অফুরান নভেম্বর

আভাস রায় চৌধুরী

জন রীডের ভাষায় ১৯১৭ সালের ৭ থেকে ১৭ নভেম্বর দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনে এই পৃথিবীর মধ্যেই শ্রমজীবী মানুষের জন্য নতুন মানচিত্রের সৃষ্টি হয়েছিল। লেনিন ও বলশেভিক পার্টির সুযোগ্য নেতৃত্বে রাশিয়ায় সফল হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। গঠিত হয়েছিল শ্রমিক, কৃষক সহ সমস্ত নিপীড়িত, বঞ্চিত, অসহায় মানুষের নিজের দেশ, নতুন দেশ সোভিয়েত দেশ। আরও দু দশক পরে রবীন্দ্রনাথ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করে লিখেছিলেন,".... না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।" পৃথিবীতে শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির ভাবনা অনেকেই ভেবেছিলেন, অনেকেই বলেছিলেন নানা ভাবে। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস প্রথম শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সঠিক রাস্তা, শ্রেণি শোষণের উচ্ছেদ করে সমাজের আমূল পরিবর্তন, বিপ্লব - তা দেখিয়েছিলেন। মার্কসের ভাবনায় ইমানসিপেশন অফ ওয়ার্কিং ক্লাস, ইমানসিপেশন অফ হিউম্যান বিইং। নভেম্বর বিপ্লব হলো এই পথে কয়েক কদম এগিয়ে চলা।

এই পৃথিবীতে দারিদ্র, বুভুক্ষা, অপুষ্টি, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও শ্রেণি শোষণ মানব সমাজের শুরুতেও ছিল না এবং শেষ পর্যন্ত তা চলতে পারে না, তা থাকবে না। ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ইশতেহার শ্রমজীবী মানুষের কাছে এই বার্তা বহন করে আহ্বান জানিয়ে ছিল, শৃঙখল  ছাড়া সর্বহারার হারাবার কিছু নেই, জয় করার জন্য আছে গোটা জগৎ। তৎকালীন প্রচার মাধ্যম কমিউনিস্ট ইশতেহারকে ব্ল্যাকআউট করেছিল। তারা চেয়েছিল এ যেন প্রচারের আলোয় না আসে। কিন্তু কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ফরাসি দেশের শ্রমিকশ্রেণি বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিল।১৮৪৮-৫০ সালের ফরাসি দেশের শ্রমিকদের বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছিল। ১৮৫০ সালে মার্কস লিখলেন, "কয়েকটি মাত্র অধ্যায় বাদে, ১৮৪৮ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত বিপ্লবের ইতিহাসের প্রতিটি গুরুতর অংশের শিরোনাম হচ্ছে বিপ্লবের পরাজয়!

এইসব পরাজয়ে যার পতন হলো তা কিন্তু বিপ্লব নয়। পতন হয়েছিল প্রাকবিপ্লবী চিরাচরিত লেজুড়গুলির, যাদের উদ্ভব সেই সামাজিক সম্পর্ক গুলি থেকে যা তখনও পর্যন্ত তীব্র শ্রেণিসংঘাতের পর্যায়ে পৌঁছয়নি...."

আলোচনার বিষয়বস্তু ফ্রান্সের শ্রেণি সংগ্রাম না হলেও এই কথাগুলোর উল্লেখ করার উদ্দেশ্য দুটো। প্রথমত, নভেম্বর বিপ্লব ইতিহাসের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শ্রমজীবী মানুষদের 'শ্রমিকশ্রেণি' হয়ে ওঠা এবং সমাজ বদলের চলমান সংগ্রামের এক পর্ব। রুশ বিপ্লবের পূর্ববর্তী শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম ও বিপ্লবী প্রচেষ্টা গুলিকে উপলব্ধি করার জন্য ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে নজর দেওয়া। দ্বিতীয়ত,এই আলোচনাতেই মার্কস শ্রমিকদের কেমন ভাবে এবং কেন শ্রমিকশ্রেণিতে রূপান্তরিত হতে হয় এবং বিপ্লবী প্রচেষ্টার জন্য শ্রমিকশ্রেণির শক্তিশালী সংগঠনের প্রয়োজন হয়, তার উল্লেখ করেছিলেন। নভেম্বর বিপ্লবে লেনিন ও বলশেভিকদের অন্যতম সাফল্য হলো, বিপ্লবী পরিস্থিতি অনুধাবন করা ও বিপ্লবের উপযুক্ত শ্রেণিঐক্য ও সংগঠন গড়ে তোল। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ফ্রান্স ও ইউরোপ ছিল বিপ্লবী সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। কিন্তু তখনও পর্যন্ত পুঁজিবাদ বিকাশের পর্যায়েই ছিল। পুঁজিবাদী দেশ গুলিতে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিকাশ অসম্পূর্ণ ছিল। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে চেতনা ও সংগঠনে অপূর্ণতা ছিল। ১৮৭১ সালে প্যারিস কমিউন ছিল ফ্রান্সের শ্রমিকদের আরেকটি বিপ্লবী প্রচেষ্টা। ৭২ দিন টিকে ছিল প্যারিস কমিউন। কমিউনার্ডদের পতনের অন্যতম কারণ ছিল, শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে গ্রামের কৃষক এবং অন্যান্য অংশের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে না ওঠা।

