমন রয়েছে, তেমনই এর তিনটি সাধারণ বৈশিষ্টও দেখা যায়। প্রত্যেক জায়গাতেই এরা মূলত দেশের অভ্যন্তরে জনসাধারণের একটি অংশকে নিজেদের শত্রু বলে চিহ্নিত করে। দেশের যাবতীয় দুর্দশার জন্য সেই অংশের মানুষজনেদেরই দায়ী করে এবং আক্রমণ নামিয়ে আনে। আমাদের দেশেও আরএসএস-বিজেপি তেমনই করছে। ভারতে অতি-দক্ষিণপন্থার আক্রমনের লক্ষ্য হল ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। এই রাজনীতি জাতিয়তাবাদী স্লোগান দেয়, জনসাধারণের চেতনাস্থিত জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের প্রভাবিত করে। এই জাতীয়তাবাদ মূলত জনগণের সংখ্যাগুরু অংশের জাতিগত, ধর্মীয়, সংস্কৃতিগত পরিচয়কে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জে জাতিয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল তার থেকে আরএসএস-বিজেপি’র জাতিয়তাবাদের মৌলিক ফারাক এটাই। এর জোরেই তারা দাবী করে আমাদের দেশে হিন্দুরাই প্রকৃত ভারতীয়, বাকিরা সকলেই বহিরাগত। আসলে বহিরাগত বলে চিহ্নিত করে আক্রমনের পক্ষে যুক্তি হাজির করে, সমর্থনের আবহাওয়া তৈরি করে। তৃতীয় বৈশিষ্টটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, আজকের পৃথিবীতে অতি-দক্ষিণপন্থা নয়া-উদারবাদ জনিত দুর্দশার প্রসঙ্গে একটিও কথা বলে না। নয়া-উদারবাদের দরুন জনসাধারণের উপরে যা যা নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়েছে কার্যত এরা সেগুলিকে সমর্থন যুগিয়ে চলে এবং তারই বিনিময়ে আন্তর্জাতিক লগ্নী-পুঁজির থেকে নিজেদের ক্ষমতাসীন রাখতে জরুরী সমর্থন আদায় করে নেয়। সেই সমর্থনই এদের বিরাট আর্থিক সামর্থ্যের পিছনের কারণ। আমাদের দেশে একেই আমরা কর্পোরেট-কমিউনাল আঁতাত বলে অভিহিত করছি।