১৯০৫ সালে রুশ দেশের শ্রমিকদের বিপ্লব প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেনিনকে। ১৯১৭ সাল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তিন বছর ধরে চলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ গিয়েছে। রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে দুর্দশার অন্ত নেই। দেশের ভেতরে কল-কারখানা বন্ধ। চাষের কাজও প্রায় বন্ধ। কারণ বেশিরভাগ চাষী তখন যুদ্ধে জারতন্ত্রের হয়ে লড়ছে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে ভয়ংকর সংকট। কিন্তু যুদ্ধ থেকে মুনাফা লুটে চলেছে কেবল বুর্জোয়া আর জমিদাররা। এই পরিস্থিতিতে রণাঙ্গনেও বিক্ষোভ শুরু হয়। ৯ জানুয়ারি পেট্রোগ্রাড, মস্কো, বাকু ও নিজনি নভগারদে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। ১৯০৫ সালে বিপ্লব প্রচেষ্টার সময় শ্রমিকদের সঙ্গে কৃষক সহ অন্যান্যদের যে ঐক্য গড়ে ওঠেনি এবার সে ঐক্য গড়ে উঠলো। শ্রমিক, কৃষক ও সেনাবাহিনীর নিচের স্তরের অংশ ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে ফেব্রুয়ারিতে জারতন্ত্রের পতন ঘটলো। রাশিয়ায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হলো। প্লেখানভ, লেনিন সহ নেতৃত্ব রাশিয়ায় ফিরলেন। ফেব্রুয়ারির বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে প্লেখানভ স্বাগত জানালেন। লেনিন দেখালেন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে শ্রমিকশ্রেণির চূড়ান্ত বিজয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পৌঁছে দিতেই হবে। পার্টির ভিতরে তীব্র মতপার্থক্য। লেনিন হাজির করলেন তাঁর বিখ্যাত 'এপ্রিল থিসিস'। ক্রমে লেনিনের মত পার্টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল। তারপর একটা নতুন ইতিহাস। লেনিন ও বলশেভিকদের নেতৃত্বে শ্রমিক- কৃষক-সৈন্যবাহিনী নিচের অংশের সার্বিক ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী সংগ্রামে নভেম্বরের ৭ থেকে ১৭ দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন।

উনিশ শতকের মধ্যভাগে মার্কস-এঙ্গেলসের ভাবনায় ইউরোপের বিপ্লবের ভরকেন্দ্র ছিল এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলি এবং জার্মানি। কিন্তু ইতিহাসে তা ঘটেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনকে দেশের ভিতর বিপ্লবের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলে শান্তি, রুটি ও জমির স্লোগানে বিপ্লব সফল করলেন বলশেভিকরা। আন্তোনিও গ্রামশি নভেম্বর বিপ্লবের সমর্থনে লিখলেন তাঁর বিখ্যাত রচনা 'রেভলিউশন এগেনস্ট দাস ক্যাপিটাল'। রাজনৈতিক-অর্থনীতির ইতিহাসের সাধারণ গতিধারার বাইরে ছিল রুশ দেশের নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে রুশ সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির অভ্যন্তরে অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকার সম্পর্কে, শ্রমিকশ্রেণির সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উপযুক্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে, শ্রমিকদের বিপ্লবী প্রচেষ্টা সম্পর্কে তীব্র বিতর্ক ছিল। রুশদেশে মার্কসীয় দর্শন চর্চার প্রাণপুরুষ প্লেখানভ ফেব্রুয়ারির বুর্জোয়া বিপ্লবের পরেই শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে ছিলেন। ফলে একসময়ের শিক্ষক প্লেখানভের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছিল লেনিনকে। রাশিয়ার পরিস্থিতি যে লেনিন ও বলশেভিকরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ইতিহাস তারই প্রমাণ দেয়।

মার্কস-এঙ্গেলস বিপ্লবের ভরকেন্দ্র হিসেবে রাশিয়াকে প্রথমদিকে না ভাবলেও তাঁদের ভাবনাতে রাশিয়ার পরিস্থিতি ও বিপ্লবী সম্ভাবনা কিন্তু একেবারেই অনুপস্থিত ছিল না। ১৮৮২ সালের জানুয়ারিতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত কমিউনিস্ট ইশতেহারের রুশ সংস্করণের ভূমিকায় তাঁরা উল্লেখ করলেন,"আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্য আসন্ন অবসান ঘোষণা করাই ছিল কমিউনিস্ট ইশতেহারের লক্ষ্য। কিন্তু রাশিয়া তে দেখি, দ্রুত বর্ধিষ্ণু পুজিতান্ত্রিক জুয়াচুরি ও বিকাশোন্মুখ বুর্জোয়া ভূসম্পত্তির মুখোমুখি রয়েছে দেশের অর্ধেকের বেশি জমিতে চাষীদের যৌথ মালিকানা। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে যে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে এলেও জমির উপর যৌথ মালিকানার আদি রূপ এই রুশ অবশ্চিনা (গ্রামীণ সমাজ) কি কমিউনিস্ট সাধারণ মালিকানার উচ্চতর পর্যায়ে সরাসরি রূপান্তরিত হতে পারে ? না কি পক্ষান্তরে তাকেও প্রথম যেতে হবে ভাঙনের সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যা পশ্চিমের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে? এর একমাত্র উত্তর আছে যা দেওয়া সম্ভব যা হলো এই: রাশিয়ার বিপ্লব যদি পশ্চিমে প্রলেতারীর বিপ্লবের সংকেত হয়ে উঠে যাতে দুই বিপ্লব পরস্পরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে রুশ দেশের ভূমির যৌথ মালিকানা কাজে লাগতে পারে কমিউনিস্ট বিকাশের সূত্রপাত হিসেবে।"লেনিন এই কয়েকটি মাত্র বাক্য থেকে নতুন উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন বোধহয়। রুশ বিপ্লবের মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক বিতর্কে এবং বিপ্লব উত্তর সমাজতন্ত্র নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে লেনিনের তত্ত্ব ও প্রয়োগে কমিউনিস্ট ইশতেহারের রুশ সংস্করণের স্পষ্টপ্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নভেম্বর বিপ্লব ছিল লেনিন ও বলশেভিকদের মার্কসীয় দর্শন ও রাজনীতির অনন্য সৃষ্টিশীল প্রয়োগ।

জন্মের পরেই শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়েছে।

বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতিকে বলা হয়েছিল ওয়ার কমিউনিজম। ১৯২০ সালে লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত হলো ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিক। চলতি কথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই বহুজাতির ইউনিয়নে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার স্বীকৃত হয়। তারপর সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলির ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে সমাজতন্ত্রকে রক্ষা ও এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে লেনিন গ্রহণ করলেন 'নয়া অর্থনৈতিক নীতি'। ১৯২৪ সালে অকাল প্রয়াণের পরে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ বলিষ্ঠতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সমাজ। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারণ কাজ খুঁজতে মানুষের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের  দরজায় যাওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছিল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনীতি ও মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের অগ্রগতি ঘটেছিল। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে শিক্ষা সংস্কৃতি জগতে গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করেছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাশিয়ার চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন,"এদের এখানকার বিপ্লবের বাণীও বিশ্ববাণী।"

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় দু কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে দুর্দমনীয় হিটলার কে পরাস্ত করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সহ গোটা পৃথিবীর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কে রক্ষা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশ গুলিতে একটার পর একটা স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করেছে। আমাদের দেশ তার মধ্যে অন্যতম। সদ্য স্বাধীন এই দেশগুলির পাশে দাঁড়িয়েছে সোভিয়েত সমাজ। সাহায্য করেছে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে।  স্বাধীন ভারত নির্মাণে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ভূমিকা ভোলার নয়। দারিদ্র, অপুষ্টি, বুভুক্ষা, নিরক্ষরতা, নিপীড়ন, বঞ্চনা, বৈষম্য ও শ্রেণি শোষণের অমানবিক পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীর বিপরীতে মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯১ সালে বিনা রক্তপাতে ভিতর থেকে ভেঙে পড়ল পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্নসৌধ সোভিয়েত ইউনিয়ন। বৈষম্যের সমাজকে বদল করার সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণি ও তার পার্টিকে মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠনের দৃঢ় পথে চলতে হয়। তেমনই সমাজতন্ত্রের নির্মাণে নতুন নতুন সমস্যাগুলিকে মোকাবিলা করার জন্য মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠনে শ্রেণির প্রতি দায়বদ্ধতা, শ্রেণির সঙ্গে গভীর ও জীবন্ত সংযোগ, শ্রেণি সচেতনতা,  সতর্কতা ও দৃঢ়তা দেখাতে হয়। নচেৎ পুঁজিবাদী দুনিয়ার বৌদ্ধিক ও বস্তুগত হাতছানি ও আগ্রাসন দুর্বল, এমনকি ধ্বংস করতে পারে শ্রমিকশ্রেণি এবং শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ভালো থাকার পথকে। সোভিয়েতের বিপর্যয় এই কথাগুলোকেই প্রমাণ করে।

এতক্ষণে সমস্ত কথাগুলি প্রায় সকলেরই জানা। বিশ শতকের সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, সমাজতন্ত্রের নির্মাণ ও সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের ঘটনাগুলি ইতিহাসের পাতায় রয়েছে। এর থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু এখন যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, একবিংশ শতাব্দীতে নভেম্বর বিপ্লবের কোনো ভবিষ্যৎ মূল্য আছে কি? প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো মার্কস-এঙ্গেলস থেকে লেনিনের সময় পর্যন্ত, শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামে কোনো পর্বই তার পূর্ববর্তী পর্বের রেপ্লিকা হয়নি। নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরবর্তীকালে পৃথিবীতে শ্রমিকশ্রেণির যতগুলি বিপ্লব প্রচেষ্টা সংগঠিত ও সফল হয়েছে, কোথাও নভেম্বর বিপ্লবের কিংবা অন্য কোনো বিপ্লবের অনুকরণ ঘটেনি। বিপ্লবের ইতিহাস থেকে ভবিষ্যৎ বিপ্লরী সংগ্রামের উপাদান ও শিক্ষা নিতে হয়।  সংগ্রামের পথের অন্ধ অনুকরণ হয় না। যেখানে যতটা অনুকরণ করার চেষ্টা হয়েছিল তা শুধু ব্যর্থ হয়েছিল তাই নয়, বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। আজ একুশ শতকে সমাজতন্ত্রের নির্মাণ, সমাজতন্ত্রের জন্য বিপ্লব বিশ শতকের অনুকরণে হবে না। প্রতিটি দেশ ও সমাজের নিজস্ব বাস্তবতায় শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লব সংগঠিত ও সফল হতে পারে। আমাদের দেশে যেমন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে বর্তমানের অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পন্ন করার জন্য আমরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে রয়েছি। শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক দৃঢ় মৈত্রের ভিত্তিতে এই বিপ্লব সম্পন্ন হতে পারে।

মার্কসবাদের মূল কথা হলো শোষণ মূলক এই সমাজের উচ্ছেদ ঘটিয়ে শ্রমিকশ্রেণি শেষ বিচারে প্রজাতি সত্তা হিসেবে মানুষের মুক্তি। পুঁজিবাদী সমাজের উচ্ছেদ ঘটিয়ে শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজে পৌঁছানো। সমাজতন্ত্র হলো পুঁজিবাদ থেকে শ্রেণিহীন সমাজে পৌঁছানোর মধ্যবর্তী স্তর। এই স্তর কতদিন কি অবস্থায় বজায় থাকবে তা নির্ভর করবে ঐ নির্দিষ্ট সমাজের বাস্তবতার উপর। নভেম্বর বিপ্লব শ্রেণিহীন সমাজে পৌঁছানোর যে স্বপ্নের প্রদীপটি জ্বালিয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরেও আজকের পুঁজিবাদী সমাজে এই স্বপ্ন বেঁচে আছে। শোষণ ও নিপীড়ন ভরা এই পৃথিবীর আজও কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতন্ত্র। বর্তমান সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চীন বিরোধী যাবতীয় ষড়যন্ত্র ও তৎপরতার মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বটি প্রকাশিত হচ্ছে।

পুঁজিবাদের উষালগ্নে শিল্পভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। সেই সময়কার বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতি, শিল্প উৎপাদনে ভারী যন্ত্রের ব্যবহার ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজকে শক্ত ভিতে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে দিয়েছিল। সামন্তশ্রেণির জায়গায় মালিকানা ও রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে এলো নতুন বুর্জোয়াশ্রেণি। শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজই জন্ম দিয়েছিল শ্রমিকশ্রেণির। নতুন শোষণ মূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করবার শক্তি কেন একমাত্র শ্রমিকশ্রেণির রয়েছে ? তার প্রধান কারণ হলো শ্রমিকশ্রেণি এই ব্যবস্থার মধ্য থেকে সৃষ্ট। এই ব্যবস্থার ভিতরের অপরিহার্য অংশ। শ্রমিকশ্রেণিকে বাদ দিয়ে এই ব্যবস্থা এক ইঞ্চিও চলতে পারে না। শ্রমিকদের শ্রম চুরি করেই উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয়। এই উদ্বৃত্ত মূল্যই পুঁজিবাদের মুনাফা, পুঁজি ও পুঁজিবাদের প্রাণ ভোমরা। শ্রমিকের শোষণ যত বাড়ে তত বেশি উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয়। শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিকশ্রেণির জীবনে যন্ত্রনা ও সংকট তত বাড়ে। তাই এই সংকট ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সমাজ বদলের সংগ্রামে যুক্ত হওয়াটা শ্রমিকশ্রেণির জন্য অনিবার্য। তবে তা আপনা আপনি ঘটে না। শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি ও প্রসারিত করে শ্রেণি হিসেবে ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদেরকে সংগঠিত করতে হয়। এখানেই ভূমিকা কমিউনিস্ট পার্টির। এখানেই সফল নভেম্বর বিপ্লব। এখানেই প্রাসঙ্গিকতা নভেম্বর বিপ্লবের।

তিন দশক অতিক্রম করা নয়া উদারবাদ গোটা পৃথিবীটাকেই বদলে দিয়েছে। আগে যা ভাবা যেত না আজ তার অনেক কিছুই বাস্তব। সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সবকিছুতেই নতুন ধারা, নতুন উপাদান। এর বেশিরভাগটাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। করবেও। সমাজ বদলের নেতৃত্বকারী শ্রমিকশ্রেণি ও তার অনুসারী জনগণকে এই বদলে যাওয়া পৃথিবীতে ইতিবাচক উপাদান গুলিকে সংগ্রহ করে সযত্নে লালন করে বিপ্লবের কাজে ব্যবহার করতে হয়। নয়া উদারবাদ পরিকল্পিতভাবে উৎপাদনের ক্ষেত্রকে ছোট করে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রকে বাড়িয়েছিল। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুনাফার সরবরাহকে অক্ষুন্ন রেখে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির অস্তিত্বকে সংকুচিত ও বিপন্ন করা। কিন্তু এর ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিপুলভাবে ধাক্কা খায়। তার সরাসরি প্রভাব পড়ে বাজারে। কারন মানুষের কাজ ও হাতে অর্থ না থাকার ফলে গোটা পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি মানুষ বাজার থেকে ছিটকে যায়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ে। এতদসত্বেও বাজার ধরে রাখাতে কর্মসংস্থানের জন্য উৎপাদনের ক্ষেত্রকে রক্ষার রাস্তায় হাঁটে নি পুঁজিবাদ। ২০০৮ সাল থেকে অর্থনীতির যে সংকট শুরু হয়েছে তার অন্যতম কারণ এটি।

অর্থনীতির পন্ডিতরা বলছেন নয়া উদারবাদী পথে পুঁজিবাদের আজকের এই সংকটের কোনো সমাধান নেই। এখন আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির নিয়ন্ত্রণ 'ফিনান্স'র হাতে। ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রকে বিকশিত করার কোনো সম্ভাবনা সম্ভবত নেই। বিপরীতে বিপুল পরিমাণ লুট এখন সম্পদ বৃদ্ধির কার্যত একমাত্র দস্তুর। এখানে শ্রমিকশ্রেণির আয়তন ছোট হচ্ছে, অস্তিত্ব বিপন্নতার মুখোমুখি। পাশাপাশি বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতি যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হাজির করে ফেলেছে তাতে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি এবং শেষ পর্যন্ত 'প্রজাতি সত্ত্বা' হিসেবে মানুষের শ্রমের অস্তিত্ব বিপন্নতার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এর অর্থ এই নয় যে, পৃথিবী থেকে মানুষের শ্রমের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তা কখনোই হবে না। শ্রম বিলুপ্ত হলে মানব সভ্যতার অগ্রগতি থেমে যাবে। এমনকি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শ্রম করার সুযোগ কেড়ে নিতে পারে। শ্রম করার চরিত্রের বিপুল পরিবর্তন ঘটে যাবে। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের শ্রম করার সুযোগ কার্যত থাকবে না। কাজের ক্ষেত্র মুষ্টিমেয় উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত থাকবে। এত ভবিষ্যতের প্রশ্ন, কিন্তু বর্তমানে এই যে পরিবর্তনগুলো ঘটে গেছে সেটাও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, বলা ভালো উদ্বেগজনকও বটে। অনেক ক্ষেত্রে সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের শ্রমিক সত্তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে স্যালারিয়েট মধ্যবিত্ত সত্তা। এই প্রবন্ধে সে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। খোলা চোখেই দেখা যায় সংগঠিত শিল্পের শ্রমিক কর্মচারী সহ সমাজের সমস্ত মানুষের মধ্যে জীবন যাপন ও জীবনবোধের বড় পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। উন্নত জীবনের জন্যই মানুষ সংগ্রাম করে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত মানুষ কৃচ্ছসাধন সাধন করবে এমনটা যুক্তিসঙ্গত নয়। কিন্তু আজকের নয়া উদারবাদ তার নিজের মতো করে সম্মতি নির্মাণের জন্য মানুষ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে কিছুটা পরিমাণে তারা সফল।

এই দেখে অনেকে বলছেন প্রলেতারিয়েতের অস্তিত্ব বিপন্নতার দিনে কে বিপ্লব করতে এগিয়ে আসবে? চোখা এই প্রশ্নটাকে উড়িয়ে দেওয়া বা এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে একটা-দুটো বাক্য ব্যবহারের আগে দেখে নেওয়া ভালো যে পৃথিবীতে এখন আমরা আছি তার বদলের কি কোনো প্রয়োজন আছে? এই প্রশ্নটাও শ্রেণি নিরপেক্ষ নয়। আসলে বৈষম্যের পৃথিবীতে মানুষের সর্বোদয় উন্নতি বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু হয় না। বৈষম্য যতক্ষণ থাকবে, তা সে শ্রেণি শোষণ অথবা সামাজিক নিপীড়ন যে আধারেই থাকুক না কেন, শ্রেণির প্রশ্নটা অস্তিত্ব, চেতনা এবং সংগ্রামে থাকবে। তাই নিরপেক্ষ অবগুন্ঠন সরিয়ে ফেলে আজকের পৃথিবীতে সমাজ বদলের প্রয়োজনীয়তা কে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিচার করা ভালো। আজকের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ থেকে ক্ষুদ্র সমস্ত সুবিধাভোগী চাইবে যেমন আছে তেমন থাক, যেমন চলছে তেমন চলুক। কিন্তু যাদের সংসার চালানোর জন্য উদয়-অস্ত পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রম করেও কুলকিনারা পাওয়া যায় না। নিজ সংসারের বৃত্ত থেকে বৃহত্তর সমাজে ক্রমশ পিছু হটতে হটতে পিঠ যখন দেওয়ালে ঠেকে যায়, তখন মানুষ বদলের জন্য চেষ্টা কি করবে না? নিশ্চয়ই করবে। বিপুল পরিমাণে উদ্বৃত্ত শ্রম পচতে পচতে সমাজের ভিতরটা যখন গেঁজে যাবে তখন কি ভোগবাদী প্রলোভন মানুষকে শোষন শৃংখলের বাঁধনে বেঁধে রাখতে পারবে? সম্ভবত না। প্যারিস ম্যানাস্ক্রিপট থেকে গ্রুনড্রিসে কিংবা ক্যাপিটাল, মার্কস সর্বত্র এই নৈতিক ইচ্ছে এবং বিপ্লবী তৎপরতার উল্লেখ করেছিলেন। আজকের পৃথিবীতে এই নৈতিক ইচ্ছে ও বিপ্লবী তৎপরতা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর বহু চর্চিত চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার কথা এখন আর আলোচনা হয় না। উদারবাদ প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ, কার্যত দেউলিয়া। এ পথে মানুষের মুক্তির কোনো সম্ভাবনাই নেই। পুঁজিবাদী বিশ্বেই এই ধারণা ক্রমশ দৃঢ়তর হচ্ছে। পৃথিবীর ব্যাপী সংকট, বৈষম্য, সামাজিক বিভাজন, নিপীড়ন বিপুল গতিতে ক্রমবর্ধন। উৎপাদনের বদলে সর্বব্যাপী লুটের মাধ্যমে সম্পদের কেন্দ্রীভবন এখন চালু অবস্থায় পরিণত হয়েছে। বেকারি, দারিদ্র, ক্ষুধার করাল গ্রাস ক্রমশ দৈত্যাকার হয়ে উঠছে। অর্থনীতির পন্ডিতরা বলছেন বর্তমান বছরে পৃথিবীর এক বড় জন-অংশকে দুর্ভিক্ষ গ্রাস করে নিতে চলেছে। আমাদের চেনা পরিবেশে, আমরা কি দেখছি না, রাস্তার একপারে গগনচুম্বি অট্টালিকা, যেখানে রাতের বেলাতেও দিনের উজ্জ্বলতা। বৈভব চিন্তার ক্ষুদ্রতাকে ঢাকতে না পারলেও চকমকি পাথর দিয়ে চারপাশটাকে চমকে দেয়। রাস্তার উল্টোদিকে নিকস কালো অন্ধকারে খিদে, অনাহার আর মনুষ্যত্বের অবমাননার সঙ্গে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে লড়াই করছে অগুন্তি মানুষ। নষ্ট হচ্ছে কত উন্নত  শ্রমশক্তি। একটু সুযোগ পেলে তারা পাহাড় টলিয়ে দিতে পারত। তার পরিবর্তে এই বিপুল পরিমাণে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি লুম্পেন রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়ে লুম্পেন অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পৃথিবী অনৈতিক। একে বদল করতেই হবে। একে ভাঙতেই হবে। ভেঙে নতুন করে গড়তেই হবে। সুযোগ পাওয়া যায় না সুযোগ আদায় করতে হয়। দুনিয়ার ইতিহাসে বিনা সংগ্রামে কখনও কোনো দিনই চেয়ে কোনো অধিকার শ্রমজীবী মানুষ পায়নি। তার জন্য জান কবুল লড়তে হয়েছে। আজকের পৃথিবীতে নভেম্বর বিপ্লব শ্রমজীবীদের দেহে আর মনে লড়াইয়ের সেই শক্তি যোগায়।

অর্থনীতির পরিবর্তন সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ঠিকই উনিশ শতকে পুঁজিবাদের বিকাশ লগ্নের মতো শিল্প শ্রমিক নেই। আজকে শিল্প শ্রমিক কি একেবারেই অস্তিত্বহীন?  না, যথেষ্ট সংখ্যায় রয়েছে। তাদের এক বড় অংশ নয়া উদারবাদের শিকার, কিন্তু এক বড় অংশ লড়াইয়ের রাস্তায় রয়েছে। গোটা পৃথিবীতে, আমাদের চেনা পরিবেশেও। এটা ঠিকই যে এখনও যে উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলো রয়েছে সেখানে দু ধরনের বিপদ উপস্থিত হচ্ছে। প্রথমত, স্থায়ী কাজকে অস্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিকদের দিয়ে করানো এবং কাজকে মূল ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরিয়ে দিয়ে আউটসোর্সিং'র মাধ্যমে করানো। দ্বিতীয়ত, সংগঠিত শিল্পের অনেকগুলি ক্ষেত্র, যেখানে শ্রমিকের শ্রমশক্তিকে প্রতিস্থাপিত করছে উচ্চমানের প্রযুক্তির ব্যবহার। আগে আমরা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কথা উল্লেখ করেছি। এখনও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সর্বব্যাপী প্রয়োগ শুরু হয়নি। তার আগেই শ্রমশক্তির বড় অংশ প্রযুক্তির দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছে। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যায়। আজকের দিনে আমাদের দেশের কয়লা শিল্পে যে কয়লা উৎপাদন হয় তারা উল্লেখযোগ্য অংশ শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ শ্রমের পরিবর্তে মুষ্টিমেয় প্রযুক্তি নির্ভর কর্মীর দ্বারা মেশিন চালিয়ে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সারা পৃথিবী জুড়ে কম-বেশি এই ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর পরে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার উৎপাদন ক্ষেত্রকে শ্রমিকের দিক থেকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলবে, মালিকের দিক থেকে অনেক বেশি মসৃণ মুনাফা সংগ্রহকারী করে তুলবে। বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তি সারা পৃথিবী জুড়েই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করছে। যাদের নেই কোনো কাজের ঠিকানা, কাজের ঘন্টা, উপযুক্ত মজুরি কিংবা সামাজিক সুরক্ষা। মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার এখন গোটা পৃথিবীর অর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৈশিষ্ট্য। আমাদের চেনা পরিবেশে লক্ষ লক্ষ যুবক বসবাসকারী এলাকায় কাজ না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছে। আজকের নতুন প্রজন্মের এক বড় অংশ কোনো স্থায়ী কাজের আশা করে না। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ ভবিষ্যতে যে কাজ পেতে পারে এমন বিশ্বাসও করে না। সব মিলিয়ে এটা বলা যায় আজকের নয়া উদারবাদী অর্থনীতিতে শ্রম-সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে যা কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশ কিংবা নভেম্বর বিপ্লবের সময়ের ‌থেকে আলাদা। এই শ্রম-সম্পর্কের পরিবর্তন শ্রমজীবী মানুষদের পুনরায় পুঁজির ক্রীতদাসে পরিণত করতে চলেছে। ভারতে আরএসএস/বিজেপির জামানায় 'নয়া লেবার কোড' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

নয়া উদারবাদী পরিবেশ প্রলেতারিয়েত কে খন্ডিত, অসংগঠিত ও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। নয়া উদারবাদে ফিনান্সের সার্বিক লুট ও শাসনের নাম গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন। অর্থাৎ অর্থনীতি বিশ্বায়িত। আসলে পুঁজির বিশ্বায়ন, লুটের বিশ্বায়ন। কিন্তু তার বিপরীতে রাজনীতিকে আঞ্চলিক স্তরে আটকে রাখতে চাইছে। বিশ্বায়নের যুগে নতুন আঞ্চলিক স্তরে আটকে রাখা রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হলো সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিহীন এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তা। এই আঞ্চলিক রাজনীতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জাত, ধর্ম, ভাষা, জাতিসত্তা, অঞ্চল ইত্যাদির নামে বিভাজনের রাজনীতিকে বহন ও শক্তিশালী করছে। এর প্রভাব শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধরা, রাজনৈতিক চেতনা ও রাজনৈতিক লক্ষ্যকেও প্রভাবিত করছে। বলা বাহুল্য এ প্রভাব নেতিবাচক। এই রাজনৈতিক ভাবনা নভেম্বর বিপ্লবের ভাবনার বিপরীত। শুধু তাই নয়, এই ভাবনা  আসলে রেনেসাঁর পথ ধরে পৃথিবীতে যে আধুনিকতার সূচনা ঘটেছিল তারও বিপরীত। মানুষের ভাবনা ও আচরণকে স্থানীয় ভিত্তিতে আটকে রাখলেও শোষণ বঞ্চনা পুঁজিবাদী দুনিয়ার সর্বত্র আরও অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও নির্মম হচ্ছে। উদ্বৃত্ত মূল্য সংগ্রহ এখন উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রম শোষণের বদলে  লুট ও চরম নিপীড়নের পদ্ধতি নিয়েছে।

 আজকের শ্রমজীবী মানুষ এবং ভবিষ্যতে যারা শ্রমজীবী ভুক্ত হবে তাদের বোঝাতেই হবে, তোমাদের এই শ্রম চুরি করে, তোমরা যে সম্পদ তৈরি করেছ তা লুট করে পুঁজির পাহাড় বাড়ছে। তোমরাই এটাকে ভাঙতে পারো। এটাকে ভেঙে ফেলা যুক্তিসঙ্গত, নৈতিক এবং প্রকৃতিগতভাবেও স্বাভাবিক। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা পৃথিবীকে শিখিয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের মুক্তি নেই। মিডিয়ার চাকচিক্য দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাবে না যে, এই সমাজে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোনো মুক্তির ঠিকানা নেই। সমাজ বদল করা অপরিহার্য।  তাই সমাজ বদলের কঠিন পথে নভেম্বর বিপ্লবের বার্তা বারে বারে ফিরে ফিরে আসে। আজকে পৃথিবীতে সর্বব্যাপী একতরফা লুট যেমন খোলা চোখে দেখতে পাওয়া যায়, তেমনই শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামও পৃথিবীর দেশে দেশে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমাদের দেশেও শ্রমিক, কৃষক, নতুন প্রজন্ম সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সংগ্রাম চলছে। আমাদের দেশেও বৈষম্যের এই সমাজকে বদল করতে হবেই এবং তা করা সম্ভব। আমাদের দেশে এই সংগ্রাম একইসঙ্গে শ্রেণি-সংগ্রাম এবং সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

প্রকৃতিগতভাবে প্রজাতি সত্তা হিসেবে মানুষ সৃষ্টিশীল শ্রমের অধিকারী এবং পরিবর্তনমুখী। এই বৈশিষ্ট্য শ্রমজীবী মানুষকে মুষ্ঠিমেয় শাসকের উদ্বৃত্ত সংগ্রহের বৈষম্যের ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে প্রণোদিত করবেই। আমাদের সমাজও তার থেকে বাদ যাবে না।

বাক্যগুলিতে মাত্রারিক্ত আবেগের ঘনঘটা খোঁজার চেষ্টা হতে পারে। আসলে যুক্তিটা সঠিক এবং সত্যি।  লড়াইয়ের জন্য আবেগ লাগে। হিসেবী মানুষ কখনও  লড়াইয়ের পথে এগোতে পারে না। রাশিয়ায় দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন পৃথিবীর সব হিসেব বদল করে দিয়েছিল। ফিন্যান্স শাসিত আজকের পৃথিবীতে রকমারি তাত্ত্বিক আয়োজনেও  শোষণ, বঞ্চনা নিপীড়ন আর উদ্বৃত্তের খতিয়ানকে বাতিল করা যাচ্ছে না। জৌলুসের মিনারে বসে থাকলেও পায়ের তলার জুতোয় কাঁটার মত এই উদ্বৃত্ত মূল্যের ধারণা এবং তা থেকে শ্রমজীবী মানুষের ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের সম্ভাবনা খোঁচা মেরেই চলেছে। আজও শ্রমিক বিপ্লবের ভুত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে পুঁজিবাদী দুনিয়াকে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নভেম্বর বিপ্লবকে অস্বীকার করতে চাইলেও সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন ও বার্তা নভেম্বর বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল তা আজও অনির্বাণ। বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ করে এই অনির্বাণ দীপশিখাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলার দায়িত্ব দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি ও তার অনুসারী শ্রমজীবী মানুষ ও বন্ধুদের। এই কথাটা যেন আমরা সব সময় মনে রাখি।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন